লেস ওয়ালেসার দেশে- ফাতেমা আবেদীন নাজলা

ইতিহাসের সঙ্গে আনন্দভ্রমণ

লেস ওয়ালেসা এক সময় ছিলেন ডক শ্রমিক, সেখান থেকে কঠিন সংগ্রাম করে নিজের দেশকে এনে দিয়েছিলেন গণতন্ত্র। গিদাইন্স্ক বন্দরের ডকে কাজ করা এই শ্রমিক শান্তিতে নোবেল জিতে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় দেশের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। এই মানুষটিকে নিয়ে জগতবাসীর কৌতুহলের শেষ নাই। তিনি থাকেন পোল্যান্ডের বন্দর নগরী গিদাইন্স্ক । সেই গিদাইন্স্ক বন্দরেই বাল্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করলেন ভ্রমনকারী শাকুর মজিদ। একা একা প্রবেশ নয়, যেনো ১৬ কোটি বাংলাদেশীকে নিয়েই প্রবেশ করেছিলেন। কোনোদিন পোল্যান্ড দেখতে না পারার আফসোস যেনো না হয়, তাই তিনি লিখলেন নতুন ভ্রমণ কাহিনী ‘লেস ওয়ালেসার দেশে’।

লেখক শাকুর মজিদ খুব ভালো করেই জানেন, শুধু লেখায় আজকাল চিড়ে ভিজে না। ইন্টারনেটের সুবাদে বিশ্বের যেকোন জায়গাই আজ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কম্পিউটার স্ক্রীনে হাজির করা যায়, গুগল সার্চ করলেই একটি দেশ নিয়ে হাজার হাজার ভিডিও ক্লিপিং, ছবি আর কত শত তথ্য পাওয়া যায় সেখানে ভ্রমনকাহিনী একদম এক ঘেয়ে হয়ে যাওয়ারই কথা। কিন্তু লেখক সেটা একদম হতে দেননি। নিজের চোখ দিয়ে চেনাবেন বলে তুলে এনেছেন পোল্যান্ডের কত কত ছবি। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে একেবারে শেষ পর্যন্ত তিনি তার ফোটোগ্রাফির কারিশমা দেখিয়েছেন। এ জায়গাটিতে শাকুর মজিদ অন্য কোনো ভ্রমণ কাহিনীর লেখকের চেয়ে এগিয়ে। দেখার চোখ এবং লেখার হাত এ দু’য়ের সুন্দর সমন্বয় যদি গুটি কয়েক ভাগ্যবানের হয়ে থাকে, শাকুর মজিদ তাদের দলে মাথা উঁচিয়ে।

বাংলাদেশের পাঁচ চিরতরুণ, নিজেদেরকে যারা পঞ্চপর্যটক হিসেবে দলভূক্ত করেছে, তারা বেরিয়েছিল ইউরোপ ভ্রমণে ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে। সুইডেন থেকে বাল্টিক সাগরে ১৯ ঘণ্টার দীর্ঘ ভ্রমন শেষে তারা লেস ওয়ালেসার দেশ পোল্যান্ডে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের অনারারি কনসাল জেনারেল ওমর ফারুক।

তাদের ভ্রমণ শুরু হয় গিদাইন্স্কের রাজবাড়িতে লেস ওয়ালেসার সাথে সাক্ষাৎ দিয়ে। শাকুর মজিদের সাথে পাঠক হিসেবে আমরাও আড্ডায় মেতেছিলাম লেস ওয়ালেসার সাথে, ঘুরে বেরিয়েছি ৭-৮শ বছরের পুরনো শহর গিদাইন্স্ক , তরুন, ওয়ারশো, ক্রাকোভ এসব। তিনি আমাদেরকে নিয়ে গেছেন কোপার্নিকাসের জন্ম ভিটায় তরুন শহরে, শুধু তাই নয় ষোড়শ শতাব্দীতে কোপার্নিকাস ক্রাকোভের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে এসেছিলেন – সেই বিশ্ববিদ্যালয়, কিংবা হাজার বছরের পুরনো ভাভেল প্রাসাদ ঘুরে ঘুরে তাদের সাথে আমরাও সঙ্গী হয়েছি ভাভেল নদীর উপর নৌ বিহারে, তিনশ ফুট মাটির নীচের লবণপুরীতে। তার সাথে সাথে আমরাও জেনেছি ফিনিক্স পাখীর মতো কেমন করে তার ভষ্ম থেকেই জেগে উঠলো ওয়ারশো নগরী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে নগরীটি প্রায় ধূলিষ্মাৎ হয়ে গিয়েছিল, সেই নগরীটি আবার কী করে জেগে উঠলো। শাকুর মজিদ তার পঞ্চ পর্যটক বাহিনী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন আশভিচ গ্রামে। শিন্ডলার্স লিস্ট ছবিতে স্পিলবার্গ যা দেখিয়েছিলেন সে ঘটনাগুলো যেখানে ঘটেছিল সেই আশভিচ আর বিকেনাও এর লোম হর্ষক বর্ণনা শুনে আমাদেরও লোম খাড়া হয়ে যায়।

শাকুর মজিদের সাথে বেড়ানোর বাড়তি মজা হচ্ছে, যেহেতু তিনি স্থাপত্যের ছাত্র, এই বিষয়ের খুটিনাটি বর্ণনা তার লেখার মধ্যে থাকে। মধ্যযুগে ইউরোপের স্থাপত্যকলার রকমফের কেমন ছিল – কোনটা গথিক, কোনটা রোমান, কোনটা নিওক্ল্যাসিক, কোনটাই বা মডার্ন, এটা এখন আমাদের কাছে পরিস্কার।
গোটা বইটা পড়া শেষে আবার নতুন করে যেকোনো পাঠককেই পড়তে হবে। কারণ এতক্ষণ তো শুধু পড়া হয়েছে, ছবি দেখা হয়নি। এবার ছবি দেখার পালা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি ছবি দেখা।
শাকুর মজিদের ছবি তোলার হাত পাকা। সুতরাং অলস পাঠকেরা যদি বইটি পড়তে পড়তে নাও চায়, পাতায় পাতায় সাজানো ছবিগুলো দেখেও তার ভ্রমণ সেরে নিতে পারে।

এই বইটির সবচাইতে অনবদ্য দিক হচ্ছে প্রতিটি নতুন শহরে প্রবেশের আগে সেখানকার বিখ্যাত লোকদের বাণী তুলে দিয়েছেন লেখক। যেমন বইয়ের প্রথম পাতায় গিদাইন্স্ক বন্দরের ছবির পরেই পাওয়া যাবে লেস ওয়ালেসার সেই বিখ্যাত উক্ত “ I am lazy. But it’s lazy people who invented the wheel and the bicycle because they didn’t like walking or carrying things.”

শুধু তাই নয়, নিকোলাস কোপার্নিকাস, দ্বিতীয় পোপজন পল, স্টিভেন স্পিলবার্গ থেকে শুরু করে সপ্তদশ শতকের পোলিশ কবি ভেসপাজিয়ান কচোভসকি পর্যন্তও এ তালিকায় আছেন।

এ বইিিটতে লেখকের তুলনা প্রিয়তা দেখে মুগ্ধ হই। যখনই ভাসতুলার তীরে হেঁটেছেন, তখনই আমাদেরকে বুড়িগঙার তীরে বেড়াতে নিয়ে গেছেন। যখনই পুরানো কোনো শহরতলীতে হেঁটেছেন, আমাদেরকে পুরান ঢাকার কথা মনে করিয়েছেন। পোল্যান্ডের সড়ক, নদী, হাট বাজারের সাথে নিজের দেশের ওগুলোকে নিয়ে কথা বলেছেন। তার সাথে আমরাও দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছি।

অবশ্য আমাদের দেশে ভ্রমন কাহিনী শব্দটা শুনলেই প্রথম যার নাম মনে আসবে তিনি সৈয়দ মুজতবা আলী। মুজতবা আলীর বর্ণনা ভঙ্গীতে একেবারে প্রতিটা দৃশ্য চোখের সামনে চলে আসবে। আমরা এখনো তার ভ্রমন কাহিনীর পাঠকই রয়ে গেছি। মুজতবা আলীর গল্পের আব্দুর রহমান যখন আ¯ত দুম্বার রোস্ট খেয়ে আহ করে ঢেকুর তুলত তখন পাঠকের ঘরময় আব্দুর রহমানের তেল, ঘি, কিসমিস এলাচ দেয়া দুম্বা ভাজার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত। তাঁর বইতে কোনো কিছুর ছবি না দেখেও আমরা দেখতে পাই, ঘ্রাণ পাই। কিন্তু শাকুর মজিদের বইটিতে প্রায় প্রতিটি বর্ণনার সাথে তার প্রামানিক রূপ নিয়ে আছে দৃষ্টি নন্দন ছবি। যে ছবিগুলোর কারণে তার বর্ণনাকে কোনভাবেই অবিশ্বাস করার সুযোগ থাকে না। আর এ কারণেই এই ‘লেস ওয়ালেসার দেশে’ পড়তে পড়তে আমরাও পোল্যান্ডের বুকে এক খন্ড বাংলাদেশকে আবিস্কার করি, একজন ওমর ভাই বা প্রবাসী বাংলাদেশীরাও আমাদের অনেক আপনজন হয়ে যান।

১০০ গ্রাম আর্ট পেপারে চার রং এ ছাপা ১০ ফর্মার এই বইটি প্রকাশ করেছে অবসর প্রকাশনী। মূল্য ৫০০ টাকা মাত্র। লেখক শাকুর মজিদের তোলা ছবি থেকে বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মাসুম রহমান।

২৬/০২/২০১২

দৈনিক সমকালে প্রকাশিত

মন্তব্য
Loading...