সিংহল সমুদ্র থেকে- ডাঃ মোঃ মনোয়ার হোসেন

পুস্তক পর্যালোচনা : সিংহল সমুদ্র থেকে- ৪৪ তম বিশেষ বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স, বিয়াম ফাউন্ডেশন,

পুস্তক পর্যালোচনা : সিংহল সমুদ্র থেকে, লেখক শাকুর মজিদ

পর্যালোচনায় ঃ ডাঃ মোঃ মনোয়ার হোসেন, ক্রমিক নং-২০, ৪৪ তম বিশেষ বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স, বিয়াম ফাউন্ডেশন, ঢাকা-১০০০

ভূমিকা

একটি ভালো ভ্রমণকাহিনী আমাদেরকে লেখকের ভ্রমণসঙ্গী করে তোলে। যে কোনো বিষয় সম্পর্কে সহজভাবে আমরা বই পড়েই জানতে পারি। ভ্রমনকাহিনীর বই যে কেবল আমাদের জানায়, তা নয়, কখনো কখনো দেখায়ও বটে। বইয়ের তথ্য ও বর্ণনা এমন অসাধারণ চিত্রকলা তৈরি করে তখন মনে হয় আমরা চলে গিয়েছি সেই স্থানে, সেই সময়ে। সেটা হতে পারে ইতিহাস নির্ভর, কিংবা নিছক সমকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটের বর্ণনা নির্ভর কোনো ঘটনার ক্ষেত্রেও। ভ্রমণ কাহিনীর ক্ষেত্রে এটি আরো বেশি সত্য । মূলত লেখকের লেখনী শক্তি, বর্ণনার সুক্ষ¥ বিস্তৃতিই পাঠককে নিয়ে যায় কিংবা যেতে সমর্থ হয় সেই সময়ে, সেই স্থানে। শাকুর মজিদের ‘সিংহল সমুদ্র থেকে’ এমনই একটি বই যা পাঠককে বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যায় বইয়ে বর্ণিত স্থান সমূহে। ‘কমনওয়েল এসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্ট’ এর স্থপতি সম্মেলন ২০১০  যোগদান উপলক্ষে তাঁর শ্রীলংকা ভ্রমন। সেখানে স্থাপত্য বিষয়ক কয়েকটি অসাধারণ স্থাপত্য দর্শনের পাশাপাশি  তিনি ভ্রমণ করেছেন কখনো হাতির মন্দিরে, কখনো কান্দালামা রিসোর্টে কখনো গ্যালে ফেইস রেস্টুরেন্টে কিংবা কখনো স্পাইস গার্ডেনে। লেখক আটটি অধ্যায়ে তার ভ্রমণ বর্ণনা লিখেছেন।

সেই ভ্রমনকাহিনী নানা বিশিষ্ট দিকগুলো তুলে ধরেছেন তাঁর এই গ্রন্থে এবং সেই সাথে শ্রীলংকার ইতিহাস, রাজনীতি, ঐতিহ্য আর্থসামাজিক অবস্থা প্রভৃতি তিনি তুলে এনেছেন পাঠকের সামনে।

বিজয় সিংহ থেকে

এ অধ্যায়ে লেখক শ্রীলংকার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। “শ্রীলংকায় সিংহলীদের রাজত্ব যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার নাম বিজয়। এই বিজয়ের লংকা জয় নিয়ে নানারকম কথাবার্তা ঐতিহাসিকদের মধ্যে চালু আছে। তার একটি হচ্ছে এমন যে, বিজয়ের পিতামহের রাজ্য ছিল কালিংঙ্গ আর ভাঙা। আজ আমরা যেটাকে উড়িষ্যা বলে জানি, সেই জায়গাটি ছিল কালিঙ্গ, আর বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যে রাজ্য ছিল, তার নাম ছিল ভাঙা।

ওদিকে সিংহবাহু কয়েকজন যমজ সন্তানের পিতা হন। তার সবচেয়ে বড় ছেলের নাম ছিল বিজয়। রাজকুমার বিজয় ছোটবেলা থেকেই অনেক উশৃঙ্খল আচরণের জন্যে নিগৃহিত হতে থাকে। সে তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অনৈতিক কাজকর্মে লিপ্ত হলে প্রজারা এসে রাজা সিংহবাহুর কাছে নালিশ জানায়। সিংহবাহু বিজয়কে শাস্তি দেন। তিনি তার মাথা আধান্যাড়া করে তাকে রাজ্য থেকে বিদায় হওয়ার নির্দেশ দেন। বিজয় তার অনুসারী ও তাদের পরিবার পরিজনসহ প্রায় সাতশ’ লোক সিংহপুর ত্যাগ করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এক জঙ্গলাকীর্ণ দ্বীপে গিয়ে বসবাস শুরু করে। মূলত এটাই সিংহলীদের রাজ্য, বর্তমান শ্রীলংকা। বিজয় বাবুর আগমনের সময়টা গৌতম বুদ্ধের তিরোধানের সামান্য কয়েক বছর পরে, এখন থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। এমন লোককথা, প্রচলিত গল্প চালু রয়েছে শ্রীলংকা নামটির সঙ্গে। তবে এখানেই শেষ নয়। ইতিহাসে রয়েছে-

“আজ আমরা যাকে শ্রীলংকা বলে জানি তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে ডাকা হতো। আদিকালের গ্রীক পন্ডিতেরা তাকে ডাকতেন ‘তাপ্রবানি’, আর আরবেরা বলতেন ‘সেরেনদিপ’। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ায় পর্তুগিজরা যখন শ্রীলংকায় এলেন, নাম দিলেন ‘সিলাও’। এই ‘সিলাও’ পর্তুগিজ শব্দটি ইংরেজদের কাছে গিয়ে ‘সিলোন’ হয়ে যায় এবং ১৯৪৮ সালে ‘ডমিনিয়ন অব সিলোন’ হিসেবেই দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করে। শ্রী আর লংকা, দুটোই সংস্কৃত শব্দ। ‘শ্রী’ মানে দৃষ্টিনন্দন, সুন্দর। আর ‘লংকা’ মানে দ্বীপ। রামায়ণ আর মহাভারতে যে নয়নাভিরাম দ্বীপটির কথা বহুবার বলা আছে, তা এই শ্রীলংকাই।”

কলম্বো: নাম-রহস্য

শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বো নামের ইতিহাস এখনো রহস্যাবৃত । লেখক সেইরহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, ১৫০৫ সালের এক সুন্দর সকালে হঠাৎ করে পর্তুগিজ নাবিক ভেড়ানো এক জাহাজ এসে শ্রীলংকার সবকিছু কেমন যেন ওলটপালট করে দেয়। প্রায় দু’হাজার বছর ধরে চলে আসা শাসনব্যবস্থার উপর আক্রমণের পর খুব দ্রæততার সাথে এই সিংহলী রাজ্য কেমন করে যেন একটা পর্তুগিজ কলোনিতে পরিণত হয়ে যায়। পর্তুগীজরা তাদের প্রধান নাবিক কলম্বাসের নামে এই দ্বীপের নামরকণ করতে পারে ঠিক যে সময় কলম্বাসের জাহাজ ছুটেছিল উত্তর আমেরিকার দিকে, কিংবা পিজারোর জাহাজ খুঁজে বেড়াচ্ছিল দক্ষিণ আমেরিকার কোনো পোতাশ্রয়, কাছাকাছি সময়ে একই গোত্রের পর্তুগিজ নাবিক লরেনকো দ্যা আলমেইদার জাহাজ এসে ভিড়ে আজকের এই কলম্বো বন্দরে।  ইবনে বতুতা এই দ্বীপ সফর করেছিলেন এবং তার লেখায় এ দ্বীপের একটি বড় শহরের নাম এসেছে ‘কালাংপু’। সিংহলী শব্দ ‘কলন থোতা’ নাম ‘কেলানি নদী তীরের বন্দর, আবার ‘কলা-আমবা থোতা’ মানে আম্রকাননের পাশের উপকূল’। এমনও ধারণা করা হয় যে, ওসব নাম থেকে বিবর্তিত হতে হতে ‘কলম্বো’ শহরের নাম এসেছে।  সে সময় এই দ্বীপরাজ্যটি মাত্র তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল। মাঝামাঝি পাহাড়ি জায়গায় ক্যান্ডি, পশ্চিম উপক‚লবর্তী অঞ্চল কটি আর উত্তরের অংশটি যা বর্তমানে জাফনা নামে পরিচিত, তাকে বলা হতো ইয়ার্লপানাম। পর্তুগিজদের আরও একশ বছর পর এই দ্বীপে আসে ডাচরা। তারাও এসে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্ষমতা দখলের কাজ খুব দ্রæত করে নেয়। কিন্তু শ্রীলংকার গহিন অরণ্যের ভেতর জীবনযাপন করা মানুষেরা কখনোই পর্তুগিজ বা ডাচদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেনি এবং তারা স্বতন্ত্রভাবেই তাদের মতো করে জীবনযাপন করতে থাকে। ক্যান্ডি তখন তাদের রাজধানী। এরপর, সবশেষ বিদেশি বেনিয়া হিসেবে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এখানে তাঁবু গাড়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইংরেজদের কাছ থেকে সিংহলীরা মুক্তি পায়, এই সামান্য ক’বছর আগে। কিন্তু তারপরও তাদের সংঘাত শেষ হয়ে যায় নি। সিংহলীরা বরাবরই ক¤েপ্রামাইজ করেছিল বিদেশী শাসকদের কাছে, করে নি তামিলরা। যে কারণে তামিলরা কখনোই সংহলীদের রাজত্ব মনেপ্রাণে মেনে নেয়নি। আর এ কারণেই তামিল আর সিংহলীর সংঘাত, শ্রীলৈংকার বহুদিনের পরিচিত একটি বিষয়। তারা ১৮০২ সাল থেকে এই দ্বীপকে একটি ‘ক্রাউন কলোনি’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শাসনকাজ চালাতে থাকে। ১৮১৫ সালে তারা যখন ক্যান্ডির রাজভান্ডার ধ্বংস করে দিল, তখন এই দেশটি পুরোপুরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চালিত হতে আর কোনো বাধা থাকেনি। ব্রিটিশরা এই অঞ্চলটি দখলে নেওয়ার পর উর্বর মাটি থেকে সোনা ফলানোর উদ্যোগ নেয়। উঁচু নিচু পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে বৃষ্টির পানি জমে না, সে জায়গাটি চা চাষের জন্য ভালো। তৈরি হতে থাকে ‘সিলোন টি’। দারুচিনি, রাবার, ইক্ষু, কফিÑ এসবের ফলন বাড়তে থাকে হু হু করে। এসব কারখানায় কাজ করার জন্য ভারতের তামিলনাড়– অঞ্চল থেকে হাজার হাজার শ্রমিক আমদানি করা হয়। কলম্বোকে রাজনৈতিক রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানেই গড়তে থাকে স্কুল, কলেজ, রান্তাঘাট, রেললাইন গির্জা।” ‘টেমারিন্ড ট্রি’ বা হোটেল তেতুলগাছ। রিসোর্টের নামটি বিস্ময়কর হলেও সুন্দর। সেখানে ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া নানা চিহ্ন বর্তমান। অবশ্য শুধু সেখানে কেন শ্রীলংকাজুড়েই এমন চিহ্ন রয়েছে আরো। টেমারিন্ড ট্রি থেকে কান্দালাম রিসোর্টের দিকে যাত্রা। লেখকসহ তাদের পাঁচ বন্ধুর এই যাত্রা এগিয়ে নেয় ভ্রমণের গল্পকে। যাত্রাপথ কখনো নিছক গল্পের, কখনো ইতিহাস বর্ণনার, কখনো নির্মল আনন্দের। তবে ইতিহাস বর্ণনার পাশাপাশি সমকালীন রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরায় বইটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। ট্যাক্্ির ড্রাইভার উদিতা ও লেখকের কথপোকথন তাই কখনো কখনো মনে হয়েছে পাঠককে নানা কিছু জানাবার একটি চরিত্র কৌশল।  কলম্বো থেকে কান্দালামা ১৬০ কিমি পথ। যেতে যেতে আরো অনেক গল্প। তবে মজার তথ্য লংকান প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ্র রাজাপাকসে এক সময় অভিনেতা ছিলেন। অনেকটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগানের মতো। শাকুর মজিদ সেই সূত্র ধরে সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাস, নিকট রাজনীতিক ইতিহাসকেও টেনেছেন খুব সুন্দরভাবে।  ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অল্পভোটের ব্যবধানে তিনি জিতে যান। প্রেসিডেন্ট ছাড়াও প্রতিরক্ষা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো দুটো অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় তিনি নিজের কাছে রেখে দেন। পরপর দু’বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া এই ঝানু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এখন প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন শ্রীলংকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে।  শুধু তাই নয়, কিভাবে তামিল টাইগারের জš§, ভিলুপিল্লাই প্রভাকরণের উত্থান, তাকে নিয়ে বিতর্ক, প্রভাকরণের মৃত্যু সেসবও তিনি তুলে এনেছেন ভ্রমণ বর্ণনার অংশ হিসেবে। পাঠক এতে কেবল ইতিহাস পড়ছেন বলে মনে করবেন না, গল্পের ঢঙে জানবেন, সিন্ধুর টিপ সিংহলকে।  শ্রীলংকানরা কেন এতো শিক্ষিত?  শ্রীলংকার ৯২% লোক শিক্ষিত। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশে শিক্ষার হার এত বেশি নয়। এশিয়ার মধ্যেও তারা শীর্ষে। শ্রীলংকাকে জানতে এই তথ্যগুলো খুব জরুরি বলে লেখক মনে করেন। পুরো শ্রীলংকাতে ক্লাস নাইন পর্যন্ত প্রত্যেক শিশুর লেখাপড়া বাধ্যতামূলক এবং তাদের স্কুল ড্রেস এবং বইপুস্তকসহ যাবতীয় খরচ সরকারই বহন করে।  আজকের শ্রীলংকাকে এরকম ঈর্ষণীয় ইংরেজি শিক্ষায় দীক্ষিত করার জন্য ব্রিটিশ আমলের তৈরি করা শিক্ষাব্যবস্থারই অবদান সবচেয়ে বেশি। সে কারণে আমাদের এই উপমহাদেশে ব্রিটিশরা যেমন শুধুমাত্র কেরানি তৈরির কারখানা হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ করেিেছল, শ্রীলংকাতে কিন্তু সেটা ঘটে নি। কারণ, ব্রিটিশদের আমলেই মাঝ স্তরের অফিসার হিসেবে শ্রীলংকানরা ব্রিটিশদের সাথে কাজ করেছে। তার রেশটুকু এখন রয়ে গেছে শ্রীলংকায়। মজার বিষয় হচ্ছে, শ্রীলংকার যে সকল গাঁওগেরামে এখনো বিদ্যুৎ পৌছে নি, সেখানেও স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সোলার ফটোভল্টেক এইডেড কম্পিউটার শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। নিজস্ব বিদ্যুৎ দিয়ে কম্পিউটার চালাচ্ছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। এই পাইলট প্রজেক্টের অধীনে পুরো শ্রীলংকার ১০০টি  স্কুলে ৭৫ হাজার শিশুকে কম্পিউটার শিক্ষা দেওয়া হয়। লেখকের কান্দালামায় যাবার পথেই প্রতœতাত্তি¡ক সাইট সিগিরিয়া। যার বয়স অনেকটা গ্রীক নগরী এক্রোপলিসের কাছাকাছি। অনেকটা ভারতের অজন্তা ইলোরার মতো। সিগিরিয়ার বর্ণনা লেখক দেন এভাবেÑ সিগিরিয়াকে অবশ্য এখন চিহ্নিত করা হচ্ছে বর্তমান সহস্রাব্দের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগর উন্নয়ন পরিকল্পনার নিদর্শন হিসেবে। মাস্টারপ্ল্যানে সুষম এবং অসম যে বিন্যাস এখানে মানুষের তৈরি স্থাপনা এবং প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা স্থাপনার মধ্যে সমন্বয় তৈরি করেছে, তা এখন এক বিস্ময়কর পরিকল্পনার উদাহরণ। ৬শ ফুট উপরের পাহাড় নগরীর পশ্চিম পাশটিতে রাজকীয় পার্ক। সিমেট্রিক বিন্যাস। এই পার্কে পানি প্রবাহের জন্য যে ব্যবস্থা দেড় হাজার বছর আগের সিংহলী রাজারা করে গেছেন।  ঐতিহাসিক সিগিরিয়া নগরী সিগিরিয়ার উদ্যানে যে বাগানের বিন্যাস এখনো আছে, সেটা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বাগিচা। এই বাগানেরও ৩টা ভাগ। পানি, পাথর আর গুহা। সিগিরিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশটিÑগুহাচিত্রের অংশ। ১৯০৭ সালে একজন প্রতœতত্ত¡বিদ লিখেছেন, পুরো পাহাড়টিই মনে হচ্ছে যেন একটা বিশাল চিত্র গ্যালারি।   হেরিটেন্স কান্দালামা   অতঃপর লেখকের কান্দালামা যাত্রা । পৃথিবীর অন্যতম হেরিটেন্স সাইট। দেশ বিদেশ থেকে স্থপতিরা আসেন শুধু এই ভবনটি দেখতে। স্থপতি জেফরি বাওয়ার ডিজাইন করা পরিবেশ বান্ধব পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য। লেখকের কমনওয়েলথ স্থাপত্য সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘টিকে থাকার স্থাপত্য’ অৎপযরঃবপঃঁৎব: জবঃযরহশরহম ঝঁংঃধরহধনরষরঃু। জেফরি বাওয়ার এই স্থাপত্যটি তারই নিদর্শন।  হেরিটেন্স কান্দালামা  লেখকের বর্ণনায় ‘পাহাড়ের মধ্যে তৈরি হওয়া এই রিসোর্টটি যেন পাহাড়েরই পরিপূরক’ প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে কোনো পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য নষ্ট না করে এমন স্থাপত্য বিরল যে কোনোখানে। তবে লেখকের বর্ণনায় মধ্য শ্রীলংকার রাজধানী ক্যান্ডির অপরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। শহরটি মূলত: দুটো কারণে বিখ্যাত- ১. নৈসর্গিক দৃশ্য, ২. বৌদ্ধ মন্দিরের জন্য যেখানে গৌতম বুদ্ধের একটি দাঁত মন্দিরে রাখা আছে। একসময় বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে ক্যান্ডির অনেক খ্যাতি ছিল। কেউ শ্রীলংকা যাবে কিন্তু দারুচিনি বাগান দেখবে না তা কি করে হয়। দারুচিনি বিশেষজ্ঞর বর্ণনা পাঠককে সেখানেও নিয়ে যায়। দারুচিনির নামে যে পাঁচতারা হোটেল আছে এখানে তাও উল্লেখ করেন। 

শ্রীলংলায় লেখক ও তার পঞ্চপর্যটকদল

ক্রিকেটের শ্রীলংকা

শ্রীলংকার ক্রিকেটের সুনাম সবারই জানা, লেখকের কাছে জয়সুরিয়াকে মনে হয় পাশের বাড়ির ছেলে। রানাতুঙ্গাকে মনে হয় ড্যাশিং হিরো। মালিংগার বিদঘুটে রঙ করা চুল, সুন্দর এবং সতেজ প্রাণ সবার  মন কাড়ে।  রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে ‘৯৬ সালে শ্রীলংকা বিশ্বকাপে  এক হাত দেখিয়েছিল তাবৎ দুনিয়াকে। ক্রিকেট দুনিয়ার স্বঘোষিত রাজা অ¯েট্রলিয়াকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ৩ ওভার বাকি থাকতেই তারা সিংহল দ্বীপে ট্রফি নিয়ে এসেছিল। আর শ্রীলংকান ক্যাপ্টেন রানাতুঙ্গাও পেয়েছিল বীরের সম্মান। লেখকের ভ্রমণ সঙ্গী  ড্রাইভার উদিতি বাংলাদেশ  ক্রিকেটের দারুন ভক্ত, তা লেখককে দারুনভাবে  আলোড়িত করে।  দারুচিনি বা সিনামন গার্ডেনের আকর্ষনীয় বর্ণনা এখানে পাওয়া যায়। দারুচিনির জন্যই সেই পৌরাণিক কাল হতে এই দ্বীপের এত নামডাক। হাজার হাজার বছর আগে থেকে এই দ্বীপে দারুচিনি, গোলমরিচ, এলাচি, লবঙ্গ, জায়ফল ইত্যাদির চাষ হত। শ্রীলংকার রপ্তানি বাণিজ্যে এই দারুচিনির অনেক অবদান। মসলাসামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় এই দারুচিনি। কৃষিজাত পণ্য যেমন চা, রাবার এবং নারকেলের পরই দারুচিনির অবস্থান শ্রীলংকায়। বছরে প্রায় দেড়শ কোটি ডলার আয় হয় দারুচিনি রপ্তানি থেকে। প্রায় ১০ হাজার পরিবার শুধু দারুচিনি চাষের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। পুরো পৃথিবীতে যে পরিমাণ  দারুচিনির উৎপাদন হয়, তার ৭০ শতাংশই হয় শ্রীলংকাতে।  হাতি মন্দির হাতি মন্দিরের বর্ণনাটিও অসাধারণ, পাঠককে টেনে নেবে অন্য এক ভুবনে। সেখানে না গিয়েও পাঠক সেখানে ভ্রমণ করছেন বলে মনে হবে। মানসিক শক্তির প্রতীক হিসেবে হাতিকে মূল্যায়ন করা হয় বৌদ্ধ ধর্মে। হিন্দু পুরাণেও হাতির কথা বহু জায়গায় আছে।   শ্রীলংকা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক  মাস পর ১৯৭২ সালের ২২ মে রিপাবলিক অব শ্রীলংকা নাম নিয়ে স্বাধীনভাবে দেশ শাসনের সুযোগ অর্জন করে। শ্রীলংকার স্বাধীনতা চত্বরের বর্ণনা লেখক বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে লিখেছেন।  শ্রীলংকা তাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন সেনানায়ককে জাতির পিতা হিসেবে মানে। এটা নিয়ে সিংহলী বা তামিল কারো মধ্যেই বিরোধ নেই। 

জেফরি বাওয়া ট্যুর

শ্রীলংকান স্থপতি জেফরি বাওয়া এক বিস্ময়কর স্থপতি। তিনি ৩৫টি রিসোর্ট ডিজাইন করেছেন। তিনি শ্রীলংকার ঐতিহ্য এবং পরিবেশকে সমন্বিত করে ভিন্নধর্মী একটি স্থাপত্যধারাকে প্রকাশ করেন। তার ডিজাইন করা বিশ্বখ্যাত পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট ‘হেরিটেন্স কান্দালামা’। পাহাড় আর লেকের মাঝখানে এমনভাবে এটা বানানো যে, মনে হয় পাহাড়ের ভেতর থেকে তৈরি হয়ে লেকের ওপর গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। পাহাড় আছে পাহাড়ের জায়গায়। কতকগুলো ভারী পাথরখন্ড বসানো হয়েছে পাহাড়ের গায়ে, যাতে এটা কোনোভাবেই পাহাড় ধসের শিকার না হয়। উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপরে বসানো হয়েছে এই পাঁচ তলা পাঁচ তারকা রিসোর্ট। তার তলা দিয়ে পাহাড়ের ঢল, বৃষ্টির পানি এমনকি বন্য জন্তু জানোয়ারও অনায়াসে চলাচল করতে পারে। ১৯৮২ সালে শ্রীলংকান মন্দির স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যকে াজে লাগিয়ে তিনি নতুন ধারার একটি সংসদ ভবন নির্মাণ করেন। আর এ কাজটির জন্যই জেফরি বাওয়ার কপালে জুটে দেশমান্য’ পদক। বাওয়ার জীবনে পুরস্কারের কমতি ছিল না। বেনটোটার কাছে একটা ০ϝইতহিাস, ঐতহ্যি ও সৌর্ন্দযরে সাথে পুরান আর কংিবদন্তি নয়িে রহস্যঘরো এই শ্রীলংকার রহস্যরে দুয়ার সমূহ একে একে খুলতে থাকি আমি ও আমাদরে পঞ্চর্পযটকরে দল। স্থাপত্যরে ছাত্র বলইে হয়তো শ্রীলংকান স্থাপত্য এবং বশ্বিবখ্যিাত পরবিশেবাদি স্থপতি জফেরি বাওয়া ও তার কাজগুলো আমাকে অনকে বশেী আলোড়তি করছে,ে তার প্রসঙ্গগুলো একারণে এসছেে অনকে বশেী। সইে সাথে র্সাবক্ষণকি মলোনোর চষ্টো করছেি বাংলাদশে আর শ্রীলংকাক।ে শ্রীলংকার আদি পুরুষরে বাস ছলিো আজকরে বাংলাদশে।ে বজিয় সংিহ থকেে শুরু করে আজকরে রাজাপাকশার সময় র্পযন্ত শ্রীলংকাও বাংলাদশেরে মতো কলোনয়িাল শাসনরে অধীনে ছলিো প্রায় ৪শ বছর ধর।ে বাংলাদশেরে মতোই চল্লশি ও সত্তুররে দশকে তারাও দু’দফায় মুক্ত হয়। আমাদরে পাহাড়ি জনগোষ্ঠরি সাথে বাঙালীদরে স্নায়ুযুদ্ধরে মতো তাদরেও সংিহলী-তামলি সংঘাত। ভাষার মলি না থাকলওে চহোরা এবং পারবিারকি সংস্কৃতরি অনকে মলি আমাদরে সাথে শ্রীলংকার। এসব কছিুই আমি আমার মতো করে দখেছে,ি বুঝছে,ি জনেছেি এবং তা নয়িে লখিছে।ি আমার সাথে র্সাবক্ষণকি ছলিনে জীবনানন্দ দাস। শ্রীলংকা ঘুরতে গয়িে আমি বনলতা সনে আবস্কিাররে আনন্দে অধীর হয়ে যাই। আমার ভ্রমণ কাহনিীগুলো অনকে বশেী তথ্যে ঠাসা বলে কোনো কোনো পাঠক আমাকে অভযিুক্ত করনে। আমি আত্মজবৈনকি কোনো লখোয় উদ্ভট কোনো ঘটনার ‘জন্ম’ দতিে পারি না বলইে হয়তো আমার ভ্রমণ কাহনিীগুলো খুব বশেী রসালো নয়। পাঠকরে এই অভযিোগ থকেে আমি খুব সহজে নস্কিৃতি পতেওে চাই না। (সূত্র: সাপ্তাহকি অন্যদনি)

তুলনামূলক আলোচনা

শ্রীলংকা নিয়ে ভ্রমণ কাহিনী বাংলা সাহিত্যে খুব একটা বেশি নেই। এক্ষেত্রে আমরা মসিহ্ মালিক চৌধুরীর লেখা ‘শ্রীলংকা ও মালদ্বীপে নয়দিন ’ বইটির কথা উল্লেখ করতে পারি। এইবইটিতে লেখক শ্রীলংকার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আকর্ষনীয় বর্ণনা দিয়েছেন। অন্য দিকে  “সিংহল সমুদ্র থেকে” বইয়ের লেখক শাকুর মজিদ শ্রীলংকার দর্শনীয় স্থানের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য সমূহ সম্পর্কে বিশেষ আলোকপাত করেছেন। যা স্থাপত্য এবং পর্যটন বিষয়ে আগ্রহী পাঠককে আলোড়িত করে।

বইটির সমালোচনা

সবল দিক

লেখক আটটি অধ্যায়ে তার ভ্রমণ বর্ণনা লিখেছেন সবটুকু।

এই পরিসরেই ভ্রমণের পাশাপাশি শ্রীলংকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা ব্যবস্থা, আর্থসামাজিক কাঠামো, রাজনীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতাÑ সবই তুলে এনেছেন।

 নিছক ভ্রমণের বর্ণনায় তিনি থাকেননি। বইটিকে তিনি শ্রীলংকার একটি ধারাবাহিক ফটো স্টোরিতে রূপ দিয়েছেন। যা পাঠককে আরো কাছাকছি নিয়ে গেছে লেখার, ভ্রমণের।

পরিবেশ বান্ধর স্থাপত্য বিষয়ে বর্ণনা বর্তমান বৈশ্বিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে পাঠককে ভাববার ক্ষেত্র তৈরী করে দেয়।

দুর্বল দিক

বইটিতে অনেক বেশি তথ্য থাকার কারণে কখনো কখনো পাঠকের কাছে তথ্যভারাক্রান্ত মনে হতে পারে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভ্রমণের চেয়ে তিনি স্থাপত্য বিষয়ক বর্ণনা বেশি দিয়েছেন, হয়ত নিজে স্থপতি বলে। সাধারন পাঠকদের কাছে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।

বইয়ের ছবি গুলো আরো মানসম্মত হলে ভাল হতো।

উপসংহার

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই বাংলাদেশ অঞ্চলের বিজয় সিংহ নামক এক রাজপুত্র ভারত সাগর পাড়ি দিয়ে সিংহল দ্বীপের রাজা হয়েছিলেন। রামায়ন ও মহাভারতের অনেকগুলো উপখ্যানের পটভূমি হিসেবে এই দ্বীপটির ভূমিকা অনেক। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর দেশ হিসেবেও শ্রীলংকা প্রতিষ্ঠিত। খ্রীস্টান ও মুসলমানদের কাছেও এই দ্বীপের কিছু অংশ তীর্থ স্থান হিসেবে চিহ্নিত। ষোঁড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় বনিককূল আগ্রাসন ঘটায় এই দ্বীপে এবং পরবর্তী ৫শ বছর ধরে তারা শাসন করে। প্রায় অর্ধ-শতাব্দী থেকেই এই দ্বীপটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তারপরও দেশটির মধ্যে অভ্যন্তরীন কোন্দল লেগেই আছে। আড়াই হাজার বছর ধরে বয়ে বলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবশেষ নিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে আজকের শ্রীলংকা কোথায় কিভাবে আছে, একজন স্থপতি, আলোকচিত্রী ও লেখকের দৃষ্টিতে শাকুর মজিদ তুলে এনেছেন তার সর্বশেষ ভ্রমণ কাহিনী ‘সিংহল সমুদ্র থেকে’ বইটিতে। যা ভ্রমণ পিপাসূ পাঠক থেকে শুরু করে সকল শ্রেনীর পাঠককে শ্রীলংকাকে নতুন করে আবিস্কার করার সুযোগ করে দিয়েছে।

৫/৯/২০১৪

বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স, বিয়াম ফাউন্ডেশন,

 

মন্তব্য
Loading...