লেস ওয়ালেসার দেশে- মাসুদুল হাসান রনি

শাকুর মজিদ : একাধারে অনেক কিছু

শাকুর মজিদ পেশায় স্থপতি।কিন্তু নেশা তার অনেক। কখনো ছবি তোলেন। কখনো দেশ-বিদেশে ঘুরে ঘুরে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। টেলিভিশনের দর্শকদের জন্য নির্মাণ করেন টেলিফিল্ম ও নাটক। কখনো দু’হাত খুলে লিখেন মঞ্চের জন্য নাটক, কখনো টেলিভিশনের জন্য। কখনো ছোটদের জন্যও লিখেন। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো আর লেখালেখিতে তিনি বিরামহীন। আটপৌড়ে সাধারণ গদ্য তার হাতে হয়ে উঠে মেদহীন ঝরঝরে। ভ্রমন কাহিনী লিখেন অসাধারণ।শুধু চোখে দেখা নয়, ইতিহাসের মিশ্রনে তিনি সেইসব দর্শনীয় স্থানকে পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরেন অনায়াসে! অবসর পেলেই পঞ্চপান্ডবের দল নিয়ে এশিয়া থেকে ইউরোপ, ইউরোপ থেকে আমেরিকা ছুটে বেড়ান। তার লেখার সাথে আমার অনেক আগে থেকেই পরিচয়। সংবাদপত্রের সাহিত্য সাময়িকীতে লেখা পড়ি প্রথম। তার কৈশোর, ক্যাডেট কলেজ জীবন নিয়ে ছোটদের জন্য লিখেছিলেন আত্মজৈবনিক ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’। এই বইটি পড়ার পর থেকেই তার প্রতি আমার একরকম মুগ্ধতা তৈরী হয়। তার লেখার প্রতি হয়ে উঠি আগ্রহী। আজিজ মার্কেট, অভিজাত বইয়ের দোকান এবং বইমেলায় খুজতে থাকি তার নতুন নতুন বই। একসময় পড়া হয়ে যায় ‘আমেরিকা কাছের মানুষ দুরের মানুষ, আমিরাতে তেরো রাত, অষ্টভ্রমণ, মালয় থেকে সিংহপুরী, কালাপানি, হো চি মিনের দেশে, সুলতানের শহর, সক্রেটিসের বাড়ি, মিং রাজার দেশে, নদীর নাম টে, পাবলো নেরুদার দেশে, সিংহল সমুদ্র থেকে, লেস ওয়ালেসার দেশে’ ভ্রমণ বিষয়ক প্রকাশিত তার সব বই। এর মধ্যে ২/৪টি বই আবার শাকুর ভাই’র অটোগ্রাফ সহ পেয়েছি। বাকী বইগুলোর মধ্যে ২/৩টি পড়া হয়েছে বইকারে প্রকাশের আগে, অন্যদিন বা সাপ্তাহিক ২০০০এ । উল্লেখিত বইয়ের ২/১টা বাদে সবগুলো বই আমার সংগ্রহশালাকে করেছে সমৃদ্ধ। গল্প লিখেছেন ‘রীতা ও দু:সময়ের গল্প’।

বইটি আমার সংগ্রহে থাকার পরও কি কারনে যেন এখনো পড়া হয়ে উঠেনি। সাম্প্রতিক সময়ে হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে তার স্মৃতিচারনমুলক বই ‘যে ছিল এক মুগ্ধকর’ নানান কারনেই ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে ‘নুহাশপল্লীর এইসব দিনরাত্রি’। অসাধারণ একটি কাজ করেছেন মঞ্চ নিয়ে। মঞ্চের বিভিন্ন নাটকের কুশলীবদের ফ্রেমবন্দী করেছেন তার ক্যামেরায়। সেইসব ছবি নিয়ে বই করেছেন ‘রিদম অন দ্যা স্টেজ’। পেশায় তিনি স্থাপত্যবিদ। তার বিভিন্ন ভ্রমন কাহিনীতে পুরানো, ঐতিহাসিক স্থাপনার বর্ণনাও দিয়েছেন। তেমনি তার একটি বইতে ইসলামের স্থাপত্য নিয়ে লিখেছেন ‘ইসলামের স্থাপত্যধারা’। শাকুর ভাই অনেক ভালো নাটক লিখেন। তৌকির আহমেদের পরিচালনায় তার লেখা একটি নাটক ‘নাইওরী’ এখনো মনে দাগ কেটে আছে। নিজের রচনায় তিনি বেশ কিছু নাটক পরিচালনা করেছেন। মঞ্চের জন্য একটি নাটক লিখেই তিনি বাজিমাত করেছেন। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জীবন দর্শন নিয়ে নাটকটি ‘মহাজনের নাও’। এছাড়াও তিনি বাউল সম্রাটকে নিয়ে বানিয়েছেন তথ্যচিত্র ‘ভাটির পুরুষ’। এটিও নানান কারনে আমার কাছে ভালা লাগা একটি কাজ। অসাধারণ ভ্রমনকাহিনী : লেস ওয়ালেসার দেশে….. গতরাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভুমিতে নির্মিত সিনেমা ‘ফল ডাউন’ দেখতে দেখতে একটা সময় আর ভালো না লাগায় বই নিয়ে বসি। বেশ কিছুদিন যাবত অনেকগুলো ভ্রমন কাহিনী পড়েছি। আমার পড়ার স্টাইলটা একটু ভিন্ন। যখন যে বিষয়টি ভালোলাগে, তখন সেই বিষয় যতো বই আছে সেগুলো পড়ার চেস্টা করি। যেমন একটা সময় ভালোলাগলো আত্মজীবনী পড়তে। কিংবা ইতিহাসের বই। তখন একটার পর একটা একই বিষয়ের বই পড়ে ফেলি। যতক্ষন নিজের এই ভালো লাগাটা কাজ করে। মধ্যরাতে নিজের লাইব্রেরীতে খুজে পেতে পেলাম শাকুর মজিদের লেখা ‘লেস ওয়ালেসার দেশে’। ২০১২ তে বইটির ২০ কি ২২ পৃস্টা পড়ার পর কেন যেন পড়া শেষ করা হয়ে উঠেনি। এতোদিন পর পুনরায় পড়তে বসে মনে হলো কেন বইটি আগে শেষ করিনি? অনেক সহজ সরল ভাষায় তিনি বইটি লিখেছেন। মুহুর্তেই গদানস্ক বা গিদাইনস্ক, ডক শ্রমিক নেতা লেস ওয়ালেসার সংগ্রামের দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। বইটি পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে গেল ১৯৮০-৮১ সালের কথা। তখন আমি ক্লাস ফাইভ –সিক্সে পড়ি। প্রতিদিন রাতে বিটিভির ৯টার সংবাদে দেখি পোল্যান্ডে ডক শ্রমিকদের ধর্মঘট চলছে। ইয়া মোটা গোফঅলা এক শ্রমিকনেতা ভাষণ দিচ্ছেন। হাজার হাজার ডকশ্রমিক তুষারপাত উপেক্ষা করে তার বক্তব্য শুনছেন। ছেলেবেলায় দেখা সেই ব্যক্তি পরবর্তী সময় জগদ্বিখ্যাত হন, পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি লেস ওয়ালেসা। শাকুর ভাই বইয়ের শুরুতেই লেস ওয়ালেসার সাথে একঘন্টার সাক্ষাতের পূর্ন বিবরন দিয়েছেন। আর্টপেপারে ছাপা, পাতায় পাতায় রঙিন ছবি’র এই বইটি শেষ না করে আজ আর উঠতে পারিনি। অসম্ভব ভালো লাগা আর মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমাতে গেলাম ভোর রাতে।

লেখক : প্রোডিউসার, একুশে টেলিভিশন

২০১৩-১০-২০০৯

মন্তব্য
Loading...