মহাজনের নাও – খালেদ হোসাইন

গত ১৮ জুন সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমীর পরীক্ষণ হলে শাহ আবদুল করিমের জীবন ও দর্শন-কেন্দ্রিক নাটক ‘মহাজনের নাও’-এর প্রিমিয়ার শো হয়ে গেল। সুবচন নাট্য সংসদ তাদের ৩৩ তম প্রযোজনায় ব্যতিক্রমী এক ব্রতযাত্রায় নিজেদের নিয়োজিত করেছে বলা যায়। শাকুর মজিদ আমাদের সাংস্কৃতিক জগতে কৃতী পুরুষ, এটি তাঁর প্রথম মঞ্চনাটক। উজ্জ্বল অভিষেকের জন্য শাকুরকে অভিনন্দন জানাই। সমবায়ী প্রয়াসে এটি এ সময়ের একটি উলে­খযোগ্য নাট্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে।

আবদুল করিম বাংলাদেশের মাটির মর্ম ভেদ করে উঠে আসা এক লোকায়ত মানব-সন্তান, তার চেতনায় জলসিঞ্চন করেছে ভাটি অঞ্চলের কালনি নদী। এই নদীর তীরে জন্মে সেই নদীকে বুকে বয়ে বেড়িয়েছেন আজীবন। প্রকৃতি ও পরিপার্শ্ব থেকে পাঠ নিয়ে আমাদের লোকজীবনের প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলেন করিম। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার তাঁর জীবনে, বাণীতে ও সুরে চিত্তাকর্ষকভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। বাঙালি-সংস্কৃতির সমন্বয়-প্রবণতা, অসা¤প্রদায়িক মনোভঙ্গি, গীতল-মানস সরলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর সৃষ্টিকর্মে। আর সেই ভাবনাবিশ্বকে তিনি চারপাশে ছড়িয়ে দিয়েছেন এমন সব বিচিত্র সুরেÑ যেন সুর নয়, ঋতুতে ঋতুতে বদলে যাওয়া বিচিত্র আয়তনের কালনি নদীর ঢেউ। কখনো উত্তাল, কখনো নমিত, কখনো বিমিশ্র, কখনো বিচিত্র, কখনো অস্থির, কখনো স্তিমিত। অবদুল করিমের চিন্তা সুরের এই বৈচত্র্যকে ধারণ করতে পেরেছে বলেই তা সব মানুষের হৃদয়লোকে সহজ প্রবেশাধিকার পেয়েছে। সুরের এই হিলে­ালই করিমের চিন্তাকে ভাবসম্পদে উত্তীর্ণ করেছে।

প্রাচীন কালের দিকে তাকালে দেখবো, সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে নদীকে কেন্দ্র করে। আর নৌযান মানুষের আদিতম বাহন। ধ্র“পদী সাহিত্যে আমরা জল-লগ্ন জীবনযাত্রার বিচিত্র চিত্র দেখতে পাই। অডিসিয়াসের ঘরে ফেরা বা সিন্দাবাদের সমুদ্রযাত্রার কথা বাদ দিই, আমাদের চর্যাপদ বা মঙ্গলকাব্যে জল ও নৌকা বড় একটি জায়গা দখল করে আছে। প্রকৃতপক্ষে, নদীমেখলা বাংলাদেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে নদী যেন একাত্ম। আবদুল করিমের জন্ম ভাটি অঞ্চলে, যে ভূখণ্ড জলে আপ্লুত থাকে বছরে আট মাস। এই ভাটি অঞ্চলের মাটি ও জল, মানুষ ও মনোভঙ্গিই গড়ে তুলেছে তাঁর শিল্পচেতনা। তাঁর চিন্তায় একটি বড় জায়গা দখল করেছিল জলজ বাতাবরণ, জলজ প্রতিমা, জলযান মানে, নৌকা বা নাও। নৌকার ব্যাপক ব্যবহার আমরা লক্ষ করি করিমের গানে। সাধারণ অর্থে কদাচিৎ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতীক ও রূপকার্থে। এ সম্পর্কে নাট্যকার শাকুর মজিদ আমাদের জানান, “বাউল সাধক শাহ আব্দুল করিমের সারা জীবনের সাধনা ছিলো নিজেকে জানা এবং সৃষ্টিকর্তার রহস্য উদঘাটন করা। এ ক্ষেত্রে দেহতত্তকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি অনেক গান লিখেছেন। এবং যেহেতু শাহ আব্দুর করিম সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের মানুষ ছিলেন, তাঁর গানে তিনি নৌকাকে অনেক বেশী ব্যবহার করেছিলেন; নিজের দেহের রূপক হিসাবে। তিনি নেজেকে ভেবেছিলেন যেনো কোন এক মহাজনের কাছ থেকে ধার পাওয়া এক নৌকা। যে নৌকার মালিক তিনি নন, শুধুমাত্র সঠিকভাবে চালিয়ে কোনো-এক ‘সোনার গাঁও’ এ পৌছানোর গুরু দায়িত্ব তাঁর। জীবনের সায়াহ্নে এসে তার নাও কোন গাঁওয়ে ভিড়েছেÑ সে শুধু তার মহাজন জানেন। মূলত শাহ আব্দুল করিমের জীবনের জটিলতা, সংকট, এবং তার থেকে উত্তরণের বিষয়গুলো এ নাটকে প্রকাশ পেয়েছে। তার সাথে উঠে এসেছে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার বোধ এবং দর্শন।”
আবদুল করিমের জীবনের আয়তন যেমন বিশাল, তেমনই তা নানা ঘটনায় বিচিত্র ও বর্ণিল। বাঙালি-লোকমানসের বিচিত্র অভিব্যক্তি তাঁর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। শ্রেণীবৈষম্য, ধর্মীয় সা¤প্রদায়িকতা, রাজনীতির ব্যভিচারের প্রতিবাদ করেছেন তিনি এবং আধ্যাত্মিকতার বোধেও স্নাত হয়েছেন। স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে ছিল রহস্যময়তা। এই বৈচিত্র্যকে শাকুর মজিদ বিস্ময়কর নৈপুণ্যে তাঁর নাটকে মূর্ত করে তুলেছেন, এবং সুদীপ চক্রবর্তী তাঁর সৃষ্টিশীল নির্দেশনার মধ্য দিয়ে মঞ্চে তা হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন। নাটকের বর্ণনায় শাকুর মজিদ শিথিল অক্ষরবৃত্ত পয়ার ছন্দ প্রয়োগ করে দর্শকশ্রোতার চিত্তকে গভীরভাবে স্পর্শ করতে সমর্থ হয়েছেন। অবদুল করিমের গান ব্যবহারে পরিণত রুচি, উপযোগিতা ও পরিমিতিবোধের যে পরিচয় শাকুর দিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। পোশাক, আলোক, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারে নৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া গেছে। পুরো নাটক জুড়ে নানা রকম ঢেউয়ের যে ব্যবহার হয়েছে বিভিন্ন ঘটনা-পরিক্রমায়, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর ফলে মঞ্চময় ভাটি অঞ্চল দর্শকদের মনোলোকে তরঙ্গময় একটি আবেশ তৈরি করে। অভিনয়ে সকলেই আন্তরিকতা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পরবর্তী প্রদর্শনীগুলোতে নিশ্চয় তা আরো মনোগ্রাহী হয়ে উঠবে।

‘মহাজনের নাও’ নিঃসন্দেহে সুবচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনা হিসেবে চিহ্নেত হবে, এবং সমকালীন বাংলা নাটককে নানাভাবে প্রভাবিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।

২০/০৬/২০১০

মন্তব্য
Loading...