যে ছিলো এক মুগ্ধকর – সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

নানা শটে হুমায়ূন আহমেদকে দেখা

শাকুর মজিদ ছবি তোলেন, তথ্যচিত্র-প্রামাণ্যচিত্র বানান, নাটক লেখেন; লেখার হাতটিও তাঁর ভাল। নিজের স্কুল জীবন অথবা কাছে -দূরের দেশ বেড়ানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর লেখা বইগুলি পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সেই অল্প বয়সেই আত্মার একটি মিল খুঁজে পেয়েছেন শাকুর  হুমায়ূনের ভেতরে যে একটি ভবঘুরে মানুষ ছিল তাকে তিনি চিনতে পেরেছেন। এই ভবঘুরে মানুষটি হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্টিশীল সত্তাটিকে যে হাত ধরে নানান জায়গায় নিয়ে যেত, মানুষের মনের অলিগলি থেকে নিয়ে বিশ্বসংসারের আনন্দ বেদনার অলিন্দে-উঠানে, সে বিষয়টি শাকুর বুঝতে পেরেছিলেন। ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে হুমায়ূন আহমেদকে তিনি দেখেছেন, জেনেছেন, তাঁর সৃষ্টিশীলতার উৎসগুলি চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপোড়েনের স্বাক্ষী হয়েছেন, তাঁর মেজাজটি পড়তে চেষ্টা করেছেন, এবং তাঁর ভেতরের ভবঘুরে মানুষটির সঙ্গে সখ্য গড়তে চেয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদও, যাকে বলে আস্কারা দিয়েছেন শাকুরকে; তাঁর কাজের প্রতি এক ধরনের সস্নেহ সমর্থন দিয়ে গেছেন। আর যত হুমায়ুনকে দেখেছেন শাকুর, তত মুগ্ধ হয়েছেন। এই মুগ্ধতার প্রকাশ যে ছিল এক মুগ্ধকর। তবে মুগ্ধতাটা মোহাবিষ্টতার প্রদর্শনী হয়ে দাঁড়ায়নি, আবেগের বিহŸলতার বিশেষণ মণ্ডিত বর্ণনা হয়ে দাঁড়ায়নি, যে বিপদটি এ ধরনের আখ্যানকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। শাকুর বরং উল্টোপথে হেঁটেছেন  মুগ্ধতা কেন, অথবা নয় কেন, কখন ও কোথা থেকে এর উৎপত্তি  এসব প্রশ্নের আদিঅন্ত খুঁজেছেন। সেই শঙ্খনীল কারাগার পড়ার অভিজ্ঞতায় যে হুমায়ূনকে তিনি চিনেছিলেন, তাঁকে যেন বাজিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন এর পরের ৩২ বছর এবং এটি করতে গিয়ে একজন লেখকের-নাট্যকারের-গান রচয়িতার- চিত্রনির্মাতা ও পরিচালকের-চিত্রকরের তিন দশকের পথ পরিক্রমা, তাঁর হুমায়ূন আহমেদ হয়ে ওঠার একটি সংবেদী ধারা বিবরণী দিয়েছেন।
শাকুরের বর্ণনায় যে হুমায়ূনকে আমরা পাই, তিনি এক আশ্চর্য প্রতিভার নাম। একবার তাঁকে নিয়ে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছিল, যার বিষয়বস্তু ছিল, তিনি জনপ্রিয় লেখক বটে, কিন্তু মহৎ লেখক নন। ইত্যাদি। আমার কাছে এই বিতর্ক অর্থহীন মনে হয়েছে। আমি দেখেছি, অসংখ্য তরুণ-তরুণী তার বই পড়ে চোখে একটা নামহীন কষ্ট, অথবা ঘোর অথবা স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাতে গেছে, তাঁর চরিত্রদের সঙ্গে হেসেছে-কেঁদেছে, তাদের সঙ্গে রাতের বৃষ্টিতে ভিজেছে, ভরা জ্যোৎস্নায় পথে নেমে গেছে। তাঁদের বোধ অনুভূতিগুলিকে নিজের অধিকারে এনে হুমায়ূন তাদের তাঁর গল্পের সহযাত্রী করে নিয়েছেন। এই অর্জনটা সামান্য নয়, এবং এটিকে মহৎ সাহিত্যের সংজ্ঞায় ফেলে বিচার করার কোনো প্রয়োজন নেই। শাকুর সেই তরুণদেরই একজন। তিনি লিখেছেন তাঁর কষ্ট-স্বপ্ন-ঘোরের কথা, জ্যোৎস্না-বৃষ্টিতে ভেজার কথা। তবে পার্থক্য এই, তিনি বর্ণনাটা করে গেছেন নির্মেদ গদ্যে, কোনো অতিশয়োক্তির আশ্রয় না নিয়ে। তিনি মুগ্ধ হয়েছেন, কিন্তু মুগ্ধতার একটা ইতিহাসও লিখে গেছেন।
যে ছিল এক মুগ্ধকর-এর নির্মাণটি একটি মোজাইক-চিত্রের মতো। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের অনেক ঘটনা-অভিজ্ঞতা থেকে ২৩টি বেছে নিয়ে তিনি মোজাইক-চিত্রটি সাজিয়েছেন। কিন্তু তলে তলে সেগুলোর একটা যোগ আছে। এবং এই যোগটা সম্ভব হয়েছে প্রতিটি বর্ণনার কেন্দ্রে হুমায়ূন থাকার জন্য। এসব বর্ণনা তাঁর সঙ্গে শাকুরের কাটানো বিশেষ কোনো মুহূর্তের, দিনের, সময়ের, ঘটনার  আড্ডায়, ভ্রমণে, অনুষ্ঠানে অথবা বইয়ের মাধ্যমে তাঁর সন্নিকট হওয়ার। হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাকুর। তারও বিবরণ আছে।
নীরদচন্দ্র চৌধুরী জানাচ্ছেন, ভাল বাঙালি বলতে যাদের বোঝায়, তারা আসলে আত্মভোলা। এরকম এক আত্মভোলা মানুষের ছবি তুলেছেন শাকুর। ক্যামেরার ভাষায় বলতে গেলে, অনেকগুলি শটে, অনেকগুলি এ্যাঙ্গেলে, লেন্সের অদল-বদল করে, ফিল্টার লাগিয়ে অথবা না লাগিয়ে তোলা ছবির একটি এলবাম যেন সাজিয়েছেন শাকুর। এসব ছবিতে হুমায়ূন কখনো স্পষ্টভাবে, কখনো আলো-আঁধারিতে হাজির হয়েছেন। আলোকচিত্রী শাকুরকেও এই বইটিতে চেনা যাবে।

মন্তব্য
Loading...