১০ সদর স্ট্রিট ঃ রবীন্দ্রনাথের কলকাতা – ড. আনোয়ারুল করীম

গল্পের আঙ্গিকে ইতিহাসের অনুপম রসালো বিবরণ

শাকুর মজিদের লেখা “১০ সদর স্ট্রিট রবীন্দ্রনাথের কলকাতা” গ্রন্থ’টি সম্প্রতি আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সৌভাগ্য এ কারণে যে এটি একটি ভিন্ন স্বাদের গ্রন্থ। গতানুগতিক যে গ্রন্থসমূহ আমরা সচরাচর পাঠ করে থাকি তা থেকে এটি ভিন্ন। এটি যে বিষয়ে লেখা তার উপরে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। সব গ্রন্থ ইতিহাসকে প্রাধান্য দিয়েছে। বৃত্তানত্মগুলোও নিরস, ইতিহাসানুগ। কিন্তু এই গ্রন্থটি গল্পের আঙ্গিকে ইতিহাস এবং তদসংশ্লিষ্ট জীবনের অনুপম রসালো বিবরণ যা বারবার পড়লেও কখনো বিরক্তি লাগে না বরং পুনরায় পড়বার বাসনা সৃষ্টি হয়। এই গ্রন্থটি ভ্রমন বৃত্তানত্মমূলক। কিন্তু কী অসাধারন আন্তরিকতায় তিনি গল্পের মাধ্যমে যে সরস বর্ণনা দিয়েছেন তা তার গ্রন্থটি পাঠ করেও দীর্ঘদিন অন্তরে সজিব থাকে।

১৯৪৬ এবং ১৯৪৯ সালে, খুব ছেলেবেলায় দু’বার আম্মার চিকিৎসার জন্য আব্বার সাথে কলকাতা গিয়েছিলাম। মনে পড়ে “মুসাফির খানা” নামে একটি বাড়ীতে আমাদের থাকবার ব্যবস্তা হয়েছিল। সে সময় নিউমার্কেট, চৌরঙ্গ্‌, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, গড়ের মাঠ, আমজেদিয়া হোটেল, চিড়িয়াখানা, হাওড়া ব্রিজ এবং শিলাইদহ স্টেশন, নাখোদা মসজিদ প্রভৃতি স্থান দেখেছিলাম। এরপর দেশ বিভাগ হলো। ভারত পাকিস্তান আলাদা হলো, ভিসা-পাসপোর্ট প্রবর্তন হল। আর যাওয়া হয়নি। এরপর মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এ সময়ে পুনরায় ১৯৭১ এ কলকাতায় গেলে বৃটিশ আমলের কলকাতা মনে আনতে চেষ্টা করলাম। অতঃপর বহুবার কলকাতায় যাওয়া হয়েছে। কলকাতা মনে হয়েছে নিজের দেশ। কিন্তু বৃটিশ-ভারতের যে কলকাতা সে স্মৃতি কিছুতেই ফিরিয়ে আনতে পারিনি।

২০১৬ সালে প্রথমা থেকে প্রকাশিত শাকুর মজিদের গ্রন্থে আমি আমার সেই ছেলেবেলার কলকাতা নানা রূপে, নানা বর্ণে চমৎকারিত্বের সঙ্গে আমার সামনে উদ্ভাসিত হল। দেশ বিভাগের পর কলকাতার আধুনিকীকরণ হয়েছে। কিন্তু লেখকের বর্ণনায় অতীতের রূপসী কলকাতা অতুলনীয় রূপ মাধুর্যে আমার দৃষ্টিতে ফিরে এসেছে। সেই মানুষটানা রিকসা, রাজকীয় ঘোড়ার গাড়ী, শিয়ালদহের আশেপাশের ঘিঞ্জি এলাকা, সেই বিহারী মুসাফির খানা, বউ বাজার, সেই ট্রামে করে গোটা কলকাতা দেখার কৈশোরকালীন অভিজ্ঞতার পূনরূদ্ভব- সব যেন দৃষ্টি নন্দন হয়ে ক্রমান্বয়ে মুদ্ধতা ছড়াতে লাগলো। ভ্রমন বৃত্তান্ত যে এমন মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠতে পারে শাকুর মজিদের লেখা না পড়লে এমন অভিজ্ঞতা হতো না।

মনে পড়ে বৃটিশ পিরিয়ডে আব্বার সাথে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছি । কলকাতা মহামেডান ফুটবল টিম তখন বাঙ্গালী মুসলমানদের প্রেরণা যোগাতো। ইস্টবেঙ্গল পূর্ববাংলার প্রাণের ফুটবল টিম ছিল। মনে আছে- সিনেমা হলে ‘উদয়ের পথে’ সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। সেই ছেলেবেলার দেখা সিনেমা, দেশ স্বাধীন করবার প্রেক্ষাপটে নায়কের দেশপ্রেমের সঙ্গে নায়িকার প্রেম মিলে কী এক অভাবনীয় অনুভূতি আজও টেনে ফেরে তা বুঝানো যাবে না।

সদর স্ট্রিটের সেই বাড়ির গাড়িবারান্দা থেকে

শাকুর মজিদ একজন জাত শিল্পী। তার বর্ণনা হৃদয়গ্রাহি তো বটেই, কলকাতার শতবৎসরের পুরনো ইতিহাস যেনো আবার নতুন ভাবে এখানে বিকশিত হল। এক অসাধারন স্মৃতির বেদনায় চোখের সামনে সব দৃশ্য জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠে। তিলোত্তমা কলকাতা, আজও স্মৃতিপটে অমলিন।

ঠাকুর বাড়ীর ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে লেখক কলকাতার পত্তনের ইতিহাস, বৃটিশ রাজত্বে কলকাতার বিলীয়মান মুঘলীয় সভ্যতার, শেষ পাশ্চাত্য নগরসভ্যতার উত্থানের কথাও উল্লেখ করেছেন।  এই সভ্যতার মূলে যে  ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভূমিকা ছিল তার লেখায় তা প্রকাশ পেয়েছে। ইংরেজি ভাষা ও সংস্কতিজ্ঞান লাভে নব্য ভারতীয় বাঙ্গালী বাবুদের উত্থানের সরস বর্ণনা  দিয়েছেন। কলকাতা যে এক সময় ইংরেজদের একটি স্মৃতির শহরে পরিণত হয়েছিল শাকুর মজিদ তারও রসালো বর্ণনা দিয়েছেন। বিশেষ করে বাবুদের বিলাস, মদ ও মেয়ে মানুষ, ইত্যাদি। এই সাথে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের উত্থান ও ঠাকুরবাড়ীর পত্তনের বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।

জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ীর কথা বলতে গিয়ে লেখক রবীন্দ্রনাথের পূর্ব পু্রুষদের ইতিহাসও উল্লেখ করেছেন। এরা এক সময়ে পুরাতন যশোর এবং বর্তমান খুলনার পিঠাভোগ ও ফুলতলার আধিবাসী ছিলেন, সে কথাও আমরা জেনেছি। রবীন্দ্রনাথের বাবার মাতৃকুলও খুলনার ফুলতলার বাসিন্দা ছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী ভাবতারিনী দেবীও যে এই বংশের সে বিষয় অনেক মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন। সব মিলিয়ে গ্রন্থটি অসাধারণ।

১০ সদর স্ট্রিট ঃ রবীন্দ্রনাথের কলকাতা। লেখক- শাকুর মজিদ। প্রকাশক – প্রথমা প্রকাশন। মূল্য -৪৫০.০০টাকা।

ড. আনোয়ারুল করীম, শিক্ষাবিদ ও লালন-রবীন্দ্র গবেষক

(প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর –ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, বর্তমান প্রো-ভিসি, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি)

 

মন্তব্য
Loading...