পীর, আমি ও মন্দিরার জোৎস্নাবিলাস

পীর হাবিবের ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে লেখা

১৯৯২ সালের কথা। ঢাকার গ্রীণ রোডে এক সময় যে দোতলা বাড়িতে ইত্তেফাকের কূটনৈতিক রিপোর্টার মতিউর রহমান চৌধুরী [এবং সাংবাদিক আমীর খসরু] থাকতেন, সে বাড়িটি একটি পত্রিকার অফিস হয়ে যায়। ইত্তেফাক ছেড়ে মতি ভাই নিজে পত্রিকা দেবেন, নামও ঠিক করেছেন, ‘বাংলাবাজার পত্রিকা’।

মতিউর রহমান চৌধুরীর সাথে আমার যোগাযোগ ১৯৮৬-৮৭ সাল থেকে। লন্ডন থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরুতো [এখনও বেরোয়], নাম ‘সাপ্তাহিক সুরমা’। সে পত্রিকায় আমিও নিয়মিত খবর পাঠাতাম। ঢাকা প্রতিনিধি হিসেবে নাম যেতো আমার, ব্যুরো প্রধান মতিউর রহমান চৌধুরী।

আমি তখন নানা রকমের পত্রিকায় লিখে বেড়াই। মাসিক পাঁচশ’ টাকা ভাতায় মাঝে মাঝে খবর দেই ‘আজকের কাগজ’-এ। আজকের কাগজের বুয়েট রিপোর্টার। আজকের কাগজ-এর লোকজন দলবল নিয়ে চলে গেলো ‘ভোরের কাগজ’এ। আমি তাদের সাথে চলে গেলাম। ভোরের কাগজ অফিসে একদিন ফজলুল বারী ভাই বলেন-মতি ভাই আপনাকে খুঁজছে। যান, দেখা করেন।

আমি দেখা করি এবং কয়েকটি প্রক্রিয়ার পর এই পত্রিকায় ‘স্টাফ রাইটার’ হিসাবে আমার চাকুরী হয়।
নীচ তলায় দু’টো রুমে সব সাংবাদিকদের বসার জায়গা, দু’তালায় অন্যান্য শাখা। প্রথম বড় রুমটি রিপোর্টারদের জন্য, তার পরেরটি আমাদের। আমাদের রুমেই দু’টো টেবিলে বসতেন সম্পাদক মতি ভাই, বার্তা সম্পাদক হিফজুর ভাই। তার উল্টোদিকের কয়েকটা ছোট ছোট টেবিলে আমাদের বসা।

রিপোর্টারদের রুমে ক্লাসরুমের মতো সারি সারি ছোট ছোট টেবিলে কয়েকজন রিপোর্টার বসেন, তাদের প্রধান বদি ভাই [বদিউল আলম, চীফ রিপোর্টার] বসেন তাদের দিকে মুখ করে। রিপোর্টারদের সাথে আমাদের কামরার লোকজনের খুবই খারাপ সম্পর্ক। কোন রিপোর্টারের কোন নিউজটি কেনো গেলনা, কোন নিউজের ট্রিটমেন্ট ঠিক হয় নাই, এ সব অভিযোগ সারাক্ষণই শুনতে হতো।

এই রিপোর্টিং সেকশনের এক দু’জনের সাথে আমার বিশেষ মধুর সম্পর্ক চিলো, যাদের বাড়ি সিলেট অঞ্চলে।
এমনিতে মতি ভাইর অনেক বদনাম হয়ে গিয়েছিলো এই পত্রিকা নিয়ে। সিলেটপ্রীতি দেখানোর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উদার। সিলেটের নিউজ দেখলে সেকেন্ড পেইজের নিউজ ব্যাক পেইজে চলে আসতো, সিলেটী যে সকল সাংবাদিক বা স্টাফ কাজ করতেন, তারা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু উচুঁ স্বরেই কথা বলতো এবং এই লাই টুকু দিতেন পত্রিকার মালিক-সম্পাদক নিজেই। এই অতি আদরে সিক্ত যে সকল সাংবাদিক নিজের পত্রিকা মনে করে দাপট নিয়ে হাউজে থাকতেন, তার মধ্যে আমি তো আছিই, আরো ছিলেন ফজলুল বারী এবং পীর হাবিবুর রহমান।

পীর হাবিব ভাই সুনামগঞ্জের লোক, উচ্চারণে স্পষ্ট। মাথায় চুল তখন বেশ ঝাকড়াই ছিলো, এখন কমে এসেছে। টগবগে তরুণ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে নতুন এসেছেন ঢাকায়। তাঁর জ্যাক ভালো। সুনামগঞ্জের সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেন বা কোম্পানীগঞ্জের হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সাথে তাঁর প্রাত্যহিক ওঠাবসা। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন দলের হয়ে মিছিল করেছেন জানি না, তবে আওয়ামীপন্থিদের সাথে যোগাযোগটা বেশী। বাংলাবাজার পত্রিকায় তাঁর কাজ হয় আওয়ামী লীগ বিট করা।
১৯৯২ সাল বিএনপির জামানা, সেখানে বিএনপি বিট করে জায়েদ চৌধুরী যে পরিমাণ আমল পেতেন সামাদ আজাদকেন্দ্রীক আওয়ামী লীগের বিটে পীর হাবিবের খুব সুবিধা ছিলো না।
পীর হাবিবের রিপোর্ট আসতো আমাদের কামরায়। যেহেতু জটিল রাজনীতি এবং বিরোধীদল [আওয়ামী লীগের] নিউজ তার হাত দিয়েই আসতো, নিউজ এডিটর হিফজুর ভাই তার নিউজ আনকাট ছেড়ে দিলেও মাতিভাই প্রায়ই আটকাতেন। ডেকে এনে বলতেন, ‘নিউজ কোথায়? এতো দেখি গল্প লিখেছেণ আপনি। যান ঠিক করে নিয়ে আসেন।’

১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসে আমি ৩ মাসের বিনাবেতনের ছুটি নেই বাংলাবাজার পত্রিকা থেকে। ৩ মাস পর আমি বুয়েট থেকে আর্কিটেকচারে গ্র্যাজুয়েশন করে বেরিয়ে যাই, পত্রিকা অফিসে আমার যোগ দেয়া হয় না। এবং বাংলাবাজার পত্রিকাকেন্দ্রীক আমার বন্ধুও সহকর্মীদের সাথে আমি যোগাযোগ হারিয়ে ফেরি।

কিন্তু তাদের সবারই খোঁজ খবর আমার কাছে চলে আসে। বাংলাবাজার পত্রিকা এক সময় মালিকানা বদল করে। সাংবাদিকেরা বিছিন্ন হয়ে যান। মতিউর রহমান চৌধুরী ‘মানবজমিন’ বের করেন। সাংবাদিকরা বড় বড় কাগজে বড় বড় পজিশনে যোগ দেন।
সুনামগঞ্জি পীরও পত্রিকা বদল করেন। তিনি যুগান্তরে যান। যুগান্তর শেষে আসেন ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ। আমি চাইলেও তাঁকে এড়াতে পারি না। বড় বড় নিউজ ছাপে প্রথম পাতায়। কোনোটি সংবাদের, কোনোটি বা পর্যালোচনার।

প্রায়ই রাষ্ট্রীয় জরুরী সংকটের বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য দেখি টেলিভিশন-এ ও তাঁকে ডাকা হয় এবং আমি খুব মজা করে দেখি যখন খোদ মতিউর রহমান চৌধুরীও তাঁর কাছ থেকে কোনো রাজনৈতিক ঘটনার ব্যাখা ও পরামর্শ চান টেলিভিশনের টক শো তে।
একদিন শেখ ওয়াহিদুর রহমান [বিয়ানিবাজার-গোপালগঞ্জ এলাকার আওয়ামী লীগের টিকেট প্রার্থী. গীতিকার] একবার আমাকে বলেন. আমি পীর হাবিবুর রহমান নামে কোনো সাংবাদিককে চিনি কি না। কারণ তার একটা রিপোর্ট ‘জাল বায় ওয়াহিদে, মাছ খায় নাহিদে’ শিরোনামে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এর প্রথম পাতায় লেখা একটা বিশ্লেষণ ধর্মী রিপোর্ট পড়ে পীর হাবিবকে নিয়ে তিনি একটা গান রচনা করেছেন, সুর দেয়া হয়েছে, তার বাউলরা সেই গান গাইছেনও, তিনি গানটি তাঁকে শোনাতে চান।
পড়লাম বিপদে। ফোন নাম্বার যোগাড় করে প্রায় কুড়ি বছর পর তাঁকে ফোন করি এবং বিষয়টি বলি। আমি ফোন কারার পর বুঝতে পারি, উপলক্ষ্য আসল বস্তুকে বহুগুণে অতিক্রম করে গেছে।
২০ বছর আগে গ্রীণ রোডে যে লোকটাকে আমি রেখে এসেছিলাম তার সাথে আসলে আমার তেমন কোনো দূরত্বই তৈরী হয়নি। আমার যাবতীয় খবরাদি  তাঁর জানা।

একদিন আমাদের দেখা হয়। তাঁর ক’টা বইও আমি পেয়ে যাই। বাকীগুলো তার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন,  একটি বই ভিন্ন, এটা একটা উপন্যাস -বললেন তিনি, নাম ‘মন্দিরা’। ২০০৯ এর বই মেলায় বেরিয়েছিল, প্রকাশক-ভাষাচিত্র।
আমি ‘মন্দিরা’র পাতা উল্টাই আর ভিন্ন এক পীর হাবিবুর রহমানকে আবিস্কার করি।
মন্দিরা কি উপন্যাস?
যাক, এ কথা এখন বলছি না। লেখক শুরুতে তার ভূমিকায় এটাকে ‘আত্মজৈবনিক উপন্যাস’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটানে বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছে-এটা উপন্যাস নয়, তবে একটা কিছু হয়েছে। অত্যন্ত সুখপাঠ্য বইটি লিখতে গিয়ে পীর হাবিবুর রহমান একটি বারের জন্যও ভূলতে পারলেন না যে, তিনি একজন সাংবাদিক।
সাংবাদিকের চরিত্র নিয়ে অসংখ্য উপন্যাস হয়েছে, কিন্তু এটা লিখতে গিয়ে, লেখক, জানিনা তার অগোচরেই হয়তো বেরিয়ে এসেছে তার কবিসত্বা। আমার কেনো যেনো মনে হলো, পীর হাবিব সাংবাদিক না হলে কবিই হতেন।
আর ‘মন্দিরা’র পরতে পরতে রাজনৈতিক উপাখ্যানমালা। সে বাংলাদেশেরই হোক কিংবা ভারত-পাকিস্থান-মধ্যপ্রাচ্য-ইংল্যান্ড-আমেরিকা বা চিলি।
কিন্তু বই পড়া শেষ হলে, আমার মনে হয়, পীর হাবিব আসলে ঢাকায় থাকুন বা জর্ডানের ফাইভস্টারে কিংবা পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেনো, সারাক্ষণ তার ভেতরে আরেকজন মানুষ থাকে- তিনি হাছন রাজা।
তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে দামী হোটেলের বিছানায় শুয়েও দূরের জানালা দিয়ে দেখেন-‘দেখার হাওড়’।
সবচেয়ে সুনিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার বাতাসও তার সুনামগঞ্জের হাওড় থেকে ভেসে আসা লিলুয়া হাওয়ার কাছে কিছু না।
পীর হাবিবের এই ‘মন্দিরা’ কে অন্যভাবে লিখলে [ধরুন ‘মন্দিরা’র চরিত্রটা বাদ]-তাহলে এ বইটিকে তাঁর আত্মজৈবনিক উপাখ্যান হিসেবে আখ্যা দেয়া হতো। তাতে সংকটা হতো, প্রাণ খুলে সব কথা বলতেও পারতেন না। তার উর্মিলা বা মন্দিরা এ দু’টো চরিত্রকে দাঁড় করিয়েছেন মূলত: তাকে কাউন্টার দেয়ার জন্য। তারা তাকে সেই সব প্রশ্নই করবে-তিনি যে কথাগুলো আসলে এখানে শোনাতে চান। আর এটুকু শোনানোর যে কায়দা তিনি দেখিয়েছেন, মাশাল্লাহ চমৎকার। আমি মুগ্ধ। আমার ভালো লেগেছে।
সবচেয়ে ভালো লেগেছে তার হাওড়ের বর্ণনা। নৌকা, পানি, বাতাস আর জোৎস্না। আমার মনে হয়েছে পীর হাবিব একজন দুর্দান্ত রোমান্টিক মানুষ।
তিনি নারী বা প্রকৃতি দু’টোকেই আলাদা আলাদা ভাবে নিজের মধ্যে গ্রহণ করেছেন। দু’টো যখন এক হয়ে গেছে তখন জোৎস্না বা বৃষ্টি বা হাওড় এসে গেছে তার প্রথম প্রাধান্য।
‘মন্দিরা’ পড়তে পড়তে আমিও মন্দিরার প্রেমে পড়ে যাই। হিসেব করে দেখেছি, পীর হাবিব আর আমি প্রায় একই বয়েসী। আমরা প্রতিবেশী সনে জন্মগ্রহণ করি। রাশির দিক থেকেও আমরা নিকট প্রতিবেশী। তিনি ধনু আমি ধনু ও বৃশ্চিকের মিশেল। তাঁর জন্ম ১২ নভেম্বর ১৯৬৪, আমারটি ২২, ১৯৬৫ নভেম্বর । এ কারনে মাঝে মাঝে মন্দিরাকে সরিয়ে তার জায়গায় আমার নিজেকে বসিয়ে দিতে খুব অসুবিধা বোধ করি না।
গতকাল রাত সাড়ে তিনটায় বইটা পড়া শেষ করে আমি পীর হাবিবকে একটা টেক্সট ম্যাসেজ পাঠাই। ম্যাসেজটা ছিলো এ রকম ‘আগামী বর্সায় কোনো এক ভরা পূর্নিমার রাতে আমি, আপনি আর মন্দিরা একসাথে দেখার হাওড়ে খোলা নৌকায় সারারাত কাটিয়ে দেবো। গলুইয়ের এক মাথায় চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে আপনি জীবনানন্দের কবিতা পড়ে শোনাবেন, মাঝখানে খাটির উপর শাড়ির চাদর বিছিয়ে বসে থাকবে মন্দিরা। সে আমার দিকে মুখ করে গাইবে রবীন্দ্রনাথে গান। আমি অপর গুলুইয়ের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে একবার চাঁদ দেখবো, একবার মন্দিরাকে। যাবেন?
পীর হাবিব এই ম্যাসেজের কোনো জবাব দেন না।
পরদিন আবার আরেকটা পাঠাই, ‘আমাদের নৌকা চলতে চলতে এক সময় হাওড়ের মাঝখানে চলে যায়। আমরা গিয়ে দেখি সাজানো বজরা থেকে গান বাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমাদের দেখে হাছন রাজা বেরিয়ে এলেন। বলেন, আসো, দেখে যাও আমার দিলারাম কেমন নাচছে।’
আপনি বললেন, ‘বস, এনজয় ইয়োরসেল্ফ, উই হ্যাভ মন্দিরা উইথ আস।’
কী বলেন নাই?
পীর হাবিব এটারও কোনো জবাব দেন না।

পুনশ্চ:
পীর হাবিবের জন্মদিন ১২ নভেম্বর। তাকে অনেক অনেক শুভেচ্চা। আগামী বর্ষায় পীর হাবিব ‘দেখার হাওড়’এ ভরা জোৎস্নার নৌকা সফরের আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যারা আগ্রহী তারা এই সংকলনের সম্পাদকের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।

এ লেখাটি ২০১২ সালে লেখা

২০১৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সিলেট উতসবে ‘আমরা হক্কল সিলটী’
মন্তব্য
Loading...