সানু ব্যানার্জীর ‘পথে বিপথে’

বই আলোচনা

২০০৯ সালে কলকাতা থেকে বেরিয়েছিল সানু ব্যানার্জির আত্মকথন – পথে বিপথে। ২০১০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি একটা  আলোচনানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও  নৃত্যকলা মিলনায়তনে। দেবাশীষ ঘোষ ছিলেন আয়োজনে। সেখানে বড় বড় আলোচক ছিলেন যেমন সৈয়দ শামসুল হক, কামাল লোহানী, গোলাম কুদ্দুস, কেরামন মাওলা, আসাদুজ্জামান নূর, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মামুনুর রশীদ প্রমুখ। আমার নামও ছিলো আলোচনায়। আমি ছিলাম জুনিয়ার মোস্ট,  প্রথম বক্তা।
এতো এতো ঝানু আলোচকের সামনে সামনে উপস্থিত থাকা লেখকের বইয়ের আলোচনা করতে হবে এটা জেনে আমি পুরো আলোচনাটা লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম । মজার কথা, দুইজন তাঁদের বক্তৃতায় আমার আলোচনার কথা উল্লেখ করেন। সৈয়দ হক বলেছিলেন- তিনি প্রথম কাউকে এমন লিখিত আলোচনা পড়তে শুনলেন । কামাল লোহানী বললেন, এটা দ্রুত কোথাও ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে। অনুষ্ঠান শেষে তিনি বলেন, তাঁকে স্ক্রিপ্টটা দিয়ে দিতে, তিনি গোলাম সারোয়ারকে পাঠাবেন।
এর কয়েকমাস পরে (৫ জুন ২০১০) সমকালের উপসম্পাদকীয় পাতায় এই আলোচনাটা প্রকাশ হয়।
এটি আমার একমাত্র বই আলোচনা।
সাদর সম্ভাষণ আর সূচনার আলোচনা

গেল শতকের তিরিশের দশকে এই বাংলাদেশেরই বিক্রমপুরের দোহার গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু প্রভাত চন্দ্র ব্যানার্জি লেখাপড়া করার জন্য কোলকাতায় গিয়েছিলেন । পড়ালেখা শেষ  করে তিনি চার্টার্ড একাউন্টেন্টও হয়ে যান। পেশায় সফল। আয় রোজগার নেহাত ছিল না। বালিগঞ্জে একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলতেও তার তেমন একটা কষ্ট হয়নি। কয়েক বছর পর বাংলাদেশ ভারত ভাগাভাগি হয়ে যায়। এপার বাংলার বেশ কিছু হিন্দু পশ্চিম বাংলায় চলে যায়। এই কাফেলায় প্রভাত বাবুর অনেক আত্মীয়-স্বজন ও ছিলেন । তারা প্রভাত  বাবুর আশ্রয়ে পশ্চিম বাংলায় নতুন করে জীবন যাপন শুরু করেন । প্রভাত বাবুর আর দেশে ফেরত আসা হয় না । কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, তিনি তাঁর পুত্রধন  শ্রী জীবনকৃষ্ণ ব্যানার্জীকে পথে আনতে পারলেন না । কলি ফোটা সুন্দর কৈশরে কী যেনো এক ভ্রষ্ট কামনার মোহ তাকে পথ থেকে বিপথে ঠেলে দিয়েছিল বারবার । আজ এখন জীবনের এই সায়াহ্ন বেলায় জীবনকৃষ্ণ ব্যানার্জী ওরফে সানু ব্যানার্জী ফিরে তাকিয়েছেন তার ফেলে আসা পথের দিকে । এ যেনো মহা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সৈকতে আসা কোনো এক নাবিক, যে কিনা সারা ক্ষন ঢেউ এর সাথে কথা বলে, নিজের সাথে কথা বলে। এই সব কথার গাঁথুনীই আজকের আলোচিত বই সানু ব্যানার্জীর পথে বিপথে

সানু  ব্যানার্জীর পথে বিপথে বইটি হাতে নিয়ে একটু হোচটই খেয়েছিলাম। যে কোন নতুন লেখকের বই পড়ার আগে আমি লেখক পরিচিতির অংশটি ভালো করে পড়ে নেই। লেখকের ছবি দেখি। কিন্তু এই বইটিতে লেখকের ছবি নাই। তাতে আমার অসুবিধা ছিল না, লেখকের চেহারা আমার চেনা, তিনি আমার পরিচিত। কিন্তু লেখকের পরিচিতির বিষয়টি না থাকার কারনে তাকে চিনে নেবার জন্য আমাকে অনেকটুকু সময় পার করে নিতে হয়। এই বইটি পড়া শেষ হবার পর আমার পূর্ব পরিচিত সংগঠক সানু ব্যানার্জী আমার কাছ থেকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে থাকেন। আমি নতুন করে অন্য এক সানু ব্যানার্জীকে আবিস্কার করি।

বিদগ্ধ আলোচকবৃন্দ

এই বিপথের কিশোর ছেলেটির সংসারে অনেক মানুষের বসবাস ছিলো। ৮ ভাই বোন ছাড়া ও আতœীয় স্বজনে বোঝাই থাকতো তার ঘর। বাবা মা ৩০-৪০ জনের এই সংসার চালাতে গিয়ে নিজের সন্তানের প্রতি ঠিক মতো খেয়াল রাখতে পারেননি। তার সুযোগ নিয়ে মাত্র ক্লাস সিক্স পযন্ত রেগুলার পাশ করা সানু ব্যানার্জী রকে আড্ডা দেয়া, সিগারেট ফোকা, ঠক বাজি, এমন কি আক্ষরিক অর্থে সিঁধেল চোরদের সাথে সখ্য গড়ে তোলেন এবং এক সময় তাদের দ্বারা চালিতও হয়ে যান। সিঁধেল চোর বন্ধুর মা বাসা বাড়িতে ঝিয়ের চাকরি করে, বন্ধুটি সকাল বেলা বাজারে কাটা মাছ বিক্রি করে, রাতে চুরি করে। এমন জানের টুকরা বন্ধুকে নিয়ে শুরু হয় কিশোর সানুর প্রতিদিনকার এডভেঞ্চার। পড়াশোনা সিকেয় ওঠে। আমোদ ফুর্তিতে মন। চলি­শের দশকের শেষ দিকে, আমোদ ফুর্তির প্রধানতম উপকরণ বাড়ি পালিয়ে সিনেমা দেখা। বন্ধু বান্ধব সহ সিনেমা দেখার জন্য যে কটি পয়সার দরকার তার যোগান দেয়ার জন্য পথ থেকে বিপথে যাওয়ার সমস্ত আয়োজন।

সানু ব্যানার্জী লিখেন, তখন কি জানতাম, পরবর্তীকালে ঐ পূর্বাশা হলেই স্কুল পালিয়ে পাঁচ আনার লাইনে দাড়িয়ে একটার পর একটা হিন্দি সিনেমা দেখতে দেখতে সেটাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। আর এই সিনেমায় বয়ে আনবে আমার চুড়ান্ত অধ:পতন। শুরু হবে অন্য পথে চলা। সানু ব্যানার্জীকে এখন যারা দেখেন, তারা তাকে সিনেমার লোক বলেই    জানবেন। তার এই পরিচয়টাকে আমি বিস্তৃত করে প্রকাশ করতে চায় না। এক সময় যে কিশোরের চোখ ছিল রাজকাপুর আর নার্গিসময় বোম্বে শহর যার কাছে ছিলো আক্ষরিক অর্থের স্বপ্নের রাজভুমি। আজ ভারতের সর্বোচ্চ পদকজয়ী চলচিত্রকারও যখন তার বুকে সযতনে আশ্রিত হন, তখনও কিন্তু আর মনে হয় না যে সেই সিনেমাপ্রীতি তাঁকে কোন অধ:পতনে নিমিত্ত করেছিল। বোম্বে এবং সিনেমা এ দুটো শব্দ সানু ব্যানার্জির শরীরের প্রতিটি রক্তে একত্রে প্রোথিত। কিন্তু রাজকাপুর নার্গিসের শহর বোম্বেকে কিভাবে তিনি প্রথম আবিস্কার করেছিলেন তার বর্নণাটি তার লেখাতে চমৎকার ভাবে এসেছে। তিনি লিখেছেন, মোদক আমর ধরল তাকে সিনেমায় নামিয়ে দিতে হবে। আমি সব শুনে Ñ এটা কোন ব্যাপারই নয় এমন ভান করে বললাম, ঠিক আছে কোন অসুবিধা নেই। তুই টাকা জোগাড় করে এনে দে আমি বোম্বে যাব। মোদক ওর দাদার রেশন দোকান থেকে ৩Ñ৪শ টাকা চুরি করে আমার হাতে তুলে দিয়ে  বলল , সানু সিনেমায় চান্স পাব তো। আমি বললাম নিশ্চয় পাবি। আমি বোম্বে পৌছেই তোকে খবর দেব। তুই বোম্বে চলে আসবি। সেবারই সানু ব্যানার্জির প্রথম বোম্বে যাওয়া। ট্রেনের থার্ড ক্লাস কামরায় দুই সিটের মাঝখানে খালি জায়গায় পত্রিকা বিছিয়ে তার উপর বসে শুয়ে টিটিকে ফাঁকি দিয়ে বিনা টিকিটে বোম্বে নামা। সে অনেক কাহিনী। তবে সানু ব্যানার্জির সেই বোম্বে সফরে তিনি ফিল্ম পাড়ার  গেটটি দেখে ফেরত আসতে পেরেছিলেন নিজের শহর কলকাতায়। মোদকের বিষয়টি ম্যানেজ করার জন্য তাকে পরেআরো অনেক কুটকৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিলো। ছোট মিথ্যা ঢাকার জন্য যেমন বড় মিথ্যার দরকার হয় তেমনি। সে কথা যাক।

দর্শকের সারিতে বিদগ্ধ শ্রোতারা

সানু ব্যানার্জী তাঁর বোম্বের স্মৃতিতে লিখেন – ১৯৯২ সালে গৌতমের পতঙ্গ ছবির জন্য ওমপুরীর সাথে যখন কথা হয়, তখন ওমপুরী  জানিয়েছিলেন গেটে এসে সানু ব্যানার্জী তার নামটুকু শুধু বলবেন নিরাপত্তা কর্মীকে, তারপর তার আর কিছুই করতে হবে না। হয়েছিলোও তাই।

পথে  বিপথে বইটির আগাগোড়াই একজন সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক চিন্তার মানুষের স্মৃতিচারনের পান্ডুলিপি। যে মানুষটি তার জীবনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সে যা বিশ্বাস করতো তার কর্মক্ষেত্রে তা প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। তার বিশ্বাসটুকুর বাস্তব প্রতিফলনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফলতার চেয়ে তার ব্যর্থ্যতাটুকুই হয়তো বেশী। যে কারনে বারবার ব্যবসার চেষ্টা করে নিজেদের লোকের কাছে মার খেয়ে পুঁজি হারিয়ে ফেরত গেছেন ঘরে।

আবার মেসোমশায়ের পুঁজি কাজে লাগিয়ে নিজে ব্যবসা করতে গিয়ে খানিকটা লোভীও হয়ে পড়েছিলেন এক সময় সানু ব্যানার্জী। নিজে্র চরিত্রের এমন বৈশিষ্টকে সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করতে তিনি এখানে দ্বিধা করেননি। অকপটে বলেছেন ‘ভাবী ব্যক্তি জীবনে যারা সাফল্য লাভ করেছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই বোধহয় আমার মতন এমন অকৃতজ্ঞ।‘ তিনি বলেছেন ‘ বর্তমানের এই পচে যাওয়া ক্ষয়িষ্ণু সমাজে অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপর্যস্ত একজন মানুষের পক্ষে এককভাবে কতটুকু সৎ এবং পরিচ্ছন্ন থাকা সম্ভব সেটা আমার কাছে একটা বিরাট প্রশ্ন ? অন্য ওেকউ সেটা পারে কিনা জানিনা, আমি পারিনি।‘

অকপটে নিজের ব্যর্থতা আর অপরাধের কথা স্বীকার করার মতো সৎ সাহস সানু ব্যানার্জীর আছে। আর সে কারনে অতি সাধারন এক পথের ছেলের জীবন কাহিনী আজ অসাধারন হয়ে উঠেছে।

সত্য প্রকাশ করার মতো দুর্দমনীয় অধিকারী এই সানু ব্যানার্জী। স্পষ্টই লিখেছেন – ‘মেধা, প্রতিভা ঐতিহ্য এই ধরনের শব্দগুলোর সাথে আমার কোন পরিচয় ছিলো না। আমাদের রকের আড্ডার অভিধানে এধরনের শব্দগুলো ছিলো না’। এরপর লিখেছেন- ‘মেধা কোন আকাশ থেকে পড়া বিশেষ জিনিস নয় যে একজনের জন্মের সময় তার ঘাড়ে গিয়ে পড়লো। আর সে মেধা সম্পন্ন হয়ে গেলো। মেধা মূলত নির্ভর করে সে কি সামাজিক পরিবেশ ও পারিপর্শিকতায় বড় হয়েছে বা হচ্ছে।’

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেরকম পড়াশোনা না করা এরকম একজন মানুষের এই বইটি পড়তে গিয়ে আমি কোথাও হোঁচট খাইনি । কী শব্দ চয়ন, কী বাক্য বিন্যাস,  অত্যন্ত সহজ সরল ভাষা, যে ভাষায় সানু ব্যানার্জী কথা বলেন সে ভাষাতেই লিখেছেন অনেক জ্ঞানী গুণী মানুষের জীবনাচরন এবং তাদের উদ্বৃতি এমন ভাবে এসেছে যে পড়তে গিয়ে হয়েছে অনেক পড়াশোনা মানুষের লেখা একটা বই পড়ছি। বইটি পড়তে পড়তে আমি অনেকবার বিস্মিত হয়েছি। তার স্মৃতিচারনের ধরন দেখে। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের কাহিনী যখন তিনি বিধৃতি করেছেন তখন একজন পাঠক হিসাবেও সে কাহিনী আমার কাছে স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট হয়ে এসেছে। নাম, ঠিকানা, লোকালয়, সিনেমার নামই শুধু নয়, তার সংলাপ, গানগুলোকেও তিনি পরম মমতায় হুবহু  এনে ধরেছেন আমাদের সামনে।

সানু ব্যানার্জীর পূর্ব পুরুষেরা এ বাংলার মানুষ তার গ্রামের বাড়ির কোন চিহ্ন বিক্রমপুরের দোহার গ্রামে খুজে না পাওয়া গেলেও তার ঠিকানাটুকুও হারিয়ে যায়নি। আর হয়তোবা সেকারনেই এ বাংলা আর ঐ বাংলার সার্বক্ষনিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য তার প্রানটি ওষ্ঠাগত। সমলয় নামে যে সংগঠনটি তিনি পরিচালনা করেন তার একমাত্র পুঁজি সানু ব্যানার্জীর অফুরান প্রান শক্তি। এই প্রানশক্তি অর্জিত হয়েছে পথে পথে জীবন কাটিয়ে।

পাড়ায় পুজার আসরে নাটক করা দিয়ে শুরু হয়েছিলো সানু ব্যানার্জীর কোন এক শিল্পমাধ্যমে প্রবেশ করা । নাটকের মানুষ তিনি হননি, নাটকের মানুষকে ভালবেসে তাদের স্বজন হয়েছেন। দুই বাংলার এমন কোন নাট্যপ্রেমী পাওয়া খুব কষ্টের হবে যে কীনা সানু ব্যানার্জীর স্নেহ, ভালবাসা কিংবা সংশ্লিষ্টতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

সিনেমার প্রতি তার আজীবনের ঝোঁক তাকে সিনেমাপ্রেমী বানিয়ে রেখেছে আজ অবধি। গৌতম ঘোষের পদ্মা নদীর মাঝি’র সুবাদে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে  তাঁর  নবজাগরনের শুরু হয়েছিলো নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে। সেই থেকে আজ অবধি গৌতম ঘোষ আর সানু ব্যানার্জী এক অবিচ্ছেদ্য যুগল। গুণী নির্মতা গৌতম ঘোষও আজ সানু ব্যানার্জীর প্রতি বড় বেশী নির্ভরশীল। এরকম নির্ভরশীলতা সানু ব্যানার্জী অর্জন করেছেন তার পথের অভিজ্ঞতা থেকে। পথ থেকে পথে, মানুষ থেকে মানুষে।  মানুষের সংসার থেকে নিয়েছেন জীবনের দীক্ষা। ঠিক ছোটবেলায় যা যা করতে চেয়েছিলেন তার কোনটিই তাকে নিরাশ করেনি। মানুষের ভালবাসা অর্জনের চেয়ে জগতে বড় সম্পদ আর কি আছে। সানু ব্যানার্জী সেই সম্পদের অধিকারী।

মার্ক্সীয় শিক্ষা, লেনিনের আদর্শ, মাও সে তুং এর তত্তকথা সারাজীবন নিজের মধ্যে ধারন করেছেন, তার যথাযথ প্রয়োগ কোথাও করেছেন আবার কোথাও করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। জীবনে যা কিছু তার উপলব্ধি তা থেকে কোথাও তাকে বিচ্যুত হতে দেখা যায়নি । আর সে কারনে হয়তো মতের মিল না থাকা উপরাস্ট্রপতির কাছ থেকে গ্রহন করা সার্টিফিকেটের ঠাই হয়েছে তার ভাগাড়ে।

বইটির শেষ অংশে অত্যন্ত হতাশার সাথে লিখেছেন  ‘যারা আমার এক সময় রাজনীতির বর্ণমালা শিখিয়েছিলেন বলেছিলেন সমাজকে পরিবর্তন করতে হবে। এবং যারা আমায় দিয়েছিলেন সুস্থ সংস্কৃতির পাঠ, নিয়ে গিয়েছিলেন সংস্কতির আঙ্গিনায়। আজ তাদের কাছেও আমি জানতে পারতাম…………………।’

কী জানতে পারতেন সেই প্রশ্নটি তিনি আর করেননি। রেখে দিয়েছেন আগামী প্রজন্মের জন্য তার ভাবনা। যারা নতুন যুগের সূচনা করবে যাদের হাত ধরে একদিন আশার আলোয় রাঙানো নতুন প্রভাতের উদয় হবে।

পথে বিপথে পড়া শেষে আমার মনে হয়েছে বইটি আসলে যৌবন উত্তীর্ণ এক এডভেঞ্চার প্রিয় কিশোরের রূপকথার গল্প। যে কিশোরটি তার সারা জীবনেও পথের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি। রকে বসে বসেই কিশোরটি তার জীবনটি কাটিয়ে দিয়েছে। তার সামনে দিয়ে বয়ে গেছে মানুষ ও সময়ের স্রোতধারা। রকটি নীরবে সব দেখে গেছে। জীবনের সায়াহ্ন বেলায় ছাপার হরফে সে তার প্রকাশ ঘটিয়েছে।

তাঁর সামনে দিয়ে বয়ে গেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ঢেউগুলো। তার কিছুটা তার উপর প্রচন্ড আক্রোশে আছড়ে পড়েছে, কিছুটা তাঁর সাথে মিশে গেছে।  এক সময়ের আইসক্রিমওয়ালা বন্ধু ঝন্টু তাঁর সামনে দিয়েই বিত্তের পাহাড় বানিয়ে সমাজে তার অবস্থান নিয়েছে। আবার সানু ব্যানার্জী, তাঁর নিজে ভাষায় সেই পথেই রয়ে গেছেন।

সানু ব্যানার্জীর জীবনের সবটুকুই পাওয়া পথ থেকে।  হাইস্কুলের গন্ডি না পেরোতে পারা এক কিশোর ফিল্মি দুনিয়ার মানুষজন দেখার জন্য বোম্বে গিয়ে ফুটপাতে শুয়ে শুয়ে, ঠেলাগাড়িতে আইসক্রিম বিক্রেতার সহকারীর কাজ করে পয়সা কামাতো সিনেমা দেখার জন্য । সেই কিশোর, তাঁর ভাষায়, তাঁর পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছে রাস্তায় পথে পথে।

পথে বিপথে পড়তে পড়তে আমার কখনো কখনো মনে হয়েছে এটা নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত এক দিকভ্রান্ত কিশোরের আত্মকথা। আবারও কখনো মনে হয়েছে, পরিপূর্ণ শিক্ষিত এক প্রবীণের জীবন সম্পর্কে পাওয়া কঠিন সব উপলব্ধির বিন্যাস।

আমার মনে একটা প্রশ্নও জেগেছিলো বইটি পড়তে পড়তে যে, সানু ব্যানার্জীকে যদি ৫০-৬০ বছর পিছিয়ে দেয়া যায় তিনি কি করতেন। একবার মনে হয় তিনি বলতেন –  না আমি বালিগঞ্জের রক থেকে আমি আমার একই জীবন শুরু করবো। আমার জীবনে কোন ভুল নাই। আবার মনে হয় তিনি হয়তো এমনও বলতে পারেন –

Give me some sunshine

Give me some rain

Give me another chance

I wanna grow once again

নিজের বই নিয়ে সবার শেষে কথা বলছেন লেখক সানু ব্যানার্জি

জীবনতো আমদের এক পায়ে হাঁটা পথ । এ পথে শুধু একবারই হেঁটে চলা যায়। আমার কেউ জানিনা ঠিক কতটুকু পথ হাঁটা হয়ে হেলে আমাদের রাস্তা ফুরোয়। আমরা গন্তব্যে পৌঁছি। সানু ব্যানার্জীও হাটছেন। তার আরো কিছু পথ হেঁটে বেড়াবার আছে। সেই হাঁটা পথ শেষে শুধুমাত্র বলা যাবে সানু ব্যানার্জী যেখান দিয়ে বিচরণ করেছিলেন তা কি পথ ছিলো নাকি বিপথ। অনেক সময় মানুষ ভুল পথে হেটেও দেখে সে অন্যের আগেই গন্তব্যে পৌঁছে গেছে । আমার সম্পুর্ণ বিশ্বাস সানু ব্যানার্জী ঠিক হেটেছেন।

অনুষ্ঠান শেষের গ্রুপ ফটো
ছবিগুলো দেবাশিষ ঘোষের সংগ্রহ থেকে পাওয়া
মন্তব্য
Loading...