একদিনের কথা

অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ

মমতাজ স্যারের সাথে আমার সারাজীবনে দেখা হয়েছে দুই বা তিন বার, কথা হয়েছে একবার । এ নিয়ে কীআর লেখা যায় ! তবে কথা কম হলেও দেখা কী আমাদের কম হয়েছে ? এটা নিয়ে কিছু লিখতে পারি।
প্রথম দেখা ১৯৮৩ সালে। তখন আমি ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজে পড়ি, ক্লাস এলেভেন-এ। কোন এক ‘প্যারেন্টস-ডে’তে শুনি মমতাজউদদীন আহমদ আজ এসেছেন। আমি এর আগেও এমন শুনেছি কয়েক জনের কাছে, তিনি মাঝে মাঝে প্যারেন্টস-ডে’ তে আসেন। আমাদের এক ব্যাচ জুনিওর, ফজলুল হক হাউজের মুশতাকের বাবা তিনি। কলেজ অডিটরিয়ামে আমাদের সাদাকালো চব্বিশ ইঞ্চি টেলিভিশনে আমরা এ সপ্তাহের নাটক দেখেছি। আমাকে প্রথমে আমাদের ফজলে চিনিয়ে দিয়েছিল এই নামটা। বলে- আরে ঐ পাগলের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করে যে!
প্রথমে জানি, তিনি পাগলের চরিত্রের অভিনেতা, পরে দেখি গরিব পরিবারের হতদরিদ্র বাবা, স্কুল শিক্ষক, এমন চরিত্রে তিনি খুব ভালো করেন। পরে জানি তিনি আসলে নিজেও নাটক লিখন, নাট্যকার। শুধু তাই না, আবার জানলাম, তিনি এক কলেজের অধ্যাপকও, ঢাকার নাম করা জগন্নাথ কলেজে মাস্টারি করেন। তো নাটক দেখার সময় মমতাজউদদীনের চেহারা পর্দায় ভেসে আসার সাথে সাথে টের পেতাম আমাদের ঠিক পেছনের সারি, যেখানে আমাদের পরের ব্যাচ নাটক দেখতে বসতো সেখান থেকে হু হু হি হি আওয়াজ উঠে আসতো। সেটা যে মুশতাকেরই জন্য এটা অনেক পরে বুঝেছি।
বাবার জন্য বন্ধু মহলে আলগা খাতির পাওয়ার রেওয়াজ ক্যাডেট কলেজে নাই। আসলে কেবলমাত্র প্যারেন্টস-ডে ছাড়া বাবা মার খোজখবর বা পরিচয় রাখার চেস্টা আমরা কেউই করতাম না, তার কোন দরকারও ছিলো না। কিন্তু করতেন আমাদের শিক্ষকেরা । সেকারনেই কীনা জানি না, বড় বড় গাড়িওয়ালাদের তফাতে রেখে আমাদের কয়েকজন শিক্ষক দেখতাম প্যারেন্টস-ডেতে পাজামা-পাঞ্জাবীতে গাঢ় শ্যাম বর্ণের চশমা পরা এই লোকটাকে খুব খাতির করতেন।

 

সূত্র ঃ লেখকের লেখা ‘ক্যাডেটের ডায়েরী’ থেকে

১৯৮৩ সালে ২৬ ফেব্রæয়ারি আমি আর সুযোগটি হাত ছাড়া করিনা। সেই প্যারেন্টস-ডে তে আমাদের শিক্ষকদের মাঝখানেই আমি আমার ডায়েরি নিয়ে হাজির হই। তার দিকে ডাইরি খানা বাড়িয়ে দিতে দিতেই তিনি হাত থেকে টেনে নেন, যেন এটা তার অনেক দিনে অভ্যাস। বুক পকেট থেকে একটা বল পয়েন্ট কলম বের করে পুরো পাতা জুডে বড় বড় হরফে লিখেন “বাংলাদেশ আমার মা” । এরপর নাম লিখেন – মমতাজউদদীন আহমদ, ২৬/২/১৯৮৩।
মঝার কথা হলো, তিনি আমাদের অপর তিনজন শিক্ষকের সাথে আলাপে ছিলেন, আলাপের মধেই আমার নোটবুকে লেখার কাজ সেরে আমাকে খাতা ফেরত দিতে দিতে আবার স্যারদের সাথে আলাপে জড়িয়ে যান। আমাদের মধ্যে কোন কথাবার্তা হয় না।
কথা হয় এর কয়েকবছর পর। আমি তখন ঢাকায়, ভর্তি হয়েছি বুয়েটে। তিতুমীর হলে শুরু হয়েছে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ। একেক সন্ধ্যায় একেক আয়োজন। নানা রকমের গান, নাটক, একক অভিনয়, বিতর্ক, সাধারণ জ্ঞান- এসব। প্রতিদিনই একজন সেলিব্রেটি আসছেন প্রধান অতিথি হয়ে। সেলিব্রেটি মানে- যাঁকে টেভিশনে দেখা যায়।
আমি হাঁটা হাঁটি করি সেখানে। কিছু ছাত্র কেমনে কেমনে জেনে গেছে যে মমতাজউদ্দীন আহমদ আমার পরিচিত। তারা এসে ধরলো- স্যারকে নিয়ে আসতে। একক অভিনয় এর বিচারক হবেন তিনি। সবার শেষে বক্তৃতা দেবেন। মমতাজউদ্দীন হলের টিভি রুমের খুব প্রিয় পরিচিত মুখ। তাঁকে চাই।
আমি কিন্তু তাঁর ঠিকানাও জানি না। তাঁর যে পুত্রকে আমি চিনতাম শুনি সে চিটাগাং মেডিকেলে পড়তে চলে গেছে। ঢাকা এলে মাঝে মাঝে জাবেরের সাথে দেখা হয়।
আমি জাবেরকে ফোন লাগাই।
ফৌজদারহাটে জাবের যখন ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয় আমি ছিলাম তার গাইড। সে আবার মুশতাকের বেস্ট ফ্রেন্ড।
জাবের আমার ফোন পেয়ে খুবই খুশী। এটা কোন ব্যাপার না। ‘চাচা’কে সে বলে দেবে। আমাকে একটা ফোন নাম্বার দিলো। আমি পরদিন ফোন করে মমতাজ স্যারকে রাজী করিয়ে হলের আয়োজকদের কাছে গছিয়ে দিলাম। তার সাথে আমার আর যোগাযোগের দরকার হয়নি।
তিনি যথাসময়ে এলেন তিতুমীর হলে। বিচারকাজ শেষও করলেন। সবার শেষে বক্তৃতা দিলেন।
এই প্রথম সামনা সামনি তাঁর কথা শোনা। বক্তৃতা তো নয়, যেন নাটকের দীর্ঘ সংলাপ। তিনি বলেই যাচ্ছেন আর বলেই যাচ্ছেন। ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে শুনেই যাচ্ছে। তিনি মূলত: বলছেন তাঁর জীবনের কিছু ‘মজার গল্প’।
মজার গল্প বলার জন্য তাঁকে অনুরোধ করা হলেও শুনি- তিনি আসলে শোনাচ্ছেন তাঁর জীবনের ছাত্রকালীন কষ্টের কিছু গল্প। বাবাকে ফাঁকী দিয়ে কী করে কুড়ি টাকা বের করে এনেছিলেন তার কাহিনী।
অনুষ্ঠান শেষ। তিনি চলে যান। ‘প্রকৌশল বিশ্বিবদ্যালয়’ লেখা একটা মাইক্রোবাসে তাঁকে উঠিয়ে দেয়া হয়। আমার সাথে তাঁর কোন কথাই হয় না।
কথা হয় এবার। তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি, ১৯৮৯ সাল। একটা পাক্ষিক পত্রিকায় কাজও করি। নির্বাহী সম্পাদক। পত্রিকার জন্য বড় বড় লেখকদের লেখা নিতে হয়। বড় বড় লেখক খুব বেশি আমার চেনা নেই। যে দুইতিন জন আছেন তার মধ্যে একজন মমতাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ‘তারকালোক’ নামক এক পাক্ষিকে নিয়মিত রঙ্গরসাত্মক লেখা লিখছেন। লেখাগুলো হলের ছেলেরা আন্ডারলাইন দিয়ে পড়ে। ভাবলাম এই লেখকের লেখা হয়তো আমি চাইতেই পারি।
যথারীতি জাবেরকে আবার ফোন এবং কায়দা করে এপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে নেয়া। আমি যথাসময়ে হাজির হয়ে গেলাম আজিমপুর কলোনীর বাসায়।
আমার পরিচয় আমি পাক্ষিক পত্রিকার সাংবাদিক। কিন্তু আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একবার স্যার বলি, আরেকবার ‘চাচা’। এবং বুঝতে চাই যে আমি তাঁর ছেলের বড় ভাই-বন্ধু এসব। এবং একসময় টের পাই যে, তিনি বিগলিত। লেখা দেবেন আমাকে। এবং রম্য রচনা। আমি খানিকক্ষণ বসি। চা-বিস্কুট খাই। লেখার সাথে তাঁর ছবি যাবে, ব্যাগে আমার ক্যামেরা আছে। ছবি তোলার জন্য তিনি খানিক সময় নিয়ে শেভ করে আসেন। আমি পরপর দুইটা ক্লিক করি। একটায় এপার্চার বেশি, একটায় কম। এবং চলে আসি। কথা থাকে, তিনদিন পর এসে লেখা নিয়ে যেতে। লেখার জন্য একটা সম্মানীও ঠিক হয়। আমি একটা খামের ভেতর ৪শ’ টাকা ভরে তাঁর হাতে দেই। তিনি তা গ্রহণও করেন।
কথা মতো তিন দিন পরে তাঁর ফ্লাটে গিয়ে হাজির হই। কিন্তু তাঁকে আর পাই না। এক ভদ্র মহিলা বেরিয়ে এলেন। আমি তাঁর অবয়ব দেখে বুঝে ফেলি, তিনি মুশতাকের মা। আমি পায়ে ধরে সালাম করি। তিনি আমার সব কথা শুনে বলেন- আজ ভোরে তিনি একটা বক্তৃতা দেবার জন্য রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে চলে গেছেন। আমার লেখাটা তৈরি করতে পারেন নি।
আমি খুব মন খারাপ করে চলে আসবো- এমন সময় আমার দেয়া খামটি তিনি ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, এটা আপনাকে দিতে বলেছেন।
এরপর আর বহু বহু বছর তাঁর সাথে আমার দেখা হয় না।
দেখা হয় ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে। সেদিন বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারের বাইরে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। তাঁর খুব মন খারাপ। তিনি কাচের ভেতর দিয়ে অপলক ভেতরের লাউঞ্জের দিকে চেয়ে আছেন। আমি সালাম দেই। তিনি সালামের জবাব দিয়ে আবার তাকিয়ে থাকেন। দুবাইগামী এমিরেটস এর বিমানে উঠে দেখা মুশতাকের সাথে। আমি তো খুবই ফ‚র্তিতে। মুডে আছি। প্রথমবারের মতো আমেরিকা যাচ্ছি। মুশতাক বলে- সেও যাচ্ছে প্রথমবারের মতো আমেরিকায়। আমি ভাবলাম সারা পথ অনেক গল্প করে যাওয়া যাবে। কিন্তু পেছনের সীটে বসা কারো সাথে তো আর প্লেনে বসে গল্প করা যায় না। ভাবলাম, দুবাইতে ৪ ঘণ্টা বিরতি আছে, সেখানে হবে।
দুবাই নেমে দুইজন দুই ফ্লাইটের খোঁজে দুই গেটের দিকে চলে যাওয়ার কারণে আর দেখা হয় না।
মজার কথা, মমতাজ স্যারের সাথে আর কোনদিন আমার কথা হয়নি। দূর থেকে কোথাও কোথাও দেখা হয়েছে। আমাকে তিনি হয়তো চিনতেন, কিংবা না। কিন্তু তাঁর চেহারা যখনই মনে হয়, তখন বুয়েটের তিতুমীর হলের চার তলার বারান্দা থেকে প্রতিদিন সকালের একটা নির্দিষ্ট সময়ে গাঢ় রঙের পাঞ্জাবী আর ঢোলা পাজামা পরে রিকশার মধ্যে বসে একটা ছাতা মাথায় দিয়ে জগন্নাথ কলেজের দিকে যেতে থাকা এই মানুষটির চেহারাই মনে পড়ে।
তিনি আসলে ছিলেন একজন শিক্ষক। ক্লাসে ছাত্রদের কী পড়াতেন আমরা জানি না, আমরা যারা কিছু নাটক লেখার চেষ্টা করেছি, তাঁদেরকে তিনি আসলে নাটক শিখিয়েছেন।

মন্তব্য
Loading...