ফুজি পাহাড়ের পর্দা- তরিকুল লাভলু

২০১৮ সালে জাপান ভ্রমণের খন্ড খন্ড চিত্র

সূর্যোদয়ের দেশে প্রথম আলোর সুরধ্বনি…

সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে টোকিওর নারিতার আকাশপথে দূরত্ব সাত ঘন্টার মত। উড্ডয়নের এই পথে বাঁ পাশে হিরোশিমা, ওসাকা ইত্যাদি শহর পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে টোকিওর দিকে যেতে হয়। আমাদের উড়োজাহাজ গন্তব্যের কাছে এসে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে যতই নীচের দিকে ধাপিত হচ্ছে, টোকিও শহর যেন ফেরিওয়ালার মাথায় সাজানো ভোগসম্ভারের ডালার মত জানালার কাছে এগিয়ে এসে উঁকি দিচ্ছে। কেবল যে ধরিত্রী তাকে মাথায় ধার্য করে রেখেছে, বাসস্ট্যান্ডের হকারের মত ফেরি করার জন্য তার কোন হাঁকডাক নেই!

আমার দুই আসন সামনে জানালার পাশে বসা স্থপতি মাসুদভাই বললেন, ‘ইশ, টোকিওটা উপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন আমাদের ক্লাস প্রজেক্টের মত মডেল বানায় রাখসে।’

জানালার বাহিরে এতক্ষণ শরতের ছেড়া ছেড়া যে মেঘগুলো অলস ভঙ্গিতে প্রায় অচঞ্চল হয়ে নীচের আকাশে থামবে নাকি চলবে এমন একটা অনিশ্চয়তায় ছিল, সেগুলি যতই কাছে আসছে, কোথা থেকে যেন অকস্মাৎ এক তীব্র গতিসঞ্চার করে পিছনে ছুটতে শুরু করে দিয়েছে।

অথচ প্লেনে বসে নীচে তাকিয়ে যে মেঘ দেখছিলাম আর সবসময় মাটিতে দাঁড়িয়ে মাথার উপরে দেখা যে মেঘ, দু’য়ের মধ্যে কোন পার্থক্যই অনুভব করি নি৷ উভয়ই একই রকম আকারহীন, অচঞ্চল, অলস এবং উদ্দেশ্যহীন। বর্নে, সঞ্চারণে, ভাবে ও ভঙ্গিতেও কত অভিন্ন।

নীচ ও উপর, বিপরীত দু’পাশ থেকে দেখার এই মেঘ একটা যদি ফেলে আসা অতিত সময়ের কোন ঘটনা হয়, তো অন্যটা দূর ভবিষ্যতের ভেতর দেখা কোন স্বপ্ন যেন। যতক্ষণ খুশী ভাবনার ভিতর তাদের অনুভব করা যায়। কোনটারই আরো দূরে চলে যাবার বা হুট করে কাছে আসার তাড়া নেই। ব্যতিক্রম কেবল এই খুব কাছ দিয়ে দ্রুতবেগে ধাবমান ত্রস্ত মেঘ। যেন এটাই আমাদের চলমান বর্তমান।

নারিতা এয়ারপোর্টে নামার পর আমাদের প্রায় সবারই একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো।

বাস্তবের জাপান তার থেকে এতো আলাদা!

জাপান নামের সাথে যে আধুনিকতার বিচ্ছুরন, প্রযুক্তির চমক, যন্ত্রের ঝনঝনানি বা হাইটেকের টঙ্কার ধ্বনি মিলেমিশে মনপটে চটকদার একটা বহুরঙা ছবি এঁকে রেখেছিল, বাস্তবের জাপান তার থেকে এতো আলাদা! এতো সাধারণ!!

চীন, হংকং, দুবাই অথবা ভারতের সাম্প্রতিক অধিকাংশ বিমানবন্দরে নামলে যেমন একটা প্রযুক্তিবিষ্ময় এসে ধাক্কা মারে, নারিতা যেন স্বেচ্ছায়, স্বযত্নে এবং স্বলজ্জে তেমন সব প্রকাশকে অবদমন করে রেখেছে।

আমাদের হতাশ বা মোহভঙ্গ হওয়া উচিৎ, অথচ উল্টো মনের মধ্যে কেমন যেন একটা স্বস্তি বোধ হচ্ছে! যে দিকেই তাকাচ্ছি, চোখে একটা প্রশান্তি অনুভূব করছি! এ যেন ঈশানকোণে মেঘের ঘনঘটার নীচে আয়োজন করা কোন বাহারী ময়ূরীর হঠাৎ নৃত্যের পরিবর্তে আটপৌরে শাড়িতে এক ঘরোয়া কিশোরীর সাবলীল, লাস্যময়ী, নম্র ও আহ্লাদি এক চিরায়ত চলন!

একটা সাদামাটা, ধূসর, একরঙা অথচ চটপটে, দক্ষ, যাত্রীবান্ধব বিমানবন্দর আমাদের স্বাগত জানালো। বোর্ডিং ব্রীজ থেকে আঁকাবাঁকা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছোটছোট পথ ও পরিসর পার করে এমনভাবে আমাদের প্রায় অর্ধ কিলোমিটার পথ হাঁটিয়ে ইমিগ্রেশনের সামনে আনা হলো যে প্রতিটি বাঁকে বা পরিসরে এসেই মনে হতে থাকলো, এই তো এসে গেছি, এই বুঝিবা ইমিগ্রেশন! দীর্ঘ একটা যাত্রার পর গৎবাঁধা এই পুরো হাঁটাপথে অবধারিত ক্লান্তি বা একঘেয়েমির বদলে একটা ছিমছাম মুগ্ধতা আমাদের চাঙ্গা করে রাখলো।

দুই স্তরের ইমিগ্রেশন। প্রথম স্তরে তিন সারিতে জোড়ায় জোড়ায় বসানো যন্ত্রের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমদের পাসপোর্ট একটা যন্ত্রে স্ক্যান করা হলো। ছবি তোলা হলো। সাহায্যকারী অফিসার কোন ভাষা বা ভাব বিনময় ছাড়াই একতরফাভাবে মাথা নুয়ে, চোখেমুখে নিরব হাসির অট্টরস ছড়িয়ে সবাইকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন, যেন যে কোন অসুবিধায় পাশে এসে দাঁড়ানো পাড়ার চিরচেনা মোখলেসভাই সে! পরে জেনেছি, সমস্ত শরীরের ভাষাকে একসাথে আকর্ণ এক বিনয় মিশ্রিত হাসির মাধ্যমে ব্যক্ত করার এক বিরল গুন জাপানিদের মজ্জাগত।

কোন একটা বাদ্যযন্ত্র যখন নিরবে রাখা থাকে, তার গঠন সৌষ্ঠব, অঙ্গের উপকরণই বেশী দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু যখন কোন সুরসম্রাট সেই যন্ত্র হাতে নিয়ে তাঁর ধ্যান, জ্ঞান ও দক্ষতায় তাতে একটা সুর তুলেন, অমনি ওই যন্ত্রের আকার, অঙ্গকে ছাপিয়ে সেই সুরের মূর্ছনা সবাইকে মোহাবিষ্ট করে ফেলে। জাপানিদের দেখে মনে হয়, বিধাতা সেই সুরসম্রাটের মতই সৃষ্টির পর থেকে জাপানিদের বাঁজিয়ে চলছেন। সেই বাদন যেন সুরের যাদুর মতই হাসির নির্মলতায় সবাইকে অধিকার করে নিচ্ছে!

প্রথম স্তরের পর দ্বিতীয়স্তরে ইমিগ্রেশনে পাসপোর্টে সীলছাপ্পর মারার আনুষ্ঠানিকতা। এই পুলিশও সেই রকম৷ বয়সে নবীন, শিশুসুলভ, সদাহাস্য ও নীরিহ এই চেহারার সাথে আমাদের অভিজ্ঞতায় ‘পুলিশ’ শব্দটা যে অর্থ বহন করে তার কোনই মিল নেই। বরং স্কুলে নিজের টিফিন অন্যকে খাইয়ে দেয়া সহপাঠিনীর মত একটা মমতাসুলভ আচরন তাঁর। সে বসে থাকা অবস্থায় আমি যে এদেশের একজন অতিথি হয়ে কষ্টকরে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সেই অপরাধ বোধেই মনেহচ্ছে জর্জরিত হয়ে আছে সে! ভাবনার চেয়েও দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে ‘সরি টু কিপ ইউ ওয়েটিং, ওয়েলকাম টু জাপান’ বলে সম্ভাষণ জানালো।

এমন একটা দেশে মনে অপার আনন্দ না নিয়ে প্রবেশের অন্য কোন সুযোগ নেই।

আগমনী হলে একে একে আমরা সবাই এসে জড়ো হচ্ছি। টাকা ভাঙ্গানো, মোবাইল সিম কেনা, হোটেলে যাবার বন্দবস্ত এসবই আসু কাজ। দলে সংখ্যায় আমরা বহুজন। টোকিওতে সবাই ভিন্নভিন্ন হোটেলে থাকবো। সুতরাং কানেকটিভিটি সবার আগে। তার আগে চাই লোকাল কারেন্সি।

আগমনী ফটকের পাশেই বেশ বড়সড় একটা ‘মানি এক্সচেঞ্জ’। এশিয়ায় প্রায় দেশেই এয়ারপোর্টে ডলারের মান সর্বোনিম্ন হয়। এখানেও তেমন ধরা খেতে হবে নাকি, ভেবে নিশ্চিত হবার জন্য আশেপাশের দোকানের কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, প্রথমত এই রাতে এটা ছাড়া অন্য কোন গতি নেই। দ্বিতীয়ত জাপানে এই বিষয়টা সমাজতন্ত্রের মতই সরল৷ অর্থাৎ প্রতিদিন উঠানামা করলেও সর্বত্র কারেন্সি রেট একই প্রায় একই হয়ে থাকে।

আমার কাছে খুচরা বেশ কিছু ডলার মানিব্যাগের কান্তি স্ফীত করে রেখেছে। ভাবলাম এগুলি ভাঙ্গিয়ে আপাতত প্রয়োজনীয় কাজগুলি সারা যাক। সব মিলিয়ে গুনে দেখি দু’শ ডলার। কাউন্টারে দিলাম ভাঙ্গাতে। দিয়েই মনে হলো বেশ বিপদে পড়ে গেলাম।

লম্বা এক্সচেঞ্জের সামনে জানালা ঘেঁষে চারটা কাউন্টারে চারজন বসার ব্যবস্থা। ভাবলাম, রাত বলেই হয়ত দুই কাউন্টারে দু’জন বসা আর বাকি দু’টো ফাঁকা। যে চারজন কাউন্টারে বসে, তাঁদের প্রত্যেকের পিছনে আরো একজন করে লোক বসার ব্যবস্থা। পিছনের জনের টেবিল সামনের দিকে হাফ পার্টিশন দিয়ে আড়াল করা। তাতে আমার জায়গা থেকে পিছনের জনের চেহারা দেখা যায় কেবল। তাঁর টেবিল দৃষ্টির অগোচরে থাকে।

তো সামনের জন চিরাচরিত অমায়িক জাপানি হাসি দিয়ে ডলারগুলি নিলেন। তারপর দুবার করে ধীরেধীরে বেশ সময় নিয়ে গুনলেন। এরপর একটা স্লিপে পেন্সিলে এক, পাঁচ, দশ, বিশ, পঞ্চাশ ইত্যাদি কোনটা কত সংখ্যায় আছে, লিখলেন৷ এরপর যা করলেন, সেটা আমার এই কুড়ি বছরের বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতায় একেবারেই অনুপস্থিত! পিছনের তাক থেকে একটা মোটা ক্যাটালগের মত নিলেন। খোলার পর দেখি, তাতে বিভিন্ন দেশের অর্থনোট আঠা দিয়ে সাঁটানো। তার ভিতর থেকে ডলারের চ্যাপ্টার বের করে আমার দেয়া প্রতিটা নোট একটা একটা করে তার সাথে মিলালেন! পৃথিবীর সব দেশের মানি এক্সচেঞ্জে এই পরীক্ষণ আর গুননের কাজটা এখন মেশিনে চোখের পলকে করা হয়! আর এই জাপানে, এয়ারপোর্টের মত জায়গায় এটা কিনা ম্যানুয়াল!!? এ যে সাধারণ নয়, বলা যায় অসাধারণ!!

দুই মিনিটেই হতে পারতো। তার বদলে পনেরো মিনেটে আমার দু’শত ডলার বিনিময় কাজ সম্পন্ন হলো। এবার সিম কেনার পালা।

আমাদের মধ্যে যাঁরা দেশ থেকেই জাপানি মূদ্রা সঙ্গে করে এনেছেন, আমার ডলার ভাঙ্গাবার সময়ে তাঁরা সিম কেনার বিষটা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। কী সিম, কোন অপারেটর, কেমন প্যাকেজ, কত দাম সব কিছুই বিচার বিশ্লেষণ শেষে রায় ঘোষিত হয়েই আছে। দলে ভ্রমণে এই এক সুবিধে। একের আবিষ্কারে অন্যের সুফল ভোগ সুগম হয়। দুর্ভোগও হয়ত কখনো হয়, তবে সেটা অভিজ্ঞতাকেই সমৃদ্ধ করে।

জানা গেল, এখানে কেবল ডাটা সিম লভ্য। অর্থাৎ সিমের কোন জিএসএম নম্বর থাকবে না। তবে দ্রুতগতির ডাটা ব্যবহার করে ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদিতে ভয়েস কল করা যাবে। একমাস মেয়াদের আনলিমিটেড ডাটা প্যাকেজের দাম ছ’ হাজার ইয়েন! আমাদের বাংলা টাকায় সাড়েচার হাজার টাকা!!

নারিতার এরাইভাল লাউঞ্জ

প্রায় সবাই সেটা কিনে ফেলেছে। টাকা ভাঙ্গাচ্ছিলাম বলে আমার জন্য শাকুর, আরিফ, খোকন, মাসুদভাই আর জগলুল ভাই তখনও অপেক্ষায়। ফোনের সেই কাউন্টারে গিয়ে দেখি লম্বা লাইন। পিছনে গিয়ে যেখানে দাঁড়ালাম, আমরা সিম পেতে পেতে ঘন্টা দুয়েক লেগে যাবে বলে ধারণা হলো। ওদিকে শেষ এয়ারপোর্ট টু হোটেল সাটল বাস একঘন্টার মধ্যেই ছেড়ে যাবে। আরিফ খুঁজে এসে জানালো, পাশের দোকানে অন্য একটা অপারেটরের সিম পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে ভিড় নেই কোন। সিম প্যাকেজও এক। তবে দাম ছ’য়ের বদলে সাত হাজার ইয়েন।

পুঁজিবাদের দীক্ষা আর চর্চায় আমরা তো অভ্যস্তই। সুবিধার দাম তাও বেশী হবেই। বরং এর উল্টোটাই আমাদের কাছে অযৌক্তিক। সিম কেনায় এক হাজার ইয়েন বাঁচাতে যদি একত্রিশ শ’ ইয়েনের বাস ফেল করি, তা’হলে ট্যাক্সিতে হোটেল যেতে গুনতে হবে আটাশ হাজার ইয়েন!!

দ্রুত অংকের এই হিসেব কষে আর্থিকভাবে লাভজনক সিদ্ধান্ত নেয়ার বিচক্ষণতাও ঐ পুঁজিবাদের দান। বিখ্যাত ব্রিটিশ কথন আছে, ‘নেভার বি পেনি ওয়াজ পাউণ্ড ফুলিস’। সাত হাজারে সিম কিনে যার যার মোবাইলে ডাটা একটিভ করতেই প্রায় সতের ঘন্টা পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো মোবাইল ফোনে সরব মুখরতায় সচকিত হয়ে উঠলো।

কোথায় গেল অর্থের হিসেব, কোথায় হারালো এই দূরপ্রাচ্যে আসায় অন্যের সাথে দূরত্বের ব্যাবধান। যোগাযোগের অপরিহার্য এই কাঙ্ক্ষিত মধুরতা অন্য সকল মাদকতাকে হার মানায় বুঝি!!

এয়ারপোর্টে থেকে হোটেল প্রায় দেড়ঘন্টার পথ। কাটায় কাটায় নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়লো। এখন রাত সাড়ে নয়টা বাজে, আর এয়ারপোর্টে এসে নেমেছি সাড়ে পাঁচটায়। সময় যখন অভিজ্ঞতা বিলাতে বিলাতে পার হয়ে যায়, তার ক্ষণ গননার তখন আর আবকাশ থাকে না।

বাসের ভিতর আলো জ্বলছে, অথচ বাহিরে অন্ধকার। জানালা দিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাতে অবশ্য কারো কোন খেদ আছে বলেও মনে হলো না। যে যার সিটে বসে নীচের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে কেবল মন আর মোবাইলে আঙ্গুলকে ব্যস্ত রাখায় নিমগ্ন। মাছের সাঁতার কাটার মত নেটে সার্ফিং এখন জীবনেরই অন্য এক অপরিহার্য্য অনুসঙ্গ। কানেকটিভিটি বদলে দিয়েছে সরব কথপোকথনের প্রবৃত্তি, স্পর্শের আকাংখা, আলিঙ্গনের তৃপ্তি এবং আরাও বদলে দিচ্ছে অট্টহাসির জলতরঙ্গময় শব্দ শুনবার কান।

তবে উদ্ভাসিত করে রেখেছে ও রাখছে সবার মুখাবয়ব। এই মুহূর্তে বাসের প্রায় সবার মুখে ছড়িয়ে আছে হাতে রাখা এক খুদে যন্ত্রের মায়াবী আলো।

অত্যুজ্জ্বল সেই আলো কতটা অন্তরজাত অনুভূতি উৎসারিত আর কতটা স্মার্টফোন থেকে বিচ্ছুরিত নেহায়তই এক কিরণ, সব সময় সেটা ঠাওর করা যায় নান

আকিহারাবার দোকান

আকিহারাবা-টোকিওর গেজেটবাজার

জাপানের টোকিওতে এসে ইলেকট্রনিক গেজেটস এণ্ড গিয়ারের মার্কেটে না যাওয়া আর মক্কায় গিয়ে মসুলমানের হজ্জ না করা প্রায় সমার্থক! তারমধ্যে আমি আর শাকুর যখন একসঙ্গে, তাও আবার এমন এক শহরে যার এই গেজেটের মার্কেট বিশ্বসেরা! ধার্মিকের যেমন ধর্মপুস্তকে, শাকুর আর আমার তেমনই গেজেটে আসক্তি (বিশেষ করে ক্যামেরা)!

এশিয়ান স্থপতিদের কংগ্রেসে প্রথমদিন রেজিস্ট্রেশন আর কিটস (একটা ব্যাগে কিছু কাগজ, কলম, কোটপিন, স্যুভেনির ইত্যাদি) কালেকশন ছাড়া আমাদের তেমন কিছু করণীয় নাই। আগের রাতে দেশ থেকে লম্বা ভ্রমন শেষে টোকিওর হোটেলে এসে উঠতে উঠতে রাত গভীর হয়ে গিয়েছিল। তার উপর সব বন্ধুরা মিলে নির্ধারিত রাতের আড্ডার গত রাতই ছিল শুভ উদ্বোধন। আগামী দশদিন জাপানে অবস্থান কালে এই আড্ডা চলবে প্রতি রাতে। আর তাতে সবার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক।

দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি, তার উপর প্রায় ভোর পর্যন্ত আড্ডা। সকালে ঘুম থেকে উঠতে তাই খানিকটা দেরিই হলো। সকাল দশটায় হোটেলে প্রাতরাশের শেষ সময়। হোটেলের ভাড়ার সাথেই নাস্তার পয়সা একসঙ্গে দেয়া। মিস করলে এই নতুন শহরে কোথায় গিয়ে কখন নাস্তা মিলবে, প্রথম দিন সেই অনিশ্চয়তায় না গিয়ে চটজলদি সবাই প্রস্তুত হয়ে প্রায় শেষ মুহূর্তে গিয়ে পৌঁছলাম রেষ্টুরেন্টে।

হরেক রকম খাবার। এসব হোটেলে কিছুদিন একটানা থাকলে যেটা হয়, প্রথম সকালে প্রায় সব খাবারেরই স্বাদ নিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ঠিক পরদিন থেকেই সেই ইচ্ছেয় হতাশজনকভাবে একটা যেন ভাটার টান লাগে। শেষের দিনগুলোতে দেখা যায়, খাবার এই ইচ্ছে শুধু পাউরুটি আর মাখনে গিয়ে ঠেকেছে!

টোকিওতে আজ যেহেতু নির্ভার প্রথম দিনের সকাল, প্রাতরাশে বসে তাই সময় নিয়ে প্রায় সমস্ত পদই একে একে আস্বাদন করা হল। রান্না, আধেক রান্না এবং কাঁচা বা র’ খাবারের সব যে উপাদেয় লাগলো তা না। তবে আমি সর্ব ভুক। নতুন খাবার আমার কাছে নতুন কোন অজানা স্থান ভ্রমণের মতই আকর্ষণীয় লাগে। গুরুদেব গানের জন্য যেভাবে বলেন, “চিত্ত পিপাসিত রে…!” আমার এই পিপাসা কেবল ‘গীতসুধা’য় তৃপ্ত না থেকে জগতের অন্য আরো যেসব সুধা-মাধুর্যে ভীষণ অনুরক্ত, খাদ্যের স্থান বলা যায় তার শীর্ষেই!!

নাস্তার আয়েসী পর্ব শেষ হল এগারোটায়। আমারা আছি টোকিওর ঐতিহ্যবাহী ওটানি হোটেলে। এটা আমাদের ‘স্থপতি কংগ্রেসের’ জন্য জাপান স্থপতি ইন্সটিটিউটের নির্ধারণ করা অফিশিয়াল হোটেল। এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মেইজি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কংগ্রেসের অনুষ্ঠান স্থান। শাটল বাসের ব্যবস্থা আছে শুনেছি। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, শেষ বাস সকাল সাড়ে আটটায় ছেড়ে গেছে। লেট-লতিফদের ভাগ্যে সব সুযোগের শিকা ছিড়ে না। অগত্যা ট্যাক্সিক্যাব।

হোটেল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দশ মিনিটের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশী পথ। তার জন্য ভাড়া গুনলাম একুশ শ’ ইয়েন। আমাদের টাকায় প্রায় ষোল শ’! জানতাম যে টোকিও পৃথিবীর অন্যতম ব্যয়বহুল শহরের একটা। প্রথমদিন ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে সেই ব্যয়ের সূচনা করলাম।

দুপুর একটার মধ্যেই কংগ্রেস কমিটির আন্তরিক খাতির যত্নের মধ্যদিয়ে রেজিষ্ট্রেশন ইত্যাদির কাজ শেষ হলো।

বিকেল তিনটেয় আয়োজকদের ব্যবস্থাপনায় রিভারক্রুজ। তার জন্য অপেক্ষার ফাঁকে কংগ্রেসে আসা নানা দেশের স্থপতিদের সাথে পরিচয় আর আড্ডাপর্ব চলতে থাকল। একুশ দেশের স্থপতিদের মিলন মেলা। ইতোপূর্বে অন্য কোন দেশে পরিচিত হওয়া প্রায় সব দেশেরই একাধিক পরিচিত মুখের পুনঃসাক্ষাত মিলে এসব মিলনে।

এর মধ্যেই খোঁজ ও তথ্য নিয়ে রেখেছি, পৃথিবীর সবচে বড় যে ইলেকট্রনিকস মার্কেটটা আছে এই টোকিও শহরে, তার সম্পর্কে নানা বৃত্তান্ত। শহরের মধ্যে সেটা আবার আরেক শহর। নাম ‘আকিহাবারা’। নতুন, পুরাতন, নব্য, অভিনব আর দুর্লভ সব ইলেকট্রনিক সামগ্রীর এলাহি পসরা। দুনিয়ার সবচে’ বড় এনিমেশন, আর কমিকের (জাপানিজ মাংগা) আখড়া।

আকিহারাবার ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেট

বিশাল এই আয়োজনে আমাদের প্রাথমিক আগ্রহ যদিও ক্যামেররা, ক্যামেরা-এক্সেসরিজ, কম্পিউটার আর নেটওয়ার্ক সামগ্রীর প্রতি, কিন্তু মনে ধরলে যে কোন কিছুই আমাদের ক্রয় তালিকায় স্থান পেতে পারে। আমরা পঞ্চ-পর্যটকরা যেবার চিলি ভ্রমনে গেলাম, ফেরার পথে দুবাইতে তিনদিনের ট্রানজিট ছিল। সেবছর সিনেমা-টিভি আর ‘অল-ইন-ওয়ান কম্পিউটার’ প্রথম বেরিয়েছে। কিনতে কারোই এতোটুকু দ্বিধা হয় নি!

আকিহাবারা ঘুরে দেখার উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে সন্ধ্যের পর। ভিতরের নিত্যনব সামগ্রীর পাশাপাশি বাহিরের নিয়ন ও হালের এলইডি সাইনের ঝলকময় প্রদর্শনীও যুগপৎ আকর্ষণীয়। সেই সাথে সন্ধ্যার পর এর রাস্তায় নামে নবীন কমিক আসক্তদের নিজ হাতে নক্সা করা নানা সজ্জার গাড়ি। এছাড়াও আকিহাবারা খুবই বিখ্যাত এর নানান ধরনের মুখরোচক খাবার দোকানের জন্য।

অথেনটিক জাপানি খাবার মাত্রই ব্যয়বহুল। তার উপর টোকিওর মত শহরে সেই খাবার সাধারন জাপানিরাও কিনে খেতে সাহস করেন না। এই দুঃখ মনে নিয়ে আশির দশক থেকে আকিহাবারায় সস্তায় জাপানি খাবার বিক্রির প্রথা চালু হয়। অবস্থাপন্য জাপানিরা একসময় বিদ্রুপ করে একে বলতো বি-কিউ ( b-kyu), অর্থাৎ বি-গ্রেড ফুড। কালেকালে এই বি-গ্রেড ফুডই এখন জাপানের সবচে’ জনপ্রিও, মুখরোচক আর বৈচিত্রময় খাবার!

জাপানী খাবারে আগ্রহ নেই শাকুরের, তার ছবি তুলে রাখার জন্য সে ব্যাকুল

ক্যাম্পাস থেকে তিনটায় যাত্রা করে আমাদের রিভার ক্রুজ শেষ হলো বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যায়। সেই সাথে শুরু হলো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। ক্যাম্পাসে ফিরে এসে সবাই যে যার মত নিজস্ব পছন্দের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ হোটেলে ফিরতে চাইলো। কেউ খেতে বা শহর দেখতে বের হলো। শাকুর আর আমি ছুটলাম প্রতিক্ষিত আকিহাবারা দর্শনে।

আমাদের ছোট দলটার জাপানে এসে প্রথম পাঁচদিন টোকিও ঘুরাঘুরি পর্বে বন্ধু আরিফ (Qazi M Arif) মহা ব্যস্ত থাকলো। আরকেশিয়া নানা কমিটির কাজে তাঁর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। বলেই দিয়েছে, টোকিওয় ঘুরাঘুরিতে সে নেই। দলের সাথে ওর ঘুরা শুরু হবে ওসাকা থেকে।

দলের সবাই তাই বেশ আলগা। একা বা ছাড়াছাড়া দলে যার যেদিকে খুশী ঘুরতে চলে যাচ্ছে। সবাইকে ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছায় একদলে, এক গন্তব্যে একসাথে ঘুরার নিয়ম মানাতে যে ছাইমাখা হাতে সবাইকে ধরে রাখতে হয়, আরিফ ছাড়া আমাদের আর কারো হাতেই সেই ছাই নাই।

মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুরুগাদাই ক্যাম্পাস থেকে দুই মিনেট হাটার দূরত্বে ওচানোমিজু স্টেশন। সেখান থেকে মেট্রোতে বারো মিনিটের পথ আকিহাবারা। জনপ্রতি টিকিট ১৬০ ইয়েন। দেশ থেকে আমরা সবাই সাত দিনের রেল পাশ নিয়ে এসেছি। সেটা একটিভেট করবো ভ্রমণের শেষ সাত দিনের শুরুতে। আন্ত শহর যাত্রা তো বটেই শহরে ঘুরার জন্যও এই পাশ ভীষন সাশ্রয়ী। সাত অথবা চৌদ্দদিন মেয়াদের সেই পাশ আমাদের দশদিনের ভ্রমণের জন্য মাপে মিলে না। এ ছাড়াও প্রথম পাঁচ দিন যেহেতু কেবল টোকিওতেই থাকা, তাই এখানকার লোকাল যাত্রা খুচরা টিকিটেই সারা হবে, এমনটাই সিদ্ধান্ত।

মেট্রো ধরে এসে নামলাম স্বপ্নের আকিহাবারায়। আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের দিকনির্দেশনা দেয়া আছে কোন দিকে গেলে মিলবে ইলেকট্রনিক জগত। সেই দিকে এগিয়ে মাটি ফুরে যখন উপরে উঠলাম, মনে হলো অন্য কোন গ্রহে এসে পড়িলাম।

সমস্ত বড় রাস্তা জুড়ে বড়বড় দশ বারোতালা দোকান তো আছেই। সেগুলোর দুইপাশে যত ছোটরাস্তা আছে, সবগুলোতেই ছোটছোট দোকান ঠাসা। একজন বললো, একেক রাস্তা একেক কারনে বিখ্যাত। আপনার পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ারের মাদারবোর্ড নষ্ট হয়েছে? বা পুলি ভেঙ্গে গেছে? তো এই রাস্তায় যান। ক্যামেরার স্পেশাল লেন্স চাই? তো সেই রাস্তা। নতুন আইটেম চাই? তো ঐ দিকে!!আপনার ইলেকট্রনিক কোন চাওয়াই ফিরেয়ে দিবে না আকিহাবারা। তা সে যত পুরনো যন্ত্র বা যত অভিনবই হোক না কেন!

এই ইলেকট্রনিক শহরে সারাদিন ঘুরে দশদিন অনায়াসেই কাটিয়ে দেয়া যায়। অথচ দশদিনে জাপানের কত শহর, কত স্থাপনা, কত ঐতিহাসিক জায়গাই না আমাদের দেখতে হবে। হতবিহ্বল আমাদের পা সরে না। কোন দিকে, কোন দোকানে, কিভাবে শুরু করবো!? কে দিবে সেই অঢেল অপরিহার্য্য সময়? মিষ্টি পাগল ক্ষুধার্ত কোন শিশুকে মিষ্টির দোকানে নিয়ে যদি বলা হয় যা খুশী খাও, তবে সময় কিন্তু পাঁচ মিনিট, তবে সে এক বড্ড তামাশার খেলা।

বিধাতা আমাদের নিয়ে এমন খেলা যে প্রয়শই খেলেন!!

বোধকরি বিধাতার এমন খেলার সাথী হতেই আমরা দু’জন কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে গিয়ে ঢুকলাম একটা বিশাল দোকানে। নাম Bic Camera!

ঠিক হলো, আজ কোন কেনাকাটা না। কেবল দেখা। ঘন্টা তিনেক তাই করেই কাটলো। কি কি কেনা হবে তার একটা প্রাথমিক তালিকা হলো। বাহিরে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। আগামী ভালো আবহাওয়ার কোন দিনেই এগুলি কিনে ফেলবো৷

হোটেলে কোন পথে, কোন ট্রেনে ফিরতে হয় জানিনা। খুঁজে নিতে হবে। দু’জনের কাছেই সদ্য কেনা দু’টো জাপানি ছাতা আছে। সুতরাং, ভয় কি!

প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে। হোড়েলে ফেরার আগে খেতে হবে। আগেই বলেছি, আকিহাবারা বি-গ্রেড ফুডের জন্য বিখ্যাত।

সামান্য খুঁজতেই ফুডকোর্টের সন্ধান পাওয়া গেল। সেখানে বসে আয়েস করে হরেক পদের বি-গ্রেড খাবারের ওয়ার্ডের দিলাম। দাম আসলেই সস্তা! টেবিলে খাবার দিতে খানিক সময় লাগবে। সেই অপেক্ষায় বসে না থেকে আমরা ঘুরেঘুরে দোকানগুলোর সামনে ডিসপ্লে করা নানান খাবারের ছবি তুলতে মশগুল হয়ে গেলাম।

জাপানের চকবাজার, ‘নাকামিসে-ডোরি’ ….

“রাজা হারান আপন প্রাসাদ থেকে,
রাজ্যটাকে ভবিষ্যতে রেখে।
নিত্যজীবন তেমনি থাকে জেঁকে,
বাজার ঘিরে বেচাকেনার ঝোঁকে।”
– তরিকুল লাভলু (জনপদের পদাবলী)

টোকিওতে পৌঁছানোর পরপরই স্থপতিরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন জাপানের বিখ্যাত সব স্থপতিদের স্থাপনা দেখার জন্য। বিভিন্ন পুস্তক, ম্যাগাজিনে এতদিন যেসবের ছবি দেখে আর নিবন্ধ পড়ে পড়ে মনের মধ্যে একটা বিশাল আগ্রহ অপার তৃষ্ণা নিয়ে অপেক্ষায় ছিল, এসব দর্শন করে তাকে নিবারণের জন্যই তো এত দূর ছুটে আসা।

কিন্তু কেবল তালিকা ধরে সেইসব স্থাপনার খোঁজে ছুটে বেড়াতে মন সায় দিচ্ছে না। আমার আগ্রহ বরং পাহাড়, নদী পুরনো জনপদ আর লোকালয় ঘুরে দেখাতে। সে সব ঘুরতে গিয়ে যদি দুই এক পিস তাদাও আনদো, ফুমিহিকো মাকি বা কেঞ্জো টাঙ্গের মত স্থপতিদের কাজ চোখে পড়ে যায়, নাহয় দেখে নেয়া যাবে।

স্থপতিরা বলেন, তাঁরা রূপ দেন ভবন, আর সেই ভবন রূপান্তর করে মানুষ, সভ্যতা, জনপদ। একথা সত্য ধরে নিলেও হালের স্থাপত্যকর্ম দেখে কোন দেশ বা শহরের আবহমানতাকে অনুভব করা দুরহ।

আজকের স্থাপত্যগুলো শত শত বছর পরে গিয়ে হয়ত অন্য কোন পরিব্রাজকের সেই তৃষ্ণা নিবারন নিশ্চয়ই করবে। আমার ইচ্ছে তাই শত বছর আগের স্থাপনার সামনে গেয়ে দাঁড়ানো। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘুরে বেড়ানো। একটা নৌকায় চড়ে নদীর তীর ছুয়েছুয়ে ভেসে চলা। এ’ভাবেই আজকের এই জনজীবনাচারের উৎসকে সেই সময়ের স্থাপনার মধ্য দিয়ে নিবিড়ভাবে অনুভব করা।

মিশরের নীলনদ ধরে তিন দিন চার রাতে লুক্সোর থেকে আসওয়ান যাবার সময় পথে থেমে থেমে প্রাচীন স্থাপনাগুলো দেখে যেতে যেতে ফারাও শাসনামলকে উপলব্ধি করার এমন অনুভূতি হয়েছিল। রাতে জাহাজের ছাদে শুয়ে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকার সময় মনে হতো দুপাশে বত্রিশ শ’ বছর আগের হাম্মুরাবি নাহয় হাটসেপসুটের রাজত্ব অতিক্রম করে চলছি!!

আমার এই ইচ্ছের সাথে আমার ভ্রমনসাথী শাকুরের ইচ্ছে বরাবরই খুব মিলে যায়। এসব ভ্রমনান্তে শাকুর খুবই তথ্যপূর্ণ ভ্রমনকাহিনী লেখে, প্রামান্যচিত্র বানায়। এ’বছর ভ্রমনকাহিনীর জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কারও পেয়েছে সে। আমাদের পঞ্চপর্যটক দলের ও একটা গর্ব।

মূল দল থেকে দু’জন আলাদা হয়ে আমরা টোকিও আর তার আশেপাশের নদী, পাহাড় আর প্রাচীন স্থাপনাগুলোর সন্ধান করে করে সেগুলোতে ছুটে ছুটে যাই। দু’জন মিলে ছবি তুলি। ভিডিও করি। শাকুরের জন্য এসবই তাঁর আগামী সৃষ্টির জন্য বড়ই উপাদেয় মশলা।

যে কোন পুরাতন শহরের ঐতিহাসিক সময়কার সাধারণ জীবনাচরণের উত্তাপ খুঁজে পেতে হলে পুরনো রাজপ্রাসাদ বা যাদুঘর ঘুরে তার খানিকটা হয়ত মিলে। কিন্তু তার সাথে কল্পনার মিশেল ছাড়া পূর্ণাঙ্গ চিত্র পওয়া যায় না। সেটা পেতে হলে যেতে হয় সেই শহরের পুরনো বাজারে, প্রাচীন লোকালয়ে, নদীর পুরনো ঘাটে অথবা প্রাচীন বানিজ্যিক বন্দরে।

ঢাকার চকবাজার, দিল্লির চাঁদনিচক, গ্রীসের প্লাকা, মিশরের খান-এল-খলিলি, আমিরাতের সুক ঘুরে আমার তেমনটাই মনে হয়েছে।

এর একটা কারণ হয়ত, রাজপ্রাসাদ ক্ষমতাকেন্দ্রীক বিধায় ক্ষমতাহীন সময়ে তার বৈভব থমকে যায়। কালের আবর্তে তার অবয়ব থেকে পুরনো পলেস্তরার মত খসে পড়তে থাকে আরোপিত জৌলুশ আর প্রতাপ প্রতিপত্তির উষ্কে দেয়া বিভা। প্রাসাদের জীবন দক্ষিণাপ্রলুব্ধ চাটুকারের লেহনে মসৃন থাকে বিধায় দানের অবর্তমানে জিহবা যখন সিক্ততা হারিয়ে ফেলে, অক্ষমতার হিম চারপাশ ঘিরে ধরে, প্রাসাদ কুশিলবেরা সেই বিশুষ্কতায় প্রাণ হারান।

পক্ষান্তরে একই সময়ে সেই জনপদের বাজার গড়ে উঠে জনমানুষের নিত্যদিনের জীবনোভ্যাস, জীবন স্পন্দন ও পারস্পরিক নির্ভরতার উপর ভিত্তি করে। সমাজবদ্ধ মানুষের এই অভ্যাস, এই নির্ভরতার ভিত যাপিত জীবনের নিত্যাকাংখা, পাওয়া, না পাওয়া, স্বপ্ন ও সাধনার গভীরে প্রথিত থাকে বিধায় সময়ের পরিবর্তনে বিলুপ্ত না হয়ে বরং বিকশিত হতে থাকে পরম্পরায়।

এই টিকে থাকার শক্তি সে সঞ্চয় করে প্রবাহমান জীবনের অন্তর্গত ও অবিচ্ছেদ্য নানা চলমান উৎস থেকে। সময়ের বিবর্তনেও কোন জনপদের হাট-বাজার বা সাধারণ মানুষের লোকালয় তাই অতিত ও বর্তমানের মধ্যে এক জীবন্ত সেতু বন্ধন।

ঢাকার শাঁখারীপট্টি বা তাঁতিবাজার ঘুরে মুঘল ঢাকার নাগরিক জীবনের যে উপলব্ধি এখনও পাওয়া যায়, আহসান মঞ্জিল ঘুরে তার কিছুই তেমন পাওয়া যায় না।

পৃথিবীর নানা দেশে আনা অঞ্চলে পুরনো বাজারগুলোতে গেলে সেখানকার পুরাতন জীবন, সংস্কৃতি ও জীবনাচারের একটা গন্ধ এসে এসে নাকে লাগে। মনে হয় একটা পুরনো পাতলা আবরণের ঢাকনা আলতো করে উঠিয়ে তার নীচে স্বযত্নে লুকিয়ে রাখা সেই অতিত সময়ের অঙ্গনে পৌঁছে যাওয়া গেল!

জাপান ভ্রমণে গিয়ে টোকিওর ‘নাকামিসে’ বাজারে গিয়েও সেই একই অনুভূতির পুনরাবৃত্তি হলো।

নাকামিসে বাজার গড়ে উঠেছে আসাকুসা এলাকায়, টোকিওর সবচে’ পুরনো ‘সানসোজ’ মন্দিরে যাবার পথের দুপাশ ধরে। মূল এই পথ আগে কত দীর্ঘ ছিল জানিনা। এখন এটা মাত্র ২৫০ মিটার লম্বা। নাম নাকামিসে-ডোরি।

প্রায় ১২০০ বছরের প্রাচীন এই মন্দিরে আগত অতিথিদের একসময় যেসব স্থানীয়রা অভ্যর্থনা জানাতেন, খাদ্য ও পানীয় দিয়ে সাহায্য করিতেন, তাঁদেরকেই পরবর্তিতে মন্দিরের রাস্তার দুই পাশে দোকান করার অনুমতি দেয়া হয়। বংস পরম্পরায় এঁরাই আজও নাকামিসেতে তাঁদের দোকানগুলো নিয়ে টিকে আছে।

মন্দিরের পথের শুরুতেই একটা বিশাল তোরণ। জাপানিরা বলে ‘কামিনারিমন’ যার অর্থ হলো বজ্রতোরণ। ৯৪১ সালে জাপানি সামুরাই কিনমাসা বৌদ্ধ স্থাপত্য আদলে এই তোরণ তৈরী করেন। এই তোরণের মাঝখানে ঝুলানো আছে কাগজের মণ্ড দিয়ে বানানো বিশাল এক ঝারবাতি। তার গায়ে লাল আর কালো রঙের চিত্রে বজ্রপাতের চমক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই তোরণের পরেই নাকামিসে-ডোরি যার দুইপাশে সেই পুরনো আমলের দোকান। আর দোকানের পরেই সানসোজ মন্দির চত্বর।

নাকামিসে-ডোরি’র একদিকে ৫৪ অন্যদিকে ৩৫ টা দোকানে জাপানের শতবছরের ঐতিহ্যবাহী প্রায় সব পণ্যের বাহারী পসার লক্ষণীয়।

রাত আটটার পর দোকানগুলি বন্ধ হয়ে গেলে নাকামিসে-ডোরি যেন আরেক অভূতপূর্ব রূপে আবির্ভূত হয়। এই ডোরি যেন প্রাচিন জাপানের কাহিনীচিত্র এক প্রদর্শনী গ্যালারিতে পরিনত হয়!

দোকাএর ঝাপ বা সাটারের উপর প্রাচীন জাপানের এই রাস্তা ঘিরে ঘটে যাওয়া নানা কাহিনীচিত্র জলরঙ ও রেখায় এঁকে রাখা হয়েছে। গভীর রাত পর্যন্ত মন্দিরে আসা দর্শকেরা সেই চিত্রপ্রদর্শনী উপভোগ করতে পারেন।

বিদেশী পর্যটকরা তো বটেই, অনেক জাপানিরাও এখানে এসে ঐতিহ্যবাহী কিমোনো পোষাক সারাদিনের জন্য ভাড়া করে তাই পরে মন্দির এলাকায় ঘুরে বেড়ান, ছবি তুলেন, আর কেনাকাটায় মগ্ন থাকেন।

আধুনিক জাপানের এই একটুকরো জানালা দিয়ে প্রাচীন জাপানের গন্ধমাখানো হাওয়া এসে একটা অজানা জনপদের গল্প গাঁথা আর ভুলে যাওয়া গান সবার কানেকানে বাঁজিয়ে শুনায়।

ওসাকার হারবারে বসে রাতের বেলা ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিল ওরা। সখের বসে। ছোট একটা দল। দু’জন জাপানি, চার জন ফিলিপিনো আর একজন কম্বোডিয়ান।

আমরা কজন সন্ধ্যায় এসেছিলাম স্থপতি তাদাও আনদো’র ডিজাইন করা সান্তরি মিউজিয়াম দেখতে। সকাল থেকেই ঘুরছি বিধায় সবাই ক্লান্ত। রাত ন’টার দিকে আমি আর শাকুর বাদে সবাই হোটেলে ফিরে গেলো। আমরা গিয়ে উঠলাম ওসাকার ফেরিস হুইলে। উদ্দেশ্য রাতের ওসাকার স্কাই লাইনের ছবি তুলবো।

হুইল থেকে নেমে হারবার কিনারা ধরে হেঁটে আসতে আসতে ছোট এই দলটাকে দেখি মাছ ধরছে। সিগারেট ধরাবার জন্য শাকুর গিয়ে একটা দেশলাই চাইতেই একসাথে দুই তিনজন মহা আগ্রহে লাইটার বাড়িয়ে ধরল!! ব্যাস পুরো দলের সাথে আমার আর শাকুরের সখ্যতা হয়ে গেল।

তারপর উদ্দেশ্যহীন আলাপে মেতে উঠলাম সবাই। হাসি, ঠাট্টা, হইহুল্লোড়, ধর্ম, সমাজ আর নানা রিচুয়াল নিয়ে আলাপ, আর আরো পরে সবাই মিলে কোরাসে গান। মনে হলো সবাই কতদিনের পুরনো পরিচিত!

একটু আলাপে পৃথিবীর সব দেশের সাধারন মনুষ কত সহজেই পরস্পরের কাছে চলে আসে। বন্ধু হয়ে যায়!

ওসাকার উপকন্ঠে ‘ইবারাকি’ একটা ছিমছাম ছোট্ট পাড়া। জাপানের অন্যসব আবাসিক এলাকার মত এটাও ভীষন গুছানো, পরিচ্ছন্ন, প্রশান্ত। কিন্তু স্থপতিদের কাছে এই পাড়াটা বিখ্যাত হয়েছে তাদাও আন্দোর নক্সায় নির্মিত খুবই ছোট্ট অথচ দারুন নান্দনিক এক চার্চের কারণে।

জাপান ভ্রমনে আসা স্থপতিরা দলে দলে আসেন এই চার্চ দেখতে। পাড়ার মানুষেরা এইসব মুগ্ধ দর্শনার্থীদের পছন্দ করেন। সহযোগিতা করেন। খুবই মিশুক স্বভাবের। ভাষার বোধগম্যতা থাকলে হয়ত দুটো মনের কথাও বলা হতো।

এঁদের কেউ কেউ অবশ্য ইংরেজি পারেন। এমন একজন বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের পথ চিনিয়ে এই চার্চের কাছেনিয়ে এলেন। পুরোহিতের সাথে কথা বলে ভিতরে ঢুকার বন্দোবস্ত নিশ্চিত করে তবেই ‘হ্যাভ আ নাইস ভিজিট’ বলে বিদায় নিলেন।

চার্চ দেখে ফিরার পথে চোখে পড়ল পাড়ার মানুষদের পারস্পরিক হৃদ্যতা বিনিময়ের নানা খন্ডচিত্র।

মাকি মাকি

জাপানি স্থপতি ফুমিহিকো মাকি এই সেপ্টেম্বরে নব্বইতে পা দিলেন। এ’মাসেই  টোকিওতে অনুষ্ঠিত এশিয় স্থাপত্য কংগ্রেসের চতুর্থ দিনের (১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮) মূল বক্তা ছিলেন তিনি। মিলনায়তন ভর্তি স্থপতিদের সামনে নিজেই উপস্থাপন করলেন তাঁরা বিশাল কর্ম নিদর্শনের সামান্য কিছু অংশ।

মাকি স্থাপত্যে স্নাতক হন টোকিও ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৫২ সালে। পরবর্তী বছর তিনি অধ্যয়ন করেন মিশিগান ক্রানব্রুক স্কুল অব আর্টে। ১৯৫৪ সালে মাস্টার্স করেন এমআইটি থেকে। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন বিখ্যাত স্থাপত্য ফার্ম স্কিডমোর, ওউইংস ও মেরিল (এসওএম) এ। উল্লেখ্য, এই ফার্মে একই বছরে যোগ দেন বাংলাদেশের গর্ব, আকশচুম্বী ভবনের যুগান্তকারী কাঠামো উদ্ভাবক, প্রকৌশলী এফ আর খান।

ষাটের দশকের শুরুতে মাকি আরো কিছু জাপানি স্থপতি যেমন কেঞ্জো টাঙ্গ, কিওনোরি কিকুটাকে, কিশো কুরোকাওয়া এঁদের সাথে জড়িয়ে পড়েন জাপানের বিখ্যাত ‘মেটাবোলিজম’ স্থাপত্য আন্দোলনে। যোগ দেন মেটাবোলিস্ট স্কুল অব আর্কিটেকচার-এ। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল জাপানের ক্রম বর্ধিষ্ণু শহরগুলোর ক্রমবর্ধমান ব্যবহারিক সমস্যাসমূহের একটা উপযোগী স্থাপত্যিক সমাধান খুঁজে বের করা।

মানুষের বয়স ও আকৃতি বৃদ্ধির সাথে সাথে তার অবয়ব বিকৃত না করে যেমন আপনাতেই বদলে যায় তার বিপাকতন্ত্র, মানুষের বসবাসের চাহিদা বৃদ্ধি ও ধরণের পরিবর্তনকেও একই প্রক্রিয়ায় স্থাপত্য যেন ধারণ করতে পারে, নগর যেন সংকুলান করতে পারে, ভবন যেন এক নান্দনিক শৈলীতে আপন কলেবর বৃদ্ধি করে ঠাঁই দিতে পারে সময়ের সাথে মানুষের বর্ধিষ্ণু চাহিদাকে এই উপায় উদ্ভাবনে নানা পরীক্ষায় মেতে উঠেন জাপানের এই স্থপতিবৃন্দ।

টোকিওতে মাকির নক্সায় হিলসাইড টেরাস এপার্টমেন্ট এই মেটাবোলিজম স্থাপত্য চিন্তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আধুনিক নির্মান উপকরণ যেমন স্টিল, কনক্রিট আর গ্লাস ব্যবহার করে বানানো এই ভবন ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে বহুপর্যায়ে নির্মিত হয়!

আধুনিক স্থাপত্যে মেগা স্ট্রাকচারের আধিপত্যের বিপরীতে মাকি’র নক্সাকৃত আধুনিক ভবন কাঠামোগুলো আকৃতিতে মানুষের উপলব্ধি বান্ধব, গম্যতায় সহজ, ছোট বড় বৈচিত্রময় পরিসর ঘিরে রচিত ও সম্ভাব্য ক্ষেত্রে উদ্যান কেন্দ্রিক যা কিনা জীবন ঘনিষ্ট বসবাস ও সনাতন মানবিক স্থাপত্যের সাথে দারুনভাবে সঙ্গতিপূর্ণ! বর্তমান স্থপতিদের কাছে মাকি তাই এক অত্যাধুনিক অথচ মানববান্ধব স্থাপত্য রচনার একজন অনুকরণীয় স্থপতি।

স্থপতি মাকি তাঁর কাজের জন্য ১৯৯৩ সালে স্থাপত্যে নোবেল হিসেবে খ্যাত প্রিটজকার পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক স্থাপত্য সংঘের স্বর্ণপদক সহ এআইএ স্বর্ণপদক ও অন্যান্য নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর নিউইয়র্কের গ্রাউন্ড জিরোতে ২০১৩ সালে নির্মিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টাওয়ার-৪, নির্মিতব্য নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নতুন ভবন ও ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের ক্যাপিটাল সিটি মাকি’র উল্লেখযোগ্য কাজের এক বহুলালোচিত উদাহরণ।

মাকি যখন শ্রোতা

১৩ই সেপ্টেম্বরে মেইজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুরুগাদা ক্যাম্পাসে দুপুর দেড়টায় ছিল মাকির বক্তৃতা। গ্যালারিতে বসে মুগ্ধ হয়ে সবাই তার উল্লেখযোগ্য চমৎকার সব কাজগুলোর উপস্থাপনা উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে তুলনামূলকভাবে খানিকটা তাঁর নিরস বক্তৃতাও সবাই মিলে হজম করলাম।

বিকেলের দিকে হেঁটে ক্যাম্পাসের কাছেই ওচানোমিযু স্টেশনে এসেছি আমরা ক’জন স্থপতি। উদ্যেশ্য, মেট্রো ধরে টোকিও স্টেশন যাব আমাদের রেইল পাসগুলো একটিভেট আর পরদিনের জন্য ওসাকার বুলেট ট্রেনের আসন রিজার্ভ করা।

আকাশ মেঘলা। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কেমন অলস লাগানো আবহাওয়া। যত গুরুত্বপূর্ণ বা আকর্ষণীয়ই হোক, বক্তৃতা শুনে ঘুম পায় না এমন বাঙ্গালী বিরল। স্টেশনে আসা আমাদের অনেকের চোখেই সেই চিহ্ন স্পষ্ট।

একজন লোকাল টিকিটের খোঁজ নিতে কাউন্টারে গেছে। বাকিরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। এরই মধ্যে স্থপতি জগলুল ভাই এক অভাবিত দৃশ্যে অবাক বিষ্ময়ে চিৎকার শুরু করলেন!

স্থপতি ফুমিহিকো মাকি, এশিয় স্থাপত্য কংগ্রেসের আজকের প্রধান বক্তা, নব্বই বছরের প্রবীণ আমাদের পাশ দিয়ে ছাতা ভাঁজ করতে করতে গটগট করে হেঁটে আন্ডারগ্রাউন্ড প্লাটর্মে নেমে যাচ্ছেন ট্রেন ধরবেন বলে! একা!!

এমন একটা আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে আমন্ত্রিত হয়েই তিনি বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন, বক্তৃতা দিয়ে ফিরেও যাচ্ছেন। অথচ সঙ্গে নিজস্ব গাড়ি নেই, ড্রাইভার নেই, আয়োজকদের সেবক, সাহায্যকারী সাথী কেউ নেই! অবশ্য তেমন কিছুর যে আবশ্যকতাও নেই সেটা আমরা জাপানে অবস্থানের এই পাঁচ দিনেই বুঝে ফেলেছি! এ শহর সব বয়সের মানুষকে কেবল গতিই দেয়নি, দিয়েছে স্বাধীন, নিরাপদ ও সহজ গম্যতা।

এই দৃশ্য আমাদের দেশে আমরা দেখেতে তো মোটেই অভ্যস্ত না। এমন একজনকে এভাবে একা ছাড়া আমাদের কাছে একটা গর্হিতও কাজও বটে! এমন বর্ষিয়ান কেউ আমাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এলে তাঁকে গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে আসা, হাত ধরে আসনে বসানো থেকে শুরু করে তাঁর সার্বক্ষণিক তত্বাবধানে আমাদের অকুণ্ঠ নিবেদনের অনুপস্থিতি একেবারেই অকল্পনীয়।

এমন দৃশ্যে যুগপৎ দুটো বিষয় আমাদের ভীষন অভিভূত করলো।

এক, নব্বই বছর বয়সের একজন মানুষের এমন সাবলিল চলৎক্ষমতা, সাধারণ জীবনাচরণ আর স্বনির্ভরতার আত্মবিশ্বাস।

দুই, জাপানের বিরাজমান জনবান্ধব, বয়সবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা।

খানিকপরে টিকিট নিয়ে আমরাও নামলাম আন্ডারগ্রাউন্ড প্লাটফর্মে। অফিস ছুটি হয়ে এসেছে। স্টেশনে বেশ ভিড়। টোকিওর সকাল ও বিকেলের ট্রেনের বিখ্যাত ও অকল্পনীয় ভিড়ের নানা দৃশ্য ইউটিউবে দেখতে পাওয়া যায়। পিক আওয়ারে জনস্রোতে ভাসিয়ে নিজেকে ট্রেনের কামড়ায় প্রায় চালান করে দেয়া এখানে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

দুই মিনিটের মধ্যেই ট্রেন এলো। তাতে একরকম ঠাসাঠাসি করে উঠার সময় খাবি খেতেখেতে নিজেকে মাকি’র বয়সী ভাবতে আর সাহসে কুলালো না!!

ক্রাশ যখন তাদাও আনদো

এশিয় স্থপতিদের এ’মাসে অনুষ্ঠিত জাপান কংগ্রেসে আংশ নেয়া শতাধিক বাংলাদেশী স্থপতি ও স্থাপত্যের ছাত্রছাত্রীদের ‘ক্রাশ’ ছিল জাপানি স্থপতি তাদাও আনদো এবং তাঁর অসাধারণ সব কাজ।

ছোটছোট গ্রুপে ঘুরে বেড়ানো আমাদের দলগুলির প্রত্যেকের ভ্রমন তালিকায় স্থান করে নিয়েছিল টোকিও, ওসাকা বা কিওতোর নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা স্থপতি আনদোর ছোট বড় উল্লেখ্যযোগ্য নানা স্থাপত্যকর্ম। বর্তমান ও হবু স্থপতিগন সেই কাজগুলি দেখে একধরনের প্রশান্তির অনুভবে ভাসিয়ে দিয়েছেন নিজের কান্তি ও ক্লান্তি। অনুপ্রাণিত হয়েছেন। বিমুগ্ধ, বিহবল ও সমৃদ্ধ হয়েছেন নিজের চিন্তায় ও সৃজনকল্পনায়।

স্থাপত্যের ভিতরে ও বাহিরে যথার্থভাবে ঠিক এই অনুভবের ক্ষেত্রটুকু সৃষ্টি করতে পারাটাই হচ্ছে স্থপতি তাদাও আনদোর কাজের অন্যতম সাধনা ও সফলতা।

আনদোর সৃষ্ট স্থাপত্য সাধারনভাবে সহজবোধ্য, সরল, স্পষ্ট এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি বন্ধুসুলভ। এই বিরল শৈলী তিনি অর্জন করেছেন নিজের চিন্তার স্বচ্ছতা ও বলিষ্ঠতা থেকে এবং যার অনুপ্রেরণা তিনি সংগ্রহ করেছেন দিনের পর দিন অপরাপর গুরু স্থপতিদের বিখ্যাত অথচ আপাতঃ আটপৌরে সব কাজের সৌন্দর্য্য মন্থন করে।

জাপানের অসংখ্য স্থাপত্যের স্থপতি তাদাও আনদোর জন্ম ১৯৪১ সালে। আনদো কখনোই কোন প্রথাগত স্থাপত্যের ছাত্র ছিলেন না। অন্তর্গত শিল্প সুষমা যার থাকে তার জন্য প্রথাগত শিক্ষা জরুরীও নয়। শিল্পের নানা শাখায় সফল অনেক শিল্পীর ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য।

যৌবনের শুরুতে তিনি যখন একজন মুষ্টিযোদ্ধা এবং কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, নিজের জন্মস্থান ওসাকা থেকে টকিওতে এসেছেন বেড়াতে। উঠেছেন টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলে। বলা যায় এই হোটেলে উঠার ঘটনাটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

ইম্পেরিয়াল হোটেলের স্থাপত্যশৈলী দেখে আনদো একাধারে এতই বিস্মিত, মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত হলেন যে তাঁর অন্তরের সমস্ত বাসনা স্থপতি হবার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে উঠলো! কারোই অজানা নয়, এই হোটেলের স্থপতি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট!

পরবর্তী দুই বছর আনদো তাঁর বক্সিং পেশায় স্তফা দিয়ে এবং হাইস্কুল গ্রাজুয়েশন শেষ করে স্থপতি হবার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। নৈশক্লাসে ভর্তি হয়ে অঙ্কন ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনে তালিম নেয়ার পাশাপাশি স্থাপত্যের পঞ্চগুরুর অনন্য চারজন অর্থাৎ লী করবুসিয়ের, মিজ ভেন্ডার র‍্য, ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট ও লুই কানের নক্সা করা কাজগুলোর যতগুলো সম্ভব দর্শন, নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন ও অধ্যয়নে নিবেদিত হলেন। ১৯৬৮ সালে ওসাকায় ফিরে নিজ ফার্ম প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তিনি একনিষ্ঠভাবে এসবেই বুঁদ হয়ে থাকলেন।

জাপানী স্থাপত্য আর হাইকু

একজন ওসাকান জাপানি হিসেবে আনদোর কাজে জাপানি ধর্ম ও জীবনাচারের প্রত্যক্ষ প্রভাব সুস্পষ্ট। বলা হয়, আনদোর স্থাপত্য হচ্ছে জাপানি ‘হাইকু’ কবিতার মত যেখানে স্থাপনার সৌন্দর্য্য ও সাধারণত্ব প্রকাশের জন্য একটা পরিসর সৃষ্টি করে তার শূন্যতাকেই বিশেষ গুরুত্বের সাথে ত্রিমাত্রিক অবয়বে ফুটিয়ে তোলা হয়। অর্থাৎ নির্মিত স্থাপনা নয়, তার দ্বারা সৃষ্ট পরিসরটাই স্থাপত্য। সেটাই গল্প।

হাইকু হচ্ছে পৃথিবীর সংক্ষিপ্ততম কবিতা। ১৭শতকে চর্চিত তিন লাইনে সতেরোটা (৫-৭-৫) সিলেবলে রচিত এই কবিতার গঠনশৈলী একমাত্র জাপানি ভাষাতেই সম্ভব। অন্য ভাষায় অনুদিত হাইকু তাই তিন লাইনে রক্ষা পেলেও সতেরো সিলেবলর নিয়ম মেনে চলতে ব্যর্থ হয় প্রায়শই।

হাইকুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাতে ঋতুর প্রতি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কের আভাস থাকতেই হবে। এমনকি যখন ব্যক্তিগত আবেগকে কেন্দ্র করে হাইকু লেখা হয়, সেখানেও ঋতুর ইঙ্গিত প্রত্যাশা করা হয় যাতে ব্যক্তির আবেগ আর প্রকৃতির নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তির মধ্যে একটা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়! এভাবেই বিশেষ আবেগ বা অভিজ্ঞতাকে প্রকৃতির মাধ্যমে সার্বজনীন করে তোলা হাইকুর বিশেষ গুন হিসেবে বিবেচিত ও স্বীকৃত।

হাইকু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাপানযাত্রীতে লিখেছেন, “এ ছবি দেখার কবিতা, গান গাওয়ার কবিতা নয়।”

এই যে একটা ভাব কে দৃষ্টির সামনে ছবির মত ফুটিয়ে তুলে সেটার বহুমাত্রিক রূপকে কল্পনায় প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা, তার সাথে জীবনবোধ আর প্রকৃতির একাত্মতাকে মিলিয়ে নেয়া, এখানেই বোধহয় হাইকু পাঠ আর স্থাপত্যের মধ্যে বসবাসের অনুভূতি একসুরে, ছন্দে ও ভাবে অনুরণনিত হয়।

স্থপতি তাদাও আনদোর রচিত খালি পরিসরের আপাত শূন্যতার অন্তরালে সেই পরিসর যাপিত জীবনাচারের যে ভাব, ভাষা, দুঃখ, আনন্দের অনুভূতিকে ধারন করে থাকে এবং দিনের নানা সময়ে, ঋতুর নানা বদলে আলো, আঁধার আর চৌহদ্দির মহিমায় তাই প্রকাশ করে, সেটাই আসলে আনদোর স্থাপত্য।

তাদাও আন্দোর ডিজাইন করা এই গীর্জাটি ঘিরে আমাদের অনেক কৌতুহল ছিল।

মানুষের জীবন ও প্রকৃতিতে বিরাজমান আধ্যাত্মিক ভাব ও সংবেদনশীলতাকে স্থাপত্যের নানা পরিকাঠামো রচনার মধ্য দিয়ে যুগপৎ ধারণ ও সম্পর্কিত করার মাধ্যমে কোন ভবন বা স্থাপনাকে সেটার ব্যাবহারিক উপযোগিতার সাথে সাথে একটা দার্শনিক ও আদর্শিক মাত্রা দেয়ায় আনদোর যে মুন্সীয়ানা তার জন্য তিনি স্মরণীয় এবং অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন নিশ্চিতভাবেই। তাঁর এই দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে ইতোমধ্যেই প্রিটজকার সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

টোকিওতে আমি সহ আমাদের অনেক স্থপতি ছিলেন নিউ ওটানি হোটেলে। কংগ্রেস চলাকালীন সময়ে জাপান স্থপতি ইন্সটিটিউটের অফিসিয়াল হোটেল ছিল সেটা। আবার অনেকেই ছিলেন অনুষ্ঠান কেন্দ্রের আশেপাশের হোটেলে।

কিন্তু যেই হোটেলটা একসময় আনদোর জীবনটাকেই পালটে দিয়ে আজকের স্থপতি তাদাও আনদোর জন্ম দিল, স্থপতি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইটের সেই পেনিনসুলা হোটেল আমরা কেউ দেখতে গিয়েছি বলে জানা নাই। হয়ত এই তথ্যটাই জাপান অবস্থানকালে আমাদের অজানা ছিল।

তবে হাইকু কবিতা নিয়ে যে উৎসাহ জাপান ঘুরে আসার পর নিজের মধ্যে অনুভব করছি, কবিতাগুলো পড়ে হাইকুর রসাস্বাদনের সাথে সাথে আনদোর স্থাপত্যগুলো ঘুরে দেখবার সেই মুহূর্তের যে অনুভূতি, এই দুইয়ের মধ্যে দেখি মিল খুঁজে পাই কি না।

আপাতত এই শরতে সবচে’ পুরনো ও সেরা হাইকু কবি বাশো’র (১৬৪৪-৯৪) একটা কবিতার সাথে নিজের দেখা ফুজি পাহাড়ের অভিজ্ঞতা যে দারুনভাবে মিলে যাচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি!

“শরতের হিমেল বৃষ্টি
ফুজি পাহাড়ের পর্দা করে
তাই তাকে আরো সুন্দর দেখায়।”

গুরুদেব যথার্থই বলেছেন, ‘এ ছবি দেখার কবিতা, গান গাওয়ার কবিতা নয়!’

 

 

 

 

মন্তব্য
Loading...