একজন গরবিণী মায়ের সাথে কিছুক্ষণ

১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে  পাক্ষিক অঙ্গনায় প্রকাশিত সাক্ষাতকার

‘কনিকা’র সোজা সিঁড়িটা সরাসরি দোতলার ড্রয়িং রুমে এসে থেমেছে। ছিম-ছাম সাজানো কামরা। ভেতরে ঢুকতেই তেল রং এর আঁচড়ে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে থাকা রুমির দিকে চোখ পড়তে না পড়তেই মৌন মূর্তিতে গাম্ভীর্যমাখা বেশে জাহানারা ইমাম এসে দাঁড়ালেন। পরিচয় দিতেই বসতে বলে নিজে বসলেন রুমির পেইটিংটির নিচে রাখা সোফাটিতে। যেন স্নেহময়ী মাকে আড়াল করে দষ্টুু বালক তার মায়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

পাশের কামরা থেকে মৃদু স্বরে ভেসে আসছিলো কনিকা বন্দোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র সঙ্গীত। যে ঘরটিতে বসে ছিলাম তার সমস্তটিতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক রকমের পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন। সমস্ত ঘর জুড়ে এক পবিত্র নীরবতা। তার বর্তমান শারীরিক অবস্থা জানার পর আমার কৌতুহল একেবারেই চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কি এ বাড়িতে একাই থাকেন?’

প্রশ্ন শুনে কটমট দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর খানিকটা অনুযোগের স্বরে বলেন, ‘কেন, একজন পুরুষ যদি একা থাকেন, তাকে তো জিজ্ঞাসা করা হয় না একা থাকেন কি না?  তবুও বলছি শুনুন, হ্যাঁ এ দোতলায় আমি একাই থাকি, নিচতলায় আমার ভাসুর, ছেলে-বৌ-বাচ্চা নিয়ে আছেন।’

তারপর নরম গলায় বললেন, ‘প্রধানতঃ লেখালেখি করেই আমার সময় কাটে। বই পড়ি, পত্রিকা পড়ি, তাছাড়া ঢাকায় আমার আত্মীয়-স্বজন আছেন, তাঁদের সাথে যোগাযোগ রাখি, ৭১ এ রুমির সাথে যারা যুদ্ধ করেছিল এদের যারা বেঁচে আছে তারা অনেকেই আসে। বিচিত্রার শাহাদাৎ চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, চিন্ময় মুৎসুদ্ধি আমাকে মা বলেই ডাকে, ওরা আসে। এছাড়া বাংলা একাডেমী আছে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড আছে, সেখানে যাই, আমার সময় কেটে যায়।’

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বীরপ্রসবিনী লেখিকা জাহানারা ইমাম।

জাহানারা ইমামের জন্ম ৩রা মে, ১৯২৯ সালে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের এক মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারে। ম্যাজিস্ট্রেট পিতার সাথে ছোটবেলা কেটেছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরে। তাঁর আত্মজীবনী (প্রথমখন্ড) ‘অন্য জীবন’ এ বিধৃত বর্ণনানুযায়ী জুডু (জাহানারা ইমামের পারিবারিক ডাক নাম) নামের কিশোরী বালিকা অন্যসব সনাতনী গেঁয়ো কিশোরীদের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। বালিকা জুডু কুড়িগ্রাম শহর জুড়ে সাইকেল চালাতো, বাম রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ‘মুকুল ফৌজ’ সংগঠনের সাথে কাজ করতো, বাবার সংগ্রহে রাখা দেশী বিদেশী পত্রপত্রিকা পড়তো। ক্লাস সেভেনে পড়ার শুরুতে সাহিত্যপাগল গৃহশিক্ষকের দ্বারা তার বিশ্বসাহিত্যের পাঠ। ঐ বয়সেই পরিচিত হন টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি, ভিক্টোর হুগো, শেক্সপিয়র, বার্নাড শ’ প্রমুখ মহিয়ান সাহিত্যিকদের অনুবাদকর্মের সাথে।

সপ্তম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে অটো প্রমোশন পাওয়া কিশোরীকে তার বিদ্যানুরাগী পিতা মেট্টিকের বই কিনে দেন। সেসময় জাহানারার মেজো চাচা তাঁর অনুজকে চিঠি লিখেন-

“শুনিলাম তুমি শ্রীমতী জাহানারাকে ম্যাট্টিক ক্লাসের বইপত্র কিনিয়া দিয়াছ। আমার মতে ইহা অত্যন্ত বেশরিয়তী কাজ হইয়াছে। স্ত্রীলোকদিগকে অধিক লেখাপড়া শিখাইলে তাহারা বেহায়া ও বেপর্দা হইয়া যায়… (অন্যজীবন, পৃষ্ঠা-৮৭)”।

এ চিঠি লেখা মানসিকতার সনাতনপন্থী আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বাধা এলেও শিক্ষা জীবনে ফাটল ধরেনি।

এরই মধ্যে জাহানারা তাঁর আপন গতিতে এগিয় চলেন। পারিবারিক যোগাযোগেই এক সময় ভালোবাসার মানুষ প্রকৌশলী শরীফ ইমামকে বিয়ে করেন। বিবেচক ও বিচক্ষণ স্বামীসহ একসঙ্গে শুরু হয় জাহানারা ইমামের ব্যক্তিত্বময় জীবন-যাপন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক জাহানারা ইমাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৪-৬৫ সালে ফুলব্রাইট স্কলার হিসাবে এবং ১৯৭৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণও দিয়েছেন দুবার। স্বামী ও দু’সন্তান রুমি ও জামিকে নিয়ে এক সময় তার সুখঘন পরিবার ছিলো আনন্দে বিভোর। মুক্তিযুদ্ধে রুমি ও স্বামীকে হারিয়েছেন। ছোট ছেলে জামিকে আমেরিকা পাঠিয়ে দেশে নিঃসঙ্গ (যদিও তিনি স্বীকার করেন না) জীবন-যাপন করছেন।

লেখিকা হিসাবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ‘মুকুলের ফৌজ’ এ মুকুল থাকাবস্থায় স্কুলে পড়ার সময়ে।

লেখালেখি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই বলেন, “আমি নিয়মিত লেখক নই। ছোটবেলা থেকেই ও ব্যাপারে আমি খুব আলসে ছিলাম। আড্ডাবাজ মানুষ বলে লেখালেখির কস্ট করতে চাইতাম না। কিন্তু ইচ্ছেটা সব সময় ছিলো।” ষাটের দশকে এসে তেপান্তরের ছোট শহর, নদীর তীরে ফুলের মেলানগরী নামে তিনটি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার এযাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে গজ- কচ্ছপ, সাতটি তারার ঝিকিমিকি, এ্যান ইন্ট্রোডাকশান টু বেঙ্গলী ল্যাংগুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার, বীর শ্রেষ্ঠ, অন্যজীবন, একাত্তরের দিনগুলি, চিরায়ত সাহিত্য প্রভৃতি।

জাহানারা ইমাম সর্বাধিক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ‘সাপ্তাহিক সন্ধানী’তে ধারাবাহিকভাবে লিখিত এবং পরে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত দিনলিপি একান্তরের দিনগুলির জন্যে।

“…রুমির সাথে ক’দিন ধরে খুব তর্ক বিতর্ক হচ্ছে। ও যদি ওর জানা অন্য ছেলেদের মত বিছানায় পাশবালিশ শুইয়ে বাবা-মাকে লুকিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে চলে যেত, তাহলে একদিক দিয়ে বেঁচে যেতাম। কিন্তু ঐ যে ছোটবেলা থেকে শিখিয়েছি লুকিয়ে বা পালিয়ে কিছু করবে না। নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়েছি। রুমি আমাকে বুঝিয়েই ছাড়বে, সে আমার কাছ থেকে মত আদায় করেই ছাড়বে।

কিন্তু আমি কি করে দেই? রুমির কি এখন যুদ্ধ করার বয়স? এখনতো তার লেখাপড়া করার সময।…

…আম্মা, দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মত অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রী নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হব কিন্তু বিবেকের ভ্রæকুটির সামনে কোনদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?…..

… আমি জোরে চোখ বন্ধ করলাম, না তা-চাইনে। ঠিক আছে, তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানী করে। যা, তুই যুদ্ধে যা।…” (একাত্তরের দিনগুলি

এই আশির্বাদ দিয়ে যুদ্ধে পাঠিয়ে বুকে পাথর বাধেন মা। তারপর দেশ স্বাধীন হয়। রুমির সাথে যুদ্ধে যাওয়া তার বন্ধুরা ফিরে আসে। রুমি আসে না। তার পিতাও না। তিনি জানেন তারা আর কখনো আসবেও না। তারা গত।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ডাইরীর আকারে ঘটনাপুঞ্জ লিখে শেষ করেছেন ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এনে। দেশ তখন স্বাধীন হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার ১৯৭১ তার দিনপুঞ্জিতে লেখা হয়।

“… আজ ভোরে বাসায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হল।… ২৫ মার্চের যে ফ্ল্যাগ পোস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আবার নামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেই ফ্ল্যাগের পোলটাতেই আজ আবার সেদিনের সেই পতাকাটাই তুললাম। সবই কাঁদতে লাগলেন। আমি কাঁদতে পারলাম না।” (একাত্তরের দিনগুলি)

মেক্সিম গোর্কির বিশ্বনন্দিত উপন্যাস ‘মা’র দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠাতেই দেখা যায় মার আর কান্না আসে না। হৃদপিন্ডটা শুকিয়ে যেন কুঁকড়ে গেছে। এমন অবস্থায় সন্ধ্যে বেলা জারের পুলিশ এলো। মা অবাকও হলেন না, ভয়ও পেলেন না। সেই মা চরিত্রের অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছে রুমির মায়ের চরিত্রে। সম্ভবতঃ এ জন্যেই জাহানারা ইমামকেও অনেকে গোর্কির সেই ‘মা’ বলেই ডাকতে ভালোবাসেন।

জিগ্যেস করলাম- ‘আপনাকে যখন কেউ বাংলাদেশের গোর্কির মা বলেন, আপনার কেমন লাগে?’

জবাবে বিনম্র ভঙ্গিতে বলেন- ‘আমি বুঝি আমাকে সম্মান দেখানোর জন্যেই অনেকে বলেন। ভালো লাগে। তবে গোর্কির মার চেয়ে রুমির মা সম্বোধনটাই আমার অনেক প্রিয়।’

জাহানারা ইমাম আর এখন স্বাভাবিক স্বরে কথা বলতে পারেন না। কেমোথেরাপির পর জিহবাটা সামান্য বেড়ে গিয়েছে। ১৯৮২ সালে নিচের চোয়ালের সব কটি দাতই ফেলে দিতে হয়েছিল। মাথার চুল সবটুকু পড়ে এখন গজাতে শুরু করেছে। কথা বলার সময় তাই ছবি না তোলার অনুরোধ জানান। এক ফাঁকে তার কটি  স্থিরচিত্র ধারণ শেষে তিনি চা নিয়ে এলেন। কাগজের কাপে চা। দ্বিগুণ বেতন ও সুযোগ সুবিধা দিয়েও কাজের লোক এসে টেকে না বলেই কাপ ধোয়ার ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্যে এ ব্যবস্থা। নিজে খেলেন পাইপ দিয়ে টেনে। এখন আর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কোনো পানীয় খেতে পারেন না। জানালেন আমেরিকান ডাক্তারের কাছে এ বছর জুন জুলাইর দিকে আরেকবার গিয়ে কেমোথেরাপি দেবেন। চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম – ‘একাত্তরের দিনগুলি যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে আপনার ডাইরী কি সেভাবেই লেখা ছিল?’

‘আসলে ডাইরী লেখার অভ্যাস আমার ছিলো। একাত্তরের মূল ঘটনাগুলো আমি আমার নিজস্ব সাংকেতিক ভাষায় লিখে রাখতাম যাতে কেউ বুঝতে না পারে। তারপর যখন এটা প্রকাশের জন্য লিখতে শুরু করলাম তখন সব ঘটনার বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি লাইব্রেরী থেকে সে সময়ে প্রতিটি দৈনিক থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি। আমার ইচ্ছা ছিলো পাঠকরা যেন পূর্ণাঙ্গ তথ্য সেখানে পান।’

‘প্রকাশিত তথ্যসমূহের সত্যতা সম্পর্কে কি আপনি নিশ্চিত?’

‘শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিত না হয়ে আমি কোনো তথ্য প্রকাশ করিনি। এমনও হয়েছে কোথাও তিনটা ছেলে একটা অপারেশনে গিয়েছিল। আমি তাদের তিন জনকেই ডেকে আলাদা আলাদা ইন্টারভিউ নিয়েছি, তাদের কথা রেকর্ড করে রেখেছি এবং সেখান থেকে মূল সত্যটি বের করেছি যাতে মানুষের স্মৃতি তার সাথে বিট্রে করতে না পারে।’

‘এমন কোনো ঘটনা কি আপনার ডাইরীতে ছিলো যা প্রকাশের সময় বাদ দিয়েছেন?’

‘একেবারে বাদ কিছুই দেইনি। তবে কোথাও কোথাও সংক্ষিপ্ত করেছি। যেমন পীরদের কাছে যেতাম। তাদের কথা ডিটেল লেখার দরকার মনে করিনি, কিন্তু উল্লেখ করেছি।’

‘একাত্তরের দিনগুলি’ প্রকাশের পর আপনি সাধারণ জনগণের কাছ থেকে কি রকম সাড়া পেয়েছিলেন?

‘সাড়া আমি অতিমাত্রায়ই পেয়েছি। সন্ধানীতে যখন প্রথম বেরোয় তখন অনেকই সন্ধানীতে ফোন করতো, জানতে চাইতো কবে বই হয়ে বেরুবে। তাছাড়া তোমাদের বয়সী অনেক ছেলে মেয়েই দেখা করতে আসে-। এতোটা সাড়া পাবো আমি ভাবিনি।’

‘এবার একটু ভিন্ন প্রেক্ষিতের প্রশ্ন। আপনার অন্যজীবনে পড়েছি আপনারা খুব রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে আপনার জন্ম। তারপর অনেকটা কাল পার করেছেন বিভিন্ন প্রতিক‚লতার মাঝ দিয়ে। পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই আপনি রাজধানী কেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্থ হন। আমার প্রশ্ন হচ্ছেÑ বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে আপনার সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?’

‘এ মুহ‚র্তে আমি কোনো মূল্যায়নই করবো না, আমি কেবল মাত্র পর্যবেক্ষণ করছি। আমার এই উপলব্ধিগুলোকে আমি তুলে ধরবার চেষ্টা করছি আমার লেখার মাধ্যমে।’

‘ঠিক আছে, আপনার পর্যবেক্ষণটিই বলুন।’

‘আমার পর্যবেক্ষণের পুরো ফলাফল এখনই দিতে পারবো না। তবে প্রচÐ রকমের পরিবর্তন এবং ভাংচুর আমি লক্ষ্য করছি।’

‘এ ভাঙচুর ভালো না মন্দের লক্ষণ?’

‘ভালোমন্দের বিচার আমি করতে যাবো না। তবে পৃথিবীর সর্বত্রই তা হচ্ছে। এর সঠিক জবাব সমাজ বিজ্ঞানীরা দিতে পারবেন। তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি প্রতি প্রজন্মই ক্রমশঃ পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রবীণরা বরাবরই পরিবর্তনটাকে ভয় পায়। তাদের সে ভয়কে অগ্রাহ্য করে তারা নতুন ধারার প্রবর্তন করে।’

‘বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের সম্পর্কে আপনি কি মত পোষণ করেন?’

‘এদের সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ আশাবাদী। এরা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। তবে হ্যাঁ, কিছু তরুণ প্রথভ্রান্ত। পৃথিবীর সব জায়গায় তা আছে, আমাদের দেশেও আছে। আমাদের তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমন্বিত রাখার জন্য লড়াই করছে, তাদের মধ্যে যারা বিভ্রান্ত তাদেরকেও তারা রুখে দাঁড়াচ্ছে।’

‘যে চেতনা ও আদর্শকে সামনে রেখে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তা কি সঠিকভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌছেছে বলে মনে করেন?’

‘না, তা পৌছেনি। তারও যথেষ্ট কারণ আছে। কতগুলো বিদেশী শক্তির চক্রান্তে সে সব চেতনা বিকশিত হতে পারছে না। তবে এতোসব বিরুদ্ধ স্রোতের মধ্যেও যেটুকু চেতনা মানুষের মধ্যে আছে তাতে আমি খুব আশাবাদী।

জাহানারা ইমাম এখন প্রায় সারাদিনই লেখালেখির মধ্যে কাটিয়ে থাকেন। সাধারণতঃ রাত বারোটায় ঘুমান। যে রাতে ঘুম আসেনা, সেরাতে সারারাত লিখেই কাটিয়ে দেন। জানালেন হাতে কয়েকটা উপন্যাস আছে। প্রায় এক সাথেই সবকটি লিখছেন। লেখালেখির ব্যাপারে তিনি খুবই খুঁতখুঁতে স্বভাবের বলে জানান। নিজের পছন্দ না হলে কাটাকাটি করে আবার ফ্রেস করে গোড়া থেকে লিখতে শুরু করেন।

বাংলাদেশের লেখিকাদের সম্পর্কে বললেন- “অনেকেই বেশ ভালো লিখছেন সেলিনা হোসেন, রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুন, মাফরুহা চৌধুরী, মকবুলা মনজুর, জুবাইদা গুলশান আরা ভালো উপন্যাস লিখেন। কবিতাতো অনেকেই লিখছেন। প্রবন্ধে হোসনে আরা শাহেদ, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা, খালেদা সালাহউদ্দিন, নয়ন রহমান, এঁদের হাত ভালো। আরো অনেকেই আছেন, সবার নাম মনে পড়ছে না।”

‘ধর্ম সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা?’

‘ধর্ম জিনিসটা ব্যক্তিগত। তবে ধর্মের নামে শাসন ও শোষণ কোনটাই আমি পছন্দ করি না।’

কথা বলতে বলতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়লেন জাহানারা ইমাম। এক সময় অনুরোধ করাতে পুরনো ছবির একটা বান্ডিল এনে দেখালেন। তিনটে ছবি বেছে রাখলাম ফেরত দেবার প্রতিশ্রæতি দিয়ে।

ড্রয়িংরুমের দেয়াল ঘড়িতে দুপুর বারোটা বাজার সংকেত দিল। দু’ঘণ্টা আলাপ করে ক্লান্ত হয়েই পড়ার কথা। খুব বিনীত স্বরে জাহানারা ইমাম বলেন, “আজ শেষ করি, তুমি না হয় আরেকদিন এসো।”

বললাম, আমার শেষ প্রশ্ন- ‘আপনার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা কোনটি?’

তিনি খুব চিন্তিত হলেন। বললেন- ‘একক কোনো ঘটনা তো নেই, অনেকগুলো ঘটনাই স্মরণীয়। তবে মহান এবং পবিত্র মুক্তিযুদ্ধে আমার জীবন জড়িয়ে গেছে এটাই আমার সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা।’

‘আপনার আকাংখা?’

‘যে কয়দিন বাঁচি, শুধু লিখে যাওয়া।’

এবার উঠে আসতে হয়। দোতলা থেকে নেমে নিচতলার সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে স্নেহময়ী জননীর মতো দরদ মাখা গলায় বললেন- “আবার এসো। তোমরা এলে আমার ভালো লাগে।”

কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে পড়লাম। রুমির মার দিকে ফিরে তাকাতে আর সাহস হলো না।

এপ্রিল, ১৯৮৮ সালের  পাক্ষিক অঙ্গনায় প্রকাশিত
মন্তব্য
Loading...