জামিলকথন

জাতীয় অধ্যাপক ডঃ জামিলুর রেজা চৌধুরী স্মরণিকার জন্য লেখা

জামিল স্যারকে (জাতীয় অধ্যাপক ডঃ জামিলুর রেজা চৌধুরী) আমি ঠিক কবে থেকে চিনি, মনে করতে পারবো না। তবে ২০১১ সালে আমার লেখা ৮টি ভ্রমণকাহিনীর সংকলন প্রকাশনার উতসবে প্রধান অতিথি হয়ে যখন অনুষ্ঠানে আসেন, সেদিন তাঁকে আমার সবচেয়ে কাছে থেকে দেখা। এরপর আরো ভালো করে দেখার সযোগ পেলাম যখন ২০১৬ সালে তাঁকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র বানাতে হুকুম দিলো বুয়েট এলামনাই। একুশে পদক প্রাপ্তির সম্মাননা অনুষ্ঠানে আলোর পথযাত্রী নামক সেই প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। এরপরও তাঁকে আরো কয়েকবার আমার ক্যামেরায় নিয়েছি। কখনো তিনি ডেকে নিয়েছেন কোন কিছু রেকর্ড করতে, কখনোবা অন্যরা বলেছে তাঁর কিছু ধারন করে দিতে।

বুয়েট এলামনাই একটা বড় রকমের প্রামাণ্যচিত্র আমাকে দিয়ে বানায় । আমাদের  বুয়েট, আগামীর বুয়েট নামের এই প্রামাণ্যচিত্র বানানোর কাজের জন্য প্রায় ১ মাস একসাথে কয়েকবার আমাদের বসা হয়েছে। ২০১৬ সালে বুয়েটকাল নামে আমার যে স্মৃতিচারণমূলক বই প্রকাশ হয়, তার পেছনের ফ্লাপের জন্য তিনি লিখেও দেন। এরপর প্রথম আলো একবার ঢাকার নগরায়ণ বিষয়ে তাঁর একটা সাক্ষাতকার নিতে আমাকে পাঠায় তাঁর কাছে। সেখানেও তিনি অকুতোভয় অনেক কথা খোলামেলা বলেন। সবশেষে তাঁর সাথে আমার মোলাকাত হয় ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারী । সিলেট মহানগরীতে একটা বড় পরিসরের ডিজাইন করেছে আমাদের প্রতিষ্ঠান। সিলেটের মেয়র ঢাকায় এসেছেন এ বিষয়ে তাঁর মতামত নিতে। তিনি ঢাকার সব বড় বড় স্থপতিদেও নিয়ে এটা দেখে মতামত দেয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন। এই শেষ। আর দেখা হলো না।

২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত কাছাকাছি থেকে তাঁকে যেমন দেখেছি তাতে আমার মনে হয়েছে তা হল ঃ

  • প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারি
  • ছোটবেলা খেলোয়াড় ছিলেন
  • ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যানুরাগী ছিলেন এবং শেষ বয়সেও প্রতিদিন কিছু না কিছু অকারিগরি বিষয়ক লেখা পড়তেন
  • আগাগোড়া মেধাবী
  • শুধু কারিগরি বিষয়ই না, সমসাময়িক যেকোন বিষয়েই তিনি অগাধ জ্ঞান রাখতেন।
  • কোন বিষয়ে বা কারো স¤পর্কে কথা বলতে গেলে আগে তিনি অনেক হোম ওয়ার্ক করে যান।
  • তাঁর বন্ধু কেমন আছে জানি না, তবে তাঁর কোন নিন্দুক আমি খুঁজে পাইনি।
  • তাঁর ব্যক্তিগত সততা কখনোই প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুনিনি।

তাঁর অনেকগুলো কথা আমার কাছে রেকর্ড করা আছে। তাঁর নানা সাক্ষাৎকারে (বেশিরভাগ ২০১৮ সালে নগরায়ণ বিষয়ে প্রথম আলোর হয়ে নেয়া) যেসকল কথা বলেছিলেন এই কথাগুলো থেকে আমাদের শেখারও অনেক কিছু আছে। নানা বিষয়ে কী ছিলো চিন্তা, কী ভাবতেন, তার কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম জামিলকথন শিরোনামে

বিপজ্জনক মহানগরী

১৯৫২ সালে আমরা যখন ঢাকায় আসি, তখন ছিল এটা প্রাদেশিক রাজধানী। জনসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষের মতো। যদিও কিছু সমস্যা তখনো ছিলো, কিন্তু বসবাসের দিক থেকে শান্তিপূর্ণ একটা পরিবেশ ছিলো। ঢাকার অলিগলি আমি ছোটবেলায় হেঁটে বেড়িয়েছি। এই দীর্ঘ ৬৭ বছরে চারবার বাড়ি বদল করে এখন এই ধানমন্ডিতে থাকছি; এর মধ্যে ৬১ বছরই কেটেছে এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায়, যেটা আমার আব্বা নির্মাণ করেছিলেন ১৯৫৪ সালে ধান ক্ষেতের মাঝখানে, অনেকটা গ্রামীণ পরিবেশে। আমার চোখের সামনে দিয়ে একটা পরিচ্ছন্ন নগরকে বসবাসের প্রায় অযোগ্য মহানগরে পরিণত হতে দেখলাম। আমার কাছে মনে হয় এই ঢাকা এখন জনসাধারনের চলাচলের জন্য সবচেয়ে বিপদসংকুল মহানগরীর অন্যতম। আমাদের নগর পরিকল্পনায় ও যোগাযোগব্যবস্থা পরিকল্পনায় পায়ে হাঁটা পথকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটাও বাস্তবায়ন হয় না। ফুটপাত বেদখল হয়ে যায় – পথচারীরা ব্যবহার করতে পারেন না। এসব বিবেচনায়ই ঢাকা একটা বিপজ্জনক মহানগরী বলেই মনে হয়।

অপরিকল্পিত নগর

১৯৫০ দশকের শেষের দিকে  যে মাস্টার প্লান করা হয, এটা ছিল একটা প্রদেশের রাজধানীর জন্য সর্বোচ্চ ২০ লাখ লোকের কথা বিবেচনা করে। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে ঢাকা যখন একটি দেশের রাজধানী হয়ে গেলো এবং খুব দ্রুত গতিতে জনসংখ্যা বাড়তে লাগলো, তখন প্রয়োজন পড়লো নতুন করে নগর পরিকল্পনার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: আমাদের সরকার সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় অপরিকল্পিত নগর হিসাবে ঢাকা গড়ে উঠে। এরপর ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে UNDP-র আর্থিক সহায়তায় ঢাকা মহানগরী উন্নয়ণ পরিকল্পনা (DMDP) প্রণয়ন করা হয়। বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসে এটি প্রস্তুত করে দিয়ে যায়। তাতে ছিল স্ট্রাকচার প্ল্যান ও আরবান এরিয়া প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫)। তারা সুপারিশ করে এর উপর ভিত্তি করে পাঁচ বছরের মধ্যে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু এটা করার উদ্যোগ নিতে নিতে ২০০৪ সাল হয়ে যায়। তখন ৪টি দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ভাগ করে চার এলাকায় কাজটি দেয়া হয়, কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ তাদের কাজের মধ্যে পার¯পরিক সমন্বয় ছিলো না। এই অসামঞ্জস্যতা দূর করার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে আমাকে চেয়ারম্যান করে একটা কমিটি করা হয়, যাদের দায়িত্ব ছিল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রস্তুত করা পরিকল্পনা ও সুপারিশমালা পর্যালোচনা করে সরকারকে একটা রিপোর্ট দেয়া। ৩ মাসের মধ্যে আমরা যে সুপারিশ জমা দিলাম তার মধ্যে আমাদের অন্যতম সুপারিশ ছিল যে, Flood Flow Zone  ছাড়াও Sub-Flood Flow Zone এ পানির গতি রোধ করতে পারে এমন কিছু স্থাপনা থাকতে পারবে না, যাতে নিচে দিয়ে পানির প্রবাহটা নিশ্চিত থাকে। এটা করতে গিয়ে দেখলাম যে, রাজউকই অনেক জায়গায় এই সব Flood Flow Zone দখল করে সেখানে হাউজিং প্রকল্প করে ফেলছে। রাজউক নিজে যেখানে ডেভেলাপ করে সেখানে কারো অনুমতি নেয় না। অর্থ্যাৎ তারাই ডেভেলপার, আর একই সাথে তারাই অনুমোদনকারী সংস্থা বা রেগুলেটর – পরিস্কার ভাবে এটা স্বার্থের সংঘাত।

রাজউক ছাড়াও আমরা বেশ ক’টি শক্তিশালী সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার প্রাইভেট হাউজিং এর অনুমোদন বাতিল করার সুপারিশ করেছিলাম, কিন্তু তারা আবার মন্ত্রণালয়ে লবিং করে , ফলশ্রুতিতে নতুন কমিটি তৈরি করা হলো এই রিভিউর উপর রিভিউ করার জন্য।  তার পরও শেষ পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর নিয়ে আমাদের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা উঅচ সরকারী গেজেটে ২০১০ সালের ২০ জুন প্রকাশিত হলো। কিন্তু এর ৪/৫ দিন পরে আবার একটা গেজেট বেরুলো, সেখানে ড্যাপের রিভিউ করার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করা হলো যেখানে পাঁচ-ছয়জন মন্ত্রী ছিলেন। এটা খুবই বিব্রতকর একটা অবস্থা ছিল। একদিকে বলা হচ্ছে ড্যাপ অনুমোদিত, আরেকদিকে সমান্তরালভাবে রিভিউ করার জন্য প্রভাবশালী মহল চাপ দিচ্ছে।

রাজউক

রাজউক কিন্তু গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এখন মন্ত্রী যদি নির্দেশ দেন এটা করেন, তারা করে ফেলে। তাদের হয়তো দ্বিমত ব্যক্ত করার সুযোগ আছে, ক্ষমতা আছে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন – তারা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই চলেন।

একটা ভবন নির্মানের আবেদনের পর থেকে ইউটিলিটি কানেশনের আগে পর্যন্ত ৪ স্তরে পর্যবেক্ষণ করে রাজউকের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দেয়ার কথা । ২০১৩ সালে রানা প্লাজার ঘটনার পর রাজউক একটা তালিকা দিয়েছিল যে তখন পর্যন্ত তারা ঢাকায় মাত্র ১৮টি বিল্ডিংয়ের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দিয়েছিল। অর্থ্যাৎ আইন বা বিধি আছে, কিন্তু মানা হয় না।  বর্তমানের ইমরাত নির্মাণ বিধিমালায়ও নিয়ন্ত্রণের অনেক কথা লেখা আছে কিন্তু এগুলো কেউ দেখে টেখে না। রাজউকে এখন যে জনবল আছে তাতে ঢাকা মহানগরের যে এত বিল্ডিং হচ্ছে এগুলো প্রত্যেকটা নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা তাদের নাই।

জনবলের অভাব একটা অজুহাত, এটা দেখিয়ে তারা কিছুই করে না। রাজউক যেহেতু এটা করতে পারবে না, প্রায় ৪ বছর আগে আমরা রাজউকের নিয়োগ করা একটি কমিটি থেকে আরেকটা সুপারিশ করেছিলাম যে, রাজউক এটা আউটসোসিং করবে। বাইরের কোয়ালিফাইড কনসালটিং ফার্ম দিয়ে এই কাজ করাবে এবং কনসালট্যান্টরা রাজউক থেকে এর জন্য ফী পাবে, যে ফী রাজউকই আবেদকারীর কাছ থেকে অনুমোদনের সময় আদায় করবে। একবারেই সব হবে না। তবে বর্তমান অবস্থা থেকে অনেক উন্নতি হবে।

ভুমিদস্যু

২০১১ সালে একবার মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ল্যান্ড ডেভেলাপারদের বলেছিলেন যে, “আপনারা ভূমি দস্যুরা রাত্রে ঘুমান কিভাবে?” তার কিছুদিন পরে দেখি তিনি অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। আমরা বলেছিলাম বেআইনীভাবে যেগুলোতে মাটি ভরাট করা হয়েছে কোন দালান বানানো হয়নি, সেগুলোতে মাটিটা সরিয়ে ফেললেই হয়। পেশায় আইনজীবী মাননীয় প্রতিমন্ত্রী বললেন, আমাদের আইনে একটা কথা আছে যে “একটা অবৈধ শিশু যদি জন্মগ্রহণ করে, তার বেঁচে থাকার অধিকার আছে, তাকে বেচে থাকার সুযোগ দিতে হবে।” তারপরে তো আর এই ড্যাপের বাস্তবায়ন হলো না। ল্যান্ড ডেভেলপারস আর এক্সট্রিমলি পাওয়ারফুল। এদের বিরুদ্ধে কথা বললে জীবনের নিরাপত্তাও বিঘিœত হতে পারে।

যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই যে নীতিমালা বাস্তবায়নের তাদের অক্ষমতা। আরেকটা হলো যে টাকা পয়সা বা ক্ষমতার বিনিময়ে যে কোনো কিছুর অনুমোদন আনা যায়।

যদি এমন সরকার পাই যারা সত্যিকার অর্থে এগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ – তখন হবে।

বিধিমালা

নতুন National Building Code, যেটা সম্প্রতি চুড়ান্ত করা হয়েছে, সেখানে Bangladesh Building Regulatory Authority নামে একটি নতুন সংস্থার গঠন ও দায়িত্ব সম্পর্কে উল্লেখ আছে, যেই সংস্থার গঠনের কথা মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল সরকারকে, যার একমাত্র দায়িত্ব হবে সারা দেশে এই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাস্তবায়ন করা। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থাও দুর্নীতিগ্রস্থ হচ্ছে, এই অভিযোগ সরকার থেকেই আসছে।

বিচারব্যবস্থা

গ্রিক বিচারের দেবি থেমিসের দুই চোখ বাঁধা থাকে। এর কারন, যে বিচারক রায় দেবেন তিনি কাউকে না দেখেই দিবেন। কিন্তু মনে পড়ে একটা ছবিতে দেখেছিলাম বাংলাদেশের জন্য তিনি মাঝে মাঝে চোখের সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে দেখে নেন – সামনে কে, তারপরে রায়টা দেন।

বুয়েটের জন্য ফান্ড

আমরা একটা উদ্যোগ নিয়েছি যে একটা Endowment Fund আমরা তৈরি করবো, যেটার লক্ষমাত্রা আপাতত একশো কোটি টাকা । এই টাকা কিভাবে খরচ করা হবে তা আমরা বুয়েট কর্তৃপক্ষ আর বুয়েট এলামনাইর সাথে আলাপ কওে ঠিক করবো।

পোস্ট গ্যাজুয়েট শিক্ষা কার্যক্রম, গবেষনা প্রকল্পে অর্থায়ন, ল্যাব্রেটারি মডার্নাইজেশন, যন্ত্রপাতি কেনা, এগুলোতে সহায়তা করা – এসবে এই ফান্ড ব্যবহ্রত হতে পারে।

তারুণ্য

বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তরুণ প্রজন্ম । এদেরধ্যে যে সৃজনশীলতা দেখতে পাই, তা যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি তাহলে এরাই আমাদের মূল চালিকা শক্তি হবে।

স্বপ্ন

আমি এটা চ্যালেঞ্জ মনে করি, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশী একজন বিজ্ঞানী নোবেল প্রাইজ পাবেন।

 

সহায়ক লিংক ঃ

জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিয়ে বানানো তথ্যচিত্র (Prof. Jamilur Reza Choudhury – আলোর পথযাত্রী)

প্রথম আলোর হয়ে নেয়া সাক্ষাতকার (Jamilur Reza Chowdhury with Shakoor Majid)


Virtual commemorative event on the first death anniversary of JRC

WE Remember JRC. Memorial Symposium on National Professor Jamilur Reza Choudhury

Jamilur Reza Choudhury on launching অষ্ঠভ্রমণ
মন্তব্য
Loading...