অসুখকাল

খেলতে খেলতে কোমর ভাঙা

ফার্স্ট ইয়ার শেষ হতে না হতেই খেলতে গিয়ে যে কোমর ভেঙে এমন বেকায়দায় পড়ে যাব তা কখনোই ভাবিনি। এর আগে যতদিন ক্যাডেট কলেজে ছিলাম, খেলার মাঠে নাম ছিল আমার। নাম আমার কতটুকু ছিল সেটা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম কম, তার থেকে বেশি ব্যস্ত ছিলাম খেলার মাঠে। যে বিকেলে আকাশ মেঘলা থাকত সেই বিকেলে আমার প্রার্থনা ছিল, খেলার সময়টুকু পার হলেই যেন বৃষ্টি আসে। কোনো এক বিকেলে ফুটবল বা ভলিবল খেলতে পারব না, এমনটি ভাবলেই আমার মন খারাপ হয়ে যেত। কলেজ টিমের ভলিবল খেলি ৩ বছর, যখন আমি ক্লাস টেনে, তখন থেকে। ফুটবলেও ছিলাম হাউজ টিমে। কলেজ ছাড়ার পর খেলাধুলার আর জায়গা পাই না। খেলিও না।

বুয়েটে ভর্তি হয়ে খেলার জায়গা পেলাম প্রথমে আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের সামনের মাঠে। সেখানে একদিন দুইটা বাঁশ টাঙিয়ে নেট লাগানো হলে আমরা ভলিবল খেলতে শুরু করলাম। এক দুই ম্যাচ খেলার পর দেখা গেল আমাদের ব্যাচের যারা খেলছে তাদের এক-দুজন ছাড়া সবাই ক্যাডেট। ক্লাস টিম করা হলো। আমি, রম্য, শওকত ক্লাসের এই তিনজনই ফৌজদারহাটের, এই তিনজন টিমে আছি। ঝিনাইদহের তৌকীর, মির্জাপুরের নব্বীর আর আমিনুল হক। এই কয়জন ক্যাডেট আছি ক্লাসে এবং সবাই ক্লাস টিম খেলার জন্য সিলেক্ট হয়ে গেলাম। নন-ক্যাডেটদের মধ্যে এলো লিটন আর তুহিন। আমরা ইন্টারক্লাস টুর্নামেন্ট খেলে রানার্স-আপ পর্যন্ত হই।

১৯৮৬ সালে ফার্স্ট ইয়ারের ভলিবল টিম। (আমি দাঁড়ানো ডান থেকে প্রথম)

১৯৮৭ সালে জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি মাসে ইন্টার-হল ¯েপার্টস কম্পিটিশন হয়। হকি, ফুটবল, ভলিবল তিনটাতেই আমি নাম লেখাই। মাঠে নামি ফুটবল আর ভলিবলে। প্রথম বছরেই তিতুমীর হলের হয়ে খেলতে নামি। নাম লিখিয়েছি রাইট আউট, কিন্তু আমি প্রাক্টিস ম্যাচে যাইনি, তাই বেস্ট ইলেভেনে নাই। আছি এক্সট্রা প্লেয়ার হিসাবে। সেকেন্ড হাফের দশ মিনিটের পর রাইট আউটের শামিম ভাই ক্লান্ত হয়ে পড়লে আমাকে নামানো হলো। আমি নামার কিছুক্ষণ পরেই গোলপোস্টের কাছে অপোনেন্ট নজরুল ইসলাম হলের ডিফেন্সের এক খেলোয়াড় বলে লাথি দিতে মিস করে ফেলার কারণে খুবই অলৌকিকভাবে আমার পায়ের সামনে বলটা এসে গড়ায়। আমি টোকা দিতেই জালে ঢুকে গেল। গোল।

সাথে সাথে আমাকে নিয়ে নাচানাচি শুরু হয়ে যায়। এই ম্যাচে আরেকটা গোলও আমি দেই।

পরের দিন নিউ নেশন পত্রিকায় খেলার খবর ছাপে। দুই গোলদাতা হিসাবে আমার নাম ছাপা হতে দেখি আর তিতুমীর হলের পরের ম্যাচগুলোতে রেগুলার ফার্স্ট ইলেভেনে সুযোগ পেয়ে যাই। কিন্তু সংকটের শুরু তার পরের মাসে, ভলিবল টুর্নামেন্টে।

১৯৮৭ সালের তুতুমীর হল ফুটবল টিম (আমি দাঁড়ানো বা থেকে দ্বিতীয়)

শের-এ-বাংলা হলের সাথে নক-আউট পদ্ধতির খেলা। তিন গেমের খেলায় প্রথমটাতে আমরা জিতি। পরেরটায় হারি। ফলাফল নির্ধারণী তৃতীয় গেমে আর আমাদের স্ম্যাশার-ডিফেন্ডার কেউ দম পায় না। শের-এ-বাংলা হলের মিডিলম্যান স্থাপত্যের সোবহান ভাই’র বুস্টিং আর তড়িতের ওয়ালী ভাই’র স্ম্যাশিং-এ আমরা কাহিল হয়ে পড়ি। আমার কাজ দ্বিতীয় বল ধরে লিফট দেয়া, মানে মোলায়েম করে নেটের উপর তুলে দেয়া যাতে আমাদের স্ম্যাশার অপনেন্টের মাঠে আরাম করে দাবিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু আমি বলই পাই না। অপর পক্ষের ওয়ালী ভাই খালি স্ম্যাশই করেন না, তিনি নেটের ফাঁক দিয়ে ফুড়–ৎ করে বলও ফেলে দেন। এ রকম বেশ কয়েকটা বল মাটি ছোঁয়ার আগে উঠিয়ে ফেলার জন্য আমাকে লম্বা ডাইভও দিতে হয়। এসব আমি ভালো পারতাম আরো দু-চার বছর আগে। এখন দেখি শরীর ঠিকমতো ওঠে-নামে না।

একবার একটা বল মাটিতে পড়ার আগে ডাইভ দিয়ে তুলতে গিয়ে টের পেলাম আমার কোমরে বেশ চাপ লেগেছে। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। একবার ভাবলামÑনেমে যাই। আমার সাবস্টিটিউট আছে সাইড লাইনে। কিন্তু পরে মনে হলো, এই ম্যাচ হেরে গেলে টুর্নামেন্ট থেকেই আমরা আউট হয়ে যাব, সুতরাং চেষ্টা করি। এই চেষ্টার কোনো ফলই আমাদের পক্ষে ছিল না। আমরা আলটিমেটলি সেই ম্যাচে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় হই, আর পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই কোমরে একটু ব্যথা অনুভব করতে থাকি। বিষয়টাকে আমি পাত্তা দিতে না চাইলেও উপায় নাই। আমার বাহন আমার সাইকেল। টের পাই, সেটা চড়ার জন্য পা উঠাইতে গেলেও কোমরে লাগে। দুই তিন দিন পর একবার ডিপার্টমেন্টের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে দেখি পা ওঠে না।

বুয়েটের হাসপাতাল

একদিন ডিপার্টমেন্টের ৫তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে হাবিব ভাই বলেন, হইছে কী তোমার।

আমি বলিÑকিছু না। এমনি একটু কোমরে ব্যথা লাগে।

হাবিব ভাই নাছোড়বান্দা। আমাকে বলেনÑচলো, হসপিটালে যাই।

আমি বলিÑআজ থাক। দেখি, কমেও যেতে পারে।

 

বুয়েটের হাসপাতাল মোটামুটি সারাদিনই খোলা থাকে। তিন চারজন ডাক্তার আছেন, তাদের বিশেষ কাজ নাই। এডমিশন টেস্টের সময় এরা পুরা জামাকাপড় খুলে শরীর দেখে আর একবার আন্ডারওয়ার একটু নামিয়ে ধরে কাশি দিতে বলে। এটা নাকি হার্নিয়া টেস্ট। বুয়েটে ক্লাস শুরু হয়েছে এক বছরের বেশি সময় ধরে, কিন্তু কখনো এই হাসপাতালে আসার দরকার হয়নি। এখানে ডাক্তার ফ্রি, ঔষধ ফ্রি। শরীর বেকায়দায় দেখে আমি দুই-তিন দিন পর ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার আমাকে বিছানায় শুইয়ে পা উঠাতে নামাতে বলেন। আমি ঝামেলা করি। তিনি আমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে একটা স্লিপ ধরিয়ে দেন। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে এক্স-রে করিয়ে আনতে হবে। বারবার মনে করিয়ে দিলেন, আমি যেন রসিদটিও আনি। আমার নিজের টাকায় এক্স-রে করাতে হবে, আর ওই রসিদ এখানে জমা দিয়ে এক্স-রে করার টাকা উঠানো যাবে। দুইদিন পর এক্স-রে রিপোর্ট নিয়ে আসি।

বুয়েটের ডাক্তার আমাকে বলেন ৭ দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে। আমি মুখে বলিÑজি স্যার, আর মনে মনে বলিÑআমাদের ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল টার্মে শেষ দিকের ক্লাস চলছে, আমার টিউশনিও আছে, বিছানায় শুয়ে থাকব কেমনে? তারপরও তারিখমতো ৭ দিন পর আবার যাই ডাক্তারের কাছে। তিনি আরেকটা কাগজ ধরিয়ে দেন আমাকে। এবার বলেন- শ্যামলীতে একটা ক্লিনিক আছে, সেখানে বসেন ডাক্তার রুহুল হক। তাঁর কাছে গিয়ে দেখাতে। নিয়ম একইÑসেই ডাক্তার যত খরচ করাবেন সবকিছুর রসিদ এখানে জমা দিয়ে টাকা তুলে নেয়া যাবে। যত রসিদ, তত টাকা। রসিদ নাই টাকা নাই।

একদিন সন্ধ্যা বেলা সাইকেল চালিয়ে গিয়ে হাজির হই ডাক্তার রুহুল হকের চেম্বারে। তিনি আগের এক্স-রে দেখে আমার কথা পুরা শোনার আগেই কতগুলো ঔষধের নাম লিখে দেন। আর লিখেন, বেড রেস্ট ফর টু উইকস। এর নিচে ১৫ দিন পর দেখা করার তারিখ আর কিছু ঔষধ।

আমি গভীর চিন্তিত স্বরে তাঁকে বলিÑস্যার, আমার তো সামনে পরীক্ষা।

তিনি ততোধিক গভীর স্বরে বলেন- সিক বেডে পরীক্ষা দেন।

বলেন কী!

আমি মন খারাপ করে চলে আসি। আসার আগে তাঁর এসিস্ট্যান্টের কাছ থেকে তাঁর ফি একশো টাকার একটা রসিদ নিয়ে এসে বুয়েটের ডাক্তারকে সব বলি।

তিনি বলেনÑআমাদের এখানে সেরকম কোনো বেড নাই। আমরা কেবল পক্সের রোগীদের জন্য আইসোলেটেড আলাদা বেডের ব্যবস্থা করি।

স্লিপ দেখিয়ে ঔষধ নিয়ে এলাম। ঔষধ খেয়ে আমার ব্যথা অনেকটুকু কমে যায়। আমি মহানন্দে যাবতীয় কাজকর্ম করি। সুযোগ পেলে বিছানায় শুই কিছুক্ষণ, না পেলে ক্লাস করি, পরীক্ষা দেই।

পরীক্ষার গ্যাপে একবার ডাক্তার রুহুল হকের কাছে যাই। বলি, ব্যথা কমেছে, কিন্তু হাচি-কাশি দিলেই কোমরে টান লাগে। সকাল বেলা কোনো সাপোর্ট ছাড়া বিছানা থেকে উঠতে পারি না।

যথারীতি আমাকে আরেকটা এক্স-রে করাতে হলো তাঁর কাছে।

রিপোর্ট দেখে তিনি মহা গম্ভীর মুখে বলেনÑআপনার সমস্যা হাড্ডির না, নার্ভের। আমি হাড্ডির ডাক্তার। আপনি বরং রশিদ উদ্দিনের কাছে যান।

এই বলে তিনি তাঁর প্রেসক্রিপশনের উপর ডাক্তার রশিদ উদ্দিনের নাম লিখে আমাকে বিদায় করে পরের রোগীর জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

তাঁর এসিস্ট্যান্ট আমাকে ঠিকানা বুঝিয়ে দিল। বাংলা মোটরে জোহরা মার্কেটের দোতলায় বসেন ডাক্তার রশিদ উদ্দিন। তিনি বিখ্যাত নিউরো সার্জন। একারণেই তাঁর চেম্বারে ভিড় বেশি। বাইরের একটা ছোট রুমে কয়েকটা বেঞ্চে বসে কেউ মাথার ব্যথায় কুঁকড়াচ্ছেন, কেউ হুইলচেয়ারে বসেছেন, কাউকে কাঁধে করে নিয়ে আসা হয়েছে। মোটাসোটা মাঝবয়েসী এক লোক গোড়ালির উপর ঢিলাঢালা সাদা রঙের ফুলপ্যান্ট পরে ভিজিটরদের তদারকি করছেন। কাউকে পাশে খাটিয়ায় শুইয়ে হাত-পা-মাথা-ঘাড় নাড়ানোর কসরত শেখাচ্ছেন। যে রোগীই ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে তিনি তাঁকে নিয়েই নানা কথা বলেন, ডক্তারের ফি নেন।

এক রোগী বেরিয়ে আসতেই আমি ঢুকে যাবার চেষ্টা করি। তিনি আমাকে ঠেকান। বলেন, আপনার সিরিয়াল কত?

আমি বলিÑসিরিয়াল নাই। আমারটা আর্জেন্ট। বেশিক্ষণ বসতে পারব না।

তিনি পাশের ছোট্ট টেবিলের উপর বসা এক তরুণকে দেখিয়ে বলেনÑএখানে নাম লিখান। সিরিয়াল নেন।

নাম লিখাতে গিয়ে বিড়ম্বনা। তরুণ আমাকে বলেÑআজ হবে না। কাল বন্ধ, আপনি পরশু আসেন, নাম লিখে দিচ্ছি।

এ কী হয়? আমি এর কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তারের সাথে দেখা করে ফেলি। সেই তরুণকে দশ টাকা দেই। সে আমাকে ভেতরে দিয়ে আসে।

এই প্রথম দেখি ডাক্তার রশিদ উদ্দিনকে।

তিনি ভেতরে ততোধিক একটা ছোট রুমে বসে আছেন। টেবিলের এক পাশে একটা টিউব লাগানো ঘোলা গ্লাস। এখানে এক্স-রে দেখেন। এই কথা সেই কথার পর আবার তিনি নতুন করে এক্স-রে করে পরশু নিয়ে আসতে বলেন।

পরশু আবার দশ-টাকা এবং আবারও যাওয়ামাত্র ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে যাই। কিন্তু আজ ডাক্তার অনেক গম্ভীর। অসুখের বাইরে তিনি প্রশ্ন করেনÑআপনি কী করেন?

স্যার আমি বুয়েটে পড়ছি। ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল চলছে। আর্কিটেকচারে।

বাসা কোথায়?

স্যার আমি হলে থাকি।

তিনি আরেকবার এক্স-রের দিকে তাকালেন এবং বললেন, আপনার অপারেশন লাগতে পারে।

জি স্যার? অপারেশন? ঔষধে হবে না?

এই কথার জবাব না দিয়ে তিনি বলেনÑইংল্যান্ড বা ইউরোপে কেউ আছে আপনার?

জি স্যার, আছেন।

একটা ইনজেকশন আনাতে পারবেন? অপারেশনের আগে এটা লাগবে।

এই বলে তিনি আমার প্রেসক্রিপশনের উপর একটা ইনজেকশনের নাম লিখেন।

আমি জিজ্ঞাসা করিÑস্যার কত দিনের মধ্যে লাগবে?

দেখেন যত তাড়াতাড়ি পারেন ভালো। দেরি হলে আপনার প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে।

 

ডাক্তাররা এমন কঠিন কথা এত সহজ করে বলেন দেখে খুব অবাক হলাম। আমি আরেকটু বুঝে নেয়ার জন্য ডাক্তারকে আবার বলিÑস্যার অপারেশন কি সত্যি লাগবে?

এর জবাবে একটা মিষ্টি উত্তর আশা করেছিলাম। কিন্তু ডাক্তার আমার উপর যথেষ্ট বিরক্ত হলেন বলে মনে হলো। তিনি বলেন আমার কথা আপনি বোঝেননি? আমি তো বাংলায় বলেছি আপনাকে।

আমি উঠে যাই। তিনি বেল টেপেন। সেই ঢোলা প্যান্টপরা লোকটি আসে। তিনি তাঁকে কী যেন বলেন। লোকটি আমাকে বলে, আপনি আমার সাথে আসেন, বুঝিয়ে বলছি। তিনি আমাকে বুঝানÑআমার মেরুদণ্ডের নিচের দিকে একটা জায়গায় ডিস্ক সরে গিয়ে রক্ত সঞ্চালনে বাধা দিচ্ছে। এটা ঠিক করার জন্য অপারেশন লাগবে। কিন্তু এই অপারেশনের জায়গাটা সঠিক বোঝার জন্য আমাদের দেশে এমআরআই করার মেশিন নাই। এর জন্য একটা ¯েপশাল এক্স-রে করতে হয়। এই এক্স-রের ভালো ফল পাওয়ার জন্য মেরুদণ্ডের ঐ হাড্ডির ভিতর একটা ইনজেকশন পুশ করে এক্স-রে করতে হয়। এর নাম অমনিপ্যাক এই ইনজেকশন বাংলাদেশে নাই। ইউরোপে আছে। কাউকে দিয়ে আনান। এটা আনার পর অপারেশন হবে। অপারেশন যেকোনো জায়গায় করাতে পারেন, স্যারকে দিয়ে করালে পিজি বা মেট্রোপলিটান হাসপাতালে। পিজিতে সিট পাবেন না, প্রাইভেটেই করানো ভালো হবে। মেট্রোপলিটান হাসপাতালটা মহাখালীতে। আপনাকে ৭ দিন থাকতে হবে অপারেশনের জন্য। খরচ পড়বে সব মিলিয়ে ৩৫ হাজার টাকার মতো। আমাকে খুব দ্রুত এটুকু বুঝিয়ে তিনি অন্য রোগীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান।

ডাক্তারের চেম্বারের নিচে রাস্তার পাশে একটা ল্যা¤পপোস্টের সাথে আমার সাইকেল বাঁধা। আমি সাইকেল খুলি। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ। মোটামুটি ভালো ঠান্ডা। আমার গায়ে সোয়েটার পরা আছে। কিন্তু টের পেলাম, আমার বেশ গরম লাগছে। আমি কি ঘামছি তবে?

হতেও পারে। মাথার মধ্যে দুই তিনটা শব্দ। অপারেশন, ইনজেকশন আর ৩৫ হাজার টাকা। কেমনে কী করি? একসময় আমার জ্যাকেটের চেন খুলে আমি সাইকেল চালাতে থাকি। তাতে বেশ আরাম বোধ হয়। পলাশীর কাছে আসতেই টের পেলাম। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। আবার সাইকেল থামিয়ে চেন আটকালাম জ্যাকেটের। হলে গিয়ে অনেকগুলো সিকি হাতে নিয়ে কয়েন বক্সের পাশে এসে দাঁড়াই।

 

অমনিপ্যাকের সন্ধানে

তিতুমীর হলের আমার রুমটার পাশেই কয়েন বক্স। এটা আবার মাঝে মাঝে ডেড দেখায়। কেউ নাকি বুদ্ধি করে এর কানেকশন উপরে নিয়ে যায় রাতের বেলা। নরমাল টিএ্যান্ডটি লাইনের রিসিভার দিয়ে অবিরাম কথা বলতে পারে, কোনো কয়েন লাগে না। দিনের বেলা আবার এই লাইন ঠিক করে দিয়ে যায়। এটা আমি শুনেছি, কিন্তু দেখিনি। আমি ফোন করতে গেলেই দেখি লাইন কাটা। ফোন করার জন্য রাতের বেলা সেইফ হচ্ছে সিভিল বিল্ডিংয়ের নিচের কয়েন বক্স। নিতান্ত প্রেমিক ছাড়া কেউ সেখানে ফোন করতে যায় না। প্রেমিকদের সরানোর কৌশল আমার জানা আছে। ফোনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে শোনা হয় প্রশ্নÑ‘কী দিয়া খাইলা, আর কে কে ছিল, আমার কথা কী মনে পড়ছিল, আমি টেংরা মাছ খাই না, শুঁটকি আমার পছন্দ না’, এইসব কথামালা চলতে থাকে আর তিন মিনিট পর পর ঝন ঝন করে দুইটা সিকি বাক্সের ভিতর পড়ে যায়। ফোনকারী পেছনে তাকিয়ে লোক দেখলে ক্রমশ তার স্বর নিচু হয়ে হয়ে এক সময় কথা খুব দ্রুত শেষ হয়। শেষ হয় এই বলে যে, ‘এই, আমি ৫ মিনিট পর ফোন করছি, ঘুমাইও না, কথা আছে’। তখন তিনি ফোন ছেড়ে দিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকেন বা সিগারেট ধরান আর আমিও জেনে যাই, ৫ মিনিটের মধ্যে আমার কথা শেষ করে বুথ ছেড়ে দেয়া মঙ্গলময় হবে।

আমি সেদিন খালি পেয়ে যাই সিভিল বিল্ডিংয়ের কয়েন বক্স। আমার হাতে অনেকগুলো কয়েন। আমি প্রথমে ফোন করি আশরাফকে। বলি ইনজেকশনের কথা। এর নাম অমনিপ্যাক। এটা বিশেষ এক্স-রের আগে পুশ করতে হয়। আশরাফ নাম লিখে রাখল। বলল, তার বড় ভাইয়ের ফার্মেসি আছে শ্যামলীতে। ভাইকে বলে দেখবে, আনাতে পারে কিনা। এরপর ফোন করি মহাখালীর দাদাকে। দাদা সব শুনে বললেন, তাঁর পরিচিত এক আকুপাংচারিস্ট আছে। পায়ের গোড়ালিতে সুই ঠুকিয়ে ঠুকিয়ে চিকিৎসা করে ভালো করে দেয়। অপারেশনের দরকার হবে না। এইসব অপারেশন সাকসেসফুল না হলে মানুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। আমি কাল তাঁর বাসায় গেলে তিনি নিয়ে যাবেন সেই লোকের কাছে।

এই প্রথম আমার অসুখের কথা কেউ জানল। আর কাকেই বা জানাতে পারি? মাকে? অসম্ভব। কেন জানাব? তিনি কীই বা করতে পারবেন আমার জন্য? দুই বছর হয় নাই তাঁর স্বামী হারিয়েছেন। এখন অবলম্বন বড় ছেলে। তাঁর আরো ৪টা ছোট ছোট বাচ্চা গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করছে। এমন সময় বড় ছেলের এমন কঠিন অসুখের কথা শুনে হা-হুতাশ ছাড়া আর কিছুই তো করতে পারবেন না। আর, আমি তো চলাফেরা করতেই পারছি। সাইকেল চালাই, ক্লাসে যাই, সিনেমা দেখি। একটু উঠতে বসতে সমস্যা, শরীর বাঁকা করতে সমস্যা, নামাজে রুকু দিতে পারি না, সেজদা দিতে পারি না, চেয়ারে বসে বসে ইশারায় নামাজ পড়ি। এই যা।

 

পরদিন সকাল বেলা। ঘুম ভাঙে ঠিক সকাল সাতটায়, কিন্তু জেগে ভাবি—আমি আজ কী করতে পারি? ডাক্তার বলেছেন শুয়ে থাকতে। অথচ ক্লাস চলছে। আমি ক্লাসে যাব না আজ। কোমরে ব্যথা থাকে সকাল বেলা। শীত কমলে ব্যথাও কমে আস্তে আস্তে। রাতে আবার ব্যথা হয়। এর বাইরে বাঁ পা তুলতে কষ্ট হয় সাইকেলে চড়ার সময়। এটা সিঁড়ি বাইতেও লাগে। এদিকে সেমিস্টার শেষ হবে কয়েক দিনের মধ্যে। ফাইনাল প্রজেক্ট সাবমিশন আছে। এ সপ্তাহেই শেষ ক্লাস। ফাইনাল প্রজেক্ট সাবমিশন হবে মাসের শেষের দিকে, দুই সপ্তাহ পর। তারপর ২১ দিনের প্রিপারেটরি লিভ। এরপর পরীক্ষা। আমার নানাপদের কাজ হাতে। কয়েকটা পত্রিকায় লেখার কাজ দেয়া, সেটা নিয়া ব্যস্ততা। আনন্দপত্রে একটা কভার স্টোরি করাল আমাকে দিয়ে, ‘বাংলাদেশের স্থাপত্যধারা’। ভালো বিল পেয়েছি। ৬শ’ টাকা দিয়েছে। নিপুণের জন্য ফিল্ম রিভিউ লিখি। প্রতি রিভিউর জন্য ৭৫ টাকা করে দেয়। মোহন ভাইর কাছে লেখা দেই, মোহন ভাই অ্যাকাউন্টস থেকে এনে আমাকে টাকা দিয়ে দেন। সুরমা থেকে ১০০০ টাকা পেয়েছি কিছুদিন আগে। এই আমার সম্বল। সাইকেলটা থাকার কারণে আমার যাতায়াত খরচ নাই। আমার সব টাকাই বেচে যায়। মেসে ৩৫০ টাকা মাসে দিয়ে আমি মোটামুটি চলে যাচ্ছি। কিন্তু কোমর সারানোর এত টাকা আসবে কোথা থেকে? আমি আড়মোড়া ভেঙে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।

ঘুম ভাঙলে দেখি আমার মাথায় ইফতেখারের হাত। ইফতেখার সিভিলে পড়ে আশরাফদের সাথে। সে খবর পেয়েছে কাল রাতে আশরাফের কাছে। ইফতেখার বললÑআশরাফ আসবে, কথা হইছে। ও ইনজেকশন ম্যানেজ করতেছে। মিটফোর্ডে লোক লাগাইছে। আমরা গল্প করি কিছুক্ষণ।

সে বললÑতোর শরীর একটু গরম আছে, শুয়ে থাক।

আমি বলিÑসারাদিন তো শুয়ে থাকা যায় না।

সে বলল, হাল্কা মাত্রার ৫ মিলি ঘুমের ওষুধ খাইতে পারিস। এমন কেসে আব্বুও ঘুমের ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। ঘুম বেশি হলে বিছানায় বেশি থাকা যাবে।

আশরাফ আসে দশটার দিকে। বলে, তার ভাইয়ের কাছে প্রেসক্রিপশন পাঠাবে। তিনি মিটফোর্ডে ঔষধের সাপ্লাইয়ারকে দিয়ে আনানোর চেষ্টা করবেন। খানিক পরে আশরাফ আর ইফতেখার চলে যায়। এগারোটায় ক্লাস তাদের। যাবার সময় আমার প্রেসক্রিপশন নিয়ে যায়। বলে—পলাশী থেকে ফটোকপি করিয়ে এনে দিচ্ছি। তুই রেস্ট নে।

দুপুরে লাঞ্চের জন্য উঠে দেখি নড়তে পারছি। লাঞ্চ সেরে সাইকেলে টান দিয়ে চলে গেলাম মহাখালী দাদার ওখানে। এসময়ে দাদা বাসায় থাকবেন না, তিনি থাকবেন তাঁর দোকানÑআল-আমিন টি’তে। আমি সেখানে গিয়ে বিস্তারিত বললাম। কিন্তু আকুপাংচারের ব্যাপারে তাঁর আর উৎসাহ দেখি না। তিনি বলেন, হোমিওপ্যাথি খা। এটাতেই সেরে যাবে। অপারেশনে যাইস না। এটা আরো খারাপ হয়ে যায়। পুরাপুরি নার্ভ ড্যামেজ করে দেবে ডাক্তার।

চিন্তায় পড়ে যাই। তিনি আমাকে আমতলীর কাছে এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ঔষধের টাকা দিলেন দেড়শো টাকার মতো। বললেন, একমাস পর আবার এসে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে। আমি হোমিওপ্যাথি ঔষধ খাওয়া শুরু করি।

 

এর কিছুদিন পর ডিজাইন জমা দিয়ে এ বছরের জন্য পড়াশোনা থেকে মুক্ত। কী মনে করে বাড়ি চলে গেলাম পরদিন। কমলাপুর থেকে সকাল সাতটার ট্রেনে সিলেট। এটা পৌঁছে দেড়টার দিকে সিলেট। সেখান থেকে ৫ টাকার রিকশা ভাড়ায় কদমতলী। কদমতলী থেকে বাসে বিয়ানীবাজার। বিয়ানীবাজার থেকে ৩ টাকার টেম্পোভাড়ায় মাথিউরা ঈদগাহ বাজার। সেখান থেকে দেড় কিলোর মতো রাস্তা হেঁটে নিজের বাড়ি। বাড়িতে এসে আছরের নামাজ পড়ার সময় আম্মা লক্ষ্য করেন, আমি উপুড় হচ্ছি না। জিজ্ঞেস করেন।

বলিÑকোমরে একটু ব্যথা।

এইটুকু বলে ফেঁসে যাই। এখন রাত থেকে শুরু হয় মালিশ করা। পানিপড়া খাওয়ানো। পাশের গ্রামের এক লোক আছেন। লবণ পানিতে তিনি ফুঁ দিয়ে দেন। তার ফুঁ-ওয়ালা পানি খেলে নাকি যেকোনো হাড্ডি জোড়া লেগে যায়। আমি সেই পানিও খাই।

আম্মাকে বলি, সাথে সাথে তো লাগবে না, কয়েকদিন লাগবে। আমি ঢাকা যাই। তোমাকে জানাব।

আমি দুই দিন পর ঢাকা এসে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি। আর রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য সাইকেল নিয়ে বেরুই।

১ ফেব্র“য়ারি ১৯৮৭ কবিতা উৎসব বসেছে টিএসসিতে। বিকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত বক্তৃতা আর কবিদের কণ্ঠে কবিতা শুনি। দেশের বড় বড় কবিরা আজ দুই ভাগে বিভক্ত। যারা সরকারি সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন তারা এক দলে। এরশাদ এদেরকে নানা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। এই দলে আছেন সৈয়দ আলী আহসান, আল-মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, আলাউদ্দিন আল আজাদ এঁরা। এদেরকে এই আসরে বলা হলো রাজকবি, যারা মধ্যযুগে রাজার জন্য স্তুতি লিখতেন। এঁরা নানা রকমের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন এরশাদের কাছ থেকে আর এরশাদকে বড় কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করছেন। কারণ আহমেদ হুমায়ূনের স¤পাদনায় যে সরকারি দৈনিক বাংলা বেরোয়, তাতে প্রায়ই এরশাদের কবিতা প্রথম পাতায় বক্স আকারে ছাপা হয়ে থাকে। এই কবি কণ্ঠের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান বড় বড় হোটেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হল ঘরে হয়ে থাকে, বঙ্গভবনে হয়ে থাকে। গতবছর (১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে) এমন একটা অনুষ্ঠানও আমি কাভার করেছিলাম, হোটেল পূর্বাণীতে ছিল সেই আয়োজন। এঁদের বিপরীতেই মূলত জাতীয় কবিতা পরিষদ তৈরি এবং তাঁদের আয়োজনে কবিতা উৎসব। কবি সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন, সৈয়দ শামসুল হকসহ অন্য সব ছোট-বড় কবিরা এই দলে আছেন। উদ্যোগে মোহন রায়হান, মোহাম্মদ সামাদদের মতো কয়েকজন।

কবিতা শোনার ফাঁকে সাইকেলে টান দিয়ে একবার ডাক্তারের সাথে দেখা করে এলাম। তিনি জানতে চাইলেন, অমনিপ্যাক ইনজেকশনটা এসেছে কী না। এলে তাড়াতাড়ি এটা পুশ করে মাইলোগ্রাম করতে হবে। এরজন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

বলেন কী ! এ তো দেখি খালি বেরাছেরা।

আমি বলি, সামনে আমার পরীক্ষা।

তিনি বলেন, পরীক্ষা শেষে যেন দেখা করি।

আমি আবার পড়াশোনায় ব্যস্ত হই।

 

২১ ফেব্র“য়ারি আসে। রাত ১২টায় শহিদ মিনারে যাই। শহিদ মিনারের পেছনে একটা কাপড় দিয়ে লাল রঙ ফেলা হয়েছে তার উপর। চমৎকার সূর্যের অবয়ব। আমি আমার ওটোফোকাস ক্যামেরায় একটা কালার ফিল্ম ঢুকিয়ে ছবি তুলতে যাই। কিন্তু ঠিক বারোটার আগেই গণ্ডগোল লেগে যায়। জিয়াউর রহমান, কর্নেল তাহের আর বঙ্গবন্ধুর ছবি তিনটা কোথায় লাগানো হবে তা নিয়ে গণ্ডগোল।

হঠাৎ ৪/৫টা ককটেল ফোটে শহিদ মিনারের বেদির পাশে। আমরা দৌড়ে চলে যাই। ১০-১৫ হাত কাছে থাকলে ককটেলের স্পি­ন্টারের ছিটা গায়ে এসে বিঁধতো। যাক বাঁচা গেল।

মাসখানেক পরে একদিন আশরাফ খবর দিল। তার ভাইয়ের এক বন্ধু গ্রিস থেকে অমনিপ্যাক নিয়ে এসেছেন। দাম পড়েছে বাংলাদেশী টাকায় ১৯৩০ টাকা। আশরাফকে ২০০০ টাকা দিলাম। সে বললÑআমি ১৯৩০ দিয়ে দিয়েছি। তুই ৭০ টাকা ফেরত পাবি।

আমি বলিÑউনার সাথে একটু দেখা করে থ্যাঙ্কস দিতে চাই।

সে বলে, আমি ভাইয়াকে বলব। ঐ লোককে তো আমিও চিনি না।

ঔষধ পাওয়ার খবর জানাতে গেলাম ঢাকা মেডিকেলের হোস্টেলে। রাতে আলাপ হলো আমার ডাক্তারি পড়া বন্ধুদের সাথে। আলাউদ্দিন, নাভিদ, শায়েখ এরা বলল ঢাকা মেডিকেলেও মাইলোগ্রাম করা যায়। কিন্তু সেখানে ত রশিদ উদ্দিন অপারেশন করবেন না। শেষ চেষ্টা করার জন্য পরদিন আলাউদ্দিন আমাকে নিয়ে যায় পিজিতে। যদি সেখানে ভর্তি করা যায়, কম খরচে অপারেশনটা হয়ে যাবে। না হলে প্রাইভেটেই করাতে হবে।

আলাউদ্দিন হাল ছাড়ে না। বলে, পিজির প্রফেসরের নোট আছে হসপিটালে এডমিটের জন্য। সিট দিতেই হবে। চল কাল যাই পিজির আউটডোরে, দেখি কী বলে। পিজির আউটডোরে আমার মাইলোগ্রামের শিডিউল পাই না। দেড়টায় নতুন শিডিউল হয়। একদিন একটু আগেই চলে গিয়েছিলাম। একটার দিকে। সাইকেল লক করে গাছের গুঁড়িতে বসে আছি। হঠাৎ করে একটা গাড়ির হর্ন বাজে।

কেউ যেন ডাক দেয়Ñআরে শাকুর ভাই, এখানে কী করেন?

তাকিয়ে দেখি জাবের।

জাবের ক্যাডেট কলেজে আমার এক ব্যাচ জুনিয়র ছিল। ওর বাবা ডঃ এরশাদ আলী সিলেট মেডিক্যালের প্রিন্সিপাল। আমার সাথে পেরেন্টস ডে তে একবার দুইবার দেখা হয়েছে, তেমন আলাপ হয়নি। একবার আমার বাবাও পেরেন্টস ডে তে জাবেরের বাবার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, উনি অনেক বড় গাইনোকোলজিস্ট। আমার সাথে একবারই তাঁর দেখা হয়েছিল ৫ বছর আগে। আমাদের এসএসসির রেজাল্ট দেখার জন্য তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। ফলাফল ঘোষণার একদিন আগে তাদের কাছে ফলাফলের বই এসে গিয়েছিল। খবর পেয়ে তাঁর কাছে রাখা বইতেই আমার ফল জেনেছিলাম। আমার রেজাল্ট দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। ৬টি লেটার, মেধাতালিকায় নাম। আমিও আপ্লুত ছিলাম। সেদিনও এই জাবের নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল তার বাবার অফিসে। আমি জাবেরকে বলিÑআমার এখানে ভর্তি হওয়া দরকার, মাইলোগ্রাম হবে, অপারেশন হবে, সিট পাচ্ছি না।

জাবের জানতে চায় কোন প্রফেসরের আন্ডারে?

ডাক্তার রশিদ উদ্দিন, নিউরো সার্জন।

ও, রশিদ আংকেলের সাথে বাবার খুব খাতির। আমি বাবাকে বলে দেব। বাবা তো এখন সিলেট নাই, পিজিতেই ক্লাস নেন। রাতে একটা ফোন দিয়েন বাসায়Ñএই বলে বাসার নাম্বার লিখে দিল এক কাগজে।

আমি রাতেই ফোন করি। জাবেরের বাবার সাথে কথা হয়। তিনি কাল সকাল নয়টা পঁয়তালি­শ মিনিটের সময় পিজির গেটে থাকতে বলেন আমাকে।

আমি থাকি। তিনি আমাকে নিয়ে প্রফেসর রশিদ উদ্দিনের রুমে যান। আমার অনেক প্রশংসা করেন। আর মাইলোগ্রামের কথা বলেন।

এই দুই ডাক্তারের মুখোমুখি হওয়া এবং আমাকে নিয়ে পিজি হাসপাতালের ডাক্তার রশিদ উদ্দিনের চেম্বারে দেখা হওয়ার ঘটনা মোড় ঘুরিয়ে দিল সব কিছুর।

এরমধ্যেই ঠিক হয়ে গেল, আমি হলে থেকেই এসে মাইলোগ্রাম করব পিজিতে। মাইলোগ্রামের পর যদি থাকতে হয়, কোনো ওয়ার্ডে রেখে দেবে।

 

আহ মাইলোগ্রাম!

৩০ মার্চ ১৯৮৭ মাইলোগ্রাম হবে। সকাল সাড়ে আটটায় আশরাফ চলে এলো হলে আমার রুমে। একটা রিকশায় করে আগের এক্স-রের রিপোর্ট, সবগুলো প্রেসক্রিপশন নেয়া। আশরাফ খুব যতœ করে অমনিপ্যাকের শিশিটা রেখেছে তার কাছে। এতদিন তার বাসার ফ্রিজে ছিল এই শিশি। এটা নিয়ে পিজি হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছাই সকাল নয়টায়। আমাকে অপারেশন থিয়েটারের মতো একটা ঘরে বিছানার উপর শুইয়ে রাখা হলো অনেকক্ষণ। একজন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এলেন। তাঁর নাম ডক্টর আফজাল। ইনজেকশন তিনি মারবেন। তাঁকে সাহায্য করবে আরো দুইজন। তারা আছেন আশেপাশে। একবার জিজ্ঞেস করলেনÑ আমার কোনো এটেন্ড্যান্ট আছেন কী না। আমি আশরাফের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালাম। আশরাফ পাশের একটা টুলের উপর বসে আছে। তার হাতে কাগজপত্র, ফাইল।

আমাকে প্রথমেই বলা হলো সব কাপড়-চোপড় খুলে তাদের দেয়া ট্রাউজার পরে ফেলতে। ট্রাউজার ছাড়া আর কোনো কাপড় নাই আমার গায়। এবার সাদা বিছানার চাদরওয়ালা একটা বিছানায় চিত করে শুইয়ে আমার দুই পা আমার মাথার উপর উঠাতে লাগলেন দুইজন। খাসি জবাই করার আগে দড়ি দিয়ে বেঁধে তার রগ যেমন সোজা করা হয় এমন করে আমার দুই পা উপুড় করা হলো যেন আমার শরিরটা একটা চিংড়ি মাছের আকার ধারণ করে।

এবার মেরুদণ্ডের সবচেয়ে নিচের দুই কশেরুকার মাঝখানে সুই ঢুকানো শুরু হলে আমি প্রথমে চিৎকার করে উঠি এবং টের পাই ধীরে ধীরে সব ঝাপসা দেখছি আর কারো কথা আমার কানে আসছে না। কয়েক মিনিট পর আবার আস্তে আস্তে শুনতে পাই। ধারণা করিÑএসময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম কিছু সময়ের জন্য। যখন আবার সবার কথা শুনতে পাই তখন দেখি ইনজেকশন দেয়া বন্ধ করে সবাই আমাকে বাতাস করছেন। একটা টেবিল ফ্যান আমার কাছে নিয়ে আসা হয়েছে। আশরাফ তার হাতে থাকা ফাইল দিয়ে বাতাস করছে আমাকে।

লোকজনের কেউ কেউ এমনও বলছে যে, আপনি ব্যাংকক চলে গেলে পারতেন। এমআরআই করিয়ে নিয়ে এলে এখানে আরামে অপারেশন হয়ে যেত।

আমি পানি খেতে চাইলাম। পানি দেয়া হলো। আমাকে কথা বলতে দেখে ডাক্তার বেশ খুশি। বলেনÑআপনি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকেন। আমি পরে আসছি।

তিনি এলেন আরো আধা ঘণ্টা পর। এখন আবার চেষ্টা করা হবে। ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বদলানো হলো।

তাঁদের বলাবলি থেকে বুঝতে পারি, তাঁরা দুই কশেরুকার মাঝখানে না ঢুকিয়ে হাড্ডিতে সুই প্রবেশ করিয়ে ফেলেছিলেন বলে রোগী এমন এবনর্মাল আচরণ করেছে।

একবার ভাবি, বলি যে আমার এক্স-রে করা লাগবে না, আমাকে ছেড়ে দেন। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি, তাহলে এর বিকল্প কী? সারা জীবনের পঙ্গুত্ব? খানিক পরে আমিই ডাক্তারকে বললাম, আমাকে আরেক গ্লাস পানি খাওয়ান। পানি খেয়ে বললাম—নেন, আমি চিংড়ি মাছের পজিশন করে দিচ্ছি, আপনারা ইনজেকশন দেন। আমি বুঝে ফেলি, এ এক অতিশয় যন্ত্রণার কাজ হতে যাচ্ছে। এবার খুব কম সময়ের মধ্যে আমার মেরুদণ্ডের সবচেয়ে তলার প্রান্তের শেষ কশেরুকার মাঝখানে ডাক্তার সাহেব অমনিপ্যাকের ফ্লুইড ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হন। আমি শুধু দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। চিৎকার আসেনি, করিও নি। মিনিট পাঁচেক শুইয়ে রেখে আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। এবার এক্স-রে করা হবে। খানিক পরে এক্স-রের রেজাল্ট জানা গেল। ডাক্তারেরা সবাই খুব খুশি, খুব ক্লিয়ার এসেছে সব কিছু। প্রফেসর আফজাল, যিনি এই ইনজেকশন পুশ করলেন, তিনি বললেন, এই ফ্লুইডের বাকি যতটুকু আছে তা দিয়ে আরো ২-৩ জন রোগীকে ইনজেকশন দেয়া যায়। যেহেতু এটা দেশে পাওয়া যায় না, আপনি যদি অনুমতি দেন, আমি আমার কাছে রেখে দিতে পারি।

আমি অতি আনন্দের সাথে তাঁকে এটা দিয়ে দেই। তিনি কিছু টাকা দিতেও চেয়েছিলেন, আমি নেই নি।

ডাক্তারেরা খুশি, রিপোর্ট ভালো। আর আশরাফ অখুশি, কারণ ডাক্তারেরা তাকে বলেছে, অপারেশনটা যে করতেই হবে এই রিপোর্টের পর তারা আরো ভালোভাবে নিশ্চিত হয়েছেন।

এবার অপারেশনের জোর প্রস্তুতি দরকার। দা আর্লিয়ার দা বেটার।

পিজি থেকে বেরোতে বেরোতে বেলা আড়াইটা। আশরাফ বলে, তোর একটু স্যুপ খাওয়া দরকার এখন। চল, এলিফ্যান্ট রোডে বেইজিং আছে। লাঞ্চ করি। তোকে আমি চাইনিজ খাওয়াবো আজ।

কেবিনের সন্ধানে

এবার অপারেশনের পালা। কিন্তু কোথায় করি?

দেখা করি ডাক্তার রশিদ উদ্দিনের সাথে। তিনি তার প্যাডে আমাকে পিজিতে ভর্তি করার কথা লিখে দেন। এই কাগজ নিয়ে পরদিন পিজির রেন্ট কালেক্টরের কাউন্টারে গিয়ে হাজির হই। কাউন্টারে খাতা নিয়ে বসে আছে এক ছোকরা। তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি। সে খাতা দেখে বলে, কোনো সিট খালি নাই, দেড়টায় আসেন। দেড়টায় জানা যাবে।

এখন বাজে সাড়ে নয়টা। দেড়টা পর্যন্ত কে বসে থাকবে?

আমি চলে আসি।

আবার সাইকেল চালিয়ে দেড়টায় গিয়ে হাজির হই। ছোকরার একই জবাব। সিট খালি হয়নি, কাল দেড়টায় আসেন, খালি হলে দেয়া যাবে।

একদিন আমাদের চার ব্যাচ সিনিয়র চিত্তদা আমার সংকটের কথা শুনলেন। তিনি বরিশালের ভাষায় খুব তাজ্যবের সাথে বললেন, এ কী বলো তুমি, এ ত হইতেই পারে না, তুমি চলো আমার লগে, ভিসি স্যারের কাছে যাই। ভিসি স্যার পিজির ডাইরেকটারকে বলে দেবেন।

আমি বলি, ভাইÑডাইরেকটর কী ভর্তি করাবেন? ভর্তি তো করাবেন আর-সি (রেন্ট কালেক্টর)। তাঁর কাছে ভেকেন্সি রিপোর্ট না এলে কেমনে দেবে?

আরে দূরো মিয়া। বাংলাদেশ কী এইভাবে চলে নাকি। আও আমার লগে। ভিসি কে জানো তো? আমাদের মজুর বাপ। চলো।

চিত্তদা আমাকে ভিসি স্যারের কাছে নিয়ে যান। আমাদের একব্যাচ সিনিয়র মোজাদ্দিদ ভাইয়ের বাবা তিনি, এমএইচ খান। ঠিক এই পরিচয় দিয়েই ভিসির পিএস-এর সাথে কথা বলে আমরা ভিসি স্যারের রুমে ঢুকে যাই এবং সব ঘটনা বলি। তিনি পিএস-কে ডেকে পিজির পরিচালক নুরুল ইসলামের পিএস-কে আমার কথা বলেন।

আমি পরদিন আউটডোর কাউন্টারে গিয়ে বুয়েট ভিসির রেফারেন্সের কথা বলি রেন্ট কালেক্টরকে। কিন্তু জবাব আসে- সিট খালি নাই। এমন করে ৩/৪ দিন যায়। দেড়টা বাজার আগেই আমি সাইকেলটা পিজির সামনের গাছতলায় তালা দিয়ে আটকে রেখে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াই। এখন আর আমার কাগজ দেখাতে হয় না, নাম বলতে হয় না। ছোকরাটা আমাকে দেখলেই বলে দেয়- হলো না আজও। কাল খালি হলে জানাব।

এর কয়দিন পর শুনি পরিচালক বদলে গেছেন। এখন নুরুল ইসলাম নাই, নতুন পরিচালক টি চৌধুরী।

আমি আবার জাবেরকে ফোন করি। সে বলে, কাল বাবা যাবেন পিজিতে। আপনাকে সকাল নয়টায় ডিরেক্টরের রুমের কাছাকাছি থাকতে বলেছেন।

আমি ডিরেকটরের রুমের বাইরে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে থাকি। এক সময় তিনি এলেন। আমাকে নিয়ে ডিরেক্টরের রুমে যেতে যেতে আমাদের কথা হয়। পরীক্ষা দিয়েছি এটা জানলেন। বাবা কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলেন।

বললাম।

তাঁর অভিব্যক্তি শুনে বুঝতে পারলাম, খবরটা তিনি জানতেন না। তিনি খুবই আন্তরিক হয়ে গেলেন আমার প্রতি। তিন তলায় উঠে পিজির পরিচালক টি চৌধুরীর অফিস। বুঝে ফেললাম, তারা দুজনই খুব আন্তরিক হবেন, দুইজনই একই বিষয়, গাইনোকোলজির ডাক্তার। আমাকে বাইরে সেক্রেটারির রুমে বসিয়ে তিনি নিজে ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর এসে আমাকে নিয়ে গেলেন পরিচালকের রুমে। ডিরেকটরকে বললেন, ও আমার ছেলের বন্ধু, বুয়েটে পড়ছে, খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, এইটুকু।

ব্যাস। হয়ে গেল।

আমি আমার টোকেনের কপিটা তাঁর সেক্রেটারির কাছে দিলাম। সেক্রেটারি বললেন, কাল দুপুর দেড়টায় যেন আউটডোরে আরসির কাউন্টারে খোঁজ করি।

পরদিন ছোকরাটা আমাকে দেখে হেসে ফেলে। বলেÑসিট খালি হয়েছে। আপাতত একটা ফোর বেডের রুম দিচ্ছি, দুই-একদিন পর আপনি টু বেডেড কেবিন পেয়ে যাবেন।

 

হাসপাতাল পর্ব

১৩ এপ্রিল ১৯৮৭। পিজি হাসপাতালের এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ের নিচতলায় এক নোংরা রুমে আমার সিট পড়ে। জীবনে প্রথম হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। আমি খুবই রোমাঞ্চিত। সবাইকে ফোন করে আমার রুম নাম্বার জানিয়ে দিয়ে রুমে গিয়ে দেখি এই রুমে আরো চারজন নানা রোগের রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়স্বজন। কেউ কাতরায়, কেউ কোঁকড়ায়।

আমি এসে সিট দখল করেছি বটে, কিন্তু থাকার মতো কোনো কিছু নিয়ে আসিনি। বিকেল বেলা দেখি টিনের সানকিতে ঢাকা ঠান্ডা ভাত-তরকারি আমার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। এটা দেখেই খেতে ইচ্ছা করে না।

বিকেল ছয়টায় আবার ডিনার কীসের?

আমার সাথে আছে আমার সাইকেল। একটু দূরে চেন দিয়ে বাঁধা। আমি তালা খুলে বেরিয়ে পড়ি। রাতে হলের মেসে খেয়ে আবার হাসপাতালে আসি। জীবনের প্রথম হাসপাতালে রাত কাটাব, ভাবতেই রোমাঞ্চ লাগে।

রুমে এসে বিছানায় একটা চিঠি পাই। মিরপুর থেকে লালনানা এসেছিলেন। আমাকে না পেয়ে চলে গেছেন। বলেছেন ফোন করতে। পরদিন শবে বরাত। ভাবলামÑলালনানার বাসায় চলে যাই। হালুয়া-রুটি-গোস্ত খেয়ে আসি। নানির হাতের গরুর গোস্তের রান্নাটা অসাধারণ হয়।

আমি মিরপুরে চলে যাই দুপুরবেলা। সন্ধ্যা থেকে নানার সাথে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ি। কোমরে সেই সমস্যা আছে। বসে-বসে নামাজ পড়তে হয়। কিছুক্ষণ পর নানা বলেন, আর নামাজ পড়ার দরকার নাই, বাসায় চলে যা।

আমি তাঁর বাসায় এসে ঘুমিয়ে যাই। হাসপাতালে যাই না। পরদিন ১৫ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ। ভাবলাম রমনায় চলে যাব। ছবি-টবি তুলব। কিন্তু শরীরটা যেন কেমন করছে। একটু জ্বর জ্বর ভাব। বিকেলে হাসপাতালে এসে দেখি আমার বিছানায় মহাখালীর দাদা আর তাঁর ছেলে লাবলু এসে বসে আছেন। আমার জন্য তাঁদের খুব চিন্তা হচ্ছে। হাসপাতালের রোগীকে কেন বাইরে যেতে দেয়া হলো এই অভিযোগ করার জন্য তিনি লোক খুঁজছেন। কিন্তু আশেপাশে এক-দুজন আয়া ছাড়া কাউকেই পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে আয়ার কাছে বক্তৃতা দিচ্ছেন।

আমি হাসপাতালেই থাকি। শুনলাম ১৯ এপ্রিল থেকে আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হবে। আবার সেদিনই আমার কতগুলো ইনভেস্টিগেশন করার কথা। নার্স বলে গেছেনÑসকাল বেলা না খেয়ে থাকতে। আমার রক্ত, পেশাব-পায়খানা তারা নিয়ে যাবে। সেগুলো তাদের প্যাথলজি বিভাগে দিয়ে আমি সাইকেল চালিয়ে ক্লাসে চলে যাই।

প্রথম ক্লাসে একটা ডিজাইন প্রজেক্ট দিয়েছে। গ্র“প প্রজেক্ট। আমি শায়লাকে আস্তে আস্তে বললাম, আমি হাসপাতালে আছি। সেখান থেকে ক্লাস করতে এলাম।

সে আকাশে চোখ তোলার মতো করে বললÑওমা, কী হইসে তোমার?

তাকে সব বললাম।

একটা ক্লাস প্রজেক্ট দেয়া হয়েছে। ডক্টর্স চেম্বার। এটা গ্র“প প্রজেক্ট। চারজন মিলে করবে। প্রথমে যেকোনো একটা ডাক্তারের চেম্বার সার্ভে করে সেটার বর্তমান অবস্থা আঁকা এবং তারপর সেই চেম্বারের ক্রিটিক্যাল রিভিউ করে এই জায়গায় আদর্শ একটা চেম্বার কী করে ডিজাইন করা যায় তা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরিÑএটাই প্রজেক্ট। সময় দুই সপ্তাহ। প্রতি চারজনে একটা গ্র“প। শায়লা, আশরাফ কামাল, আলমগীর খোকন আর আমি আছি এক গ্র“পে। শায়লা নিশ্চিত করে দিলÑপ্রজেক্ট যথারীতি জমা হবে দুই সপ্তাহ পরে, আমি যেন চিন্তা না করি।

বাহ, মজা তো। ক্লাস না করে, ডিজাইন না করে, খাটাকাটনির সার্ভে না করেও বিছানায় শুয়ে নাম্বার পেয়ে যাওয়ার এমন সুবিধা আমি পেতামই না যদি হাসপাতালে আমাকে ভর্তি হয়ে থাকতে না হতো।

ক্লাস সেরে হলের রুমে আসি। রুমে বসে সেদিন চিঠি লিখলাম লন্ডনে। নানির কাছে। চিঠি পৌঁছাবে সপ্তা-দশদিন পর। আর লিখলাম আমার চাচাতো বড়ভাই-কাশেম ভাইকে। তাঁকে বিস্তারিত লিখে জানালাম যে, যেকোনো সময় আমার অপারেশন হতে পারে। কিন্তু আম্মাকে জানানোর দরকার নাই।

সন্ধ্যাবেলা হাসপাতালে গিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ি।

 

পরদিন সকালবেলা আর ক্লাসে যাই না। বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি হল থেকে। হঠাৎ করে জাবের আসে আমাকে দেখতে। সাথে তার বাবাও। অপারেশনের ডেট হলো কী না, এসব জেনে আর আমাকে দেখে তিনি চলে যান।

পরদিন খবর পেলাম, আমার জন্য কেবিন পাওয়া গেছে। মূল ব্লকের ৩ তলায়। রুম নং ৩০২। আমি একটা ছোট্ট ব্যাগে আমার জিনিসপত্র ভরে সেই রুমে চলে যাই।

 

কেবিনবাস

এপ্রিলের ২০ তারিখে দুপুরবেলা এই কেবিনে এসে বুঝতে পারি না যে আমার বিছানা কোনটি হবে। আমাকে যে টোকেন দেয়া হয়েছে তাতে লেখা ৩০২/ক। এর মানে বুঝেছি পরে, ঢোকার পর বাম পাশের বিছানাটা ক, ডানেরটি খ। কিন্তু দুই বিছানাতেই লোক। এক বিছানায় এক বৃদ্ধ শুয়ে, পাশে এক প্রৌঢ়া। আরেক বিছানায় আরেক প্রৌঢ়া। আমি ঢুকে পড়েছি, আমার হাতে এক হাতব্যাগ। এমন হাতব্যাগ হাতে রোগীটোগীকে দেখা যায় না, রোগীর এটেন্ড্যান্টকে যায়। আমাকে দেখে রুমের ভেতরে থাকা লোকেরা কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে যান।

আমি বুঝিয়ে বলার পর ক বেডের উপর বসে থাকা মহিলা বলেন, আপনি এই বিছানায় বসেন। আমাদের বিল দিতে সাহেব নিচে গেছেন। তিনি এলে একসাথে চলে যাব। তাঁর ছেলের মাথায় অপারেশন হয়েছিল। ভালো হয়েছে। ছেলে আগেই চলে গেছে। উনারা এখন বিদায় হবেন।

এই মহিলা আমার সাথে নানা কথা বলেন। তাঁর মনে অনেক ফুর্তি। ছেলে ভালো হয়ে গেছে। তিনি তাঁর বিছানায় পড়ে থাকা না খাওয়া কতগুলো কমলা আমাকে প্রায় জোর করে দিয়ে চলে যান।

পরদিন সকালবেলা একসাথে আসেন ডাক্তার রশিদ উদ্দিন আর ডাক্তার এরশাদ আলী। তারা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর নার্স এসে আমাকে বলেন, কাল আপনার অপারেশন হয়ে যাবে। আমি শুনে খুশি।

অপারেশনের আগে আমার আগের সব প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট চান। আমি বলি, এসব তো আপনাদের কাছে দেয়া ছিল। কিন্তু কোথাও কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না। আবার আমাকে সবগুলো টেস্টের জন্য রক্ত এবং অন্যান্য জিনিসপত্র দিতে হলো। সন্ধ্যার পর আমাকে একটা কাগজ দিয়ে বলল, এখানে সই করতে হবে। আপনি নিজেও করতে পারেন বা আপনার কোনো গার্ডিয়ান।

বলিÑআমি করব, দেন।

নার্স কাগজ দিতে দিতে বলেনÑআপনার গার্ডিয়ান বা এটেন্ড্যান্ট কেউ নাই?

নাই।

নার্স কেমন যেন তাকায় আমার দিকে। জিজ্ঞাসা করেÑআপনার বাসা কোথায়?

তিতুমীর হল।

এটা কোথায়?

পলাশীর কাছে।

তিনি আমার ফর্মটা ভালো করে দেখেন। বলেনÑও আপনি ইঞ্জিনিয়ার?

না না, আমি পড়ছি এখনো।

ঠিক আছে। সই করেন। আর রাতে ভালো করে সবকিছু শেভ করবেন। আপনার কোমরের দিকে অপারেশন হবে, বুঝতে পেরেছেন? এই বলে আমাকে একটা একবারের ব্যবহার করার নতুন রেজর দিয়ে দেন। দিতে দিতে বলেনÑ নিজে করতে পারবেন তো?

মনে মনে বলিÑমানে! আর কে করে দেবে? কিন্তু মুখে বলিÑহাঁ পারব। উপুড় হতে একটু কোমরে লাগে, তাও পারব।

 

আমাকে অনেকগুলো ইন্সট্রাকশন দেয়া হয়। রাতের খাবারের পর আর যেন কিছু না খাই। সকালবেলা ভালো করে যেন বাথরুম করি। সকালেও কিছু খাওয়া যাবে না। সকাল আটটায় আমাকে নিয়ে নেয়া হবে ওটিতে। নয়টায় অপারেশন হবে। আমার সব প্রেসক্রিপশন, এক্স-রে এসব যেন আমার সাথে থাকে, এগুলো অপারেশনের সময় লাগবে।

রুমে চলে আসার পর কাগজপত্র সব ঠিক করে দেখতে গিয়ে দেখি, মাইলোগ্রাম এক্স-রের রিপোর্টটি আমার এখানে নাই। বাকি সবকিছু আছে। এখন এটা ছাড়া অপারেশন হবে কী করে?

মনে মনে ঠিক করে ফেললাম—সকাল আটটায় আমাকে নিয়ে যাবে। সুতরাং সকাল ছয়টায় হলে গিয়ে নিয়ে আসতে পারব।

সকালে ঘুম ভাংগে বেশ ভোর রাতে। আমি ধীরে ধীরে তিনতলা মাড়িয়ে পিজি হাসপাতালের নিচে নেমে এসে টের পেলাম, আজ অর্ধ-দিবস হরতাল। রিকশা চলছে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েও রিকশা নাই। আমার সাইকেল হলে রেখে এসেছি। এখন পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। হাঁটলে জোরে হাঁটতেও পারি না। বাঁ পায়ে ভর পড়লে ব্যথা লাগে। পা উচাতেই কষ্ট লাগে। তারপরও আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে চলে যাই হলে। গিয়ে আমার আলমারির দরজা খুলে এক্স-রের প্যাকেটটা নিয়ে যখন আমি আমার কেবিনে ফেরত আসি তখন সাড়ে আটটা বাজে।

আমাকে দেখেই নার্সের চিৎকার, চেঁচামেচি। কোথায় ছিলাম, কেন ছিলাম, নানা প্রশ্ন। নার্স বলেনÑতাঁর চাকরি যায়যায় অবস্থা। তাঁর চোখ ফাঁকি দিয়ে অপারেশনের রোগী কী করে পালিয়ে গেল এই নিয়ে সবাই ধমকাচ্ছেন তাঁকে। তিনি এও বলছেন যে ডাক্তার আফজাল আমার সব পার্টিকুলার নিয়েছেন থানায় জিডি করার জন্য। হাসপাতালে এমন ঘটনা আগেও দুএকটি হয়েছে। অপারেশনের ভয়ে রোগী পালিয়ে গেছে। সুতরাং আমারও সেই কেস।

আমি বলি, এখন আমি এসে গেছি। ডাক্তার তো নয়টায় আসবেন, আমাকে ওটিতে নিয়ে যান। অপারেশন করেন।

নার্স চলে গেলেন আমার অপারেশনের ব্যবস্থা করতে।

কিছুক্ষণ পর এলো, সঙ্গে ডাক্তার আফজাল। তিনি খুবই বিরক্ত, নার্সের কাছে সব শুনেছেন।

আমাকে বলেন, এক্স-রে আনতে আপনি যাবেন কেন? আপনার এটেন্ড্যান্ট কোথায়?

আমি বলি, স্যার কাল হঠাৎ করে ডেট ঠিক হয়েছে, কাউকে জানাইনি।

আপনার সাথে কে আছেন?

কেউ নেই স্যার। ফ্রেন্ডরা খবর পেলে আসবে।

তিনি চুপ হয়ে যান। কথা বলেন না। আমার এক্স-রে ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে চলে যান।

নার্স বলেন কেবিনে গিয়ে শুয়ে থাকতে। কোনো কিছু যেন না খাই। যে কোনো সময় আমাকে অপারেশনের জন্য ওটিতে নিয়ে যাওয়া হতে পারে।

বেলা এগারোটায় জানা গেল, প্রফেসর রশিদ উদ্দিন আমাকে না পেয়ে খুব বিরক্ত হয়ে সব স্টাফদের খুব বকাঝকা করেছেন। তিনি অপর রোগীর অপারেশনে ঢুকে পড়েছেন। আজ আমার অপারেশন হবে না। ৪ দিন পর আগামী রোববার আমার অপারেশন করবেন।

আমি রুমে শুয়ে নতুন একটা উপন্যাস পড়া শুরু করি, সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার। বিকেলে আমাকে দেখতে বেশ কয়েকজন আসেন। আশরাফ, নাভিদ, কায়সার খান, খাজা, আলাউদ্দিন, শায়েখ এরা। আমার হাতে এখন অফুরন্ত অবসর। ক্লাস না করেও আমার গ্র“প প্রজেক্ট চলতে থাকে।

আমি পরদিন একফাঁকে বেরিয়ে একটা ছবি দেখে আসি বলাকা থেকে। ছবির নামÑচন্দন দ্বীপের রাজকন্যা। ছবি দেখা আমার আরেক পেশা। আমি আনন্দপত্রে চিত্র সমালোচনা লিখি। প্রতি সমালোচনার জন্য আমাকে ৭৫ টাকা দেয়া হয়। সিনেমা দেখার খরচ আমার। আমি একা কম দেখি, কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাই। আমার রিভিউ লেখার বিলের টাকা সিনেমা দেখার টিকেটের পেছনেই চলে যায়। এতে আমার কষ্ট নাই। সিনেমা দেখাটা তো ফাও হয়ে গেল। কিন্তু প্রতিটা সিনেমা দেখা এক সময়ে অত্যাচার বলে মনে হতো মাঝে মাঝে।

আমি কী আর কম চালাক! আমি এক টিকেটে দুই সিনেমা দেখি।

বলাকা-বিনাকার যেকোনো একটাতে ঢুকে গেলেই হয়। বিশ-তিরিশ মিনিট দেখার পর সিনেমার বাকিটুকু জানা হয়ে যায়। তখন আরেক হলে চলে যাই। যাবার নিয়মটা খুব সোজা। এই দুই হলের জন্য একটা মাত্র টয়লেট জোন। টয়লেট করার নামে এক হল থেকে ঢুকে অবলীলায় আরেক হলের পেছন দিকে চলে যাওয়া যায়। এমন করেছি অনেক। ২০ মিনিট সিনেমা দেখে পুরা সিনেমার রিভিউ লেখা হয়ে যেত। সিনেমা না দেখেও লেখা যায়। সবগুলো একই রকমের বস্তাপচা কাহিনি, ষাঁড়ের মতো চিৎকার করতে করতে অভিনয় করা এইসব রদ্দিমার্কা সিনেমার জন্য লেখাও একধরনের বিড়ম্বনা।

কিন্তু আজকে সিনেমা দেখার জন্য বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টা নজরে পড়ে গিয়েছিল আমার নার্সের। সে নাকি দুইবার এসেছিল আমার তাপমাত্রা মাপতে। আমাকে পায়নি। কঠিন ভাষায় বলেছে, ইঞ্জিনিয়ার সাব, আপনার জন্য আমার চাকরি গেলে আপনি কি আমার ফ্যামিলি চালাবেন?

আমি হাসি। বলিÑআমার জন্য আপনার চাকরি যাবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

পিজি হাসপাতালে আমার আনন্দে সময় কাটতে থাকে। এমন অফুরন্ত অবসর অনেকদিন পাই না। সারাদিন পেপার-পত্রিকা পড়া আর ঘুমানো ছাড়া আমার কোনো কাজ নাই। বিকেলবেলা বন্ধুরা আসতে থাকে। তারা আড্ডা মারে অনেকক্ষণ। পাশের বিছানার রোগীর সাথে খাতির হয়ে যায়। তাঁর নাম গোলাম সারোয়ার। পেটের ভেতর থেকে ৭২টা পাথর বের করে আনা হয়েছে। পাথরগুলো তাঁর স্ত্রী একটা বাটিতে রেখেছেন। চীনাবাদামের সাইজের পাথর। যে-ই আসে, তিনি এগুলো বের করে দেখান।

ভুলগুলো ফুলগুলো

আমার কেবিনবাসের দ্বিতীয় দিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়।

দুপুরে খাওয়ার পর শুয়ে আছি। বোধহয় ঘুমিয়েও ছিলাম, এক সময় আমাদের কেবিনে দুই মহিলা প্রবেশ করেন। একজন তরুণী, অপরজন বোরখাপরা মাঝবয়েসী। তাঁদের হাতে দুইটা ব্যাগ। তারা সরাসরি আমার বিছানায় এসে আমার দিকে বার বার তাকায়।

একবার রুমের বাইরে গিয়ে কেবিনের নাম্বার লেখা দেখে আবার আসেন।

মহিলা আমার সাথে কথা বলেন।

আমি তাঁর প্রথম শব্দেই বুঝে ফেলি তিনি সিলেটি। জিজ্ঞেস করেন, আমার এক আত্মীয় শুনেছি এই কেবিনে ভর্তি হয়েছে। পাশের ফ্ল্যাটের এক ছেলের ব্রেইন অপারেশন হয়েছিল, তাঁর মা বলেছেন। সেই ছেলেটি সিলেটি।

আমি বলি, আমার বাড়িও সিলেট।

সে তো বুয়েটে পড়ে। থাকে চিটাগাং

আমার বাড়ি তো বিয়ানীবাজার।

সেও বিয়ানীবাজার। ক্যাডেট কলেজে পড়েছে।

আমিও তো ক্যাডেট কলেজে। কিন্তু আমার নাম শাকুর। আপনি কার খোঁজে এসেছেন?

ভদ্রমহিলা আমার কথা বিশ্বাস করেন না। তিনি নিশ্চিত ভেবেছেন, আমি তাঁর সাথে ফাজলামি করছি।

তাঁকে নিশ্চিত করলাম যে আপনার শ্বশুরবাড়ি আর আমার বাপের বাড়ি একই গ্রামে। কিন্তু তিনি মেয়েকে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

মিনিটখানেক পরে সেই তরুণী একা আসেন আমাদের কেবিনে। এবার তাঁর হাতে একটা ব্যাগ। তিনি এই ব্যাগটি আমার টেবিলে রেখে বলেন, আমাদের অন্য এক আত্মীয় এখানে ভর্তি হয়েছেন শুনে এসেছিলাম। এই তথ্যটা ভুল ছিল। কিছু মনে করবেন না, এই ফলগুলো সেই রোগীর জন্য ছিল, আমি যদি আপনাকে দিয়ে যাই, আপনি রাখবেন?

জি অবশ্যই। রাখব না কেন? থ্যাঙ্ক ইউ।

এই বলে, তরুণীটি তাঁর হাতের ব্যাগ আমার বিছানার পাশের টেবিলে রেখে দ্রুতই চলে যান।

পরের দিন ঘটে অন্য ঘটনা।

বেলা আড়াইটার দিকে সেই তরুণী এসে হাজির। সঙ্গে আরেক তরুণী, তাঁর ক্লাসমেট। এবার এসে তিনি আমার বিছানার উপর বসে পড়েন। গতকালের ঘটনাটা খুলে বলেন, এবং সাথে সাথে এও বলেন যে—তোমার বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠী আমার বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠীর পরিচিত এবং তুমি আমার আত্মীয়। আমাকে ডাকবা নাসরিন আপা। আমি তোমার তিন ব্যাচ সিনিয়র। তুমি পড় সেকেন্ড ইয়ারে আর আমি মাস্টার্সে।

তিনি আমার সাথে কথা বলেন, কখনো খাস সিলেটিতে কখনোবা মান বাংলায়। খুব মজা করে বলেন, তাঁদের পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা বলেছে যে সিলেটের বিয়ানীবাজারের একটা ছেলে বুয়েটের আর্কিটেকচারে পড়ে, চিটাগাংয়ের ক্যাডেট কলেজে পড়েছে এখন এই কেবিনে আছে। তাঁর ¯পাইনাল কর্ডের অপারেশন হবে। আমরা ভেবেছি তিতাশ নিশ্চয়। এসে দেখি, অন্য একজন। তুমি। তখন বাবা বললেন, আমাদের গ্রামের আরেকজন আছে, ক্যাডেট এবং বুয়েটে পড়ে আর্কিটেকচারে। আবদুল মজিদের ছেলে। এবং সেও আমাদের আত্মীয়, স¤পর্কে তুমি আমার নাতি হও।

আমি এবার সব ভেদ ভাঙ্গি। বুঝতে পারি, ইশতিয়াক জহির তিতাশ ভাইকে নিয়ে কনফিউশন তৈরি হয়েছিল।

নাসরিন আপা অনেকক্ষণ থাকেন আমার কেবিনে। নানা গল্প শুনি সবার। তিনি বলেন, তাঁদের বাসা কলাবাগানে। বাসায় গিয়ে সব বলবেন।

তারপর দিন থেকে আরো অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। পরদিন বিকালে সেই পরিবারের ৪ জন এসে হাজির। সঙ্গে দুই ব্যাগ ফলমূল। আমার ফুর্তি কে দেখে।

নাসরিন আপা প্রায় রেগুলার আসা শুরু করেন। তাঁর আচরণের মধ্যে শাসক শাসক ভাব। তিনি এসে আমার ময়লা কাপড় কিছু নিয়ে যান। বলেন, এগুলো আমি বাসা থেকে ধুইয়ে এনে দেব। আমাকে ডাক্তারের সব কথা শোনার জন্য বাধ্য করেন। বাইরে গিয়ে সিনেমা দেখা তো দূরের কথা আমাকে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতেও দেয়া হয় না। তিনি যতক্ষণ থাকেন আমি অস্বস্তিতে থাকি। চলে যাওয়ার পর শান্তি।

 

অবশেষে আমার স্পাইনাল কর্ডের অপারেশনটি হয়ে যায় দ্বিতীয়বার নির্ধারিত দিনে পরবর্তী রবিবার।

অপারেশনের দুই দিন আগে আমার সহরোগীর স্ত্রী বললেন, হাফেজ্জী হুজুর আছেন এই ফ্লোরে, কাল ভর্তি হয়েছেন, আপনি তাঁর কাছ থেকে দোয়া নিয়ে আসেন, উপকার পাবেন।

আমি হাফেজ্জী হুজুরের রুমে যাই। তাঁর রুমটা ভিআইপি রুম। বাইরে এক অংশে তাঁর এসিস্ট্যান্ট আছেন দাঁড়িওয়ালা তরুণ হুজুর। আগে তাঁর কাছে গেলাম, বললাম, আমি লন্ডনের সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকার ঢাকা প্রতিনিধি। আমার অপারেশন হবে পরশু। হুজুরের দোয়া নিব আর একটা ইন্টারভিউ করব।

তিনি ভেতরে গিয়ে হুজুরের সাথে কথা বললেন। হুজুর সময় দিলেন আছরের পর। আমি গিয়ে হাজির হই। হুজুরকে এরশাদ বিষয়ে নানা প্রশ্ন করি। তিনি এড়িয়ে যান। চলে আসার সময় বলি- আমার জন্য দোয়া করে দেন। পরশু আমার অপারেশন। হুজুর আমার মাথায় হাতান, মুখে ফুঁ দিয়ে দেন।

রুমে এসে আমি তাড়াতাড়ি ইন্টারভিউটা লিখে পরদিন লন্ডনে পোস্ট করে দেই।

২৬ এপ্রিল আমার অপারেশন। সকালবেলা আমার আপত্তি সত্তে¡ও অপারেশন থিয়েটারে আমাকে হুইলচেয়ারে করে নেয়া হয়। যতই বলি, আমি হেঁটে হেঁটে যেতে পারব, আমার কথা কেউ শুনে না। আমি ওটির কাছে যেতেই দেখি, আমার পিছুপিছু সেই মহিলাও, যার পুত্রের ব্রেইন অপারেশন হয়েছিল।

ওটিতে নিয়ে একটা ইনজেকশন দেয়া হয়। অল্প ব্যথা পাই। এরপর যখন ঘুম ভাঙে আমি ন্যাপথালিনের গন্ধভরা এক ঘরের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করি। চোখ খুলতেই দেখি মোস্তফা সেলিম। সে কী করে এই ঘরে আমার সন্ধান পেল বুঝতে পারি না। আমাকে দেখে কান্না শুরু করে দিল। কেন কাঁদে আমি বুঝি না। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি। আমার কোমরে ব্যান্ডেজ। নড়াচড়া করা নিষেধ। নড়তে হলে নার্স এসে নড়িয়ে দেয়। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি। আমার খুব ঘুম পায়।

পরদিন আমাকে আমার নিজের বিছানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আরো ভিড় বাড়তে থাকে। মহাখালীর দাদা-দাদি, মিরপুরের নানা-নানি, বাড়ি থেকে আসা কাশেম ভাই আছেন। আর ক্যাডেট কলেজের ফ্রেন্ডরা সবাই দলে দলে আসতে থাকে। আড্ডা মেরে চলে যায়। শুধু আশরাফ সহজে যায় না। তার কাঁধে ভর দিয়ে আমি বাথরুমে যাই। পেশাব আসে না। সে নানারকমের চেষ্টা-তদবির করে আমার পেশাব আনার ব্যবস্থা করে দেয়।

দ্বিতীয় দিন ডাক্তার রশিদ আসেন আমার রুমে। আমাকে বলেন, দেখি উঠে হাঁটেন তো। আমি আশরাফের কাঁধ ধরে হাঁটতে থাকি।

আমাকে বলেন, হাঁটার সময় কোমরে ব্যথা লাগে?

আমি বলি না, সেই ব্যথাটা আর নাই।

ডাক্তার তার সহডাক্তারদের সাথে কী সব সাংকেতিক ভাষায় কথা বলে আমার জন্য নানা রকমের ঔষধের নাম লিখে দিয়ে চলে যান।

অপারেশনের দশম দিন আমার সেলাই কেটে দেয়া হলো। সেলাই কাটতে এলেন ডাক্তার আফজাল। হাসপাতালে আমার বিছানার পাশে তখন লুৎফুল, কাকলী, কাকলীর বন্ধু শাহীন। তাঁদের সামনেই আমাকে উপুড় করে সেলাই কাটলেন। আমি উল্টা দিক থেকে জিজ্ঞেস করি, ডাক্তার সাহেব, কয়টা সেলাই ছিল?

ডাক্তার বলেন, সেলাইর সংখ্যা দিয়ে কী করবেন, আপনার কত জটিল অপারেশন ছিল আপনি তো জানেন না। আপনাকে দেখে তো মনেই হয় না যে আপনি এত কঠিন অসুখের মধ্যে ছিলেন।

আমি কথা বলি না।

ডাক্তার বলেনÑআপনি চাইলে আজকেই চলে যেতে পারেন।

এসব ক্ষেত্রে রোগীরা খুব খুশি হয়, সবাই বাসায় গিয়ে আরাম করবে।

আমাকে বললেন, ছেড়ে দিতে পারি, কিন্তু আরো সাতদিন পুরো বিশ্রামে থাকবে হবে। ঠিক আছে?

আমি বলিÑআমি তো হলে থাকি।

ডাক্তার কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর বলেনÑঠিক আছে। আরো পাঁচদিন আপনি থাকেন। সামনের শনিবার চলে যাবেন।

আমি মার কাছে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখি। তাঁকে জানাই আমি এখন পুরাপুরি ভালো, দৌড়াদৌড়ি করতে পারছি, নামাজ পড়তেও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। খুব শীঘ্রই আমি বাড়ি আসছি।

পরের শনিবার সকালবেলা ডাক্তার আফজাল আমার জন্য বিল রেডি করে আনেন। আমি ঔষধের ক্যাশমেমোগুলো তাঁর কাছে দেই। ২৬ দিনের হাসপাতালবাস, অপারেশন, ঔষধ, সব মিলিয়ে সাড়ে ছয় হাজার টাকার মতো বিল হয়েছে। আমি নগদে এই টাকা দেই। বুয়েটের মেডিক্যাল সেন্টারে এই কাগজপত্র জমা দিলে সব টাকা ফেরত পাওয়া যাবে।

মহাখালীর দাদা এসে আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যান। কিছুদিন তাঁর বাসায় থেকে আমি প্রথমে বাড়ি চলে যাই। দুই দিন থেকে আবার চলে আসি বুয়েটে, আমার তিতুমীর হলে। চলতে থেকে আমার বুয়েটকাল।

 

মন্তব্য
Loading...