ত্রাণকাল ১৯৮৮

১৯৮৮ সালের বন্যায় আমাদের ত্রানকাল নিয়ে লেখা, 'বুয়েটকাল' বইয়ের একটা অধ্যায়

১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ঢাকার প্রধান খবর বন্যা। টেলিভিশনেও বন্যা আর এরশাদীয় ত্রাণ সরবরাহ ছাড়া কোন খবর নাই। খবর মধ্যে দেখা যায় জেনারেল এরশাদ বুট পায়ে খাকী পোষাক পরে হাঁটুজলে হেঁটে হেঁটে আসছেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজে, ‘তোমাদের পাশে এসেৃৃ’। দরাজ গলায় গান গাইছেন এন্ড্রু কিশোর। গান গাওয়া শেষ হলে হয়তো খবরের বাকী অংশ পড়ে শুনাচ্ছেন কেউ। টিভি তখন সাহেব-বিবি-গোলামের। প্রথম ২০ মিনিট এরশাদের কোন জনসভার পুরো ভাষন, দ্বিতীয় ১০ মিনিট রওশন এরশাদের আর পরের ১০ মিনিট কাজী জাফর আর কিছু মন্ত্রীর। একারনে টেলিভিশনে কেউ খবর দেখে না। কিন্তু খবরের পরে ভালো অনুষ্ঠান থাকলে হলের কমন রুমে নিজের আসন পাকা করে রাখার জন্য অনেকেই বসে বসে খবরের এইসব তামাশা দেখে।

২ সেপ্টেম্বর রাতের টেলিভিশন খবরে বলা হলো, কাল থেকে পরবর্তি ১০ দিন ঢাকা শহরের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এই বন্ধ অনেক মজার, ক্লাস হবেনা ঠিক আবার হলে থাকা যাবে। এর আগে যখনই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের কথা বলা হয়েছে তখনই পরের ভোরে হল ছেড়ে দেয়ার কথাও থাকে। এবার তা নাই।

৩ সেপ্টেম্বর আমার রেফার্ড পরীক্ষা। প্লাম্বিং এ রেফার্ড খেয়েছি, শুধরাতে হবে, এই প্রস্তুতি নিয়ে ডিপার্টমেন্টে যেয়ে শুনি নো পরীক্ষা, নো ক্লাস। ১৩ তারিখ ইউনিভার্সিটি খুললে রেফার্ডের নতুন ডেইট পড়বে। একদিকে খুশি, পরীক্ষা নাই- অপর দিকে বেজার, রেফার্ডের জন্য যা যা শিখেছিলাম, সব তো এই ১০ দিনে ভুলে যাব। আবার পরীক্ষার আগের রাতে পড়তে হবে। কী যে যন্ত্রনা !

ফ্যাকাল্টির নীচে দেখি জটলা। জগলুল ভাই, হাবিব ভাই, মাহবুব ভাই কী নিয়ে যেনো আলাপ করছিলেন। আমি পাশ দিয়ে যেতেই বলেন- কাল সকাল আটটায় শহীদ মিনারে আসবি।

কেন?

তোকে আসতে বলছি, আসবি। এতো কেনো কেনো করবি না। কাল থেকে রাস্থায় দাঁড়িয়ে আমরা ত্রাণের জন্য ফান্ড তুলব। দুই দিন তোলার পর এগুলো নিয়ে যাব। তোর ক্যামেরা রেডি রাখিস।

এঁদের কথা সত্যসত্য ফলে গেলো। পরদিন সকালে দেখি ছেলেরা দলে দলে রিকশা, গাড়ি থামাচ্ছে। কেউ এদের টাকা দিচ্ছে, কেউ বকা দিয়ে চলে যাচ্ছে।

এক সময় আমিও নামলাম। রিকশা থামালাম। আপা, খালাম্মা, আংকেল বলে কথা শুরু করলাম। বন্যার কথা বললাম- দেখি দেদারসে টাকা আসছে। এক টাকা থেকে শুরু করে ৫শ টাকার নোট পর্যন্ত চলে এলো। আমাকে যে রুমাল দেয়া হয়েছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভরে গেলো। আমি রুমাল জমা দেই। সবাই সবারটা জমা দেয়।

এবার বাজেট করা হয়। দুই দিনে টাকা উঠেছে ৫৫ হাজারের মতো। এই টাকা কী করা হবে তা নিয়ে মিটিং চলতে চলতে খবর পাওয়া গেলো, অক্সফাম নামে একটা এনজিও যে ত্রাণ দেবে তাদের কিছু ভলান্টিয়ার দরকার। আমরা খুব সহজে তাদের সাথে মিশে যাই। আমাদের যা উঠেছিলো তা দিয়ে আমরা গুড়, চিনি, গুড়াদুধ, দেয়াশলাইবাক্স কিনি। অক্সফাম থেকে আরো নেব চিড়া আর গুড়। ঠিক হলো ৮ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টায় আমরা অক্সফামের অফিসে গিয়ে পৌছাবো।

এই ট্যুরের আয়োজক স্থাপত্য বিভাগ ছাত্র সংসদ। হাবিব ভাই এর ভিপি। জগলুল ভাই, হাবিব ভাই দুইজনই নেতা। কথা ছিলো জগলুল ভাই তাঁর এসএলআর ক্যামেরা নিয়ে এসে আমাকে দিয়ে দেবেন। আমি হবো অফিশিয়াল ফটোগ্রাফার। কিন্তু আগের দিন সন্ধ্যা বেলা তিনি এলেন খালি হাতে। ক্যামেরা আনেন নি। এনেছেন ২ টা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট রিফিল ফিল্ম। আমাকে বলেন- বৃস্টিবাদলার মধ্যে এসএলআরটা রিক্সি হয়ে যায় শাকুর। চিন্তা করে দেখলাম, তোমার অটোফোকাস যখন আছে, এটাতেই মারো। হয়ে যাবে, তোমার কোন কাজ নাই। বস্তাবাস্তা যা আছে আমরা সব উঠাবো-নামাবো, তুমি খালি ছবি তুলবা। ঠিকাছে?

জ্বী ভাই। ঠিকাছে।

অক্সফামের অফিসের সামনে থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। এটা ছিলো তোলা প্রথম ছবি

৮ সেপ্টেম্বর, সকাল ঠিক সাড়ে ছয়টায় বুয়েটের সেন্ট্রাল ক্যাফে থেকে দুইটা ট্রাক ছেড়ে দিল। আমরা গোটা বিশেক ছাত্র। আমাদের সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, সামনে থার্ড ইয়ারে উঠবো, কিন্তু একনো ফাইনাল রেজাল্ট বাকী। ফার্স্ট ইয়ারের ফারুক, পারভেজ। সেকেন্ড ইয়ার থেকে শুধু আমি আর রম্য। থার্ড ইয়ারের ইশতিয়াক ভাই, মাহবুব ভাই, সাব্বির ভাই, ইকবাল ভাই, হেলাল ভাই, এহসান ভাই, নাজমুল হাসান ভাই, শামীম ভাই,। ফোর্থ ইয়ারের বেশ বড় দল। নকী ভাই সংসদের সেক্রেটারি। সংগে আছেন তাঁর ব্যাচমেট আরিফ ভাই, খোকন ভাই, সোবহান ভাই, সাজ্জাদ ভাই, চন্দন ভাই। ফিফথ ইয়ার সিনিয়ার মোস্ট ব্যাচ। এই ব্যাচের হাবিব ভাই, জগলুল ভাই। (আরো কয়েকজন নিশ্চয়ই ছিলেন, সবার নাম মনে পড়ছে না)। আগের রাতে কাওরান বাজার থেকে বাজার করে নিয়ে আসা মালামাল রাখা হয়েছে ক্যাফেটেরিয়াতে। রাত জেগে কয়েকজন সেগুলো প্যাকেটও করেছে। সেগুলোকে বস্তাবন্দি করে উঠানো হয়েছে ট্রাকে। বস্তাগুলোর উপর আরাম করে বসা যায়। আমরা দুর্গত ঢাকা দেখতে দেখতে ভোর সাতটার মধ্যেই মোহাম্মদপুর শাহজাহান রোডের অক্সফাম অফিস এসে পড়ি। সেখান থেকে উঠানো হলো ৪০ মন চিড়া আর ১০ মন গুড়। এদের মালামাল পেয়ে আমরা অনেক সমৃদ্ধ হয়ে যাই। এই অফিস থেকে একজন যাবেন আমাদের সাথে। তাঁর পরিচিত কালিগঞ্জ, রূপগঞ্জের কোন এক গ্রামে আজ সকাল এগারোটা থেকে এই ত্রাণ দেয়া হবে। সন্ধ্যায় ফেরত আসার কথা।

আমাদের দুইটা ট্রাক ছুটে চলে বারিধারার দিকে।

বারিধারা এলাকাটা অর্ধেকের বেশি ধানক্ষেত। মাঝে মাঝে কিছু একতলা দোতলা বাড়ি দেখা যায়। দোতলা বাড়িগুলো সব ডুপ্লেক্স। এক ফ্যামিলি থাকার মতো। এক পাশে একটা দেয়াল দেয়া হয়েছে। ভেতরে লাল ইটের গাঁথুনি দেয়া দালান উঠছে। এখানে নাকি আমেরিকান এমবেসি চলে আসবে। এটা এখন আছে মতিঝিল, চলে আসবে এই বারিধারায়।

১৯৮৮র বন্যাকালে ঢাকার বারিধারা আবাসিক এলাকা

আমাদের ট্রাক দুটো নতুনবাজারের কাছে এসে থেমে যায়। এর পর আর শহর নাই। একটা খাল আছে বারিধারার পেছনে। সেই খালটি এখন আর নাই, পানিতে ভরে সামনের হাওড়ের সাথে মিসে গেসে। আমরা একসময় একটা নৌকা ঘাটের মতো জায়গায় চলে আসি। এখানে অনেকগুলো নোকা বাঁধা। একটা বড় ট্রলার ভাড়া করা হয়। সেই ট্রলারে করে কালিগঞ্জের রাঙ্গামাটিয়া এলাকায় আমাদের যাবার কথা। আমরা মালামাল বোঝাই শেষ করে যাবার জন্য তৈরি হয়ে থাকি, কিন্তু ট্রলার ছাড়া হয় না। ট্রলারের মাঝি বসে বসে বিড়ি ফুঁকছেন। তার সহকারি পেট্রলের ড্রাম হাতে করে বেরিয়েছেন। তিনি পেট্রল পাচ্ছেন না। পেট্রলের পাম্প পানির তলে। অনেক খুজে মহাখালির কাছ থেকে তিনি ড্রাম ভর্তি পেট্রল নিয়ে যখন এলেন তখন বেলা সাড়ে এগারোটা।

আমরা আমাদের শিডিউল থেকে দুই ঘন্টা পিছিয়ে পড়ি।

আমাদের নোকাটা যথেষ্ঠ বড়। এর ধারণক্ষমতা ৫০০ মন। অক্সফাম আর আমাদের দুইপক্ষের মালামাল ভরার পর এটা প্রায় টইটম্বুর। মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা বারিধারার পেছনের গ্রামগুলো ফেলে একটা হাওড়ের মধ্যে এসে পড়ি। সামনে, ডানে বায়ে থৈ থৈ করা পানি। আমাদের অনেকেই নৌকার ছইয়ের উপর উঠে বসে পড়েন। জোরে বাতাস বইলে ভয় পেয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। নৌকায় লাইফ জ্যাকেট আছে। বলা হচ্ছে সবাই যেনো লাইফ জ্যাকেট পরে নেয়। কিন্তু সবাই নিজে নিজে মহা মাস্তান। এইসব ডর ভয় কারো নাই। কেবল নকী ভাইয়ের একটু বেশি ডর। তিনি সাতার জানেন না, তাঁকে আগলে রাখা হচ্ছে নৌকার খোলের মধ্যে।

এখন যেটা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, তার উপর দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। বায়ে যে গ্রামটি দেখা যাচ্ছে তা সম্ভবত বর্তমানের জি ব্লক

ঢাকা ছাড়তেই হাতের বা পাশে একটা গ্রাম আমাদের চোখে পড়ে। মাঝি বললও, এই গ্রামের নাম – ডুমনি। এই গ্রামের অনেকগুলো বাড়ির ঘরের চালের অর্ধেক পর্যন্ত পানি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বললও, এই গ্রামেইতো ত্রাণ দিতে পারি।

কিন্তু অক্সফামের যে লোকটা আমাদের সঙ্গে আছেন, তিনি এই গ্রামে দেবেন না। যে গ্রামে নিয়ে যাচ্ছি, সেটা তার এলাকা। বলা হলো, সেখানেই দিতে হবে।

রূপগঞ্জ যেতে যেতে আমরা কোথাও থেমে যাই

আমরা বালু নদী পার হয়ে ঘুরাঘুরি করতে থাকি, কোন দিকে গেলে কালিগঞ্জের রাঙ্গামাটিয়া গ্রাম পাওয়া যাবে, আমাদের মাঝি চিনতে পারেন না। আমাদের গাইডও জানেন না। কারন তিনি কখনো এই ভাবে পানি পথে আসেন নে। এসেছেন নদী পথে। এখানে নদী আর ধানক্ষেত একাকার করে হাওড় হয়ে গেছে।

অবশেষে বেলা দেড়টার দিকে যেখানে গিয়ে পৌছালাম, সেটা রুপগঞ্জ থানা। থানা ঘরের জানালা পর্যন্ত পানির নীচে। আমাদের নৌকা দেখে কয়েকশ নারী পুরুষ ঘাটে এসে ভিড়েছেন। ঘাট বলতে যা, তাও একহাঁটু পানির তলে। বেশ কিছু বৃদ্ধাকে দেখি থালা হাতে কোমর পানি ডিঙ্গিয়ে আমাদের দিকে আসছেন।

শৃংখলার সাথে ত্রাণ বিতরনের চেষ্ঠা

আমাদের নৌকা থামানোর পর, পুলিশের সাহায্য নিয়ে সব লোককে লাইন করে দাড় করানো হয়। এর মধ্যে দেখি আমাদের অনেকে লুংগি পরে ফেলেছেন। লুংগি পরা, মাথায় গামছা দেয়া হাবিব ভাই একটা হ্যান্ড মাইকে ঘোষনা এবং ধারা বিবরনী দিতে থাকেন। আমরা ত্রাণ নিতে আসা সবাইকে রুটি, গুড়, প্যাকেটস্যালাইন দিতে থাকি। কেউ কেউ শৃংখলা রক্ষার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। লোকজনকে লাইন করে বসানো ছিলো সবচেয়ে কঠিন কাজ।

ত্রাণ দেয়া শেষে নৌকা থেকে হিসাব গেলো, ৭৬০ জনকে প্যাকেট দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্গতদের ত্রাণ দিতে দিতে এক্সময় মনে হলো আমরাও উদ্ভাস্তু হয়ে গেছি। দুপুর বেলা নৌকায় বনরুটি আর কলা দেয়া হয়েছিলো সবাইকে। এই নিয়ে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাদামাখা জলে হাটাহাটি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সবাই।

এখন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। সূর্য ডুবু ডুবু। আমরা থাকবো কই? খাবো কি?

ত্রাণকর্তা হিসাবে আবির্ভুত হলেন রূপগঞ্জ থানার ওসি। তিনি বললেন, এখানে থানা হাসপাতালের নতুন একটা ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। বণ্যার কারনে এটা উদ্ভোধন হচ্ছেনা। পানি নেমে গেলে মন্ত্রী এসে উদবোধন করে যাবেন। তার আগে আপনারা আজ রাতে এখানে ঘুমাতে পারবেন।

রূপগঞ্জ থানা সদর

হাসপাতালের কর্মচারিরা আমাদের জন্য কয়েকটা কম্বল আর বালিশ নিয়ে এলেন। বিদ্যুত নাই। মশা আর মশা। শোনা গেলো, শাপখোপেরাও এদিকে হরহামেশা বেড়িয়ে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছেয়ে বসলো কিছুক্ষ্ণের মধ্যে। ওসি সাহেব বলে গেলেন, আমাদের জন্য রান্না করা হচ্ছে। আলু দিয়া ডিম আর ডাল। খুব তৃপ্তীসহকারে আমরা খেলাম। কিন্তু কী করে কিভাবে ঘুমিয়ে না জেগে সেই হাসপাতালের ফ্লোরে শুয়ে রাত কাটিয়েছিলাম, পুরাটা আর মনে নাই।

৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮। খুব ভোররাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ঘরের বাইরে ছুটোছুটি করতে থাকি। সবার তলপেটের চাপ নিষ্ক্রান্ত করার জন্য বনবাদাড়ের আড়াল খুঁজি। সাড়ে ছয়টার দিকে ওসি সাহেব আমাদের জন্য রেডিমেড নাস্তা পাঠান। রুটি, ভাজি আর ডিম। সঙ্গে চা। বাহ। এটুকু খেয়েই সাড়ে সাতটায় আমরা বেরিয়ে পড়ি কালিগঞ্জের মূলগাও এলাকায়। এ যাত্রায় আমাদের সঙ্গে আছেন একজন দারোগা, ৪ জন কনস্টেবল। সাড়ে আটটায় সেই গ্রামে পৌছে ৫০০ জন লোককে চিড়া, গুড়, আর রুটি দেয়া হলো। সেখান থেকে জালোপাড়া, দেওপাড়ায় শ’চারেক লোককে এসব দিয়ে রওয়ানা হই নারগানা গ্রামের দিকে। সেই গ্রামের মেম্বার শাজাহান আমাদের সঙ্গে আছেন। তার গ্রামে নিজ হাতে তিনি ত্রাণ দিতে চান। কিন্তু গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এই গ্রামটি শুকনা। লোকজন যে যার বাড়িতে আরামে আছে। আমরা নাও ভিড়াই না। মেম্বার সাহেবকে নামিয়ে দিয়ে বলি, এই গ্রামে ত্রাণ দেয়া হবে না, আপনি চলে যান।

আমাদের নৌকা চলতে থাকে কালিগঞ্জের উদ্দেশে। এর মধ্যে দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে। পানির উপর খাওয়া পাই কই?

আমাদের নিজস্ব ব্রেড-কলার যে ভান্ডার নিয়ে আসা হয়েছিল, তা কালই শেষ হয়ে গেছে। এবার হাত পড়লো ত্রাণের খাবারের দিকে। ত্রাণের বস্তা থেকে বের করা হলো চিড়া আর গুড়। এই নিয়ে দুপুরের খাবার হলো, যে যার মতো খেলো।

বেলা দেড়টায় পৌছালাম বালিগাও হাইস্কুল মাঠে। সেখানে ৬১০ জনকে ত্রাণসামগ্রী দিয়ে যাওয়া হলো পাইলট স্কুলে। পাইলট স্কুলে ৪৮৪ জনকে দিয়ে নৌকা ছুটলো কালিগঞ্জ গার্ল স্কুলের দিকে। এই স্কুলেও কিছু দুর্গত লোক আছে। ২ বস্তা চিড়া আর ১ টিন গুড়া দুধ সেখানে দিয়ে ঢাকামুখি যাত্রার জন্য তৈরী হই। যাবার পথে আরো কিছু গ্রামে ত্রাণ দিতে হবে আমাদের। কিন্তু আমাদের কাপ্তান ভয় দেখালেন। কালিগঞ্জ ডাকাতের এলাকা। এই অঞ্চলে সন্ধায় পর নৌকাতে ডাকাতি হয় প্রায় প্রতি দিন। সুতরাং যেহেতু দিনের আলোয় ঢাকা পৌঁছা যাবে না, তাই রাতে থেকে যেতে হবে এখানে কোথাও।

এখন রাতে থাকবো কোথায়? নৌকায়?

সেটাও প্রায় অসম্ভব।

পিকনিকের যে আমেজ নিয়ে ঢাকা থেকে ত্রাণ বিহারে বেরিয়েছিলাম, দুই দিনের কাদাজলখাওয়া পথে হাটাহাটি আর বস্তা টানাটানিতে সবাই কাহিল। কারো মনে আর ফ‚র্তি নাই। কোন মতে রাত পার করা দরকার।

আমাদের সাথে অক্সফামের যে ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি একটা সম্ভ্রান্ত লোকের বাড়িতে আমাদের নিয়ে গেলেন। ফুটবলার এনায়েতের বাড়ি এটা। কেউ থাকে না বাড়িতে। খালি ঘর আছে। এই বাড়ি থেকে সামান্য দূরে নাকি চিত্রনায়ক ফারুকের বাড়ি। সেই রাতে আমরা আবার ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে মশার কামড় খেতে খেতে শাপখোপের ভয় পেতেপেতে রাত কাটাই।

সূর্য উঠার আগেই আমরা উঠে তৈরী হয়ে যাই। সকাল সাড়ে ছয়টায় আমাদের ট্রলার ছাড়ে ঢাকার পথে। নৌকায় বসে গুড়-চিড়ায় নাস্তা সারি। সকাল সোয়া আটটায় রূপগঞ্জের তালমুশুরিতে ত্রাণ দিতে নেমে বৃস্টি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলাম। ভিজতে ভিজতে ত্রাণ বিতরণ শুরু করি। দুধের বড় ড্রাম আমাকে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে এক পট করে গুড়া দুধ দিতে হবে সবার থালায়। কেউ থালা এনেছে, কেউ কাপড়ে নিচ্ছে।

আমি ছবি তোলার কাজে ছিলাম, বেশ ছিলাম। এবার আমাকে কাজ দেয়া হয়েছে। আমার হাতে এ সব মানায় না। আমি সবাইকে সমান দিতেও পারি না। বৃদ্ধা মহিলাদেরকে ডাবল ডাবল দিয়ে দেই।

একসময় শেষ হয়ে যায় দুধ। কিন্তু কিছু লোক খালি বাটি এগিয়ে দেয় আমার দিকে। আমি লজ্জ্বায় পালিয়ে আসি নৌকায়। আর দুধ নাই নৌকাতে। আমি আর নামি না।

ফেরার পথে

আমাদের ৫০০ মনি ট্রলারটা এখন বেশ হালকা হয়ে এসেছে। আছে সামান্য কয়েক বস্তা চিড়া আর গুড়। আমরা ফেরার পথে মুসুরি, মাঝিপাড়া, বাড়িয়াছনি, ডুমনি গ্রামে আর আমদিয়াটেকে বাদবাকি সব দিয়ে সকাল সাড়ে এগারোটায় ফিরে আসি রামপুরা টেলিভিশন স্টেশনের কাছের রাস্তায়। এখানেই নৌকা ঘাট। এখানেই নামিয়ে দেয় আমাদের ট্রলারের মাস্টার।

তারপর টেম্পো-রিক্সা-বেবি করে ফেরত আসি বুয়েট ক্যাম্পাসে।

পরের বছর, ১৯৮৯র বণ্যাতেও আমরা ছাত্র সংসদ থেকে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলাম মানিক গঞ্জে। সে আরেক ইতিহাস।

মন্তব্য
Loading...