মহাজনের নাও- মামুনুর রশীদ

শাহ আবদুল করিমনামার আধুনিক গীতল বর্ণাঢ্য প্রযোজনা

উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে নাট্যকারের সাথে বসে নাটক দেখছেন মামুনুর রশীদ

ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে একদা বাংলাজুড়ে একটা প্রেমের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। সে প্রেম মানবতার, সে প্রেম দেশপ্রেম। হিংসা-দ্বেষ ভুলে গিয়ে এক অলৌকিক অপার শান্তিময় ভুবন গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। চৈতন্যদেব, লালন, হাসন রাজা, নাম না-জানা অনেক বাউলসাধকের সর্বশেষ সাধক শাহ আবদুল করিম। দেহতত্ত্ব, মরমিয়া, সহজিয়া গান দিয়ে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল অসাম্প্রদায়িক পৃথিবী। তাঁদের প্রতিবাদ ছিল ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে। বিষয়-বুদ্ধিহীন এসব মানুষ গৃহে আবদ্ধ থাকতেন না। তাঁদের ঠিকানা হয়েছিল গ্রামবাংলার পর্ণকুটিরে, পথে-প্রান্তরে। প্রাণিজগতের বাঁচার নিয়মে যতটুকু খাদ্য বা বস্ত্র প্রয়োজন, তা হলেই তাঁদের চলত। বাংলার ভাটি অঞ্চল, যেখানে বিস্তীর্ণ হাওর বর্ষায় একটা সাগরের রূপ পরিগ্রহ করে। আকাশে যখন অবিরল বৃষ্টির ধারা, প্রকাণ্ড ঢেউগুলো তখন আছড়ে পড়ে। কূলহীন-কিনারাহীন অন্তরীক্ষে তারই পাড়ে জন্ম শাহ আবদুল করিমের। প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁর শৈশব, লেখাপড়াও সামান্য। তারই মধ্যে তিনি আহ্বান শোনেন এক মহাজাগতিক সত্যের। সেই সত্য তাঁর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও মূর্ত হয়। বাহন তাঁর সংগীত। যন্ত্রও সামান্য। সম্বল তাঁর কণ্ঠ এবং এক বাউলসাধকের হূদয়, যে হূদয় ক্রমাগতভাবে মেধায় পরিণত হয়েছে। তাঁর জন্মস্থান শ্রীহট্ট, সিলেট। একদিকে খাসিয়া জয়ন্তিয়া পর্বতমালা, অন্যদিকে নদী-হাওর পরিবেষ্টিত ভাটি অঞ্চল। এই বিশাল পর্বত আর হাওরের ওপর উদার নীল আকাশই কি কবি বাউলসাধক জীবনের মানস-ভূগোল সৃষ্টি করেছিল কি না, তা কোনো গবেষণার বিষয় নয়। তাঁর জীবনের ওপর যে প্রবল প্রভাব পড়েছিল তা প্রশ্নাতীত।
এই নাটকের নাট্যকার শাকুর মজিদ শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। প্রামাণ্যচিত্রটিতে তিনি নানা সচিত্র তথ্য তুলে ধরেছিলেন। নানা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারও সেখানে ছিল। যেহেতু তিনি নাট্যকার, তাই তাঁর উপস্থাপনা ছিল বেশ নাটকীয়। সেই উপস্থাপনার ফলেই হয়তো প্রামাণ্যচিত্রটি বেশ মর্মস্পর্শী হয়েছিল। একদিন অকস্মাৎ খবর পেলাম, শাকুর মজিদ একটি নাটক লিখেছেন। নাটকের নাম মহাজনের নাও। নাম শুনে একটু খটকাও লেগেছিল, কিন্তু কালক্রমে স্পষ্ট হলো, এই জগতে আমরা আসি—একটি নৌকা বা নাও পেয়ে যাই আমাদের জাগতিক ভ্রমণের জন্য। তারপর নৌকার মালিকের হাতেই আবার সমর্পণ করে চলে যাই। এই মহাজন হতে পারেন ঈশ্বর বা মহাকাল অথবা এই ধরিত্রী, যেখানে আমাদের আগমন ঘটে এবং যেখানে সবচেয়ে বড় বাস্তব আমাদের বিদায়। এখানে ভাবনাটা শেক্সপিয়রের সঙ্গে মিলে যায়।

To-morrow, and to-morrow, and to-morrow,
Creeps in this petty pace from day to day,
To the last syllable of recorded time;
And all our yesterdays have lighted fools
The way to dusty death. Out, out, brief candle!
Life’s but a walking shadow, a poor player,
That struts and frets his hour upon the stage,
And then is heard no more. It is a tale
Told by an idiot, full of sound and fury,
Signifying nothing

একাধিকবার করিমের গানে এ বিষয়গুলো এসেছে, এসেছে লালন, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-রজনীকান্ত-অতুল প্রসাদের গানেও। যেমন—
‘কোন মেস্তরি নাও বানাইলো কেমন দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়।
চন্দ্রসূর্য বান্ধা রাখছে নায়েরই আগায়
দুরবিনে দেখিয়া পথ মাঝিমাল্লায় বায়
রং-বেরঙের কত নৌকা ভবের তলায় আয়
রং-বেরঙের সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যায়।’
বাংলার এই বাউলসাধকদের জীবনযাত্রা সরল হওয়া সত্ত্বেও পদে পদে কণ্টকাকীর্ণ। ধর্মীয় অনুশাসন তাঁরা মানতেন নিজেদের মতোই। চাপিয়ে দেওয়া ধর্ম-কর্ম তাঁদের সইত না। একইভাবে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন, সাম্প্রদায়িকতার উল্লাস—এগুলোও তাঁদের সহ্যের অতীত।
মহাজনের নাও নাটকে শাকুর মজিদ শাহ আবদুল করিমের শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, এমনকি তাঁর জানাজার কাল পর্যন্ত ধরেছেন। এখানে তাঁর বড় কৃতিত্ব এই যে তিনি বাংলা নাটকের গীতল ধারাকে অনুসরণ করেছেন। নাট্যের স্থান দখল করেছে করিমের গান এবং অভিনয়ের জায়গাগুলোতে রয়েছে পয়ার ছন্দের কাব্য। কাব্যের নির্মাণে কোনো গুরুগাম্ভীর্য নেই, একেবারেই সরল-সহজিয়া রূপের। বিরতিহীন দেড় ঘণ্টার মধ্যেই তিনি করিমকে উপস্থিত করেছেন। কোনো একটি মুহূর্তই সেখানে বিরক্তির উদ্রেক করে না।
নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী তরুণ নির্দেশক। এই নাটকে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে একেবারেই নবাগত তরুণদের নিয়ে। তরুণদের নিয়ে কাজ করাটা নির্দেশকদের জন্য কঠিন ও নিরাপদও বটে। এ ধরনের নিরীক্ষাধর্মী কাজের জন্য নির্দেশকের পরিকল্পনার গহনে কিছু বিষয় থাকে, যা মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তন করতে হয়। সেখানে একটু পুরোনো অভিনেতারা প্রশ্ন তোলেন, মেনে নিতে চান না। পুরোনোর আবার একটা শক্তিও আছে। সে নতুনকে মানে না। নতুনকে গ্রহণ করতে দেয় না।


আবার সমস্যাও আছে। নাটকে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে, এটা কেউ অস্বীকার করবে না। গীতল এ নাটকটিতে অসংখ্য মুভমেন্ট আছে, তার সঙ্গে আছে গান। মুভমেন্টের সঙ্গে গান এবং মাত্রা মিলিয়ে মুভমেন্টের কাজটি কঠিনও বটে। অনেক বেশি ফিজিক্যাল ফিটনেস এবং সেই সঙ্গে দম ব্যবহারের দক্ষতা প্রয়োজন। দু-চারটা জায়গায় এর সমস্যাও হয়েছে। কিন্তু আবার অনেক জায়গায়ই প্রত্যাশার অতিরিক্ত পাওয়াও গেছে। বিশেষ করে মেয়ে দুটি (রূপা নাসরিন ও লিঠু রানী মণ্ডল) যখন করিমের ও প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় অভিনয় করছিল, তা আমাদের প্রত্যাশা অতিক্রম করে যায়। অভিনয়ের অভিজ্ঞতা থাকলে যা হয়, তাও আমরা দেখেছি। করিমরূপী আহমেদ গিয়াস যখন শেষ দৃশ্যের আগে সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন, তখন এক হূদয়স্পর্শী মুহূর্তের সৃষ্টি হয়। একেবারেই বাস্তবানুগ অভিনয়ে দর্শকদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। আবার আনসার যখন ডিসি হয়ে এসে করিমকে ভর্ৎসনা করে, তখন ও একটা অথরিটি দিয়ে রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করে। মৌলভির চরিত্রেও আসাদুল ইসলাম বেশ উজ্জ্বল।
হাওরাঞ্চলের সুরে একটা মেলোডি আছে, তালেরও কাজ আছে। তালের প্রতি যত্নবান হয়ে তা যদি উচ্চকিত হয়, তাহলে এ নাটকের করিমকে ধরা যাবে না। করিমের গায়কিটা সম্পূর্ণই আত্মমগ্ন থেকে হূদয়ের একটা গভীর তন্ত্রী থেকে ধরা। সেই জায়গাটি আরও আবিষ্কার করার প্রয়োজন আছে। নাট্যকার ও নির্দেশকের সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের যে পরিমিতিবোধ, তা উল্লেখ করার মতো। ভাটি অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু দুর্বোধ্য নয়। নাটকে নাট্যভাষার সাবলীল প্রয়োগ প্রশংসাযোগ্য। নির্দেশনার ক্ষেত্র ছাড়াও সুদীপ আলো, মঞ্চ, পোশাক ও প্রপসের কাজটিও করেছেন। সবই মোটামুটি, তবে প্রপসের নির্মাণ বিশেষ করে বৈঠা ও ট্রাংকের ব্যবহার বেশ ভালো। একটা কথা তরুণ নির্দেশকদের ভাবতে বলি। কোরিওগ্রাফিতে কাপড় ব্যবহার বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে এসেছে। বৈঠা যেমন নাটকটির ভেতর প্রবেশ করে যায়, কাপড়গুলো তেমন যায় কি? তবে করিমের প্রণয় দৃশ্যটিতে বিস্তীর্ণ কাপড়ের মধ্যে ছোট্ট জায়গাটিতে দুটি মুখ খুবই ভালো লেগেছে। প্রথম প্রদর্শনীটি দেখেছিলাম। একেবারেই নতুন মঞ্চে ওঠা তরুণ অভিনেতারা ছিলেন। কালে কালে আরও সমৃদ্ধ হবেন তাঁরা, প্রযোজনাও দিন দিন আরও শিল্পসমৃদ্ধ হবে।

আবারও বলতে হয়, বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় তারুণ্যের স্পর্শটাই সবচেয়ে বেশি গৌরবের ও গুরুত্বপূর্ণ। নাট্যকর্মীরা তরুণ, দর্শকের বেশির ভাগ তরুণ। তাই বহুদূর যাওয়ার ইঙ্গিত দেয় এই নাট্যচর্চা।
নাট্যকারের একটি বিষয় শেষে আবার বলা প্রয়োজন। নাটকের শেষ দৃশ্যে করিমের মৃত্যুসংবাদ শুনে বহু মানুষ নৌকায় পদব্রজে এসে দাঁড়ায়। হাওর তখন উথাল-পাথাল। নাট্যকারের ভাষায়:
লাশের মিছিল নিয়া দুপুরের পর/ ধল মসজিদ ঘাটে ভিড়ায় বহর/ শত শত নাও লোক হাজারে হাজার/ ইমাম সাহেব দেখে করে চিৎকার/ ইমাম: ভাইসাব, বলি আপনাদের/ অপেক্ষা করতে হবে কিছু সময়ের
বর্ষায় মাঠঘাট ভরে একাকার/ সবাইকে ধরবে না নামাজে কাতার/ একবার উঠানেতে পড়া নয় সোজা/ দুইবার হবে তার নামাজে জানাজা।

একদা বাল্যকালে এই মসজিদ থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া বালক আজ জীবনের শেষে নতুন ইমামের ভাষ্য আমরা শুনলাম। মনোমুগ্ধকর এই যে হাওরে বর্ষাকালে করিমের মৃত্যু, প্লাবিত হাওরের মানুষ সেদিন কোনো এক মুহূর্তের জন্য একচিলতে রংধনু দেখেছিল কি না জানি না, তবে নাটকের শেষ দৃশ্যে হাওরজুড়ে আমরা প্রলম্বিত একটি রংধনু দেখেছিলাম আর সেই রং শাহ আবদুল করিমের বর্ণাঢ্য জীবনেরই সাত রং নিয়ে বহু রং। নতুন শাহ আবদুল করিমের জননীদ্বয় শাকুর মজিদ ও সুদীপ চক্রবর্তীকে অভিনন্দন।

 

মন্তব্য
Loading...