নান্দনিক শাকুর মজিদ – ড. সফিউদ্দিন আহমদ

নান্দনিক শাকুর মজিদ

ড. সফিউদ্দিন আহমদ

শাকুর মজিদ স্থপতি একজন সৃজনশীল নন্দিত স্থপতি। মাঝে মাঝে তার স্থাপত্য কর্ম দেখে আমার মনে হয় নান্দনিক বিভা আর সজীবতার প্রাণ প্রবাহে তার স্থাপত্যকর্ম জড়ত্বকে অতিক্রম করে ছন্দিত হয়ে ওঠেছে। কিন্তু এ বিষয়টি আমার আলোচনার পরিমণ্ডলে নয়। শিল্পকর্মে তার বহুমাত্রিক অভিধা রয়েছে। এ অভিধাগুলোর প্রতিই আমি সামান্য  আলোকপাত করবো।

শাকুর মজিদ একজন বড়োমাপের আলোকচিত্র শিল্পী। এ শিল্পের প্রতীকী চেতনার ঐশ্বর্যে ভাস্বর তিনি এক অনন্য নান্দনিক। মাত্র ক’বছর আগেও আমাদের শিল্প বিশ্লেষকরা ক্যামেরার ছবিকে শিল্প মর্যাদার স্বীকৃতি দিতে অনীহা প্রকাশ করতেন এবং বলতেন এটা যান্ত্রিক। তারা আরো বলতো এখানে মন-মানস ও হৃদয়ের পরশ নেই, সুতরাং তা শিল্পকলার অপহ্নতি ঘটায়। এ বিষয়ে বরং কলাকৈবল্যবাদীরা বেশি উগ্র ছিলেন।

আমি দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলবো শাকুরের ছবিকে কে যান্ত্রিক বলবেন? শাকুরের মন-মানস ও হৃদয় যেমন মমতার আধারে আলোকিত তেমনি তার শৈল্পিক হাতের কোমল পরশে তোলা ক্যামেরার ছবিও যান্ত্রিকতার উত্তরণে রূপক, প্রতীক ও শৈল্পিক উত্তরণে, নান্দনিক বিভায় ঐশ্বর্যমণ্ডিত। এখানে রয়েছে একটি চিরন্তন অভিধা। ক্যামেরার ছবির রূপক ও প্রতীকীয়তায় আমি সব সময়ই নওয়াজেশ আহমদ ও শাকুর মজিদের নাম উচ্চারণ করি। তার ছবি দেখলেই মনে হয় এখানে রয়েছে হৃদয়ের অভিব্যক্তি, কোমল হাতের পরশ এবং ভালোবাসার অভিব্যক্তি ও উজ্জ্বল অনুভূতি। শাকুরের ছবি দেখে আমার মনে হয়, তার ক্যামেরা যেন শিল্পীর হাতের তুলি হয়ে ওঠেছে।

শাকুরের ছবিকে কোনো কোনো চিত্র সমালোচক তথ্যচিত্র বা প্রামাণ্য চিত্র বলেছেন। এ বিষয়ে আমি বিভাব ভাবনার অভিসারী ও দ্বিমাত্রিকতায় অবসিত। সমস্ত অধ্যাসকে এড়িয়ে একটু শৈল্পিক অভিভাবনার বলয়ে নিজকে অভিযোজন করলেই বোঝা যাবে যে, তথ্যচিত্র বা প্রামাণ্য চিত্র চোখ দিয়ে দেখার ও কান দিয়ে  শোনার। তথ্যচিত্র দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছতা ও স্থুলতাকে অতিক্রম করে হৃদ্যিক অনুভূতির প্রগাঢ়তা নিয়ে অলৌকিত আনন্দভারে শিল্পলোকে পাখা মেলতে পারে না। কিন্তু শাকুরের ছবিগুলো যারা দেখছেন তারা আমার সাথে একমত হবেন যে, এসব ছবিতে যেমন ফুটে ওঠেছে মানব মনের অন্তর্লীন রহস্যের চিত্র তেমনি মনন, দর্শন ও অন্তরের অনুভূতির প্রগাঢ়তায় কলামণ্ডিত হয়েছে।

যে জাতি তার উৎসের সন্ধান, স্বরূপের সন্ধান এবং শিকড়ের সন্ধান জানে না ও শিকড় সম্পৃক্ত নয় সে জাতিকে গ্লানির ঘানি টানতেই হবে। পরগাছা হয়ে টবের গাছ হয়ে এবং পরের ভিতে দাঁড়িয়ে কখনো শির তুলে দাঁড়াতে পারে না কোনো জাতি।

আমাদের রয়েছে একটি মহিমান্বিত অতীত ও গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। আমাদের সাহিত্য মানবতাশ্রয়ী-আমাদের সংস্কৃতি মৃত্তিকাশ্রয়ী। ধানে-দুর্বায় আর হরিদাসীর সিঁথির সিঁদুর ও সখিনার লাজনম্র ঘোমটায় আমাদের সংস্কৃতি অফুরন্ত শ্রী-তে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। চর্যাপদেরও পূর্বে একজন বাঙালি কবির নন্দিত উচ্চারণ

গঙ্গার জল যেমন পুণ্য ও পবিত্র তেমনি বঙ্গালদেশ ও বঙ্গালবাণী পুণ্য ও পবিত্র।

আমাদের লোকসাহিত্য ও লোকজ ঐতিহ্য বৈশ্বিক আবেদনে ভাস্বর। আমরা কোনো দেউলিয়ে জাতি নই। আমাদের পায়ের নিচে রয়েছে হিমালয়ের মতো শক্ত একটি ভিত্তি। আমাদের পাহাড়পুর, ময়নামতি, মহাস্থান গড়, ওয়ারী বটেশ্বর আমাদের এই ভিত্তি যেমন গড়েছে তেমনি আমাদের প্রাণের স্তরে স্তরে আত্মার গভীরে, হৃদস্পন্দনে ও রক্তপ্রবাহে রয়েছে মহান ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের সামনে রয়েছে অপরাজেয় বাংলা, শহীদ মিনার ও শহীদ স্মৃতিসৌধ। এখানেই খুঁজতে হবে আমাদের উৎসের সন্ধান, স্বরূপের সন্ধান ও শিকড়ের সন্ধান।

নান্দনিক শিল্পী শাকুর মজিদ তার শিল্পকার্যে অঙ্গুলি নির্দেশ করে আমাদের দেখিয়েছেন যে, আমাদের যা কিছু করা প্রয়োজন তা আমাদের ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই করতে হবে এবং উৎসের সন্ধানে স্বরূপের সন্ধানে ও শিকড়ের সন্ধানে তৎপর হতে হবে।

আমাকে উর্পযুক্ত উচ্চারণের আশ্রয় নিতে হলো শাকুর মজিদের ‘ভাটির পুরুষ’ এর মতো মহৎ শিল্পকর্ম উপভোগ করে। শাকুর বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিমকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। এ আবিষ্কারের বেড়াজাল দিয়ে তিনি টেনে এনেছেন আমাদের লোক-সংস্কৃতি, লোকজ-ঐতিহ্য ও হাজার বছরের বাঙালির জন জীবনের ধারাকে। এখানে শাকুর মজিদ জীবন শিল্পী, সন্ধানী শিল্পী এবং আমাদের ঐতিহ্যের নবমূল্যায়নে একজন সৃজনশীল পথিকৃত।

অভিজ্ঞতার বাইরে গেলেই শিল্পীকে হাস্যাস্পদ হতে হয়। শিল্পকলায় থাকবে জীবনবোধ, পরিমিতিবোধ। দেশ-সমাজ-মানুষ ও কালপ্রবাহের অভিজ্ঞা আর প্রজ্ঞায় অবশ্যিই ঋদ্ধ হলে তবে শৈল্পিক প্রকর্ষণায় উৎকর্ষতা আসবে।

কোনো শিল্পী স্বর্গ থেকে বা আকাশ থেকে নেমে আসেন না। তারা দেশ ও কালের, মাটি ও মানুষের পরশ নিয়েই তো শিল্পী। সুখে-দুঃখে, দ্ব›েদ্ব-সংঘাত, আঘাতে-অভিঘাতে, ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তক্ষরিত হৃদয়ের চিত্র উন্মোচন এবং মানুষের কাছ থেকে যে প্রেম ও ভালোবাসা এবং হিংসা নিন্দার তরলগরল পান করেন একজন শিল্পী, একেই তার শিল্পকর্মে নানাবর্ণে, নানা অভিভাসে চিত্রিত করেন। এখানে যিনি সার্থক তিনিই জীবন শিল্পী। শাকুর মজিদও এ অভিধায় একজন জীবন শিল্পী। বর্তমানে আমাদের ছায়াছবির জগতে যেন সুরের রাজ্যে চলেছে অসুরের উৎপাত। শিল্প সৃষ্টির কৃত্রিম পণ্যে পাঠকের মন ভুলানোতেই তারা বণিকবৃত্তির প্রাধান্য কলা-জগতে কৌলিণ্যের প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়

সেটা সত্য হোক;

শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ।

সত্যমূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতিকরা চুরি

ভালো নয়, ভালো নয় নকল সে শৌখিন মজপুরি।

শাকুর মজিদ গভীর জীবনবোধ, সামাজিক বাস্তবতা ও মানবমনের অন্তর্লীন রহস্য, অবদমিত মনের কামনা বাসনা এবং আমাদের থেকে সমাজের অভিজ্ঞা ও প্রজ্ঞা নিয়ে ভিডিও ফরমেটে কিছু ছায়াছবি নির্মাণ করেছেন। যেখানে তিনি আমাদের পুরো সমাজটাকে টেনে এনেছেন। আমি এখানে তার কয়েকটি ছবির নাম উলে­খ করছি  – নাইওরী, বৈরাতী, লন্ডনী কইন্যা, শেষদৃশ্য, চেরাগ, আজ আমার দিন, করিমুন্নেছা, সবুজ মাটির মায়া, একটি লাল শাড়ি ও ভাটির পুরুষ।

এ সমস্ত ছবিতে শাকুরের পরিমিতিবোধ, শৈল্পিক ঔচিত্য, সংযমিত মানসিকতা এবং নান্দনিকতা ও পরিচ্ছন্ন শিল্প নৈপুণ্য উজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেছে। এখানেই শাকুর জীবন শিল্পী। তিনি চোখ ও কানে নয়, মন ও হৃদয় দিয়ে সব দেখেছেন ও উপলব্ধির অভিব্যঞ্জনায় রাঙিয়ে তুলেছেন ।

শাকুরের সমস্ত শিল্পকর্ম এই স্বল্পপরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। তবে আমি শুধু তার ‘লন্ডনী কইন্যা’ প্রসঙ্গে সামান্য আলোকপাত করবো। এক তীব্র সামাজিক বাস্তবতার দ্ব›দ্ব ও সংঘাত এই ছবিতে তুলে ধরেছেন শাকুর। অর্থ, সমাজ ও মোহ ছাড়াও এ ছবিতে রয়েছে তীব্র সাংস্কৃতিক সংকট। ছবিটি এতোই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল যে, ছিদ্রান্বেষীদের কাছে হিংসার পাত্র হয়ে ওঠেছিল শাকুর। শাকুর মজিদের হাতে কখনো কখনো ক্যামেরা আবার শিল্পীর কলম রূপে অফুরন্ত নান্দনিক বিভায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কেউ হয়তো অনুসন্ধিৎসু হয়ে জানতে চাইবেন চিত্রনির্মাতা আর ক্যামেরায় চোখ রাখা শাকুর কলানৈপুণ্য দক্ষ না সাহিত্যিক শাকুর দক্ষ। তবে প্রথমেই আমাদের একটা অভিধায় অভিযোজিত হতে হবে যে, ক্যামেরা ও চিত্রনির্মাতা শাকুর এবং সাহিত্যিক শাকুর কখনো চোখ দিয়ে দেখেন না এবং কান দিয়ে শোনে না। তার দেখা ও শোনা হৃদয় ও মন দিয়ে। এজন্যই তার কোনো শিল্পকর্মই বাইরের না হয়ে আমাদের অন্তরের হয়, আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে।

শাকুর মজিদের জীবনে অন্য একটি বিষয় বিশেষভাবে অভিযোজিত যে, তিনি ভ্রমণ পিপাসু। নন্দিত কণ্ঠে শাকুরের উজ্জ্বল উচ্চারণ হতে পারে-

কত অজানারে জানাইলে তুমি কত ঘরে দিলে ঠাঁই

দূরকে করিলে নিকট বন্ধু পরকে করিলে ভাই।

আমার ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে যাবার সৌভাগ্য হয়নি কিন্তু এ সৌভাগ্যের দুয়ার আমাকে উন্মোচন করে দিয়েছেন শাকুর মজিদ। যারা তার ‘আমিরাতে তেরোরাত’, ‘হো চি মিনের দেশে’, ‘পাবলো নেরুদার দেশে’, ‘সক্রেটিসের বাড়ি’ ও ‘কালাপানি’ পড়েছেন তারাও আমার মনে হয় শাকুরের সাথে ভ্রমণসঙ্গী হয়েছেন।

বিস্ময়ের বিষয় ‘শাকুর মজিদ’ এ পর্যন্ত ২৬টি দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং যে সরকারি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের জন্য ট্র্যাভেল শো তৈরি করেছেন প্রায় একশো পর্ব এবং নাটক ও টেলিফিল্ম তৈরি করে তিনি জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে পুরস্কার পেয়েছেন বিশটি।

একটি বিষয় এখানে উলে­খ্য যে, শাকুরের দেশভ্রমণ শুধু বিলাসী দেশ ভ্রমণ নয় বা প্রাকৃতিক দৃশ্য, নিসর্গ ঐশ্বর্য এবং নান্দনিক ঐশ্বর্যে বিস্ময় বিমুগ্ধ হওয়া নয়। যেখানেই তিনি গেছেন সেখানেই তিনি একজন গবেষক, একজন ঐতিহাসিক, একজন সমাজবিজ্ঞানী নৃ-তাত্তি¡ক বিশ্লেষক, পুরাতত্ত¡বিদ ও অনুসন্ধিৎসু ।

জীবনানন্দ দাশ আমাদের নিয়ে গেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেমন

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

তবে শাকুর আমাদের নিয়ে গেছেন বিশ্বের বিস্ময় ২৬টি দেশে এবং আমাকে বিশেষভাবে নিয়ে গেছেন ‘সক্রেটিসের বাড়ি’, ‘পাবলো নেরুদার দেশে’, ‘হো চি মিনের দেশে’ও সাম্রাজ্যবাদ ও কুক্ষ্যাত ইংরেজ শাসকের দণ্ডকদ্বীপ আন্দামানে। শাকুরের উপর্যুক্ত বইগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে শাকুর আমাকে নিয়ে যায়নি, আমি নিজেই সেখানে গিয়েছিÑআমি নিজেই ঐ দেশগুলোর একজন গবেষক, ঐতিহাসিক, নৃতাত্তি¡ক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও কবি এবং সাহিত্যিক। আমি বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়েছিÑমুগ্ধতা আমাকে ভরে দিয়েছে সোপানের পর সোপান, ঘটনার পর ঘটনা, ছবির গ্যালারিতে দেখছি একটির পর একটি ছবি। প্রতিটি দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, সাহিত্য ও দর্শন, ভূগোল ও নান্দনিক ঐশ্বর্য এক কথা গোটা দেশটা যেন পড়িয়ে এনে আমাকে উপহার দিয়েছেন। আমার মনে হয়েছে আমি সেখানে ছিলাম, আমি সেখানে আছি এবং আমি সেখানে থাকবো। প্রতিটি দেশের মাটি দিয়ে শাকুর আমাকে কপালে টিপ পরিয়ে দিয়েছেন। আমি নিজে যেতে পারিনি কিন্তু সেখানে যেন আমাকে মানস-ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছেন নন্দিত শিল্পী শাকুর মজিদ।

শাকুর মজিদের ‘হো চি মিনের দেশে’ পড়ে মনে হয়েছে ভিয়েতনামের সেই বারো বছরের সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরব গাঁথার একজন বিজয়ী বীরযোদ্ধা যেনো শাকুর নিজেই। দেশের মানুষের দেশাত্ববোধ, আত্মত্যাগ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রেমপ্রকৃতি এবং জনজীবনের চালচিত্র আর নদী-নালার সাথে একাত্ম হয়ে গেছেন শাকুর। একজন বড়মাপের শিল্পী সবসময়ই তার শিল্পকর্মের ঘটনা ও কাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে যান। শাকুরও তাই করেছেন।

শাকুর মজিদের ‘সক্রেটিসের বাড়ি’ ও ‘পাবলো নেরুদার দেশে’ বই দু’টির প্রতি আমার প্রগাঢ় দুর্বলতা। আমার এ দুর্বলতার উৎসারণ শাকুর নিজেই। চষধঃড়-এর লেখা মহৎ গ্রন্থ ‘ ঞযব খধংঃ উধুং ড়ভ ঝড়পৎধঃবং’ আমি অনুবাদ করেছি ‘সক্রেটিসের শেষ দিনগুলি’ শিরোনামে। সক্রেটিসের ওপর আমার অন্য আরো একটি গ্রন্থ ‘সক্রেটিসের জবানবন্দি ও মৃতুদণ্ড’। মানুষের মধ্যে যাকে আমি প্রথমে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তিনি মহান দার্শনিক সক্রেটিস। সক্রেটিস নামটিই আমাদের কাছে এক উজ্জ্বল ও আলোকিত উচ্চারণ। এথেনীয় গ্রিক সমাজ ও সভ্যতার চরম উৎকর্ষে যে মহান দার্শনিক বিশ্ব সভ্যতাকে আপন বিভায় উজ্জ্বল ও আলোকিত করেছিলেন তিনিই মহান দার্শনিক সক্রেটিস। সেদিন এথেন্সের জনাকীর্ণ আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি অবিনাশী কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেনÑ

‘জীবন মহৎ কাজের জন্য এবং মহৎ কাজের উদ্দেশ্য থাকলে কোনো একজন মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন বড়ো নয়Ñতাকে শুধু ভাবতে হবে এবং দেখতে হবে স্বীয়কার্য সাধনে সে কোথাও কোনো অন্যায় বা অবিচারের আশ্রয় নিয়েই  কি-না, দেখতে হবে সে সত্যের সন্ধানে অনুসন্ধিৎসু ছিলো কি-না এবং এই পৃথিবীতে জীবন-যাপন করতে গিয়ে মহৎ কিম্বা হীন কোনো মানুষের ভূমিকা পালন করেছেন।

আমি গ্রিসে সক্রেটিসের এই বাড়িতে যাইনি। কিন্তু শাকুর আমাকে নিয়ে গেছেন এই সক্রেটিসের বাড়ি। আমাকে হাতে ধরে দেখালেন পুরাতন এথেন্স ও আধুনিক এথেন্স, অলিম্পিয়ান জিউস মন্দির, থিয়েটার অব হিরোডিস এটিকাস, ডায়ানেসিস থিয়েটার, এক্রোপলিসের প্রপেলিয়া পার্থেনেন, এথেনাদেবীর মূর্তি, এরিকথিয়ন মন্দির, এগোরা, সক্রেটিসের মূর্তি, সক্রেটিসের ক্লাস, সক্রেটিসের আমলের এগোরা, হেমলক পানরত সক্রেটিসকে বন্দি করে রাখা জেলখানা, সক্রেটিসের বাড়ি।

শাকুর মজিদের বরাতে আমি গিয়েছি সক্রেটিসের বাড়ি এবং বার বার আমার চোখ ভেসে ওঠেছে হেমলকের পেয়ালা হাতে বসে আছেন সক্রেটিস, সামনে বসা প্লেটো, ক্রটো, ফিডো প্রমুখ শিষ্যমণ্ডলি। সক্রেটিস হেমলক পান করেছেন আর রেখে যাচ্ছেন তার চিরন্তন বক্তব্য।

আমি যেমন সক্রেটিসের দেশে যাইনি তেমনি যাইনি পাবলো নেরুদার দেশেও। কিন্তু সেখানেও শাকুর মজিদ আমাকে নিয়ে গেছেন। সক্রেটিসের মতো পাবলো নিরুদার প্রতিও আমার অসীম দুর্বলতা, এ দুবর্লতা সম্মোহনেই তার ওপর আমার দু’টি গ্রন্থ-

পাবলো নেরুদার প্রেম ও বিপ্লবের কবিতা, অনন্যা প্রকাশনী, ঢাকা

পাবলো নেরুদার কবিতা (ভাষ্যন্তর), অনন্যা প্রকাশনী, ঢাকা

পাবলো নেরুদা আমাদের কাছে শুধু একটি সম্মোহক নাম নয় এবং তিনি শুধু সাহিত্যে নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত কবি হিসেবেই পরিচিত নন। বিশ্ব শান্তির শ্বেত কপোত হিসেবে এবং মানবতাবাদী ও যুদ্ধ বিরোধী চেতনায় শান্তির দূত হিসেবে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে নন্দিত ও শ্রদ্ধান্বিত ব্যক্তিত্ব।

এই মহান মানবতাবাদী কবি সারাজীবন নিবেদিত ছিলেন সমাজতন্ত্র, বিপ্লব, মেহনতি মানুষের মুক্তি ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। এই মহান কবি একজন সফল ক‚টনীতিবিদও ছিলেন। তিনি আমাদের পার্শ্ববর্তী বার্মায় ছিলেন কয়েক বছর এবং দিলি­ ও কোলকাতায়ও এসেছেন কয়েকবার।

পাবলো নেরুদা জীবনবাদী ও জীবনপিপাসু কবি ব্যক্তিত্ব। ত্যাগে ও ভোগে এবং বিপ্লবে ও প্রেমে তার জীবন এক সম সমীকরণের মোহনীয় মোহনায় মিলন ঘটেছিলো। নেরুদা কমিউনিস্ট পার্টি করেছেন এবং সমাজতন্ত্র ও মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে আপোসহীন-লড়াকু কমরেড তেমনি তিনি জীবনবাদী ও দেহভোগী। তিনি প্রেমিক, যৌনতা ও নারী আসঙ্গ সুখে-সুখী তৃপ্ত এক প্রাণবন্ত ও রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষ। নেরুদার জন্মভূমি (আমরা বলি মাতৃভূমি আর তারা বলে পিতৃভূমি) চিলি। আগেই উলে­খ করেছি এই চিলিতে সশরীরে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়নি কিন্তু এই চিলিতেও আমাকে নিয়ে গেছেন নন্দিত শিল্পী শাকুর মজিদ।

শাকুর আমাকে হাত ধরে দেখিয়েছেন আন্দিজের শৃঙ্গঘেরা প্রাচীরণ পাথুরে স্থাপত্য নিদর্শন, কয়েক শতকের দংশনে ক্ষয়িত দুর্গশির বেয়ে নেমে আসা জলপ্রপাত, তুষারবৃত পাহাড়-পর্বত আর আমার সামনে তুলে ধরেছেন চিলির ইতিহাস ও ঐতিহ্য, চিলির স্বাধীনতা সংগ্রাম।

শাকুরের ক্যামেরা যেমন  জীবন্ত তেমনি তার গদ্যভাষা প্রাঞ্জল ও প্রাণবন্ত। তিনি পরিচ্ছন্ন গদ্য লিখেন। ঘটনা কাহিনী ও অভিব্যক্তিময় উপস্থাপনায় শাকুর মজিদ নিখুঁত কলা-নৈপুণ্যের অভিধায়ক। নাটকীয়তা, কাব্যময়তা এবং অভিযোজিত আকর্ষণে তার উপস্থাপিত ঘটনা ও বিষয়বস্তু হৃদয়স্পর্শী ও উপভোগ্য হয়ে ওঠে। অসংখ্য চিত্রময়তা আর কারুময়তা তার শিল্পকর্মে অজস্র নান্দনিক ঐশ্বর্যে দ্যুতিময় হয়ে আলো ছড়ায়।

বঙ্কিমের ভাষায় বিষয়ানুসারেই রচনার ভাষা হবে। শাকুর মজিদের ভাষা আলোচনা প্রসঙ্গে আমাকে জিজ্ঞাসু ও অনুসন্ধিৎসু করে তুলে। দুর্গাদেবীর দশহাত দশদিকে প্রসারিত। কিন্তু শাকুরের হাত কটি? একই হাতে কি তার স্থপতির নান্দনিকতা, ক্যামেরার ছবির উজ্জ্বলতা ও পেলবতা সাহিত্যে কলানৈপুণ্যের পূর্ণতা! মাঝে মাঝে আমাকে বিস্মিত করে তিন মৌলিক শিল্পী কী করে একই মিলন মোহনার মেলায় অভিযোজিত হলো!

শাকুরের জন্মদিনে আমি কামনা করি তার উজ্জ্বল জীবন, সুস্বাস্থ্য এবং অফুরন্ত শ্রী। তার স্ত্রী মৌলিক গবেষক ও নন্দিত অধ্যাপক ড. হোসনে আরা জলী এবং  সন্তানদের জন্যও একই কামনা।

আবার শাকুরের জন্য আমার প্রার্থনা

আনন্দলোকে মঙ্গল আলোকে

ভরে উঠুক তোমার জীবন।

এবং

তোমার অভিনন্দন হোক

লোকে লোকে আলোকে আলোকে।

লেখক : অধ্যাপক, মৌলিক গবেষক ও সাহিত্যিক।

 

 

মন্তব্য
Loading...