ছবি তোলার নেশায় আমাকে কবে পেয়েছিলো ঠিক মনে করতে পারি না। তবে আমার যখন ১৪-১৫ বছর বয়স, সে সময় বাবার কাছ থেকে একটা ক্যামেরা পেয়েছিলাম। কোডাক এর ক্যামেরা । এর ভেতর ফিল্ম ঢোকানোর যে ব্যবস্থা ছিলো, আমার তা জানা ছিলো না। আমি জোর করে ক্যামেরা খুলতে গিয়ে প্রথম দিনই ক্যামেরাটা নষ্ট করে ফেলি। সিলেটের কতগুলো স্টুডিওতে ঘুরে ঘুরে কোনো মেকানিক পাইনি ক্যামেরা সারানোর জন্য।
ক্যামেরার প্রতি একটা খায়েস জন্মে আমি যখন দশম শ্রেণিতে। তখন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়ি। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়টুকুতে কলেজের নিয়মকানুন পরীক্ষার্থীদের মধ্যে শিথিল হয়ে যেতো। আমাদের হাউজের দুইজন দুটো ক্যামেরা নিয়ে আসে। তার একটি পিনহোল, টিপ দিলে ছবি ওঠে। আরেকটি ক্যামেরা বড় অদ্ভুদ ছিলো, ইয়াশিকা। ওটাতে ফোকাস করার বিষয় ছিলো। ভিউ ফাইন্ডারে তাকালে একটা গোলাকার চাকতি ভেসে আসতো, তাতে একটা বৃত্তের মধ্যে চারটা ভাগ। উপরে নিচের লাইন সোজা হলে ধরে নিতে হতো যে ফোকাস হয়েছে। এটা আমাকে প্রথম শেখায় এই ক্যামেরার মালিক আহমেদ। আমরা ছবি তুলি, এবং ফিল্মটি খুলে বাড়িতে নিয়ে যাই। আহমেদ তার ফিল্ম কাওকে ধরতে দেয় না। সে ফিল্ম পাঠাবে শারজাহ, তার ভাইয়ের কাছে। সেখান থেকে ছবি হয়ে আসবে। রঙিন ছবি প্রসেস করার মেশিন তখন চট্টগ্রামে আসেনি।

আমরা ৫ জন মিলে একবার একটা রঙিন ফিল্ম কিনি। আহমেদকে তোয়াজ করে তার ক্যামেরা নিয়ে তার কাছে ফিল্ম ভরতে শিখি, ফোকাস করা শিখি, এপারচার-শাটার স্পিড বুঝি না, শুধু বুঝি কড়া রোদে ছবি তুললে ১৬তে, কম রোদে হলে ৮ এ আর ছায়ার মধ্যে তুললে ৪ এ দিয়ে ছবি তুলতে হয়।

এই ফিল্ম  নিয়ে আমি ছুটিতে বাড়ি নিয়ে যাই এবং আমার বন্ধু ছানুর কাছে লোক মারফত পাঠিয়ে দেই দুবাই। মাস দুই পর কলেজের ঠিকানায় একটা প্যাকেট আসে। প্রতিটি ছবি দুই কপি করে প্রিন্ট করা। সবগুলো রঙিন ছবি। কেমন যেন ঝকঝক করে সব কিছু। লাল ফুল, সবুজ পাতা, নীল আকাশ এর আগে আমার নিজের কোনো ছবিতে দেখিনা। আমি মহা আপ্লুত হয়ে পড়ি আরো ছবি তোলার জন্য, কিন্তু ক্যামেরা পাবো কোথায়? কে দেবে আমাকে ছবি তুলে দেবার সুযোগ?

এরপর অবশ্য ছবি তোলার সুযোগ পাই বছর খানেক পর। ক্লাসের সবাই শিক্ষা সফরে যাবে, সঙ্গে যাবে কালেজের ক্যামেরাও। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর জন্য যত ছেলের আগ্রহ, তার পেছনে থাকতে অনুৎসাহীদের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। এই সুযোগে আমি ক্যামেরা হাতাই। আমার গলার মধ্যে ক্যামেরার ফিতা ঝুলিয়ে রাখতেই আমার ভালো লাগে। আমি ক্যামেরায় ফোকাস করা জানি, আমার সমস্য নাই।

এক্সকারশন এর পর ক্যামেরা ফেরত দেয়ার পর আবার ক্যামেরা ছু’তে সময় লাগে আরো প্রায় দু’বছর। অনেক অনুনয় বিনয় করে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী আমার এক চাচাতো ভাইকে দিয়ে আমি একটা ক্যামেরা আনাই। এটা ইয়াশিকা এমএফটু অটো ফোকাস। আমি ব্লাক-এন্ড হোয়াইট একটা ফিল্ম ভরে এটা দিয়ে গ্রামের মানুষের ছবি তুলি। বাড়ির পাশে খালের উপর হাঁসের চলাফেরা, পুকুরে ঝাপ দেয়া শিশু কিশোর, কিংবা গরুর পাল নিয়ে আসা রাখাল বালক।

আমি ব্লাক-এন্ড হোয়াইট একটা ফিল্ম ভরে এটা দিয়ে গ্রামের মানুষের ছবি তুলি, ১৯৮৪

১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ঢাকা চলে আসি। সঙ্গে আমার ইয়াশিকা এমএফটু অটোফোকাস। আমি ঢাকার ছবি তুলি। পত্রিকায় পত্রিকায় ঘুরি ফিচার লেখার জন্য। ফিচারের সঙ্গে ছবি থাকলে ভালো হয়। আমি এই ক্যামেরাতে ছবি তুলতে থাকি।

দুরন্ত শৈশব ১৯৮৫

বাবার জীবদ্দশায় ক্যামেরা পেলামনা। তাঁর মৃত্যুর কয়েকমাস পর আমার জন্য একটা ক্যামেরা এলো। দুবাই থেকে আমার চাচাতো ভাই একটা ক্যামেরা পাঠালেন। ইয়াসিকা এফএম টু, অটোফোকাস। সঙ্গে একটা ম্যানুয়েল।এটা পড়েই বুঝে ফেলি, ছবি তোলা অতীব সহজ একটি কাজ । ক্যামেরার সঙ্গে লাগানো চামড়ার প্যাকেটের বোতাম খুলে ক্যামেরা অন করে একটা বোতামে চাপ দিলেই ছবি ওঠে যায়। আমি এ ক্যামেরা নিয়ে ঢাকা চলে যাই ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। বুয়েটে ক্লাস শুরু হতে আরও দু’মাস বাকী। আমি টিউশনি ধরি আর বিভিন্ন সাপ্তাহিক-পাক্ষিকের অফিসে ঘোরাঘুরি করি, এসাইনমেন্ট নেই। লেখার সঙ্গে ছবির দরকার হলে সব সম্পাদককে বলি, আমার ক্যামেরা আছে, আমি নিজে ছবি তুলে দেবো। এবং যথারীতি আমি নিউমার্কেটের সবচেয়ে সস্তার দোকান খোঁজে বের করে ফেলি। পত্রিকার জন্য সাদাকালো ছবি দরকার, তাই সবচেয়ে সস্তায় সাদাকালো ফিল্ম কিনি ২০-২৫ টাকায়, ১০টাকায় নিগেটিভ প্রসেস করি, ২ টাকায় বি-টু সাইজের ছবি প্রিন্ট করে লেখার সঙ্গে ছবিও জমা দেই। এ কারনে আমার লেখার বিলের সঙ্গে ৪০-৫০টাকা যোগ হয়, আমার চলে যায়।

এ ক্যামেরাতে ছবি তুলতে তুলতে এবং অনেকগুলো ফিল্ম খরচ করতে করতে আমি কিছু জিনিস শিখি। দিনের কোন বেলার আলোয় ছবি তুললে কেমন আসে, রাতের বেলা ছবি কেন কালো হয়ে যায়, ফ্ল্যাশ লাইট কতোটুকু দুরত্ব কভার করে, ক্যামেরার কতটুকু কাছে এলে আর কারো মুখের ছবি তোলা যায় না, এ সব শিখি নিজের ভুল থেকে। সঙ্গে গাইড বইটাও মিলিয়ে নেই। সেখানেও চমৎকার কিছু নির্দেশবলী ছিল, তার কাছ থেকেই জানি। ফটোগ্রাফির প্রথম শিক্ষক ছিলেন আমার –ক্যামেরা ম্যানুয়েল পুস্তকখানী।

১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বুয়েটে আমাদের ক্লাস শুরু হয়। মাস তিনেকের মাথায়ই একটা বড়ো ছুটি পেয়ে গেলাম- এরশাদ ভ্যাকেশন। আমি ক্যামেরা নিয়ে বাড়ি যাই। ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে বিয়ানীবাজার, সেখান থেকে রিকশায় নিজের গ্রামের ইদ্গাহ বাজার, তারপর পায়ে হেঁটে বাড়ি। রিক্সা থেকে নেমেই আমি ক্যামেরাটা ব্যাগ থেকে বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখি। তার দু’টো কারন। এক- আমার একটা ক্যামেরা আছে, সাংবাদিক-সাংবাদিক ভাব, এটা জনগনের জানা ভালো। দুই- হঠাত করে মজার কিছু সামনে পড়ে গেলে ঝটাপট শাটার টেপা যায়। এ শাটার টেপাও অনেক হিসেব করে করতে হয়। ফিল্ম এনেছি ১ রোল, তাতে সাকুল্লে ৩৬ টা ছবি তোলা যাবে। এর বেশী না। সুতরাং বুঝে শুনে শাটার টেপা।

১৯৮৫ সালে তোলা অটোফোকাস ক্যামেরা ইয়াশিকা এমএফটু তে

আমি বাড়ির পুকুর পাড়ে এসে যখন পৌঁছই তখন ভর দুপুর । দেখি পুকুরের ঘাট থেকে একজন একজন করে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ছে, সুইমিং পুলে যেমন করে ডাইভ দেয়া হয়, অনেকটা সেরকম। যারা এ ডাইভিং খেলায় মত্ত, তারা আমারই অতীব ঘনিষ্ঠজন- ছোটো ভাই, খালাতো ভাই, চাচাতো ভাই, এবং কারো বয়সই ৭-৮ বছরের বেশী নয় এবং সঙ্গত কারণেই কারো শরীরেই সুইমিং কসটিউম নাই।  তারা বারবার পানিতে নামছে , সাঁতার কেটে আবার পাড়ে উঠে আবার ডাইভ দিচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াই, তাদের দিকে ক্যামেরা তাক করি, আমাকে পাত্তা দেয়ায় মতো সময় তাদের নাই, তারা ডাইভিং-এ ব্যাস্ত। আমি ঠিক করলাম, ছবি তুলবো । অপেক্ষা করছি কখন তাদের দু’জন একসঙ্গে লাফ দেয়। যে মুহুর্তে লাফ দেয়ার জন্য শরীরটা ৪৫ ডিগ্রীর মত একটা কোনে বাঁক নিলো, আমি ক্লিক করে বসি। ফায়ার হয়ে যায়। কিন্তু কী হল, তা বোঝার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয় মাস খানেক সময়। আমার ঢাকা যাওয়া, ফিল্ম প্রসেস করা, বি-টু সাইজে প্রিন্ট নেয়া।

ছবিটা দেখে আমাই চমকিত হই। এটাই চেয়েছিলাম।

এ ছবিটির প্রিন্ট আমার কাছে থাকে অনেকদিন। বহু বছর পর, আবু হাসান শাহরিয়ারকে এ ছবি দেখালাম, তিনি তাঁর ট্যাবলয়েড পত্রিকায় প্রায় অর্ধেক পৃষ্ঠা জুড়ে এ ছবিটি ছাপিয়ে দিলেন। শিরোনাম দিলেন- দুরন্ত শৈশব।

এটাই আমার সংগ্রহে থাকা আমার তোলা সবচেয়ে পুরনো উল্লেখযোগ্য ছবি। ২৯ বছর আগে তোলা এ ছবির পাত্রদের বর্তমান বয়স মধ্য তিরিশ, সবাই বিবাহিত এবং কারো কারো সন্তানের বয়স তাদের ছবির সময়কার বয়েসের চেয়ে বেশী। সেকারনে ছবিটি ফটোশপে কিঞ্চিৎ সম্পাদনা করা হলো।

প্রথম পোর্ট্রেট
১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের ক্লাস শুরু হয় বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে। ক্লাস শুরু হবার মাস খানেকের মাথায় আমার ঠাঁই হয় তিতুমির হলের নীচ তলার ১০৬ নম্বর কামরায়। সিঁড়ির গায়ে লাগানো এই কামরায় কেউ থাকতে চাননা বলে নতুন আমদানিদের সীট পড়ে এখানে।  অন্য যারা তখনো এ রুমের বাসিন্দা ছিলেন, তাদের সঙ্গে আমার দেখা হতো গভীর রাতে। ঘুমাতে এসে তাঁরা গীটার নিয়ে গান বাজনা করতে বসে যেত। আমার তখন বিরক্তির চূড়ান্ত। মুখ ফোটে কিছু বলতেও পারিনা । সকালবেলা তাদেরকে বিছানায় ঘুমের মধ্যে রেখে আমি চলে যাই ক্লাসে। রাতে যখন ফিরি , আমার হাতে পত্র-পত্রিকা, কাঁধে অটোফোকাস ক্যামেরা। আমি তাদেরকে আমার লেখা, পত্রিকায় ছাপানো আমার তোলা ছবি দেখাই । তাঁদের একজন আমার ক্যামেরা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দেন । আমাকে বলেন, এটা দিয়ে তুমি কী ছবি তুলবা ? এতে ফোকাস চেঞ্জ করা যায়না, ক্লোজ আপ ছবি হয়না। তোমার জন্য দরকার এসএলআর ।
আমি তাঁর মুখের দিকে তাকাই। তিনি তাঁর আলমারীর ভেতর থেকে ক্যামেরা বের করেন । বলেন, এটা হচ্ছে এসএলআর – সিঙ্গেল ল্যান্স রিফ্লেক্টিং ক্যামেরা। বলেই খপ করে ক্যামেরা থেকে ল্যান্স খুলে ফেলেন, আবার লাগান। বলেন, সেকেন্ড ইয়ারে ফটোগ্রাফি সেশনাল আছে , এস এল আর লাগবে।
    আমি বলি, আমাদেরকেও শেখাবে ফটোগ্রাফি?
    ভাই বলেন, এটা কম্পলসারি সেশনাল। শিখতেই হবে। ডিপার্টমেন্টের নীচতলায় ডার্করুম আছে, ওখানে নিজের হাতে ছবি প্রিন্ট করতে হবে।
আমি বলি, ওটা কে শেখায় ?
ব্যাপারনা , সময় মতো সব জেনে যাবা।
যদি এখন শিখতে চাই ?
তুমি ঝুমু আর জামীর সঙ্গে যোগাযোগ কর। ল্যাবের চাবি ওদের কাছে থাকে।
পরদিন থেকে আমি ঝুমু ভাই আর জামী ভাইকে খুঁজে বেরকরি এবং তাঁদের টাইমিংটা জেনে নেই। রাতের বেলা তাঁরা ডার্ক রুমে ঢুকবেন । তাঁদের মন জয় করার জন্য আমি বাড়তি খাটনি খাটি। তারা আমাকে রিকশা ভাড়া সহ হিসাব করে টাকা দেন। আমি নিউ মার্কেট যাই, আকসা স্টুডিও থেকে ৬০ টাকা দিয়ে এক প্যাকেট ব্রমাইড পেপার আনি। এক প্যাকেটে ১০ টা শীট থাকে। সঙ্গে হাইপো দানা কিনি, সলিউশন কিনি এবং রাত দশটা বাজার আগেই ডিপার্টমেন্টের নীচ তলায় গিয়ে অপেক্ষা করি। তারা এলে আমি ঢুকি। আমার কাজ হচ্ছে তাঁদের কাজ দেখা। আমি দেখি কেমন করে সবুজ বাতি জ্বালিয়ে নিগেটিভকে প্রসেস করা হয় আবার লাল বাতি জ্বালিয়ে নিগেটিভ থেকে ব্রমাইডের উপর আলো ফেলা হয় । আমি অবাক হয়ে দেখি- ব্রমাইডের উপর এক্সপোজ করা কাগজটি হাইপো মেশানো পানিতে দেয়ার পর কেমন করে ধীরে ধীরে বদলে যায়। প্রথমে চুল আসে, পরে চোখ, নাক, মুখ, কেমন যেন বিকশিত হয়। এটা নির্ভর করে এনলার্জার থেকে কত সময় ধরে আলো ফেলা হয়েছে তার উপর। এটা ঠিক না হলে বারবার করতে হয়। তাতে কাগজের অপচয় হয় বলে প্রথমে কাগজের ছোট ছোট টুকরার উপর স্যাম্পল প্রিন্ট করতে হয়। সে টাইমটা ঠিক মনে হলে তারপরই বড় কাগজের উপর আলো ফেলা, হাইপোতে চুবানো এবং সবশেষে পরিষ্কার প্রবহমান পানিতে তাকে অনেকক্ষণ ধোয়া।
এ কাজটা যথেষ্ট পরিশ্রমের। সবাই করতে চায় না। কিন্তু আমি কেনো যেনো মজা পেয়ে যাই। পরবর্তি্তে আমি তাঁদের কাছ থেকে চাবি নিয়ে একা একা ছবি প্রিন্ট করার কাজটি করতে শুরু করি। প্রথম যে ছবিটা প্রিন্ট করি, তা আমার নিজের ছবি। ঝুমু ভাই তাঁর ক্যামেরায় তুলে আমাকে নিগেটিভ দিয়ে দিলেন, আমি নীরিক্ষা করার জন্য নিজের ছবিটাই বেছে নিলাম। ৩ বার কাগজ নষ্ট করার পর মনে হলো, এ প্রিন্টটা কাওকে দেখানো যায়।
১৯৮৭ সালে সেকেন্ড ইয়ারে ফটোগ্রাফি কোর্সের ক্লাস নিতে আসেন ইফতেখার (মুদি) স্যার। প্রজেক্ট-এর নাম ব্যাকেটিং। পরপর তিনটা ছবি তুলতে হবে। একটায় কম এক্সপোজার, একটায় সঠিক এবং একটায় বেশি। প্রথম তিনটায় এপার্চার বদল এবং পরের তিনটায় সাটার স্পীড বদল করে এ কান্ড ঘটাতে হবে, জমা দিতে হবে নেগেটিভ।
    আমি আমার ক্যামেরা দেখাই স্যারকে। স্যার হাসেন। বলেন- এসএলআর লাগবে। তিনি এপার্চার-সাটার স্পিড গল্প শোনান এবং পরের ক্লাসে নেগেটিভ জমা দেয়ার কথা বলে ক্লাস শেষ করেন।
ইফতেখার স্যার বেশিদিন পড়ান না। তিনি বিদেশ চলে যান। আমাদের ফটোগ্রাফি শেখাতে আসেন সদ্য পাশ করা, ছিপছিপে এক ভাই, ইনান ভাই। তাঁকে আমরা গত বছর দেখেছি ফিফথ ইয়ারে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরাঘুরি করতে । এবার তিনি আমাদের ফটোগ্রাফি ক্লাস নেবে। প্রথম ক্লাসেই তিনি একটা প্রজেক্ট দেন। সাবজেক্ট হচ্ছে – পোর্টেট। আমি ছবি তোলার জন্য অস্থির হয়ে যাই।
    আমি জামি ভাইয়ের ক্যামেরা নিয়ে নিউমার্কেট যাই। ওখান থেকে এফডিসির চোরাই ফিল্ম কিনি ১৫ টাকায় এবং গেটের বাইরে এক ভিখারিনীকে দেখতে পাই। তাঁর ছবি তুলি এবং নিজে প্রিন্ট করে ক্লাস প্রজেক্টে জমা দেই।  এই ছবিটা ক্লাসে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেলো। আমি ক্লাসে কখনোই কোনো বিষয়ে হাইয়েস্ট মার্ক পাই না। মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকি। কিন্তু এখানে হাইয়েস্ট!পোর্ট্রেট তোলার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। কিন্তু বাংলা একাডেমীর বই মেলায় নাসির আলী মামুন নামক এক ফটোগ্রাফারের তোলা কিছু পোর্ট্রেট দেখে আমি বুঝে যাই, আমারটা কিছুই হয়নি। আমার আবার নতুন ভাবে পোর্ট্রেট তোলা শুরু করি।

 অটোগ্রাফ
১৯৮৬-৮৭ সালের ঘটনা । তখনো আমার অটোফোকাস ক্যামেরাই ভরসা। ছবি খুব একটা খারাপ আসেনা। দিনের বেলা রোদের আলো থাকলেই হয়। শুধু খুব কাছে গিয়ে কারো মুখের ছবি তোলা যায়না। ফ্লাসের আলোয় ৬-৭ পর্যন্ত কাভার করে । এ জন্য আমি বেছে বেছে সময়ের ছবি তুলি। আমার ছবি তোলার বিষয় পত্রিকা জন্য লেখা ফিচারে যা দরকার, শুধু সেটুকুই।
ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা নিয়ে একটা ফিচার হবে, প্রচ্ছদ কাহিনী। সুতরাং, আমি বিকেল হলেই বইমেলায় চলে যাই। বড়ো বড়ো লেখকদের দেখি । শামসুর রাহমান আর সইয়েদ শামসুল হক বসে বসে গল্প করছেন, এম আর আখতার মুকুল তাঁর ‘আমি বিজয় দেখেছি’ বই নিয়ে নিজের স্টলে বসেছেন, মুহম্মদ রফিক একটা টেবিলের উপর নিজের বই নিয়ে আছেন পুকুর পাড়ে। কোথাও বসে আছেন রফিক আজাদ, কিংবা ‘এখানে নির্মলেন্দু গুণকে পাওয়া যায়’ শিরোনামের স্টল, এসব। এসময় হুমায়ুন আহমেদেরও কদর শুরু হয়। তাঁর ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটি উপন্যাস হয়ে এসেছে, তাঁকে ঘিরে প্রকাশকদের স্টলে ভিড়। তিনি ভাগ করে করে বিভিন্ন স্টলে গিয়ে বসছেন । তরুণ-তরুনীদের ভিড় তাঁকে নিয়েই দেখি বেশী।
একসময় দেখি এ ভিড়ে এক পরিচিত মহিলা কবিও। তাঁকে আমি তখন চিনি, তিনি তসলিমা নাসরিন। ‘নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’ নামে তাঁরও একটা কবিতার বই বেরিয়েছে। জাতীয় কবিতা পরিষদের আসরে তিনি কবিতা পড়ছেন। কিন্তু তিনিও যে হুমায়ূন আহমেদের এত ভক্ত, জানা ছিলো না।  ১৯৮৬ সালের বইমেলায় তাঁকে দেখেছি এপ্রোন পরা আরো কয়েক তরুনীর সঙ্গে স্টলের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে থাকা হুমায়ুন আহমেদের অটোগ্রাফের জন্য হাত বাড়াতে, সে ছবিও তুলেছিলাম। আবার ১৯৮৭ সালেও যখন হুমায়ুন আহমেদকে ঘিরে থাকা তরুনীদের ছবি তুলতে আমার অটোফোকাস তাক করি, সেখানেও কাকতালীয় ভাবে তাঁকেই পেয়ে যাই।

১৯৮৬ সালের বইমেলায় তাঁকে দেখেছি এপ্রোন পরা আরো কয়েক তরুনীর সঙ্গে স্টলের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে থাকা হুমায়ুন আহমেদের অটোগ্রাফের জন্য হাত বাড়াতে

এ ঘটনার বছর পাঁচেকের মাথায় তসলিমা নাসরিনের বিরাট পরিবর্তন হয়। দুজন ডাক সাইটে সম্পাদকের সাথে তাঁর প্রণয় ও পরবর্তিতে বিবাহের ফলে সেসময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাগজসমূহে তাঁর কলাম ছাপা হতে থাকে। প্রেমের কবিতা দিয়ে শুরু করলেও তিনি নারীবাদি কলাম লেখিকা হিসেবে নাম করেন। কলামের পাশাপাশি পুরুষ ও ধর্ম বিদ্বেষী কিছু লেখার কারনে তিনি বিতর্কিতা হয়ে পড়েন। ১৯৯২ সালে শহীদুল হক খান ‘নাট্যসভা পুরস্কার’ দেবেন ৭ গুনীকে। আমন্ত্রন পত্র আসে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার অফিসে। আমাকে পাঠানো হয় এসাইনমেন্ট কাভার করার জন্য। রিপোর্ট লেখা, ছবি তোলা- দুটোই আমার কাজ। আমার তখন নিজের এস এল আর হয়েছে, মিনোল্টা এফএক্স-৩০০। আমি যথা সময়ে জাতীয় যাদুঘর-এর ছোট্ট হল (সুফিয়া কামাল মিলনায়তন)-এ গিয়ে দেখি কাজী আনোয়ার হোসেন, কবি শামসুর রাহমান প্রমুখ পুরস্কারপ্রাপ্তদের সঙ্গে চমৎকার একটা শাড়ি পড়ে সামনের সারিতে বসে আছেন তসলিমা নাসরিনও। এর আগে তসলিমা নাসরিন কোনো বড়ো পুরস্কার পেয়েছেন বলে শুনিনি।  তবে সে বছরই তিনি কলকাতার ‘আনন্দ পুরস্কার’ও পান। এ নিয়ে বাংলা একাডেমিতে অনেক কথাও বক্তৃতায় বলা হয়েছিলো, সবই পুরস্কারের বিরুদ্ধে।

কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখি, বেশ কিছু গুণমুগ্ধ পাঠক কিছুক্ষণ পরপর তসলিমার কাছে এসে বই খুলে অটোগ্রাফ নিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। তাঁর পাশে কবি শামসুর রাহমান। তিনি চুপচাপ বসে আছেন।
মাত্র ৫ বছরের ব্যাবধানে অটোগ্রাফ দেয়া নেয়া নিয়ে একই মানুষের এমন পরিবর্তন আমাকে চমকিত করে।

তাঁর পাশে কবি শামসুর রাহমান। তিনি চুপচাপ বসে আছেন।

সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় থেকেই বুয়েটের আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের আন-অফিসিয়েল ফটোগ্রাফার হিসেবে আমার একটা কদর হয়ে যায়। ঘটনাটা ঘটে বুয়েটের ‘রজত জয়ন্তি’ উৎসবের সময়, ১৯৮৮ সালে।
রজত জয়ন্তি উপলক্ষে যে স্মরণিকা বেরোবে, আমি তাঁর সম্পাদক। কিন্তু আমি পড়ি সেকেন্ড ইয়ারে, আমার মুরুব্বিরা সবাই ফিফথ ইয়ারের। তাঁরা যা যা বলে দেন, আমি তা তা করি। নামে আমি সম্পাদক, কামে আমি তাঁদের চাকর।
ম্যাগাজিনে অনেক ছবি যাবে।আমি বড়ভাইদের বলি- ছবি তুলবে কে?
কেনো- তুমি তুলবা।
খুব সরল জবাব। আমি নিউমার্কেটে যাই। সস্তার ফিল্ম কিনি।সবগুলো ক্লাসের গ্রুপ ছবি, সাব কমিটির, শিক্ষকদের, ক্লাস এক্টিভিটি, ডিপার্টমেন্টের পরিবেশ, এসবের ছবি তুলে তুলে আমি ২-৩ টা ফিল্ম শেষ করে ফেলি। ছাত্র সংসদের কোষাধ্যক্ষ খোকন ভাইকে বলি- টাকা দেন, ফিল্ম প্রসেস করবো, প্রিন্ট করবো।
–    কত লাগবে?
–    দ্যান, ৩-৪ শ’তো লাগবেই। বেশিও লাগতে পারে। আপনি ৫শ টাকাই দেন। যা লাগে লাগবে, বাকিটা ফেরত পাবেন।
খোকন ভাই আমাকে ১শ টাকা দেন। বলেন, নিউমার্কেট থেকে ফটোপেপার কিনে এনে ল্যাবে নিজে প্রিন্ট করতে। আমি নিউমার্কেট যাই। ৮০ টাকায় এক প্যাকেট ফটোপেপার পাওয়া যায়। এ-ফোর সাইজের ১০টি কাগজ থাকে সেখানে। আর্কিটেক্‌চার ডিপার্টমেন্টের নিচ তলায় ডার্করুম। এই ডার্করুমের চাবি আমার কাছে। আমার নিজের টাকায় কেনা হাইপো আছে, সলিউশন আছে। সুতরাং আর টাকার কী প্রয়োজন! আমার সাথে যোগ দেন ঝুমু ভাই আর জামি ভাই। উনারা থার্ড ইয়ারে। দু’জনে ছবি প্রসেস করতে পারেন। এখানেও আমি কামলা। ঝুমু ভাই ঘড়ি ধরে এক্সপোজার ঠিক করেন। আমার কাজ হাইপোর ভিতর ফটো পেপার চুবিয়ে খুব মোলায়েমভাবে কাগজে ঘষা, যাতে কেমিক্যালের সবটুকু ঠিকমতো কাগজে লাগে। ছবি ঠিক মতো এক্সপোজ হলে কলের পানিতে ধোয়া। ২০ মিনিটের মতো ধুইয়ে তারপর আংটা দিয়ে টাঙিয়ে দিতে হবে ঝুলনো রশির ওপর। এ করে আমি ছবি প্রিন্ট করা শিখে ফেলি। আমার খরচ একদম কমে এসেছে। ৭০ টাকার প্রিন্ট আমি ১০ টাকার কাগজে সারতে পারি।এখন সাবজেক্ট খুজি ছবির।ক্যাম্পাসই আমার সাবজেক্ট।
আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের পশ্চিম পার্শে বুয়েট ক্যাম্পাসের সীমানা বরাবর বড়ো রাস্তার উপর কতোগুলো উচু গাছ। দুপুর বেলা এ গাছ থেকে ছায়া পড়ে পীচ ঢালা রাস্থার উপর। আমি প্রায়ই এ ছায়া দেখি।
বুয়েটের পাশেই পলাশী থেকে নীলক্ষেত বরাবর একটা বিশাল বস্তি। এ বস্তির পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে সাইকেলে চলাচল করা যায়, রিকশা চলেনা। এ বস্তির কিছু শিশুর সঙ্গে আমার খাতির আছে। কারন তাঁদের ছবি তোলার জন্য আমি ওখানে যাই। অনেকেই আমাকে চেনে, কারন তারা আমাকে ক্যাম্পাসে দেখে।কয়েকদিন পরে তাঁরা ডিপার্টমেন্টে এসে আমাকে খোঁজে, তাঁদের ছবি নিয়ে যায়। এরা আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসে বাথরুমের কল থেকে কলসী ভরে ভরে পানি নিয়ে যায়। ঘটনা প্রতিদিনের। কিন্তু একদিন আমি পেয়ে গেলাম। ভাইবোন এসেছে কলসী ভরে পানি নিতে, ফেরার সময় পেছন থেকে আমি তাঁদের দেখি। আমার সঙ্গে থাকে ক্যামেরা, আমি আর দু্যুটি হারাই না।
সাধারনত ‘টপ সান’-এর সময় আমি ছবি তুলিনা।এসময় ছায়া আসে , সাবজেক্ট হারিয়ে যায়। অথচ, ভর দুপুরের কড়া রোদে টপ সানের এ ছবিটা আমার স্মৃতি জাগানিয়া ক্যাম্পাসকে বার বার মনে করিয়ে দেয়।

প্রশান্তি

১৯৮৯ সাল। রুমমেটের ক্যামেরা আমি হেফাজতে রাখি আর খালি সাব্জেক্ট খুজি। আমার সাইকেল আছে একটা। বুয়েটের বাইরে কিছু পত্রিকার অফিসে ছুটোছুটি আর নীলক্ষেত-নিউমার্কেট পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি, এই আমার কাজ।
আমার কালো রঙের একটা ব্যাগ থাকে সবসময়। আর্কিটেকচারের সব ছাত্রকেই এরকম একটা ব্যাগ সঙ্গে রাখতে হয়। এর মধ্যে থাকে কাগজ কাটাকাটির জিনিসপত্র। আমার ব্যাগে বাড়তি থাকে একটা ক্যামেরা। আমি কাজ না থাকলেও বস্তির পাশ দিয়া সাইকেলে মেরে যাই। বস্তিতে সাবজেক্টের অভাব নাই। আর গরিব মানুষের ছবি তোলা বেশী সহজ। কারন তাঁদের প্রাইভেসি নিয়ে তারা চিন্তিত নয়।
বস্তির পাশ দিয়ে গেলে বিকেল বেলা তাঁদের সুখী জীবনের চিত্র পাওয়া যেতো। দুপুরের আহার সেরে তারা আড্ডায় বসতো। এদের বেশীরভাগের পুরুষ সদস্য সস্তা শ্রমের কাজে বাইরে, বস্তিগুলো নারী ও শিশুময়। লাইন ধরে বসে একজন আরেক জনের মাথার উকুন বেছে দিচ্ছি, তলা নিয়ে হয়তো কোনো শিশু মায়ের দুধ খাওয়ার পায়তারা করছে, মা ও ব্যাবস্থা করে দিচ্ছে, সমস্যা নাই।
আমার চেনা জানা পরিসরের বাইরে মা আর সন্তানের আন্তরিক ঘনিষ্ঠতার ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে বেশ কিছু বস্তিতে । ছবি তোলার সময় তারা নিষেধ করা দূরের থাক, কেউ কেউ পাত্তাই দিতো না। কেউ শুধু অনুরোধ করতো ছবিটা পাওয়ার। পরেরবার ছবি নিয়ে গেলে, ঘরের পান-সুপারী খাইয়ে দিতো কেউ কেউ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের এস এম হলের সামনের রাস্তার উপর মায়ের সাথে শিশুর ঘুম, ১৯৮৯

একবার পলাশীর বস্তি (পলাশী নীলক্ষেত)র ছবি তুলে ডিপার্টমেন্টে ফিরছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের এস এম হলের সামনের রাস্তা দিয়ে। সেখানেই একটা গেট ছিলো তখন। গেটের পাশে একটা বড়ো গাছ ছিল। গাছটি আছে, গেটটি নেই। সেই গেটের কাছে ফুটপাথের অপর দেখি শুয়ে আছেন এক মহিলা, তাঁর পাশে এক শিশু। তাঁদের পাশে কিছু খাবারের প্যাকেট। বিকেল বেলা রাস্তা দিয়ে গাড়ি যায়, রিকশা যায়,হর্ণ বাজে, কিন্তু তাতেও দিবানিদ্রার কোনো ব্যাঘাত ঘটছেনা মা এবং শিশুটির। তারা যেহেতু ঘুমিয়েই ছিলো, তাই টের পায়নি বলে আস্তে করে টিপ দিয়ে ছবিটা তুলে চলে এলাম। কী পরিমান নির্ভরতা থাকলে ছোট্ট শিশুটি মার পাশে এমন অরক্ষিত পরিবেশে ঘুমাতে পারে, আমাকে তখন সে কথাই ভাবাচ্ছিলো।

বাবার সাথে সংসদ ভবনে

এর পরের বছর জাতীয় সংসদ ভবনের চত্বরে দেখি এক বাবার পাশেও কী আরামে শুয়ে ঘুমাচ্ছে আরেক শিশু। 

 

রোকশানা ঃ আমার টার্নিং গার্ল

কাওরান বাজার বস্তির রোকশানা আমার ফটোগ্রাফি জীবনটা পালটে দিয়েছিলো। ১৯৯০ সাল। পড়ি বুয়েটের থার্ড ইয়ার আর্কিটেকচারে, থাকি তিতুমীর হলের উত্তর ব্লকের ৪০৪ নম্বর রুমে। আমার টেবিলের সামনের দেয়ালে নিজের হাতে সাদা-কালোয় প্রিন্ট করা কতোগুলো ছবি গাম দিয়ে আটকানো।

একদিন নির্ঝর ভাই (স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর) এলেন আমাদের রুমে কী একটা কারনে। তিনি দেখি সব বাদ দিয়ে তিনি আমার তোলা ছবিগুলো দেখছেন। আমাকে বলেন- তুমিতো ভালোই ছবিতুলো, সামনে একটা ভালো কন্টেস্ট আছে, ইউনিসেফের। সাবজেক্ট- মেয়ে শিশু। ওখানে ছবি দিতে পারো।

আমি বলি, মেয়েশিশু নিয়েতো আমার কোনো ছবি নাই, ছেলেশিশু আছে।

তিনি বলেন, তুলে ফেলো। ৪-৫ দিন মাত্র সময় আছে, বিপিএস এ জমা দিয়ে দাও।

-কোথায়?

-বিপিএস। বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি। এলিফ্যান্ট রোডে অফিস। আজই গিয়ে ফর্ম নিয়ে আসো, ডিটেইলস জেনে আসো।

আমি পরদিন ক্যামেরা নিয়ে বেরোলাম। সঙ্গে আমার লাল রঙের হিরো সাইকেল। এখন মেয়েশিশু পাই কই?

প্রথমে গেলাম হলের পাশের পলাশী বস্তি। সুবিধাজনক মেয়েশিশু চোখে পড়েনা। আমি সাইকেল চালাতেই থাকি। নীলক্ষেত-হাতিরপুর মেরে হাজির হই কাওরান বাজার বস্তিতে। সুন্দরবন হোটেলের পেছন দিকে এখন যেখানে একটা কনভেনশন সেন্টার হয়েছে, সেখানি বস্তিটির অবস্থান। নেমে সাইকেলটা বাইরের মাঠের কোনায় শিকল দিয়ে বেঁধে আমি হাঁটতে থাকি বস্তির ভেতর দিয়ে আর মেয়েশিশু খুজি। দেখি ৭-৮ বছরের একটা মেয়ে ঘরের বেড়ার ভেতর থেকে আমাকে দেখছে। মেয়েটির চাহনীর ভেতর কী যে এক সুন্দর লুকানো ! মনে হলো, দরিদ্র ঘরে জন্ম না হলে এ মেয়েটি ্কী সুন্দর একটা ভবিষ্যতের দিকে যেতে পারতো। আমি তার দুটো ছবি তুলি। একটি খাড়া, আরেকটি আনুভূমিক।

সেদিন আরো অনেক ছবি তুলে ফিল্ম শেষ করে ফেলি এবং নিউমার্কেটে এসে আকসা স্টুডিওতে ফিল্ম প্রসেস করে এক প্যাকেট কাগজ কিনে চলে আসি বুয়েটে, সরাসরি ‘আমার’ ডার্ক রুমে। আর কোনো ছবি পছন্দ হলোনা। এ ছবিটা প্রিন্ট করে পরদিন বিপিএসে গিয়ে জমা দিয়ে দেই। ছবির শিরোনাম দেই, ‘আলোকে অন্ধকারময়’।

এ ছবিটা প্রিন্ট করে পরদিন বিপিএসে গিয়ে জমা দিয়ে দেই। ছবির শিরোনাম দেই, ‘আলোকে অন্ধকারময়’।

এর পরের ঘটনাগুলো অন্যরকম। মাস দুই পরে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছাপা হলো একটা নিউজ। সেখানে মেয়েশিশু বিষয়ক প্রতিযোগিতার ফলাফল ছাপা হয়েছে এবং ৩য় পুরস্কারের পর আরো তিন জনের নাম আছে ‘অনারেবল মেনশন’-এ, প্রথম নামটা আমারই। প্রতিযোগিতার আয়োজক যেহেতু ইউনিসেফ, এরপর পুরষ্কার প্রদান, আলোচনা, সেমিনার সবগুলোতে আমাকে দাওয়াত পাঠানো হতে থাকে। বাংলাদেশ ফোটোগ্রাফিক সোসাইটিতে আমি সদস্য হয়ে যাই, আমাকে যথেষ্ট কদর করতে থাকেন সবাই। যে ৮শ ছবি জমা পড়েছিলো তার প্রায় সবগুলোই পেশাদার বা প্রায়-পেশাদার আলোকচিত্রীর, খুব সামান্যসংখক ছাত্র প্রতিযোগী ছিলো তার মধ্যে আমি একজন। বুয়েটের জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন মির্জা তারেকুল কাদের। তিনি এটা শুনে আমাকে বলেন, একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিতে। তার কয়েকদিন পর ইংরেজি দৈনিক ডেইলী স্টার-এর তিনের পাতায় সিঙ্গেল কলামে আমার ছবি দিয়ে একটা নিউজ ছাপা হয়- BUET Student Awarded in Photography. এটাই ছিলো কোনো পত্রিকায় আমাকে নিয়ে প্রকাশিত প্রথম কোনো সংবাদ।

একসময় দুটো প্রদর্শনী শেষে আমি বাঁধানো ছবিটা ফেরত পাই। ভাবলাম, যে মেয়েটার ছবি তুলে এতো নাম করলাম, তাঁকে ছবিটা দিয়ে দিলে সে খুশী হবে। তাঁকে টাকা দিলেই সে বেশী খুশী হতো, কিন্তু ১-২০০ টাকার বেশী দেবার ক্ষমতা আমার নাই। আমি সেই বাঁধানো ছবিটা নিয়ে আবার যাই কাওরান বাজার বস্তিতে। গিয়ে সেই ঘরের সামনে গিয়ে মেয়েটাকে খুজি। মেয়েটা খেলতে গেছে কোথাও, তার মা গেলেন ডেকে আনতে। একসময় সে এসে দাঁড়ায় আমার সামনে। নাম বলল- রোকশানা। কোনোদিন স্কুলে যায়নি। বাবা রিকশা চালান। তিনি দুপুরে খেতে এসেছিলেন ঘরে, তাঁকে বললাম ছবির কাহিনী।

রোকশানা এবং তার বাবা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিতে হইলো

রোকশানা এবং তার বাবা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিতে হইলো। মাঝে মাঝে মিটমিট করে হাসল। আমি বললাম, যাই !

তারা মাথা নাড়লো।

আমি জানিনা, বাধাই করা ছবিটা রোকশানা কি তার ঘরে রেখেছে? ওখান থেকে বস্তি উঠে গেছে বহু আগে। রোকশানার বয়স এখন ৩২-৩৩ হবে। আমার সঙ্গে কোথাও দেখা হলে তাঁকে চেনার কনো ক্ষমতা আমার নাই।

হে বন্ধু, বিদায়

ভোরের সুর্য অঠার আগে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত কেমন লাগে, এমনটি দেখার জন্য রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই আমরা বেরিয়ে পড়ি মোটেল থেকে। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন তাজু ভাই। ভালো নাম খন্দকার তাজ উদ্দিন, তিনি ২ বছর গ্যাপ দিয়ে এবার ঠিক করেছেন থিসিস জমা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাবেন। ডিজাইন প্রজেক্টের সাইট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বেতবুনিয়ার একটা পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে পুলিশের ট্রেনিং সেন্টার হবে। আমি তার সঙ্গী হয়েছি দুইটা কারনে। দ্বিতীয় কারন, তার সাইটের ছবি তুলে দেয়া। আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায় বিকেল বেলা। আমরা চাইলে ঢাকা ফিরতে পারি, অথবা রাতে থেকে পরদিন। রাতে যদি থাকতেই হয়, তবে বেতবুনিয়া কেনো? অল্প দূরে কক্সবাজার আছে, ওখানেই নাহয় রাত কাটিয়ে সকালের বাসে ঢাকা ফেরা যায়।

কক্সবাজারে আমরা রাত ১০টা নাগাদ পৌঁছই। তখন অন্ধকারে একবার হেঁটে আসি ভেজা উপকূল এবং ভোরের আলোর জন্য প্রতীক্ষা করি। সকাল বেলার প্রথম আলো্য আমরা সমুদ্র তীর দেখবো বলে শেষ রাতে ঘুম থেকে ওঠে তৈরি হয়ে যাই।

১৯৯১ সালের অক্টোবর মাস। একটু শীত পড়েছে । মোটেল থেকে খালি পায়ে বেরোতে বেশ ঠান্ডাই লাগলো। তাজু ভাইর আদেশ- খালি পায়েই যেতে হবে। পায়ের তালুতে ভেজা বালুর ছোঁয়া না লাগলে নাকি কক্সবাজারের সী বিচ কে ফীল করা যাবে না।

তখন আমার দুটো ক্যামেরা। একটায় সাদা কালো ফিল্ম, অপরটিতে রঙ্গিন। আমি সাদা কালো ফিল্মের ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এবং টের পাই, ভোরের সৈকতে একটা মিষ্টি হাওয়া বইছে। এই শীতেও শীত শীত মনে হচ্ছে না। খানিক পরে একটু আলো ফুটলে দেখি- সমুদ্র সৈকতটি যথেষ্ট নির্জন। কিছু জেলে ছাড়া আর কোনো জনমানব নাই। আমি এদিক ওদিক যা-ই দেখি ছবি তুলতে থাকি।

তখন কলাতলীর দিকে সাধারণত টুরিস্টরা খুব একটা যেতো না। পাড়েই কিছু জেলেদের বাশ-বেতের ঘর।সমুদের পাড় অনেকটা পাড় ভাঙ্গা নদীর মতো। একটা পাড়ে দেখি একটা শিশু দাঁড়িয়ে আছে, একা।

পাশে নতুন গজিয়ে ওঠা কিছু তৃণ। ছেলেটির গায়ে কোনো জামাকাপড় নাই। আমি থেমে যাই। এবং যথেষ্ট নীচু হয়ে একটা লো এঙ্গেল শট নেই শিশুটির। আমার কাছে এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এ বিশ্ব সংসারের তাবত মানুবকূলের প্রতিনিধিত্বকারী হলো এই শিশুটি। তার সামনে বিশাল আকাশ আর সমুদ্র। এদের কাছে মানবকূলতো শিশুই।

এ ছবিটা তোলা শেষ করে দেখি তাজু ভাই আমার কাছে নাই। তিনি অনেক দূর চলে গেছেন। তিনি যেখানে গেছেন, তার আশে পাশেও আর কেউ নাই। মনে হলো আর কিছুদূর গেলেই তিনি আমার লেন্সের সীমানা থেকে হারিয়ে যাবেন। মানুষের চলে যাওয়াটা এ-রকমি হয়। আস্তে আস্তে মানুষের দৃষ্টির আড়াল হতে হতে একসময় একেবারি হারিয়ে যায়।

তাজু ভাইর এ ছবিটা তোলার ২৪ বছর পর, দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১৫ সালের ৩ মার্চ তিনি মারা যান। আমি তার এ ছবিটা দিয়ে আমার ফেসবুকের কাভার পিকচার বানিয়ে আমার শোকগাঁথা লিখি । ৫ মার্চ ছিলো তার স্মরণসভা। সেখানে তার বন্ধুরা এ ছবিটা দিয়ে ব্যানার করেছিলো। নীচে লেখা- হে বন্ধু, বিদায়।

জড়ায়ে আছে বাঁধা, ছড়ায়ে যেতে চাই

আমাদের কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের নির্জন ভোর যে দেখে নাই, তার কক্সবাজার যাওয়া ঝিনুক কেনার জন্যই কেবল সার। আমি ১৯৮৩ সাল থেকে বহুবারই গিয়েছি ওই সৈকতে, এবং বলতে কষ্ট নেই, কেবল একবারই ভোরের সূর্যের আগে নিজেই পৌঁছেছিলাম সেই নির্জন সৈকতে ।চোখের সামনে দিয়ে আধার ফুড়ে এক সময় হালকা আলোতে ভরে গেলো সৈকত। কতোগুলো জেলে আর ঝিনুক কুড়ানী কশোর কিশরী ছাড়া আর কোনো পর্যটকও নাই সেখানে।

ঘটনা ১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসের। আকাশ খানিকটা মেঘলাও। একটু মন খারাপ এজন্য যে, হিসেব মতো সূর্য তখন রোদ ফেলার কথা। সকালের মিঠে রোদে ছবি তুলবো বলে এসেছি, কিন্তু রোদেরও দেখা নাই।

আমার সঙ্গী ছিলেন খন্দকার তাজ উদ্দিন ভাই। তাঁকে আর দেখছিনা। শৈবালের কূল থেকে কলাতলী পর্যন্ত পেয়েছিলাম, এখন আর নাই। তিনি কি হেঁটে হেঁটে হিমছড়ির দিকে চলে গেলেন?

আমার সামনে কতগুলো জেলে। বাচ্চাবাচ্চা ছেলে-মেয়েগুলো ছোটো ছোটো জাল ঠেলছে। কাছে গিয়ে কথা বলি ।ওরা পোনা মাছ ধরবে। একজনের সঙ্গে একজন এসিস্ট্যান্ট। এসিস্ট্যান্ট-এর কাজ একটা পানির বালতির মধ্যে পোনা মাছ রাখা।

সকাল বেলার এ আলোয় রঙের কোনো বৈচিত্র্য আনে না। তার উপর ঘোলা পানির সাগরের ঢেউ। আমি মন খারাপ করে করে আরেক জেলের কাছে যাই।

এই জেলে একটা উড়াল জাল ফেলছেন সাগরের উপর। কোমর পানি পর্যন্ত নামা তার শরীর। একবার দেখি, জালটা পুরা যখন খুলে যায়, মনে হয়ে এটা একটা গোলক, অথবা আমাদের এই বিশ্ব ভ্রম্মান্ড। আমি অপেক্ষা করি তার পরবর্তি এটেম্পটির জন্য এবং জালটি যখন পুরা খুলে গেলো তখনই ক্লিক করে শাটার খুলে দিলাম।

১৯৯৭ সালে আমার প্রথম একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী হলে এ ছবিটা প্রদর্শনীতে দেই। এর সপ্তা দুই পরে আমাকে ফোন করা হয় ‘বলাকা’ থেকে। যিনি ফোন করেছেন তিনি বাংলাদেশ বিমানের জনসংযোগ উপ-পরিচালক। ফোনে খুব সংক্ষেপে তিনি বলেন যে, ওই জাল ফেলার ছবিটা নিয়ে যেনো আমি বিমান বন্দরের কাছে তার অফিসে যোগাযোগ করি।

আমি পরদিন গিয়ে হাজির । শেষ কথা ছিলো এমন যে, বাংলাদেশ বিমান নতুন একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করছে। সেখানে এ ছবিটা ব্যাবহার হবে, নীচে লেখা থাকবে, ‘জড়ায়ে আছে বাঁধা, ছড়ায়ে যেতে চাই’।

বাংলাদেশ বিমানের বিজ্ঞাপনে দীর্ঘদিন এ ছবিটি ব্যবহার করে

কর্মকর্তা মহোদয় আমাকে বোঝালেন যে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙ্গালীদের আমরা একজালে আটকে রাখছি, এমন কিছু।

আমি তো মহা খুশী। আমাকে একটা চুক্তিপত্র দিয়ে সেখানে সই নিলেন, আর ১৫ দিন পর এসে একশো ডলারের সমমূল্যের বাংলাদেশী টাকা নিয়ে যেতে বলেন।

এরপর প্রায় ২ বছর ধরে এ ছবি দিয়ে বাংলাদেশ বিমানের বিজ্ঞাপনটা আমি বিভিন্ন জায়গায় দেখে পুলকিত হয়েছি।

 

কাওরান বাজার টেক

১৯৯১ সালে আমি বুয়েটের ফোর্থ ইয়ারে পড়ি। ‘সেমিনার’ বিষয়ক একটা সেশনাল কোর্স আছে আমাদের। ২০ মিনিট সময়ে শিল্পের যেকোনো বিষয় নিয়ে সচিত্র বক্তব্য পেশ করতে হবে, যেমন করে কোনো সেমিনারে করা হয়। ক্লাসে সবাই ব্যাস্ত হয়ে বিশয় খুঁজে, রাতের পর রাত জেগে প্রেজেন্টেশন তৈরি করে। তার কিছু ফোটোগ্রাফও থাকে, বাকি সব টেকনিক্যাল ড্রয়িং। আমি ঠিক করলাম একটি বস্তির মানুষের ঘরসজ্জা এবং ঘরের সামনের জায়গাটুকু তাঁরা কখন কিভাবে ব্যাবহার করে তা নিয়ে একটি উপস্থাপনা তৈরি করবো। জায়গা হিসেবে বেছে নিলাম- কাওরান বাজার টেক।

কাওরান বাজার টেক ছিলো সোনারগাঁ হোটেলের এক প্রতিবেশী দ্বীপ। একটা ঝিলের মাঝখানে একটা উঁচু জায়গা, সেখানে বাশ-বেত দিয়ে কিছু তাঁবু বানিয়ে কয়েকটি পরিবার থাকে। যাতায়াতের জন্য তাঁরা ব্যাবহার করে কচুরিপানার ভেলা। একসাথে কয়েকজন উঠে, কেউ একজন লগি দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়া যায় তাঁদের একান্ত সেই দ্বীপে।

কাওরান বাজার বস্তি, যেখা্নে এখন বিজিএমইএ ভবন

এ দ্বীপটা তাঁদের একান্ত নিজস্ব এক রাজ্য। কয়েকগজ দূরের পাঁচ তারকা হোটেলটিকে অবলিলায় টিটকারি দিয়ে তাঁরা নিজের মতো বিকেল বেলা হাওয়া খেতে খেতে আড্ডায় বসে যান। কয়েকগজ দূরের রাজধানীর নাগরিক জীবনের কিছুই তাঁদের নাই। না বিদ্যুৎ, না জল বা পয় নিষ্কাশনের কিছু। ঘরের মধ্যে না আছে দরোজা, না কোন জানালা। গরম লাগলে খোলা আকাশের তলায় গায়ে বাতস মেখে আরাম করে ঘুমায় তাঁরা।

আমি ছবি তুলি স্লাইড করার জন্য ট্রান্সপারেন্ট পজিটিভ ফিল্মে। সঙ্গে আমার তখন দ্বিতীয় ক্যামেরা, সেখানে সাদা কালো ফিল্ম ভরা আছে। এই বস্তিতে হঠাত এক নব্বই উর্ধ্ব বয়েসের একজনকে পেয়ে যাই।এ বয়সে তিনি কখনই কোনো চিকিৎসা নেননি, কোনো অসুখ বিসুখ তেমন হয়না, সামান্য কিছু হলে নিজের মতো ঘাষ-লতা-পাতার রস খেয়ে তিনি সুস্থ হয়ে যান।

যে লোকটির ছবি তুলি, তাঁর নামটি আমার জিজ্ঞাসা করা হয়নি।

যে লোকটির ছবি তুলি, তাঁর নামটি আমার জিজ্ঞাসা করা হয়নি। প্রায় দুই যুগ আগে যেখানে এই ছবি তুলেছিলাম, সেখানে হয়েছে হাতির ঝিল, কাওরান বাজার টেকের বস্তি দ্বীপটির উপর এখান তৈরি হয়েছে একটি বহুতল দালান।

কাওরান বাজারের মাছের বাজারের উলটা দিকের রাস্তা দিয়ে যেতে এখনো আমার মনে পড়ে সেই দ্বীপবাসিকে আর মনে পড়ে নাম না জানা সেই বৃদ্ধকে, যার ছবি পরবর্তিতে আমার ‘বাংলার মুখ’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও একই নামে আমার একটা আলোকচিত্র এলবামে প্রকাশ করি।

 কবির ছবি 

 

কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে তোলা নানা লোকের ছবি দেখে কষ্ট হচ্ছে । কবির সঙ্গে আমার বেশ যোগাযোগ ছিলো । কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার কোন ছবি নাই ।
কবির শুক্রাবাদ (তল্লা বাগ) এর বাসায় আমি প্রথম যাই ১৯৮৮ সালে তাঁর কাছ থেকে কবিতা আনতে । নগদ ২০০ টাকা দিয়ে কবিতা এনেছিলাম একটা পাক্ষিকের জন্য । এরপর আমার এক কবি বন্ধু ( দিনার হোসেন) এর কবিতার বইএর ভুমিকা লিখিয়েছিলাম তাঁকে দিয়ে ১৯৯০ সালে । আমার অনুরোধ তিনি রেখেছিলেন । ১৯৯২ সালে একবার তাঁর শ্যামলির বাসায় যাই। আমি তখন বাংলাবাজার পত্রিকার স্টাফ রাইটার, কিন্তু মাঝে মাঝে আমাকে ছবি তোলার জন্যও পাঠানো হতো । কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিনে তাঁর উপর একটা লেখার সাথে নতুন ছবির প্রয়োজন হল রিটন ভাইর । হিফযুর ভাই আমাকে পাঠালেন অফিসের ফ্রী ফিল্ম দিয়ে। আমি অনেকক্ষন থেকে অনেক ভাবে তাঁর অনেকগুলো ছবি তুললাম । কাজ শেষে ব্যাগ গুছিয়ে আমি যখন নেমে আসছি, পেছনে চেয়ে দেখি আমাকে বিদায় দিতে কবি দোতালা থেকে নামছেন ।
বিকেলের হেলানো আলো দরোজা ফুড়ে তাঁর মুখের উপর পড়েছে আর তাঁর ছায়া গিয়ে পড়লো সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এর দেয়ালে । আমি কবিকে আটকাই । ব্যাগ খুলে ক্যামেরা বের করি এবং আবার ছবি তুলি । একটাই ফ্রেম, একটাই শট। তখন মনে হলো, এ আলোয় একটা পোর্টেটও তোলা যায় । শামসুর রাহমান খুবই ক্যামেরা ফ্রেন্ডলি । তাঁকে দিয়ে পোজ দেয়ানোও যেতো । আমি তাঁর আরেকটা শট নেই ।

শ্যামলির বাড়িতে আমাকে বিদায় দিতে দোতলা থেকে নেমে আসছিলেন কবি

অফিসে ফিরে এসে পাভেল ভাইকে ফিল্ম বুঝিয়ে দিলাম। তিনি প্রিন্ট করে বের করলেন ২টা ছবি । তাঁর একটি সর্বশেষ তোলা পর্ট্রেট । আমার ইচ্ছা ছিলো ছায়া পড়া ছবিটা যেনো ছাপা হয়, কিন্তু ওটা প্রিন্টই করা হলো না। আমাকে যুক্তি দেখানো হলো, নিউজ প্রিন্টের কাগজে ওটা কিছুই আসবে না । আমি বুঝ মেনে নিলাম । অনেকদিন পর সাদাকালো নিগেটিভগুলো ডিজিটাইজড করার ফলে এ ছবিটা আবার দেখি । আজ কবির জন্মদিনে সেদিন ছাপা হওয়া আর না হওয়া দুটো ছবিই দিলাম ।
(পুনশ্চ ঃ ১৯৯৮ সালে “ফেস অফ বেঙ্গল” নামে আমার প্রথম একক যে আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়েছিলো, তাঁর উদ্বোধন করেছিলেন কবি শামসুর রাহমান, সে প্রদর্শনীতে শামসুর রাহমান এবং তাঁর মার একটা যুগ্ন ছবিও ছিলো)

হুমায়ূন আহমেদের দশ ছবি 

আমার ক্যামেরায় হুমায়ূন আহমেদের প্রথম ছবি তোলার ঘটনাটি মনে পড়লে লজ্জা পাই। ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি তাঁর আজিমপুরের নিউ পল্টন লাইনের ভাড়াবাড়িতে যখন ইন্টারভিউ নিতে যাই, সঙ্গে ছিল আমার এক অটোফোকাস ক্যামেরা।

এক ॥ প্রাচীনতম ছবি
আমার ক্যামেরায় হুমায়ূন আহমেদের প্রথম ছবি তোলার ঘটনাটি মনে পড়লে লজ্জা পাই। ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি তাঁর আজিমপুরের নিউ পল্টন লাইনের ভাড়াবাড়িতে যখন ইন্টারভিউ নিতে যাই, সঙ্গে ছিল আমার এক অটোফোকাস ক্যামেরা।

এই ক্যামেরা নতুন পেয়েছি, তোলার কায়দা কানুন শিখিনি। আমি পত্রিকায় দেখেছি, লেখকদের মুখের ছবি ছাপা হয়, একপাশ কালো থাকে, আরেক পাশে আলো। আমি বেশ কায়দা করে তাঁকে জানালার পাশে বসিয়ে ক্যামেরাটা মুখের খুব কাছে নিয়ে ছবি তুলি। সেই ক্যামেরার লেন্স ফিক্সড্। ৩৫ মি.মি অয়াইড। ছবি তোলা শেষে নেগেটিভ করা হয়, ছবি প্রিন্ট করা হয়। কিন্তু কোনো ছবিতেই হুমায়ূন আহমেদের চেহারা চেনা যায় না। ছবি ঘোলা। তার কোনো পোর্টেট ব্যবহার করতে পারিনি।
তবে পত্রিকায় দেখতাম যে, লেখকের সঙ্গে সাংবাদিকদের একটা ছবিও ছাপা হয়। সেই ছবির জন্য সেদিন তরুণ-কার্টুনিস্ট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, লেখকের ছোটভাই আহসান হাবীব আমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দিয়েছিলেন সেই ক্যামেরায়। এটাই আমার ক্যামেরায় হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে প্রাচীনতম ছবি।


দুই ॥ অটোগ্রাফ শিকারীর কবলে হুমায়ূন

১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বইমেলা চলছে। আমি তখন নানা রকমের পত্রিকায় লিখে বেড়াই। একটা পাক্ষিক পত্রিকায় বইমেলা নিয়ে প্রচ্ছদকাহিনী করছি। স্টলে স্টলে ঘুরে বইয়ের খবর নিই, লেখকদের সঙ্গে কথা বলি। বইমেলায় তখন ইমদাদুল হক মিলন আর হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ভক্তকুলের ভিড় বেশি। তারা দুজন বিভিন্ন স্টলে বসছেন। হুমায়ূন আহমেদের নতুন বই বেরিয়েছে—এইসব দিনরাত্রি। আগে এটা হিট ধারাবাহিক ছিল—এখন উপন্যাস বেরিয়েছে। এটাও হিট। তরুণীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। লেখকের সামনে বই মেলে ধরছেন, লেখক সই করে দিচ্ছেন।
একদিন এই তরুণীদের সারিতে দেখি তরুণ কবি ও চিকিৎসক তসলিমা নাসরিনও দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে আগের বছরও দেখেছি এই মেলায়। তিনি এপ্রোন পরে মেলায় এসেছেন, সঙ্গে এপ্রোন পরা আরো দুই-তিন তরুণী। তসলিমা তখন কবিতার আসরে স্বরচিত কবিতা পড়েন। টিএসসি এলাকায় বেশ পরিচিত।
আমার অটোফোকাস ক্যামেরায় একটা ক্লিক করি। পরবর্তীতে এ ছবিটা যখন প্রকাশ হয়, ক্যাপশন ছিল ‘ভক্তদের মাঝে হুমায়ূন আহমেদ’। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তসলিমা নাসরিন অনেক বিখ্যাত হয়ে যান। এখন সম্ভবত: এ ছবি ছাপা হলে ভিন্ন ক্যাপশন হবে।


তিন ॥ আগুনের পরশমনির আলোচনা সভায়

১৯৮৯ সালের ১৭ এপ্রিল। পত্রিকায় দেখলাম ধানমন্ডির গণগ্রন্থাগার মিলনায়তনে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নতুন প্রকাশিত উপন্যাস ‘আগুনের পরশমনি’ নিয়ে আলোচনা করবেন। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা আহমদ ছফা। পত্রিকার খবর দেখে চলে যাই সাত মসজিদ রোডের সেই মিলনায়তনে। সেখানে দেখি লেখক তাঁর উপন্যাসের কাহিনী শোনাচ্ছেন আর তরুণ-তরুণীদের নানা রকম প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন।
সামনের সারিতে বসে আছেন আহমদ ছফা। হুমায়ূন আহমেদ অত্যন্ত গুছিয়ে কথা বলছেন। প্রত্যেকটা জবাবের সঙ্গে হাস্যরস মাখাচ্ছেন। পাবলিক খুব মজা পাচ্ছে। সেই আসরে তার কাহিনী নিয়ে বানানো ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ছবিটির ব্যাপারে একটু নাখোশ মন্তব্য করেন। বলেন, লোকে বলে এটা বড় টেলিভিশন নাটক হয়েছে। ‘টেলিফিল্ম’ টার্মটা তখনও চালু হয়নি। হলে হয়ত সেটার কথাই বলতেন।
সেই আসরে তিনি বলেন, এই উপন্যাস নিয়ে একটা ছবি বানানোর ইচ্ছা তার। প্রডিউসার পাচ্ছেন না। পেলে বানাবেন। এ ঘটনার ৫ বছর পর তিনি উপন্যাসটি নিয়ে ছবি বানান এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান।

চার ॥ নুহাশপল্লীতে নিষাদের সাথে
মাঝখানে অনেক বছর হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকে না। যোগাযোগ পুনরুদ্ধার হয়ে যায় ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, আমার ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’ বইটি প্রকাশের পর। মার্চের শেষের দিকে তাঁর আমন্ত্রণে—আমার বাড়ির কাছে কুলাউড়ার একটি গেস্ট হাউজে আমাদের একরাত থাকা হয়। ‘আমার আছে জল’ ছবির শুটিং হচ্ছিল সেখানে। শুটিংয়ের বাকি কাজ করার জন্য তিনি সরাসরি চলে যান নুহাশপল্লী। সেখানেও যেদিন শুটিং শেষ হয়ে গেল, সেদিনই আবার আমার ডাক পড়ল, নুহাশপল্লীতে। সঙ্গী অন্যপ্রকাশ-এর মাজহারুল ইসলাম। এই প্রথম আমার নুহাশপল্লী দেখা।
৯ এপ্রিল ২০০৮। সকালবেলা নাস্তা খেয়ে আওয়াজ দিলাম ঢাকা যাব। হবে না। পুকুরে জাল ফেলা হয়েছে। বড়সড় একটা রুই মাছ ধরা হয়েছে। এই মাছ এখনো লেজ নাড়াচ্ছে। বারবার হয়ত বলছে—আমাকে আবার পুকুরে ফেলে আসো। কিন্তু কে শোনে তার কথা। এই মাছ আজ দুপুরে আমাদের উদরে যাবে। তার আগে একটু হাঁটাহাঁটি দরকার।
আমাকে নিয়ে বেরুলেন নুহাশপল্লীর বোটানিক্যাল গার্ডেনের গাইডেড ট্যুরে। আমরা নানা রকমের ঔষধী বৃক্ষ দেখলাম, ভাস্কর্য দেখলাম এবং পুরো পুকুরপাড় ঘুরে এসে যখন ঘরের ভেতর ঢুকব—নির্দেশনা এলো, সুইমিংপুলে নামতে হবে সবার।
নুহাশপল্লীতে একটা কৃত্রিম ডোবা আছে। এখানে মটর দিয়ে পানি ভরা হয়। তার তলায় নীল রঙের টাইল্‌স লাগানো। স্বচ্ছ পানির ভেতর দিয়ে দেখা যায় পুলের তলা বরাবর। সেখানে হুমায়ূন ও অন্যদিন পরিবারের সবার সঙ্গে আছেন নায়ক জাহিদ হাসানও। একসময় দেখি দেড় বছর বয়েসী পুত্র নিষাদকে তিনি পরম মমতায় ধরে ধরে পানিতে চুবাচ্ছেন আর মাঝে মাঝেই তাকে বেঞ্চের ওপর বসিয়ে একা একা কথা বলছেন।
আমি ডোবা থেকে উঠে গিয়ে ক্যামেরা ধরি। নুহাশপল্লীর সুইমিংপুলে পুত্র নিষাদকে নিয়ে তার একটা ছবি তুলি।

পাঁচ ॥ সুন্দরবনের জাহাজে একাকী হুমায়ূন

২০০৯ সালের ১১ জানুয়ারি। ৫ দিনের জন্য সুন্দরবন সফরে বেরিয়েছি আমরা। ২০০৮-এর এপ্রিল মাস থেকে তাঁর সঙ্গে আমার দহরম মহরম। সপ্তাহে ৩/৪ দিন দেখা হচ্ছেই। তিনি যেখানে যাচ্ছেন—অবশ্যসঙ্গী আমিও। ইমপেরিয়েল কলেজ তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে কয়েক বছর ধরে এ ধরনের আয়োজন করছে। অন্যপ্রকাশ-এর মাজহারুল ইসলাম এই কলেজের গভনিং বডির সদস্য। সুতরাং তাঁর আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি হুমায়ূন আহমেদ, আর অন্য অতিথিরা সব হুমায়ূনের সঙ্গী। আমিও সেই দলে একজন। চারতলা এই জাহাজের সবচেয়ে উপরের তলায় আমাদের কেবিন। আমার জন্য সিঙ্গেল কেবিন, তার পাশের ডাবল কেবিনটা হুমায়ূন আহমেদের।
পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখি তিনি একা একা পায়চারি করছেন বারান্দায়। আমি ভেতর থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে আসি। পায়চারি থেমে যায়। দেখি বারান্দার রেলিং ধরে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের সামনে তখন নদী না সমুদ্র ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, ওপারে কিছুই দেখা যায় না। কিছু জেলে নৌকা, কিছু গাঙচিল। তিনি একা একা নিজের সঙ্গে যখন কথা বলছেন, আমার ডিএসএলআরে একটা চাপ দেই। এই সেই ছবি।

ছয় ॥ প্রিয় পোর্টেট

হুমায়ূন আহমেদ ক্যামেরাবান্ধব ছিলেন না। ক্যামেরা বাড়ালেই বলতেন—ধুর, রাখো এসব ছাতামাতা, বসো, গল্প করো। যখন আমার ভালো ক্যামেরা ছিল না তখন তাকে নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করেছিলাম, আমার দোষে ছবি হয়নি। পরে যখন আমার এসএলআর-ডিএসএলআর হলো, তখন ছবি তোলার জন্য আর তাঁকে বাগে পাই না।
সুন্দরবন সফরের সময় (২০০৯, জানুয়ারি) আমাদের সবারই অবসর। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও তার নাইকন হাতে নিয়েছেন। আমরা নদী, গাছপালা, পাখি এসবের ছবি তুলি। একবার জাহাজের ডেকে উঠে আমরা দেখি, যতজন যাত্রী, ততটি ক্যামেরা। দামি দামি ক্যামেরার বাইরে মোবাইল ফোন তো আছেই। হুমায়ূন আহমেদ ঘোষণা করে বসেন—এখন থেকে একটা ফটো কনটেস্ট হবে। প্রত্যেকে ১০টি করে ছবি জমা দেবে নুহাশপল্লীতে গিয়ে। সেই ১০টা করে পাওয়া ছবি থেকে ফার্স্ট-সেকেন্ড পুরস্কার ঘোষণা করা হবে এবং প্রথম ১০টি ছবি বাঁধাই করে নুহাশপল্লীতে রাখা হবে।
ফটো প্রতিযোগিতার কথা শুনে উৎসাহ বেড়ে যায় সবার। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কারণ, একজনের তোলা একটা ছবি ক্যামেরার এলসিডিতে দেখেই তিনি রায় ঘোষণা করেন—এটাই ফার্স্ট। সেই যাত্রায় হুমায়ূনের একটা পোর্টেট তুলে খুব মজা পেয়েছিলাম।
আমরা একসময় বড় জাহাজ থেকে নেমে ছোট ইঞ্জিন নৌকায় উঠি। এই নৌকা আমাদের নিয়ে যাবে খালের মধ্য দিয়ে সুন্দরবনের ভেতরে। আমার পাশেই হুমায়ূন আহমেদ। একসময় দেখি চিবুকে হাত দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সুন্দরবন দেখছেন তিনি। তার মুখের একপাশে রোদ পড়েছে। অপর যে পাশটিতে ছায়া, সেখানে পাশের একটা ঘাটের বেড়া থেকে প্রতিফলিত আলো এসে ছায়াটাকে আলোকিত করে দিয়েছে। আমি পরপর দু’টো ছবি তুলি তাঁর। একটি ব্যবহার করি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম স্মৃতিগ্রন্থ ‘যে ছিল মুগ্ধকর’(প্রথমা)-এর প্রচ্ছদে। প্রচ্ছদের জন্য এ ছবিটাই পছন্দ করেছিলেন বইটির ডিজাইনার—কাইয়ুম চৌধুরী। আমার তোলা হুমায়ূন আহমেদের সব ছবির মধ্যে এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়।

সাত ॥ সর্বোচ্চ সংখ্যক সাংবাদিকের মুখোমুখি
হুমায়ূন আহমেদ একসাথে সর্বোচ্চ সংখ্যক সাংবাদিকের মুখোমুখি হয়েছিলেন ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। একবার ১১ মে ২০১২, চিকিৎসা বিরতিতে তিনি দেশে আসেন। দ্বিতীয়বার ২২ জুলাই ২০১২-য় যখন তার লাশ আসে, সেই বিমানবন্দরের একই লাউঞ্জে এসে নামে।
দু’টো ঘটনার সময়ই আমি উপস্থিত ছিলাম। প্রথমবার কুয়েত এয়ারের বিমান থেকে নামার পর ভিআইপি এরাইভাল লাউঞ্জে আমরা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলি আমার আইপ্যাড নিয়ে। ডিএসএলআর বাদ দিয়ে আইপ্যাডে ছবি তুলছি দেখে তিনি অনেক হাসাহাসি করলেন। বললেন, তোমার এই খেলনায় ছবি কেমন আসে? ডেপথ অব ফিল্ড কন্ট্রোল করো কী দিয়া?
আমিও হাসি। বলি, সাধারণ ছবির জন্য এটা খুবই আরামের। সাথে সাথে এডিট করা যায়, মেইল করা যায়, ফেসবুকে আপ দেয়া যায়, অনেক সুবিধা। তিনি নিজেও একটা কিনেছেন। আইপ্যাড ওয়ান। আমারটা পরের ভার্সন। এটাতে কী কী সুবিধা বেশি, সেগুলো দেখেন। দু’য়েকটা ছবি নিজেও তোলেন।
প্রায় আধাঘণ্টা পর আমরা ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে একসঙ্গে বেরোই। গোটা বিশেক ক্যামেরা তাক করা আছে তাঁর দিকে। একসঙ্গে এত ফটোগ্রাফার তিনি এর আগে কখনো মোকাবেলা করেছেন বলে আমার জানা নেই। এত সাংবাদিককে একসাথে দেখে প্রথম তিনি যে কথাটি পুনরাবৃত্তি করে দুইবার বলেন—‘আমি অভিভূত’। এরপর রজনীকান্ত সেনের একটা গানের কথা বললেন, ‘আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাও নি/ যা দিয়েছো তারই অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাও নি।’ ধন্যবাদ জানালেন সাংবাদিকদের। তাঁরা প্রশ্ন করলেন চিকিৎসা নিয়ে, ডাক্তার কী বলল—এসব নিয়ে। হুমায়ূন আহমেদ শাওনের দিকে ইঙ্গিত করেন। বলেন, এ বিষয়টা ও গুছিয়ে বলতে পারবে ভালো। শাওন কথা বলে। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে শুনি।


আট ॥ ভোরের নরম আলোয়

২৫ মে ২০১২। নুহাশপল্লীতে আমি আর কমল ড্রইংরুমের মেঝের ওপর ঘুমিয়েছি। এ ঘরটি অনেক আরামের। কিন্তু আজ আরাম মনে হলো না। রাতে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল, ভোর পর্যন্ত এলো না। সে কারণে এ ঘরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রটি কাজ করছে না। গরমের ঠেলায় বেশ ভোরে আমার ঘুম ভেঙে যায়।
একবার মনে হলো কেউ যেন দরোজা খুলল। আমি কমলকে পাশের বিছানায় ফেলে রেখে ধীরে ধীরে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ি। দেখি, থ্রি কোয়ার্টার একটা প্যান্ট আর স্ট্রাইপ করা, রাতে শোয়ার কারণে ভাঁজ খাওয়া একটা হাফশার্ট পরে হুমায়ূন আহমেদ গাছতলা দিয়ে একা একা হাঁটছেন।
ভোরের শিশির পড়েনি ঘাসের ডগায়। কিন্তু গতরাতের বৃষ্টির রেশ রয়ে গেছে নরম সবুজ ঘাসের ওপর। তার সঙ্গে ভোরের শীতল মিষ্টি হাওয়া। আমি জাপানী বটের নিচের বেঞ্চিতে বসে থাকি, হুমায়ূন হাত দু’টো পেছনে দিয়ে একা একা হাঁটছেন। কখনো বা কোনো গাছের পাশে গিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন, আবার একটু হাঁটছেন। যেন সবগুলো গাছের সঙ্গে তাঁর এখন দেখা করার কথা, গল্প করার কথা, সবার খোঁজ-খবর নেওয়ার কথা। আমার কখনো দেখার সুযোগ হয়নি, তবে নুহাশপল্লীর লোকজনের কাছে শুনেছি, তিনি নাকি গাছগুলোর সঙ্গে কথা বলতেন। গাছের পাশে গিয়ে বলতেন, এই ব্যাটা, তোর হয়েছেটা কী, বাড়ছিস না কেন? ওরা কি তোর খাবারদাবার ঠিক মতো দেয় না?
নিজের হাতে চারা লাগানো, গাছ লাগানো, বীজ বোনা এবং সেখান থেকে ধীরে ধীরে একটা চারাকে বৃক্ষে রূপ নেওয়ার সবগুলো স্তর তার নিজের দেখা, সন্তানের মতো মমতা দিয়েই বৃক্ষপ্রেমী এই মানুষটা একটা জঙ্গলকে উদ্যানে পরিণত করেছেন। আর সেকারণেই নুহাশপল্লীতে বেড়াতে আসা যেকোন অতিথিকে নিয়ে প্রথমেই নিজের গাছপালার রাজ্য দেখানোতে তাঁর সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল।
এই গাছগুলোর নিচে এরপর আর কখনো তাঁর দাঁড়ানো হয়নি।


নয় ॥ বাপ-বেটার মধুর ছবি

নুহাশপল্লীতে সেদিন (২৫ মে ২০১২) একেবারেই অন্যরকম ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর চলাচল, কথাবার্তা, হাঁটাহাঁটি কোনো কিছু দেখে কোনোভাবেই আঁচ করার সুযোগ ছিল না যে, কঠিন একটা অসুখ শরীরের ভেতর নিয়ে তিনি আছেন। দু’সপ্তাহ পরেই তার অপারেশন। সেদিন আরেকটা বিষয় দেখেছি—সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন অনর্গল। একই প্রশ্ন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সাংবাদিক করছেন। তাদের সবাইকে আবার একই উত্তর দিচ্ছেন না। ভিন্ন ভিন্ন জবাব দিচ্ছেন। নুহাশপল্লীতে তাঁর বড় ঘরটার পাশে রট-আয়রনের চেয়ারে বসে বেশিরভাগ কথা বলেছেন। একবার উঠে গেলেন। সঙ্গে শিশুপুত্র নিষাদ। নিষাদ তার হাত ছাড়ছে না। তিনি হাঁটছেন, সাংবাদিকরা দৌঁড়াচ্ছেন। কেউ আগে, কেউ পেছনে। বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখা শেষ করে ঢালু বেয়ে নামলেন নিচে। সেখানে একটা ডোবা আছে। তাঁর ওপর মৎসকন্যা, আর ডোবার পাড়ে এক দৈত্য মুখ বের করে শুয়ে আছে। যেন এই দৈত্যের সঙ্গে কথা বলার জন্য এইমাত্র পানির ভেতর থেকে উঠে এসেছে এক মৎসকন্যা।
এর পাড়টা সম্ভবত নিষাদের খুব পছন্দ হয়েছে। তাকে নিয়ে বসে পড়লেন এখানে। ডোবার জলে পড়েছে বাপ-বেটার ছায়া। নিষাদ কী যেন জিজ্ঞেস করল তাঁকে। তিনি মুখ ঘুরিয়ে জঙ্গলের দিকে তাকালেন, সঙ্গে নিষাদও। আর সেই মুহূর্তে আইপ্যাডের ক্যামেরার বোতামে চাপ দেই। বাপ-বেটার এমন মধুর ছবি আমি আগে তুলিনি।

দশ ॥ দখিন হাওয়ার বারান্দায়

হুমায়ূন আহমেদ খুব ধূমপান করতেন। কিন্তু ঘরের ভেতর এটা করার জন্য খুব সুবিধাজনক কোনো জায়গা ছিল না তাঁর। প্রায় সব জায়গায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, সুতরাং ধোঁয়া বেরোনোর জায়গা কোথায়?
এ কারণে ঘরের মধ্যে তাঁর এক চিলতে একটা বারান্দা ছিল। ফ্যামিলি লিভিং স্পেস-এর সঙ্গে যুক্ত এই বারান্দাটিতে থাকত একটা রকিং চেয়ার। পাশে একটা স্তম্ভের ওপর এশট্রে। এ জায়গাটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। দিনের বেলা এখানে বসে সিগারেট ফুকতে ফুকতে তিনি বই পড়তেন, চা-কফি খেতেন।
২০১১ সালের ২৮ মে, যেদিন বিকেলবেলা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন গুলশানে, শ্বশুড়বাড়িতে—সেদিন দুপুরের খাবারে তাঁর সঙ্গী হবার জন্য ডাক পড়ল।
ভর দুপুরে তাঁর বাড়িতে আমার খুব কমই যাওয়া হতো। চিকিৎসা বিরতির এই সময়ে এটা হচ্ছে। এর আগেও আরো ২/৩ বার দুপুরবেলা খেয়ে গিয়েছি দখিন হাওয়ার এই বাড়ি থেকে।
ভেতরে ঢুকতেই দেখি হুমায়ূন আহমেদ পেছনের বারান্দার রকিং চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছেন। ক্যান্সার ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিগারেট ছেড়েছেন। এখন এই বারান্দায় এশট্রে নেই, শুধু চেয়ার, আর তাঁর পড়ার বই।
আমি কথা বলার আগেই আইপ্যাডের ফটো বোতামে চাপ দিয়ে ছবিটা তুলে রাখি। এটাই আমার তোলা জীবিত হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ ছবি।