আমাদের রবিদা

কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন স্মরণে

প্রথম দেখা, ১৯৮৬

বুয়েটে আমার শিক্ষকদের বাইরে প্রথম যে স্থপতির সাথে আমার পরিচয় হয় তাঁর নাম রবিউল হুসাইন। সুত্র ধরিয়ে দেন মোহাম্মদ বারী নামক এক সাংবাদিক। তিনি মাসিক নিপুন এর হাউজ থেকে নতুন যে সাপ্তাহিক বেরুবে (নাম ‘সাপ্তাহিক আনন্দপত্র’, যার সাব হেডিং ছিলো- ‘কম্পিউটারে কম্পোজ করা বাংলা ভাষার প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা’) তার নির্বাহি সম্পাদক (প্রধান সম্পাদক – মুস্তাফা জাব্বার)।

মাসিক নিপুনে আমার দু’টো লেখা বেরিয়েছে, বিল আনার জন্য গিয়েছি। আমাকে ডাকেন কালো মতো এক ভদ্রলোক। নাম পরিচয় দেবার পর বলেন, সামনের মাস থেকে আমরা নতুন একটা পাক্ষিক বের করছি, আপনি যেহেতু আর্কিটেক্ট, বাংলাদেশের স্থাপত্যরীতি নিয়ে আমাদের একটা কভার স্টোরি করে দেন।

আমি বলি, ভাই, আমি মাত্র ভর্তি হয়েছি বুয়েটে। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কয়েক মাস হলো ক্লাস শুরু হয়েছে। আমি তো কিছুই জানি না এই বিষয়ে।

তিনি আমাকে বলেন, আপনি রবিউল ভাইয়ের কাছে যান। উনার বই আছে এ নিয়ে । উনি একজন কবিও। অনেক তথ্য পাবেন ।

এখন রবিউল ভাইকে পাই কই ?

আমি ডিপার্ট্মেন্টে এসে লাইব্রেরি থেকে আই এ বি ডাইরেক্টরি কয়েক পাতা ফটোকপি করি। সেখানে স্থপতি রবিউল হুসাইনের নাম ঠিকানা আর ফোন নম্বর পাই। দুইটা সিকি ঢুকিয়ে ডিপার্ট্মেন্টের নীচতলার কয়েন বক্স থেকে ফোন করে ফেলি শহিদুল্লাহ এন্ড এসোসিয়েটস- এর নাম্বারে এবং পরদিন আমার হিরো সাইকেল চড়ে হাজির হয়ে যাই গ্রিন সুপার মার্কেটের পেছনে জাহানারা গার্ডেন নামক এক আবাসিক এলাকায়। সেখানে একটা দোতালা বাড়িতে একটা বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটা আর্কিটেকচারাল ফার্ম । আমি ভয়ে ভয়ে হাজির হয়ে যাই। পত্রিকার এসাইনমেন্টের কথা বলি। তিনি জানান, তিন দিন পরে এলে আমাকে একটা বই দেবেন, সে বইতে সব কথা লেখা আছে।

তিন দিন পরে আমি মনে করে হাজির হয়ে যাই, কিন্তু টের পেলাম, তিনি নিজে আর বিষয়টা মনে রাখতে পারেন নি। পুরোই ভুলে গিয়েছিলেন। অথচ আমি যে চলে এসেছি ঠিক সময় মত, এ নিয়ে তিনি খানিকটা লজ্জিত।

আমাকে বলেন, বইটির কোন কপি তাঁর কাছে নাই। যে প্রকাশক ছেপেছিলো, তাঁর অফিস পল্টন। চলো, গিয়ে নিয়ে আসি।

মানে, এখন কি আমরা পল্টন যাবো বই আনতে !

আমাকে বলেন, তোমার সময় থাকলে আমার সাথে চলো।

আমি বলি, আপনি ঠিকানা দিয়ে দেন। আমার সাথে সাইকেল আছে। আমি নিয়ে আসবো।

আমার এই কথায় কাজ হলো না। তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতে উঠালেন। বললেন, ঘন্টা খানিক পরে এখানেই নামিয়ে দেবেন। আমি সাইকেলটা ভালো করে তালা মেরে তাঁর গাড়িতে উঠে পড়ি, তাঁর সাথেই পেছনে, তাঁর পাশে বসি। গাড়ি ছুটে চলে সেগুন বাগিচার দিকে । সেখানে এক বিজ্ঞাপনি সংস্থার অফিসে যাই। গিয়ে দেখি এক নাম করা অভিনেতা এখানে বসে আছেন। নাম পীযুস বন্দ্যোপাধ্যায়।

সেদিনের কথা বেশি মনে নাই। শুধু এটুকু মনে আছে। ‘বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি’ বইটি নিয়ে ফেরত এসেছিলাম। ফেরার পথে আমি সামনে,  ড্রাইভারের পাশের সীটে বসি। কবি ও অভেনেতা পেছনের সীটে বসে গল্প করতে থাকেন। পীযুস বলেন, তিনি একটা সিনেমা বানাতে চান , গল্প খুঁজছেন, গল্প পাচ্ছেন না , এমন। রবিউল ভাই নানা কথা বলেন। ডানে বামে পত্রিকার অফিস চোখে পড়লে বলেন, এই অফিসে অনেক টাকা পাই, লেখার বিল। কেউ আমাকে লেখার বিল দেয় না। আর আমার বই বিক্রি থেকে এক পয়সাও কেউ দেয় না, বলে বই বিক্রি হয় না । আসলেই তো, এই সব বই কে কিনবে ? আমি নিজেই মাঝে মাঝে কিনে আনি। বন্ধু বান্ধবদের দেই , শেষ হয়ে গেলে আবার কিনি। এই হচ্ছে আমার অবস্থা ।

স্থপতি রবিউল হুসাইনকে আমি প্রথম দিন থেকেই ‘ভাই-ভাই’ বলে ডাকা শুরু করি । এই তরিকার কথা আমি আগেই জেনে যাই যে, স্থপতি, তিনি যত বড়ই হোন না কেন বয়সে, তিনি ‘ভাই’। তিনি ‘বস’ হতে পারেন, চাকরিদাতা হতে পারেন, নিয়োগ কর্তা হতে পারেন, তিনি ‘ভাই’ই, ‘স্যার’ নন । জেষ্ঠ স্থপতিরা ‘স্যার’ হয়েছেন আরো পরে সরকারি অফিসে আর বুয়েট বাদে স্থাপত্যের অন্য স্কুল থেকে স্থপতি বেরিয়ে আসার পর থেকে বেসরকারি খাতেও বড় স্থপতিরা আর ‘ভাই’ থাকেন না, তারা কেউ ‘বস’,বেশিরভাগই ‘স্যার’ হয়ে যান। আমার কাছে স্থপতি রবিউল হুসাইন আগাগোড়া ‘রবিউল ভাই’ হিসাবে থেকে যান। তবে শেষের দিকে এসে স্থপতিকূলের বাইরেও সংস্কৃতিকর্মী অনেকের মুখে স্থপতি রবিউল হুসাইনকে  ‘রবিদা’ বলে ডাকতেও শুনেছি। সেই থেকেই তিনি ‘আমাদের রবিদা’।

সেদিনের এই দুই তিনঘন্টার সহযাত্রা আর মাঝেমাঝে কথার সাথে যুক্ত হয়ে কথা বলা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আমারও ঝোঁক আছে এটা দেখার পর তাঁর সাথে আমার একটা প্রায়ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সুত্রপাত হয়ে যায়। আমার যেকোন প্রয়োজনে আমি তাঁর কাছে চলে যেতে পারি । আমার আর্টিক্যালের জন্য কারকার কাছে গেলে ভালো তথ্য পাবো, তার হিসাবে দিতে থাকেন। আমি তাঁর পরামর্শ নিয়ে মাজহারুল ইসলামের কাছে যাই, কথা বলি, ছবি তুলি। রবিউল ভাইর ডিজাইন করা ফার্মগেটের লাল ইটের বার্ক বিল্ডিং এর ছবি তুলি। তাঁর নানা গল্পশুনি। ছাত্রাবস্থায় খুব স্ট্রাগল করেছিলেন। একশো টাকা বেতনে ড্রাফস্টম্যানের চাকরি করেছেন, ক্লাসে একবার ফেল করেছেন। এসব নানা ব্যর্থতার গল্প শোনাতেন ।

বুয়েটে স্থাপত্য বিভাগ খুলে ১৯৬১ সালে। তিনি ক্লাস শুরু করেন পরের বছর ১৯৬২ সালে। পাশ করার কথা ছিলো ১৯৬৭তে, তিনি করেন ১৯৬৮তে। এরপর কাজ করেন ‘বাস্তুকলাবিদ’-এ। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তখন তাঁদের দুই বস স্থপতি মাজহারুল ইসলাম আর প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুল্লা। যুদ্ধের বছর খুব বিপাকে পড়ে যান। সে সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাজ শুরু হয়েছে। জুনিয়ার আর্কিটেক্ট হিসাবে আছেন তিনি আর শা্মসুল ওয়ারেস। সে বড় কঠিন সময় ছিলো তাঁদের।

১৯৮৭ সালে তাঁর কাছে আবার যাই কবিতা নিতে। তখন আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ‘ত্রিমাত্রা’ নামক একটা একুশে সংকলন বেরুবে স্থাপত্য বিভাগ ছাত্রসংসদের পক্ষ থেকে। আমাকে করা হয়েছে সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক। আমি তাঁর অফিসে গিয়ে হাজির। দেখি সেলাই না করা একটা বস্তা গায়ে পেঁচিয়ে এক পাগল বসে আছে তাঁর রুমে। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। উনি হলেন কবি সাবদার সিদ্দিকি। তিনি জামা কাপড় পরেন না, ছালা দিয়ে শরীরের কিছু অংশ ঢেকে চলাচল করেন ।

আমি এই কবিকে দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ি । কয়েকটা কবিতা আমিও লিখেছি। এখনো তেমন কেউ জানে না যে আমি কবি । কবি হতে হলে যদি এমন ছালা পরে থাকতে হয়, তাহলে আর কবিতা লেখার দরকার নাই। আমি মনেমনে কবিতা লেখা বাদ দেয়ার কথা চিন্তা করি আর ছালাপরা কবি সাবদার সিদ্দিকির সাথে একটু একটু কথা বলি। তাঁর একটা কবিতা আমাকে দেন, আমি কবিতা নিয়ে আসি এবং আমাদের সংকলনে তা প্রকাশও করি। কিন্তু এই কবির সাথে আর কখনোই আমার দেখা হয় না। এর কয়েক বছর পর কাগজে তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনি ( ১৯৯৪ সালে ঘুরতে ঘুরতে দিল্লি গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কোলকাতা হয়ে ঢাকায় ফেরার পথে সাতক্ষীরা সীমান্তে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই নাম না জানা এক গ্রামে সমাহিত হন)।

রবিউল ভাই আমার সাথে অনেক গল্প করেন। আমরা যে লিটিল ম্যাগাজিন বের করছি, এর জন্য প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় কবিতা ছাপা উচিত না। এতে কবিতার ক্ষতি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁরা একটা সংগঠন করেছিলেন, নাম ছিল – ‘না’। এটা এন্টি এস্টাব্লিশমেন্ট। তাঁদের মুভমেন্ট ছিলো প্রচলিত অনেক কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, এক সাথে ‘না’ বলা। ইপুয়েটে (এখন বুয়েট) সেসময় তাঁদের সাথে খুব সক্রিয় ছিলেন, তাঁর ভাষায় – ‘আমাদের হাবু। হাবু চিনসো ? ঐ হাবিবুল্লাহ সিরাজী আর কী’ (বর্তমানের বাংলা একাডেমি মহাপরিচালক) । তো, তাঁরা সে সময় লিটিলম্যাগ ছাড়া আর কোথাও লিখতেন না। কারন পত্রিকাগুলো কারো না কারো দালালী করবেই। এই ছিলো কারন।

তাঁর প্রথম ছবি তোলা

তাঁর অফিসে একবার ক্যামেরা নিয়ে যাই। ১৯৮৮ সালে স্থাপত্য বিভাগ রজত জয়ন্তী পালন করবে। এ উপলক্ষ্যে যে স্মরণিকা বেরুবে আমি তাঁর সম্পাদক। সেখানে লেখকদের লেখার সাথে ছবি যাবে । ‘বাংলাদেশের স্থাপত্য’ নিয়ে তাঁর একটা লেখা ছাপি। ছাপি- মানে তাঁর বই থেকে একটা অধ্যায় তুলে দেই। এর সাথে ছবি দেয়ার জন্য তাঁর অফিসে যাই। এই প্রথম আমি তাঁর ছবি তুলি। তখন মার্চ মাস । সামনে স্বাধীনতা দিবস । আমার সামনে তাঁর অফিসের  একজন স্থপতিকে ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দেন । নাম বলেন – সৈয়দ মাইনুল হোসেনের । নাম বলতেই আমি চিনে ফেলি। আর্কিটেকচারের ভর্তি পরীক্ষায় বিশিষ্ঠ স্থাপনার নাম ও তার স্থপতিদের নাম মুখস্থ করেছি আর ‘ সাপ্তাহিক আনন্দপত্র’তে লেখার সময়ও এই স্থাপনা নিয়ে লিখেছি। হালকা পাতলা রোগা মতোন এক স্থপতি আসেন তাঁর রুমে , আমরা এ নিয়ে অনেক গল্প করি। ৭ সংখ্যার নানা রকমের মডিউল এখানে কীভাবে ব্যবহার হলো, প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ, বুয়েটের সময় , অনেক কিছু। আমাদের শহীদ মিনার নিয়েও আলাপ হয়। স্বাধীনতার পর আয়োজন করা হয়েছিল একটি প্রতিযোগিতা। সেখানে রবিউল হুসাইনের ডিজাইনটি প্রথম হয়। কিন্তু জয়নুল আবেদিন তখন মতামত দেন যে, ১৯৫২ সালে হামিদুর রহমানের নকশাটির সাথে আমাদের ইমোশন জড়িত হয়ে গেছে। সুতরাং এটা না বদলানোই উচিত । এ কারনে সেই প্রতিযোগিতা বাতিল করা হয়, ফলাফল ঘোষনা করা হয় না। ঘোষনা হলে রবিউল হুসাইনের নাম আসতো বিজয়ী আর এই জাতীয় শহীদ মিনার ভেঙ্গে নতুন যে শহীদ মিনার হতো তাঁর হতো রবিউল হুসাইনের ডিজাইনে। তবে যে কারন দেখিয়ে মূল অবয়বটি রেখে দেয়া হয়েছে তাঁর সমর্থন করলেন রবিউল ভাই।সেই অফিসে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন মোস্তফা হারুন কুদ্দুস (হালী) নামক আরেক স্থপতির সাথে । শহীদুল্লাহ এন্ড এসোসিয়েটস নানা ভাবে আছে, কিন্তু এই তিন স্থপতির কেউই আর এখন বেঁচে নাই।

বাম পাশের ছবিটি আমি তুলি ১৯৮৮ সালে। ডানপাশে আমার সাথে রবিউল হুসাইনের এই ছবিটি তুলে এডিপিএস এর সদস্য তৃতীয় বর্ষের কাশেফ চৌধুরী, ১৯৯১ সালে বুয়েটের সিভিল বিল্ডিং এর সেমিনার রুমের সামনের লবিতেতাঁর অফিসে গেলে কাউকে না কাউকে পাওয়াই যেতো যে তিনি আড্ডা দিচ্ছেন। হয় কবি নয় অভিনেতা নয় সাংবাদিক। আমার ছাত্রাবস্থায় দু’বার আমি গিয়াস কামাল চৌধুরীকে পেয়েছি তাঁর কামরায়। তাঁর  কামরাটাও থাকতো পত্র-পত্রিকা, বই-পুস্তকে ঠাসা। পুরো টেবিল জুড়েই কাগজপত্র। সামনের বোর্ডে কিছু ক্যালেন্ডার, ছবি, নিজের ডিজাইনের কিছু নকশা, এই যা। একবার দেখি ছোট্ট একটা নিউজ বোর্ডে পিন দিয়ে আটকানো। তাতে একটা নিউজ, রবিউল হুসাইন নামে এক তরুন মৃত্যুবরণ করেছে তার সংবাদ।  দেশে হাসি পেলো। কবিরা তো এমনই রসিক হবেন।

১৯৯১ সালে একবার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসি বুয়েটে। তখন তিনি বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট আর আমি আর্কিটেকচার ডিপার্ট্মেন্ট ফটোগ্রাফিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। আমরা বার্ষিক একটা আলোকচিত্র প্রদর্শণীর আয়োজন করি । তিনি প্রধান অতিথি। উদ্বোধন করতে এলেন, সাথে নিয়ে এলেন সাধারন সম্পাদক ইয়াফেস ওসমানকে

১৯৯১ সালে এ ডি পি এস এর আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্ভোধনে স্থপতি রবিউল হুসাইন এবং স্থপতি ইয়াফেস ওসমান

এর অনেক দিন পর আর তাঁর সাথে আমার তেমন দেখা হয় না। যদিও পেশাগত অবস্থানে আমি তাঁর সমগোত্রীয় হয়ে যাই। আমরা উভয়েই তখন স্থপতি-স্থপতি ভাই ভাই। তাঁর সাথে আমার দেখা হয় কবিতার মাঠে কিংবা বইমেলায় বা মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের অনুষ্ঠানে। ১৯৮৭ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠিত হলে তিনি প্রথমেই তার ট্রেজারার হোন, পরে এক সময় সভাপতিও ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের ট্রাস্টি ছিলেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে খুব দায়িত্ববান মনে করতেন নানা কাজে ।

জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক দায়িত্বই তিনি আন্তরিকতা ও সততার সাথে পালন করেন
তিনি যখন আমার অনুষ্ঠানের অতিথি

১৯৯৩ সালে আমি বুয়েট থেকে বেরুনোর পর তাঁকে আমার কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেই ১৯৯৯ সালে তিন দেশের সংস্কৃতি, ভূমিরূপ আর জলবায়ূর কারনে কেনো তিন দেশের (ভারত, নেপাল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) স্থাপত্য তিন রকমের হলো তা নিউএ আমার দ্বিতীয় একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘ট্র্যাভেলার্স ক্লিকস’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে। জাতীয় সংসদের স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ছিলেন প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানে আমি স্লাইড শোর মাধ্যমে পুরো প্রদর্শনীর ছবি দেখাই। বিশেষ অতিথির ভাষনে বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটের সভাপতি রবিউল হুসাইন বলেন, এই উপস্থাপনাটা স্থাপত্যের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও দেয়া উচিত। আমি বুঝতে পারি তিনি কাজকে খুব প্রশংসা করতে শুরু করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মন্তব্যের খাতায়ও এমন কিছু লিখলেন তিনি ।

১৯৯৯ সালের ২০ আগস্ট আমাত আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে রবিউল হুসাইন

এর অনেকদিন পর, তাঁর সাথে আমার আরো সখ্য বেড়ে যায়। একদিন ফোন করে বলেন, ঈদসংখ্যা  ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ এ তোমার ‘সক্রেটিসের বাড়ি’ লেখাটা পড়লাম। এটা তো দুর্দান্ত লিখেছো। আর্কিটেকচার ক্লাসে তোমার এই লেখা পড়ানো উচিত, কারন তুমি গল্পের মতো করে পৃথিবীতে আর্কিটেকচার আসার কাহিনী শুনিয়েছ। কিন্তু এক জায়গায় যেখানে এম্ফিথিয়েটারের কথা লেখা সেখানে ‘নাটক-ফাটক’ এই কথাটা লিখলা কেন ? তুমি তো নিজেও নাটকের মানুষ, নাটক লিখো, ফাটক কেন লিখলা?

বুঝলাম, গ্রিক এম্ফিথিয়েটারের বর্ণনার এই যায়গায় এ শব্দ লিখেছিলাম, স্থানীয় এক লোকের উদৃতি দিয়ে। বললাম, যখন বই হবে তখন নাটক থেকে ফাটক সরিয়ে দিব।

খুশি হলেন তিনি।

কিন্তু বই যখন বেরুবে, তখন তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হলাম অন্য ইস্যু নিয়ে। এই বইয়ের মুখে মুখে যখ প্রশংসা যখন করেই ফেলেছেন, এটা তাঁকে দিয়ে  লিখিয়ে নিতে চাইলাম। বললাম, আপনি যা যা বলেছিলেন এগুলো যদি একটু গুছিয়ে লিখে দেন তবে আমি  তা ফার্স্ট ফ্ল্যাপে ব্যবহার করতে পারি। তিনি লিখলেন –

শাকুর মজিদ বহুগুণে গুনাণ্বিত একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। তিনি একাধারে দেশের যেমন একজন বিশিষ্ট স্থপতি, পাশাপাশি টেলিভিশন নাটক ও তথ্যচিত্র নির্মাতাও। তাঁর দেখার যেমন আলাদা একটা চোখ আছে লেখার মধ্যেও এর চমৎকার প্রকাশ ঘটে। তাকে আমরা ব্যতিক্রমধর্মী এক ভ্রমণ শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। ভ্রমণকেন্দ্রিক তথ্যচিত্র নির্মানে তিনি যে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তা অনবদ্য। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের আলেখ্য সেলুলয়েডের ভাষায় যেমন সাবলিল ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, সেগুলি দর্শকবৃন্দ টেলিভিশনের পর্দায় নিবিষ্টমনে উপভোগ করেছেন অনেকদিন ধরে, তেমনি অক্ষরের মাধ্যমে বইয়ে লিপিবদ্ধ করে এর প্রসার ঘটিয়েছেন বিশেষ বৈশিষ্ট্যে।
‘সক্রেটিসের বাড়ি’ শীর্ষক বইটির কয়েকটি অংশ যখন এক জনপ্রিয় পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল তখনই সেটি পাঠকের দৃষ্টি কেড়েছিল, তার মধ্যে আমি একজন। বিশেষ করে লেখকের সুক্ষ পর্যবেক্ষন ক্ষমতা, ইতিহাস ভিত্তিক শিক্ষামূলক বর্ণনা এবং ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে সেই স্থানের স্বচ্ছ ও পরিস্কার বিবরণ এত প্রাণবন্ত হয়ে মন ও মননে ধরা পড়ে যে মনে হয় লেখকের সঙ্গে পাঠকও অদৃশ্যভাবে তার সঙ্গে ছায়া হয়ে সর্বক্ষণ সঙ্গ দিচ্ছেন। এখানেই একজন ভ্রমণ শিল্পীর সার্থকতা। ছোট বেলায় সেই রমাকান্ত বিশ্বাসের ভ্রমণকাহিনী পড়ে যেমন রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম শাকুর মজিদের লেখায় সেই স্বাদ পেয়েছি। ‘সক্রেটিসের বাড়ি’ বইটিতে ইউরোপের ইতিহাস প্রসিদ্ধ তিনটি শহর- বার্লিন, এখেন্স ও প্যারিসকে নিয়ে লেখকের চার বন্ধু সহকারে একটা অনবদ্য ভ্রমণ আলেখ্য। বইটি শুধু ভ্রমণের বর্ণনা নয়, সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশ ও শহরের ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থার বিশদ পরিচয় খুব নিখুঁতভাতে তুলে ধরা হয়েছে। পাঠকের সঙ্গে ইতিহাস ও স্থাপত্যের ছাত্রদের জন্য বইটি অবশ্য পাঠ্য বলে মনে করি। সব মিলিয়ে একজন পাঠক হিসেবে বইটির বহুল প্রচার কমনা করি। অভিনন্দন শাকুর মজিদকে।রবিউল হুসাইন
কবি ও স্থপতি

আইএবি-তে রবিউল ভাই

২০০১ সালের পর থেকে পর পর দুইবার আমিও বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটের কার্যকরি কমিটিতে ছিলাম। এ নিয়ে নানা বৈঠকে কখনো বর্তমান সভাপতি কখনোবা প্রাক্তন সভাপতি হিসাবে ইন্সটিটিউটের নানা সভায় আমরা এক সাথে কাজ করেছি। কাজের সময় একটা কথা বার বার বলতেন, থিঙ্ক গ্লোবালি, ওয়ার্ক লোকালি।

রবিউল ভাইকে কখনো ইংরেজি বলতে শুনিনি। পারতপক্ষে বলতেনও না। কিন্তু ২০০২ সালে আই এ বি ভারতের বিখ্যাত স্থপতি বল্কৃষন দোসিওকে নিয়ে যখন অনুষ্ঠান করে তার পরিচালনার সময় হঠাত করে যেটুকু ইংরেজি বলেন তিনি, আমি ধারন করে ফেলি।

আরেকটা কথা আমাদের শোনাতেন। জাগতিক কাজের ক্ষেত্রে কোন কাজকে কখন কতোটা গুরুত্ব দিতে হবে । বলতেন- প্রথমে নিজের পরিবার, তারপর নিজের প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে তোমার আয়ের সংস্থান হবে। এ দুটোর পর, তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ হবে তোমার এই ইন্সটিটিউট। বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটটাকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালো বাসতেন, এমনকি যখন্তিনি সভাপতি ছিলেন না, তখনও। ২০০৯ সালে যখন নিজস্ব জায়গায় স্থানান্তরিত হলো এই ইন্সটিটিউট, তখন তাঁর আনন্দ দেখে কে!

২০০৯ সালের ২৭ অক্টোবর রাজধানীর আগারগাওয়ের নিজস্ব জমিতে আই এ বি সেন্টার উদ্ভোধনের সময়

এর দুবছরের মাথায় আবার আমার বড় ধরনের দরকার হয় , যখন আমাদের ৫ জনের ভ্রমণদল ‘পঞ্চপর্যটক’ হিসাবে নিজেদেরকে ঘোষনা নেই একটি অনুষ্ঠান করে, যেখানে আমার প্রথম ৮ টি ভ্রমনের বই একসাথে প্রকাশের প্রকাশনা উতসব করা হয় ৩০ জানুয়ারী ২০১১, রোববার, সন্ধ্যা ছয়টায়, ৭৫ মহাখালি ব্রাক সেন্টার অডিটরিয়ামে । এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন বেসামরিক বিমান চলাচল এবং পর্যটন মন্ত্রনালয়ের মানণীয় মন্ত্রী জি. এম. কাদের এম.পি আর বিশেষ অতিথি হিসেবে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী উপস্থিত থাকেন । অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে নির্ধারিত আলোচক হিসাবে উপস্থিত থাকেন স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইন এবং মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব আলী ইমাম । ডেলভিস্তা ফাউন্ডেশন এর খরচাপাতি দে। সেই অনুষ্ঠানের রবিউল হুসাইন চমৎকার কথা বলেন স্থপতিদের ভূমিকা নিয়ে । (বকতৃতার লিংক পেতে এখানে ক্লিক করুন) .  আমার সহপর্যটকদের উদ্দেশ্যে বলেন, শুধু একজন নয়, পঞ্চপর্যটকের সব পর্যটকেরই উচিত সবগুলো ভ্রমণ নিয়ে ফিরে এসে বই লেখা।

২০১১ সালের ৩০ জানুয়ারি পঞ্চপর্যটকের আত্মপ্রকাশ ও আমার লেখা ‘অষ্ঠভ্রমণ’ এর প্রকাশনা উতসবে লেখক, আলোচক, অতিথি, স্পন্সর, প্রকাশক ও পর্যটকদের সাথে রবিউল হুসাইন

২০১১ সালে আমি একবার ক্যামেরা নিয়ে হাজির হই তাঁর অফিসে । আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল, স্মৃতিসৌধ, জাতীয় শহিদ মিনার এসব নিয়ে যেসকল কথা আমাকে বিভিন্ন সময় বলেছিলেন, তা ধারন করা। করলামও তাই। তাঁর ‘আমাদের স্মৃতির সৌধমালা’ নামক একটা অনুষ্ঠানে প্রচার হয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে ।

কথা বলেছেন শহীদ মিনারের ডিজাইন প্রতিযোগিতা নিয়ে।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ নিয়ে কথা

সেই ১৯৯১ সাল থেকে আমি লেগে আছি। আমি জানি, আমার কোন কিছু হলেই রবিউল ভাইকে এক ডাকে আমি পাবো । এরপরে আমার ডাক ছিলো ২০১৩ সালে নেপাল ভ্রমণ নিয়ে লেখা বই ‘অন্নপূর্ণায়’ এর মোড়ক উন্মোচক হিসাবে আসা, ২০১৪ সালে।আমার সেই বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়ে নিলেন নাসির ভাই।

খবর পেয়ে সে অনুষ্ঠানে চলে আসেন নেপাল দূতাবাসের প্রথম সচিব। রবিউল ভাই তাঁর কাছে নিয়ে যান বইটির মোড়ক উন্মোচনের জন্য।

ভ্রমণগ্রন্থ ‘অন্নপূর্ণায়’-এর মোড়ক উন্মোচন, ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ,

এশিয় স্থপতিদের সংগঠন আর্কএশিয়ার বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে আমরা গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দলিয় আড্ডাবাজি আর নেপালি স্থাপত্য নিয়ে লিখেছি দেখে রবিউল ভাই খুব প্রশংসা করলেন তাঁর বক্তৃতায় । এখানেও সবাইকে বলেন ভ্রমণের পরপর এসে বই লিখে ফেলার জন্য, তাতে সব কিছু ডকুমেন্টেড থাকে।

রবিউল ভাই এরপর আমার অনেক ভক্ত হয়ে যান। ২০১৫ সাল থেকে তিনি বছরের একটা নির্দিষ্ঠ মাসে আমার বায়োডাটা সংগ্রহ করেন এবং কিছুদিন পর বিফল মনোরথ নিয়ে বলেন, – হলো না, এরা যে কী করে, কেন করে বুঝতে পারি না…এই বলে কিছুক্ষণ মেজাজ খারাপ করেন তিনি।

২০১৪ সালে আমি বার্জারের আইএবিএওয়ার্ড এর ডকুমেন্টেশন করি। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের মাত্র দুই দিন আগে সিদ্ধান্ত হয় যে প্রথম বারের মতো লাইফ টাইম এচিভমেন্ট এওয়ার্ড দেয়া হবে রবিউল হুসাইনকে । নাসির ভাই ফোন করেন- ভাইডি একটা ৩/৪ মিনিটের প্রফাইল ডকু বানাই দাও।

বহু বছর পর আবার তাঁর অফিসে যাই, অনেক পরিবর্তন হয়েছে অফিসে। আগের জায়গা, আগের ঠিকানা, কিন্তু এখন এটা এপার্ট্মেন্ট। সেখানে ৪ টা ফ্ল্যাট নিয়ে তাঁদের অফিস। তাঁর কামরাটার চরিত্রের কোন বদল নাই। সেই আগের মতো দেয়ালে সাঠানো কিছু ছবি, পোস্টার। নতুন ছবি দেখলাম- জীবনানন্দ দাশের পাশে স্থপতি হালী ভাইর ছবি। আর আরেকপাশে দুজন মহিলার। হয়তো একজন তাঁর মা, আরেকজন প্রয়াত স্ত্রী। টেবিলের উপর কাগজপত্র ঠাঁসা। রুমের একপাশে একজন জুনিয়ার আর্কিটেক্ট একটা কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে, তিনি তাঁর কাছে মাঝে মাঝে গিয়ে ডিজাইন দেখিয়ে দেন।

২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে রবিউল হুসাইনের অফিসের দেয়াল
২০১৪ সালে তাঁর অফিসে

এটা ছিলো দ্বিতীয়বার ভিডিও ক্যামেরায় তাঁকে ধারন করার সময়। এর আগে তাঁর নিজের ডিজাইন করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার আর অন্যান্য শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধ নিয়ে কথা ধারন করেছিলাম ২০১১ সালে। এখন মানাতে হবে ৪ মিনিটের প্রফাইল ভিডিও, যেটা বার্জারের অনুষ্ঠানে তাঁকে লাইফ টাইম এচিভমেন্ট এওয়ার্ড দেয়ার সময় দেখানো হবে।

বিদেশে তাঁর সাথে

২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে রবিউল ভাইর সাথে বিদেশ সফরের সুযোগ হয়। আমার ধারনা এটা করেছেন নাসির ভাই। নাসির ভাই আমাকেও প্রায় জোর করে (গাঁটের টাকায় টিকেট কেটে) নিয়ে গেছেন। তিনি তখন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান স্থপতি আবার ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্টস-এরও সভাপতি। তাঁর কথায় না করার সাধ্য কার!

ঢাকা ও কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে রবিউল ভাই

বিমান বন্দরেই দেখা হয়ে যায় রবিউল ভাইর সাথে । প্রাণখোলা হাসির এক সত্তোরোর্ধ তরুন। দুইপাশে স্কট করে থাকেন দীলু ভাই আর নাসির ভাই। সবার সাথেই তাঁর হাসি ঠাট্টায় সময় যায়।

 

হোটেলে নামতেই তিলকমাখা অভিবাদন, ৩ নভেম্বর ২০১৭
নাসির ভাই সারাক্ষণই আগলে আগলে রেখেছেন কাঠমান্ডুতে
নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাস্ট্রদূত একজন স্থপতি। তাঁর বাসভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে , ৫ নভেম্বর ২০১৭
আমাদের পোড়া কপাল

রবিউল ভাই আর আমি, আমাদের দুইজনেরই মহা কপাল পোড়া। আমাদের কোন কাজই লেগেও লাগে না। আমি মুখে বলি না যে লাগে না, রবিদা বলেন।

একবার আমি তাঁর ফার্মের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে একটা সরকারি কাজের জন্য বিড করি। মোটামুটি বড় কাজ। যে সুত্রে আমি খবর পেয়েছি প্রস্তাব জমা দিতে সে কাগজপত্র দেখে মনে হলো আমার ফার্মের সে রকম সরকারি কাজের অভিজ্ঞতা নাই, যেধরনের কাজের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমি চাইলে জয়েন্ট ভেঞ্চারে কোন অধিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ফার্মের সাথে মিলে করতে পারি।

আমার কাছে প্রথমেই মনে হলো- শহীদুল্লাহ এন্ড এসোসিয়েটসই হচ্ছে আমার প্রথম এবং প্রধান পছন্দ। কারন এর চেয়ে পুরোনো সক্রিয় ফার্ম দেশে নাই  আর এখানে আছেন আমাদের রবিউল ভাই।

আমি ২০১৭ সালে তাঁদের অফিসে কাগজপত্র নিয়ে হাজির হয়ে যাই। বলি, আমার সাথে কী জয়েন্টট ভেঞ্চারে  বিড করবেন ?

জবাবে আমি – ‘না’  শুনার জন্য তৈরি ছিলাম, কিন্তু এটা রবিউল ভাই। তিনি আমার হাত ধরে আমাকে তিন তালা থেকে নামিয়ে দোতালায় চলে এলেন, তাঁর কোম্পানীর এমডি সোবহান সাহেবের কাছে । আমার সম্পর্কে নানা কথা বলা হলো তাঁর কাছে। আমি আমার কোম্পানীর প্রফাইল দেখাতে চাইলাম, তা না দেখেই আমাদের একটা ডীড হয়ে যায়, ৪৯% আমাকে দিয়ে ৫১% তাঁদের।

বাহ। অনেক বড় পাওয়া আমার জন্য। আমি ৩০-৭০তেও হয়তো রাজী হয়ে যেতাম।

এর পরের কাহিনী অনেক লম্বা। সেটা এখানে লিখার বিষয় না। তবে সংক্ষেপে বলি, এটা ছিলো কিউ সি বি এস পদ্ধতির দু খাম বিশিষ্ঠ প্রক্রিয়া।  সে কাজের জন্য টেকনিক্যাল প্রপোজালে আমরা ৯৬% নাম্বার পাই, কিন্তু অন্য এক প্রতিষ্ঠান, যে ৭৮% নাম্বার পেয়েছিলো সে আর্থিক প্রস্তাবে এমন আচানক নিম্নদর দিয়েছিলো যে দুইটার যোগফলে আমরা আধা নম্বর কম পেয়ে দ্বিতীয় হয়ে যাই। এখানে জুয়ার দানের মতো ফলাফল হয়। দ্বিতীয় আর সপ্তমে তফাত নাই, যিনি প্রথম তিনি কাজ পাবেন।

আমরা কাজ পাই না। কিন্তু রবিউল ভাই ফোসফাস করতে থাকেন। নানা জনকে ফোন করেন। বারবার বলেন, আমি বহুবছর ধরে এই টু-এনভেলাপ সিস্টেমের বিরুদ্ধে ফাইট করে যাচ্ছি, কাজ হচ্ছে না। এই সিস্টেমে বদমাইশ টাইপের কিছু ফার্ম মাত্রাতিরিক্ত কম ফী কোট করে, মুখে কেউকেউ বলে যে তারা ফ্রীতেও কাজ করে দিতে চায়। আসলে এদের মতলব খারাপ থাকে । এরা ঠিকাদারকে দিয়ে টাকা উঠায় আর সরকারের লস করায়, খারাপ ডিজাইন দে। এই হচ্ছে অবস্থা।

এ নিয়ে আমি সিপিটিইউ মহাপরিচালক, আই এ বি সভাপতি,  সচিব, মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রতিবাদপত্র লিখে পাঠাই। ফলাফল- যিনি কাজ পেয়ে গিয়েছিলেন বলে ডুগডুগি বাজিয়েছিলে, তার মুখ শুকিয়ে গেলো, টেন্ডার বাতিল। আমাদেরও মন খারাপ, আমরাও পেলাম না। এখন নাকি এটা আবার নতুন করে ডাকা হবে।

রবিউল ভাইর সাথে এ নিয়ে যতোবার কথা হয়েছে, ততোবারই বলেছেন- এখানে আমি আছি তো, কাজ হবে না। আমি তো কপাল পোড়া, জানো না !

২০১৮ সালটা আমাদের দুজনের জন্য উত্তম ছিলো। আমি পাই বাংলা একাডেমি আর তিনি পান একুশে পদক। কিছুদিন আগেও তিনি আমার বায়োডাটা সংগ্রহ করেন এবং ফলাফল প্রকাশের পর আমাকে ফোন করে খুশি হবার বার্তা শুনান। ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্টস আয়োজন করে আমার জন্য একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। সেখানে আমার গায়ে উত্তরীয় পরিয়ে দেন রবিউল ভাই। (অনুষ্ঠানের লিংক এখানে)

২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

এর ঠিক ৪ দিন পর, ২৬ ফেব্রুয়ারী রবিউল ভাইয়ের জন্য আরো গর্জিয়াস অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আই এ বি।

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। একুশে পদক প্রাপ্তির কারনে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট। বামে কবির সাথে আমি আর ডানে কবির সাথে ইন্সটিটিউটের সভাপরি কাজী গোলাম নাসির

কিন্তু সে আসরে ঘটলো বিপর্যয় । সেদিন আকাশে গুড়গুড় করছিলো মেঘ। মিস্টি কিছু বাতাসও বইছিলো । সন্ধ্যার আলো জ্বলতেই ঝিকিমিকি করে উঠলো আইএবি সেন্টারের আঙ্গিনা। তামান্না আপা তাঁর দল নিয়ে প্রণতিনৃত্য করে অভিবাদন জানালেন। এরপর মঞ্চে যাওয়ার পালা। অনুষ্ঠানের সুন্দর ধারা বর্ণনা চলছে। মঞ্চে আমাদের ৪ সভাপতি। এঁদের একজন আজ সংবর্ধিত অতিথি, আর একজন বর্তমান সভাপতি, বাকী দুইজনও  প্রাক্তন সভাপতি। আমাদের কম্যুনিটির বাইরের একজন অতিথিও এসেছেন, তিনি চিত্রকর হাসেম খান। উত্তরীয়টি তাঁর হাতে । তিনি এখুনি পরিয়ে দেবেন। ঘোষনা দিচ্ছেন ভাষ্যকার। কিন্তু যে মুহূর্তে তাঁকে সম্মাননা উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হলো, সে মুহূর্তেই দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে নিলো তার ব্যানার। শত শত দর্শকের সামনে ধপাস করে পড়ে গেলো দুইখানা ব্যাকড্রপ। এর মধ্যে ঝুম বৃস্টি শুরু হয়ে গেলো। বাইরের অনুষ্ঠান পন্ড। সবাই এখন ভেতরে যাবে।

রবিউল হুসাইনের জীবনটাও নানা বাঁকে অনেক সংগ্রাম, অনেক বিপর্যয়ে ভরা। ব্যাক্তি ও পারিবারিক জীবনও নাটকের মতো। সকল প্রতিকূলতাকেই তিনি হাসতে হাসতে বরণ করেছেন। এখানেও তাঁর মুখে আনন্দের হাসি ।

বৃস্টি এসে গেলে খোলা জায়গা থেকে সরিয়ে ইনডোরে ছোট করে শেষ করা হলো বাকী আয়োজন। আমার তখন প্লাস্টার পরানো ভাঙা হাত। হাড্ডি জাড়া লাগে নাই। তাও এক কোনায় বসে আমি ধারন করি এই চমৎকার অনুষ্ঠান। কাজী আরিফ ভাই আইএবি-র সাধারন সম্পাদক। মূল আয়োজকও তিনি। রবিউল ভাইর কবিতা পড়ার জন্য এসেছেন দেশ সেরা আবৃত্তিশিল্পীরা । আরিফ ভাই নিজেও পড়লেন কিছু কবিতা । আর নাসির ভাইর পাশে বসে কবি নিজেই শুনলেন আবৃত্তিকারের কন্ঠে নিজের লেখা কবিতা।

৪৭ বছর পর যখন সমুদ্র সৈকতে

পরের সপ্তাহে আমাদের যেতে হলো কক্সবাজার । যেতে যেতে শুনি দেশ স্বাধীনের পর তিনি নাকি কোন দিন কক্সবাজার আসেন নাই। শুধু তাই না বিদেশের কোন সমুদ্র সৈকতেও নাকি তিনি যান নাই।

আমরা যে হোটেলে ছিলাম, সেখানে আর্কেশিয়া কোন ভেন্যুতে হবে, কক্সবাজার হলে কী কী সুবিধা আছে এই জিনিস রেকি করতে গিয়েছিলাম প্রায় তিরিশ জন স্থপতি। রবিউল ভাইকে খুব কাছে থেকে দেখি। তবে তাঁকে সারাক্ষণ আগলে রাখতেন দীলু ভাই আর নাসির ভাই।

আমাদের আড্ডায়, বৈঠকে প্রায়ই আর্কেশিয়া নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা বলতেন।

তবে বেশি মজা পাই এটা শুনে যে তিনি ৪৭ বছর পর কক্সবাজার এলেন।

৩ মার্চ ২০১৮। কক্সবাজার

এটা শোনার পর আমরা একবার গাড়ি থেকে নামিয়ে সবাই মিলে তাঁকে সমুদ্রের তীরে নিয়ে যাই। বালুকারাশির উপর হাঁটতে হাঁটতে আমার কাছে থাকা ম্যাচ-বক্সের সাইজের গো-প্রো ক্যামেরাতে তিনি তাঁর অভিব্যক্তি শোনান। আমিও তা ধারন করি।

২০১৮ সালের আগস্ট মাসে বুয়েট নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র বানাতে গিয়ে আবার আমার ক্যামেরার সামনে আসেন রবিউল ভাই।

একুশে পদক ছাড়াও আই এ বি গোল্ড মেডেল পান তিনি ২০১৮ সালে। ডিসেম্বর মাসে এই পদক তাঁর হাতে তুলে দেয়া হয় (ডানে), আর বায়ে ২০১৮ সালে বুয়েটের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানানোর সময় আই এ বি সেটারে ক্রুদের সাথে রবিউল হুসাইন
বিদায় রবিদা

২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর। আমাদের পঞ্চপর্যটকের দল সস্ত্রীক অস্ট্রেলিয়া সফরে । এর মধ্যে ফেইসবুক ভেসে গেলো মর্মান্তিক দুসংবাদে। আর আমি হিসাব করে দেখলাম, ১৯৮৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ৩৩ বছরের যোগাযোগটা আমার একেবারেই স্থব্ধ হয়ে গেলো। ইতি টানতে হলো  আমার রবিদা উপাখ্যানের।

উইকিপিডিয়ায় রবিউল হুসাইন

রবিউল হুসাইন (৩১ জানুয়ারি ১৯৪৩ – ২৬ নভেম্বর ২০১৯) ছিলেন একজন বাংলাদেশি স্থপতি ও কবি। ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি ২০১৮ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।এছাড়া, তিনি ২০০৯ সালে কবিতায় অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তিনি শিল্প-সমালোচক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতিকর্মী হিসেবেও পরিচিত। ১৯৭১ সালে সংগঠিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সদস্য ছিলেন।

রবিউল ১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার রতিডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক কুষ্টিয়া জেলায় সম্পন্ন করে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

রবিউল স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর স্থপতি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। কর্মজীবনে তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্যসহ শিশু-কিশোর সংগঠন কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রিটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।

তার নকশায় তৈরি উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তি ও স্বাধীনতা তোরণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ফটক, ভাসানী হল, বঙ্গবন্ধু হল, শেখ হাসিনা হল, খালেদা জিয়া হল, ওয়াজেদ মিয়া সায়েন্স কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম ও একাডেমিক ভবন কমপ্লেক্স.

রবিউলের কবিতা, উপন্যাস, শিশুতোষ ও প্রবন্ধ সম্পর্কিত ২৫টির বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হলো: কী আছে এই অন্ধকারের গভীরে, আরও উনত্রিশটি চাঁদ, স্থিরবিন্দুর মোহন সংকট, কর্পূরের ডানাঅলা পাখি, আমগ্ন কাটাকুটি খেলা, বিষুবরেখা, দুর্দান্ত, অমনিবাস, কবিতাপুঞ্জ. স্বপ্নের সাহসী মানুষেরা. যে নদী রাত্রির,এইসব নীল অপমান, অপ্রয়োজনীয় প্রবন্ধ, দুরন্ত কিশোর, বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি, নির্বাচিত কবিতা, গল্পগাথা, ছড়িয়ে দিলাম ছড়াগুল

রবিউল ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ৭৬ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এরপূর্বে তিনি রক্তের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেন এবং তার পরিবারের সাথে দেখা করেন।

 

মন্তব্য
Loading...