কোন গগণের তারা

ইমদাদুল হক মিলনের ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষে লেখা

আমার যখন সতের ইমদাদুল হক মিলনের সাতাশ। এবং সেই সময়, ১৯৮২ সালে আমার এসএসসি পরবর্তি ছুটির সময় কোনো একটা ঈদ সংখ্যায় ‘পরাধীনতা’ নামক একটা উপন্যাস পড়ার সময় আমি এই লেখকের প্রথম নাম শুনি। ‘পরাধীনতা’ ছিলো জার্মানিতে অভিবাসিত এক বাঙালি তরুণের দু:সহ যন্ত্রনার কাহিনী। পরবর্তীতে শুনি, এই লেখকও জার্মানি গিয়েছিলেন, চলে এসেছেন। তাহলে ঐ উপন্যাসটি কি তাঁর নিজের জীবনের গল্প? আমি এই লেখকের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি।

পরের বছর থেকে আমি ঈদ সংখ্যা খুঁজি, এই লেখক যেখানে লিখেন, সেটাই আমি কিনে ফেলি। পরবর্তী লেখাগুলো দেখি আরো মজার। সবগুলো প্রেমের কাহিনী। মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের গল্প। গল্পের নায়কেরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিংবা ভাইয়ের হোটেলের বেকার বাসিন্দা। নায়িকারা সব বড়লোকের মেয়ে। আমি বড় লোকের মেয়েদের দেখিনি। আমার কৌতুহল লাগে ওদের কথা জানতে। আমি গো-গ্রাসে ইমদাদুল হক মিলন গিলি।

আমি যখন তাঁর ঐ প্রেমের গল্প-উপন্যাসগুলো পড়ি, তখনো আমি ঢাকা আসিনি। আমি পড়াশুনা করি চট্টগ্রামের এক গ্রামের ভেতর এক আধাসামরিক আবাসিক কলেজে। সেখানে শুধু ছেলেরা পড়ে। আমরা মেয়েদের দেখতে পেতাম না। মাসে একবার প্যারেন্টস ডে- হলে দু’চারটা কিশোরী বা তরুণী  দেখা যেতো। যত তরুণী আমাদের চোখে পড়তো সব বন্ধুদের বড় বোন, আপা। শুনি- কেউ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, কেউ মেডিকেলে। এঁদের কারো সঙ্গেই আমার কথা বলা হয় না। কিন্তু এঁদের মতো তরুণীদের গল্প পাই ইমদাদুল হক মিলনের লেখায়।

১৯৮৪ সালের মে থেকে ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে ফাঁকা সময় ছিলো। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বসে আছি, ক্লাস শুরু হতে অনেক দেরি। এ সময়ে মূলত: আমি প্রচুর গল্প-উপন্যাস পড়ি। এর আগে আমার পড়ার বিষয় ছিলো নীহার রঞ্জন, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় এবং তার পরে শঙ্কর। এবং এঁরা সবাই ওপার বাংলার লেখক। নায়ক নায়িকারা সব হিন্দু। সেসময় আমি এক সঙ্গে দু’জন লেখক পাই হুমায়ূন আহমেদ এবং ইমদাদুল হক মিলন যাঁরা আমাদের সময়ের কাহিনী শোনান। তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা লব্দ যে-সকল কাহিনী শোনান- আমার কাছে সেটাকেই ফ্যান্টাসি বলে মনে হতো। আমি দু’জনেরই সে সময়কার সব লেখা পড়ে ফেলি। হুমায়ূন আহমেদের লেখা কম পাওয়া যেতো, মিলনের বেশি। মিলনের তরুণীদের সঙ্গে আমরও প্রেম করতে ইচ্ছে করতো। ভাবতাম, যদি আমারও একটা লাল মোরগের মতো হোন্ডা থাকতো, আহা !

আমি মিলনের উপন্যাস পড়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা, টিএসসি, নিউমার্কেট রমনা পার্ক, সোহরওয়ার্দি উদ্যান- শহীদ মিনার, রোকেয়া হল, শাহবাগ, মৌলী রেস্তোরা – এসবের নাম জানি। এর আগের উপন্যাসে পেতাম হিন্দু চরিত্র এবং কলকাতার অচেনা জায়গার নাম- মিলনে এসে আমি ঢাকাই নাগরিক জীবন পেতে শুরু করি। আমার তখন ঊনিশ-কুড়ি, আমার মধ্যে প্রেম প্রেম, আমি ইমদাদুল হক মিলনে তখন নিমজ্জিত।

বামে পাক্ষিক ‘দিশা’র একটি পাতা, যেখানে ১৯৮৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাতকারে হুমায়ূন আহমেদ জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের তরুন লেখকদের মধ্যে ইমদাদুল হক মিলন তাঁর প্রিয় লেখক। ডানে, সে সময়ের এক আড্ডায় হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলন, সামনে বসা হুমায়ূন আজাদ, শামসুর রাহমান ও সালেহ চৌধুরী

১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই লোকটির সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায় বাংলা একাডেমির বই মেলায়। আমি  তখন ‘দিশা’ নামক একটি পাক্ষিক (বর্তমানে লুপ্ত) পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত লেখা শুরু করেছি। বইমেলা নিয়ে আমার এসাইনমেন্ট। সম্পাদিকা বলে দিয়েছেন বড় বড় লেখকদের পেলে তাদের ছবি তুলতে, ইন্টারভিউ করতে। আমি বইমেলার স্টলে স্টলে একটা অটোফোকাস ক্যামেরা নিয়ে ঘুরি আর লেখক পেলে ছবি তুলি। ছবি তুলেছি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, আহমেদ রফিক, এম.আর. আখতার মুকুল এঁদের। কথা বলার সাহস তেমন হয় না। ভয় পাই। দূর থেকেই ছবি তুলে সরে পড়ি।      ‘চারিদিক’ নামে একটা স্টলের সামনে দেখি জিন্সের প্যান্ট, সাদা ক্যাডস্ আর পলো টি-শার্ট পরে গোঁফওয়ালা তিরিশের এক তরুণ দাঁড়িয়ে। অনেক তরুণী তার পাশে। তিনি অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত।        লেখকেরা গুরু গম্ভীর হবেন, ছালার ব্যাগ নিয়ে হাঁটবেন। কিন্তু এই লেখক দেখি ছোকরা প্রকৃতির। আমি কাছে গিয়ে জিগ্যেস করি- আপনি কি ইমদাদুল হক মিলন?

– জ্বী

– আমি দিশা পত্রিকার রির্পোটার, আপনার একটা ছবি তুলবো, কিছু কথা বলবো।

– বলুন

আমি তার নতুন প্রকাশিত বই নিয়ে কথা বলি। তার ছবি তুলতে চাই। তিনি স্টলের সামনে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে পোজ মেরে দাঁড়ান। স্টুডিওতে এমন পোজ দিয়ে কিছু লোকের ছবি তুলতে দেখেছি। ফিল্মের নায়করা হয়তো এভাবে পোজ দেন। আমি এই লেখকের পোজ মারা ছবি তুলি। কাছে যাই, মুখের ছবি তুলবো ক্লোজ-আপ।

লেখক আমাকে বলেন- আপনার এই ক্যামেরায় (ইয়াশিকা এম এফ টু, অটোফোকাস) ক্লোজ আপ আসবে না। আপনাকে আমি ছবি দেবো।

কোথায় পাবো ছবি আপনার?

এক কাজ করুন,  আমার একটা প্রেস আছে গেন্ডারিয়ায়। আপনি ওখানে চলে আসুন কাল, আমি ছবি রেখে দেবো।

আমার গেন্ডারিইয়া যাওয়া হয় না। কিন্তু তার ফোন ঠিকানা আমি রেখে দেই।

এর মাস দুই পরে আমার আরেকটা এসইনমেন্ট পড়ে পত্রিকা থেকে। ২৫শে বৈশাখ উপলক্ষে একটা কভার স্টোরি হবে। কয়েকজন বিশিষ্ঠ লেখক তাঁদের লেখায় রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে ধারণ করেন, তা নিয়ে এর কাহিনী।

এর মধ্যে দেশের দু’জন বিশিষ্ঠ ও জনপ্রিয় লেখক আমার পরিচিত হয়ে গেছেন। আমি হুমায়ূন আহমেদের মন্তব্য সংগ্রহ করি এবং ইমদাদুল হক মিলনের মন্তব্য গ্রহণের জন্য ফোন করি।

ফোনে একবারে তাকে পেয়ে যাই। তিনি প্রশ্নটি শুনেন এবং বলেন- কাল আপনি এখানে (গেন্ডারিয়ার প্রেস)-এ এসে লেখা নিয়ে যান।

আমি বলি, সঙ্গে কি আপনার একটা ছবিও দেবেন, পোর্টেট ?

ঠিক আছে। আসুন।

আমি তখন বুয়েটের ছাত্র। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ক্লাস শেষ হয় আড়াইটায়। তারপর খেয়ে দেয়ে সাড়ে তিনটার দিকে আমার লাল রং এর হিরো সাইকেল নিয়ে হাজির হয়ে যাই গেন্ডারিয়ার প্রেসে।

প্রেসটি খুঁজে পাই। কিন্তু লেখক তো নাই।

আমার আকুতির কথা জানালাম একজনকে (সম্ভবত: ম্যানেজার)। তিনি আমাকে একটা টেবিলে বসিয়ে রেখে খানিক পরে একটা খাম দিলেন। তার ভেতরে এক পৃষ্ঠায় ইমদাদুল হক মিলনের বড় বড় টানাটানা হরফে লেখা, সঙ্গে একটা পোস্টকার্ড সাইজের সাদাকালো ছবি। ছবিতে লেখকের হাত ও আঙ্গুল সামনে, আউট অব ফোকাস, পেছনে গোঁফওয়ালা তরুণ ইমদাদুল হক মিলন। ছবির পেছনে হাতে লেখা- ‘আলোকচিত্র- নাসির আলী মামুন’।

এরপর বেশ ক’বছর তাঁর সঙ্গে আর দেখা সাক্ষাৎ হয় না। বইমেলাতে দেখি স্টলের ভেতর দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়ের উপর সই করেই যাচ্ছেন।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার মাঝামঝি সময় থেকে আমি ‘আউট বই’ পড়া প্রায় ছেড়েই দেই। প্রথমত: সময় পাই না, দ্বিতীয়ত: যে-সকল বই না পড়লে পরীক্ষা পাশ হয় না, সে-সকল বইও যখন আমার পড়া হচ্ছে না তখন এসব আর কেন?

এর মধ্যে পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করাটা কমে আসে। পত্রিকায় লেখার চেয়ে অন্যের বাড়ি গিয়ে ছাত্রী পড়ানো যখন আমার জন্য অনেক বেশি অর্থ বহন করে আনে, তখন কম পয়সার লেখালেখির কী দরকার! আমার অবসর কাটে ছাত্রী পড়িয়ে। সেখানেও কোনোকোনো ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রীর টেবিলে আমি ইমদাদুল হক মিলন দেখি, কেউ কেউ আমাকে তার দু’য়েকটা বইও পড়তে দেয়। আমি কয়েক পাতা পড়ে দেখি- এর কাহিনী আমার আগে পড়া। এমনটা লক্ষ্য করি আরো কয়েক জায়গায়। বুঝি, অতিরিক্ত লেখার তাগিদ মেটাতে গিয়ে নিজেই নিজের লেখায় পুনরাবৃত্তি করতে করতে ‘সিলভার্স অব স্টোলেন প্রপার্টি’ গড়ে তুলেছেন। আমি পড়াপড়ি থেকে অবসর নেই। এর মধ্যে তাঁর সঙ্গে আমার প্রতিবছরই অন্তত: একবার দেখা হয়, বইমেলায়। কিন্তু কথা হয় না। আর বইমেলা ‘কভার’ নিয়ে যেহেতু আমার কোনো এসইনমেন্ট থাকে না, আমি গায়ে পড়ে তাঁর সঙ্গে কথাও বলতে চাই না।

ইমদাদুল হক মিলনের বই পড়া বাদ দিলেও তাঁকে আমরা বাদ দিতে পারি না। ‘কোন কাননের ফুল’, ‘যত দূরে যাই’, ‘রূপনগর’ এসব ধারাবাহিক নাটক তখন একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভিতে হিট। আর সেগুলোর সবক’টির নায়ক আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আর বিজনেস পার্টনার তৌকির  আহমেদ । সুতরাং তৌকিরের নাটক দেখতে বাধ্য হয়ে আমরা ইমদাদুল হক মিলনের রোমান্টিক টেলিভিশন নাটক দেখে আপ্লুত হই। আমাদের সময় চলে যায়।

এর মধ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমার লেখা নাটকও প্রচার হয়। টেলিভিশনে যাঁরা নাটক লেখেন তারা সংগঠিত হয়ে ‘টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ’ তৈরি করেন। এই সংগঠনের প্রথম কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইমদাদুল হক মিলন, মাসুম রেজা সাধারণ সম্পাদক, আমি যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক। কায়েস চৌধুরী আরেকজন ভাইস প্রেসিডেন্ট। আমাদের প্রেসিডেন্ট মান্নান হীরা। সংগঠনে ছিলো গাজী রাকায়েত। অভিনয় শিল্পী সংঘ একটা ছিলো, এর সাধারণ সম্পাদক তৌকির আহমেদ।

২০০৮ সালে আমার বইয়ের (ক্লাস সেভেন ১৯৭৮) মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ইমদাদুল হক মিলন, বামে। আর ডানে, ২০১৬ সালে ‘সমরেশ বসু স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার’ অনুষ্ঠানে

তখন প্রায়ই আমাদের লালমাটিয়ার অফিসে মিটিং হতো নাট্যকার-শিল্পীদের নিয়ে। তৌকির, রাকায়েত আমি তখন একই প্রতিষ্ঠানের তিন অংশিদার পরিচালক। আমাদের আর্কিটেকচারাল আর রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন কোম্পানির বিকেল-সন্ধ্যাগুলো কাটতো নাট্যকার-পরিচালক আর নাট্যকর্মীদের আড্ডায়। সেই আখড়ায় ২০০১-২ সালের দিকে আমার সঙ্গে নতুনভাবে পরিচয় ইমদাদুল হক মিলনের। প্রথম পরিচয়ের দিনে তিনি আমার দু’টো আলোকচিত্র ‘কেনেন’ তার শুটিং হাউজে টাঙিয়ে রাখার জন্য আর ‘প্রায়’ জোর করে দু’হাজার টাকা আমার হাতে গুজে দেন ছবির ‘মূল্য’ হিসেবে। এই থেকে শুরু নতুন মাত্রা।       এখানে এসে আমি আরেক ইমদাদুল হক মিলনকে পাই। আমদের আড্ডায় তাঁর গল্প-উপন্যাস বা তার নাটক কখনোই প্রধান হয়ে উঠেনি। সেখানে তাঁকে একজন বন্ধুবৎসল, সরস, বুদ্ধিদীপ্ত মানুষকে পাই। মজার বিষয় এইযে, আমাদের মধ্যে অনেক আগে যে পরিচয় হয়েছিলো সে ঘটনাটা তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েও কাজ হয়নি। তিনি মনে করতে পারেননি। আমিও সেটা আর ঘাটাইনি।

আমাদের এই আড্ডার আয়ূ বেশিদিন স্থায়ী হয় না। ২০০৪ সালে মাস খানেকের জন্য বিদেশ যাওয়া পড়ে। আড্ডা বন্ধ হয়ে যায়। আর নতুন করে গড়ে ওঠেনি।

নতুন করে ইমদাদুল হক মিলনকে আমি আবার পাই ২০০৮ সালের পর, যখন হুমায়ূন আহমেদের দখিন হাওয়ায় আমারও যাতায়াত শুরু হয়। এ পর্যায়ে দখিন হাওয়া আর নুহাশপল্লীতে আমরা বহুবার একত্রিত হয়েছি। কিন্তু সেই আড্ডায় হুমায়ূন আহমেদ সঞ্চালকের ভূমিকায় থাকতেন, মুখ্য আড্ডাবাজ। বাকীরা শ্রোতা।        টের পাই হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে খুব পছন্দ করেন। শুধু তাই নয়, আমি বলবো, হুমায়ূন আহমেদও একসময় তাঁর লেখা দ্বারা অনুপ্রাণিতই হয়েছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর এক উৎসর্গপত্রে এমনটি লিখেছেনও মিলনকে নিয়ে। ১৯৮৩ সালে হুমায়ূন আহমেদ দেশে ফিরে জানতে পারেন ইমদাদুল হক মিলনের বই সবাই বেশি পড়ে, বইমেলায় মিলনকে নিয়েই ভক্তকূলের ভিড়, তখন তিনি নিজেও তাঁর নন্দিত কারাগার থেকে বেরিয়ে ‘তোমাকেই’ ‘সৌরভ’ এর মতো উপন্যাস দিয়ে লেখা শুরু করেন। ‘তোমাকেই’ উপন্যাসের কভারে লেখা ছিলো ‘একটি প্রেমের উপন্যাস’- সেটা ১৯৮৫ সালের গল্প। ২০০৯ সালে আমার ৪৫তম জন্মদিনের স্মারকগ্রন্থেও জন্য হুমায়ূন আহমেদ একটা লেখা দিয়েছিলেন। তখন শাওন বলেছিলো, শাকুর ভাই, আপনি হচ্ছেন দ্বিতীয় ভাগ্যবান যার জন্মদিনে হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন। প্রথম ভাগ্যবান ছিলেন ইমদাদুল হক মিলন, তাঁর পঞ্চাশতম জন্মদিনে হুমায়ূনএকটা লেখা লিখেছিলেন।

‘পরাধীনতা’ দিয়ে শুরু। তারপর ‘ভূমিপুত্র’ ‘কলিকাল’ থেকে শুরু করে ‘নূরজাহান’ বা সাম্প্রতিক ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ এসব উপন্যাসের কথা সমালোচকেরা মুখে আনে না। তার ব্রান্ডিং তার নিজের নামের মধ্যেই করে রেখেছেন রোমান্টিক উপন্যাসের রচয়িতা হিসেবেই তাঁর যে পরিচয় ধারণ করেছিলেন মধ্য নব্বই পর্যন্ত সেখান থেকে তাঁর আর বেরোনো হয় নি। ষাট বছর বয়সে এসে ইমদাদুল হক মিলন যদি পেছনে তাকান, তিনি কী দেখেন ? জীবনের প্রথম তিরিশে তিনি যে জায়গায় ছিলেন পরবর্তি তিরিশে তাতে কিছু সংখ্যা যোগ করা হয়েছে এবং তিনি এমদাদুল হক মিলন, এই ব্রান্ড নামে পরিচিত হয়েছেন। তিনি নিজের ভেতরে ধারণ করেন মানিক-তারাশংকরকে কিন্তু নিজে সেটা হতে চাননি। তিনি মিলনই হতে চেয়েছিলেন, হয়েছেনও। ইমদাদুল হক মিলনের সবেচেয়ে বড় দুঃখ এটাই যে, তিনি যে-সকল ‘ভারী ভারী’ লেখা লিখেছেন- সেগুলোর কথা মানুষ মনে রাখে নাই, তার ‘সস্তা’ প্রেমের উপন্যাসগুলোর কথাই ঘুরে ফিরে বলেন সবাই।

মিলনের সবচেয়ে বড় দখল তাঁর গদ্যে। অসম্ভব সুন্দর তাঁর বাক্যবিন্যাস। কিন্তু আমার নিজেরও মাঝেমাঝে মনে হয়েছে প্রবহমান ঢেউ দেখার মতো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আমি সাবলিলভাবে পড়েই যাচ্ছি আমি নিশানা পাচ্ছি না কোথাও। হতে পারে তাঁর সকল লেখাই এমন নয়। দুইশো’র মতো বই লিখেছেন তিনি, কিন্তু কঠিন কঠিন সমালোচকেরা সেখান থেকে যে কুড়ি খানা উপন্যাস আলাদা করবেন, সে সুযোগটাও তিনি দেন নি।

আমার দশ বছরের বড় এই মহৎ মানুষটি এ বছর ষাট বছর পূর্তি হবে। এই আনন্দঘন সময়ে তাঁর মন খারাপ হবে এমন কিছু আমি লিখতে চাই না। তারপরও কলমে যখন এসেই গেছে, বলেই ফেলি- ইমদাদুল হক মিলন ইজ এ কমপ্রোমাইজিং রাইটার। জীবনের শুরুতেই তিনি প্রকশক সম্পাদকের চাহিদা মেটাতে গিয়ে তাদের পছন্দের জন্য লিখে লিখে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। আর মধ্য পঁঞ্চাশে এসে সৃজনশীল লেখালেখি পাশে ফেলে রেখে দৈনিক পত্রিকার ‘সম্পাদক’এর ‘লোভনীয়’ চাকুরী নিয়ে তার প্রতিভার বাকীটুকু শেষ করে দিয়েছেন।

মিলন ভাইর সঙ্গে যতটুকু মিশেছি তাঁকে অনেক বড় ও পরিশ্রমী পাঠক বলেই আমার মনে হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের হেন কোনো বড় লেখক নাই যার সবগুলো লেখা তিনি পড়েন নাই। তিনি যেহেতু সে-সব পড়েছেন- একজন নিরপেক্ষ বিচারক হিসেবে লেখক মিলনকে কোথায় দাঁড় করাবেন, সেটা তাঁর চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আমি তাঁর কাজের মূল্যায়ন করার যোগ্য কেউ না। তবে আমি এও মনে করি এই লোকটা যদি আর কারো কোনো চাকুরী না করে তাঁর বাকী জীবনটা শুধু লেখালেখি করে পার করে দিতে পারে, যেখানে তিনি শুধু তাঁর পছন্দের বিষয় নিয়েই লিখবেন, তবে এখনো বাংলা সাহিত্যের আরেক কালজয়ী লেখককে আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারবো বলে মনে করি।

 

একুশে পদক প্রাপ্তিতে কালের কন্ঠ পরিবারের সদস্যরা অভিবাদন জানাচ্ছেন সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলনকে

ইমদাদুল হক মিলন একজন তারকা লেখক। তিনি কোন আকাশে উদয় হবেন এটা তাকেই ঠিক করতে হবে। বালাই ষাট পার হলো মিলন ভাই, আপনার আরো দীর্ঘ জীবন দরকার, পরিজনের জন্য নয়, বাঙালি পাঠকের জন্য।

(ইমদাদুল হক মিলনের ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষে লেখা। লেখাটি কালের কন্ঠের সাহিত্য সম্পাদক মাসুদ হাসানের আহবানে লেখা এবং ২০১৫ সালের ২৩ আগস্ট তাঁকে পাঠানো। এটা একটি জন্মদিন স্মরণিকায় প্রকাশের জন্য পাঠানো, লেখাটি প্রকাশ হয়েছিলো কী না জানা যায় নাই)
হুমায়ুণ আহমেদের দখীন হাওয়ার বাসায় যখন ‘প্রিয় হুমায়ূন’ এর জন্য সাক্ষাতকার নিচ্ছেন ইমদাদুল হক মিলন , ২০১২ সালে

ইমদাদুল হক মিলনের লেখা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে আমাকে একবার কথা বলতে হয়েছিলো বাংলা একাডেমির অমর একুশের বইমেলায়। সেখানে হুমায়ূন আহমেদের উপর মূল বক্তা ছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। তাঁর লেখা ‘প্রিয় হুমায়ূন’ গ্রন্থ থেকে তিনি কিছু অংশ পড়ে শোনান। এর পর মঞ্চে ডাক পড়ে আমার, নির্ধারিত আলোচক হিসাবে। সেখানে লিখিত বক্তৃতায় আমি এই দুই লেখককে একত্র করেই বলেছিলাম-

দুই লেখকের গল্প
ইমদাদুল হক মিলনের এই লেখাটির মধ্যে সবচেয়ে প্রকট হয়ে যে বিষয়টি এসেছে, তা হচ্ছে এই দুই লেখকের লেখালেখির সূচনা পর্বের সংকটময় সময়। দু’জনই অত্যন্ত দারিদ্রের মধ্যদিয়ে তাঁদের সংসার জীবন শুরু করেছিলেন। সে সময়ে জীবনের কঠিন বাস্তবতাগুলোকে সামনে দেখে মধ্যবিত্ত পরিবারের খোকা যে ক্রান্তিকালের বর্ণনা দিয়েছিল, তা প্রকাশ হয়েছিল হুমায়ূনের ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’এ। এ দু’টো উপন্যাসের প্রায় কুড়ি বছর পর ভাগ্যান্বেষনে জার্মান পাড়ি দেয়া এবং পরবর্তীতে দেশে ফেরত এসে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অপর টগবগে তরুণ ইমদাদুল হক মিলন লিখেছিলেন তাঁর প্রথম দিককার মাইল ফলক উপন্যাস ‘নির্বাসন’।
হুমায়ূন আহমেদ দীর্য় প্রায় চার দশক ধরে লেখালেখি করেছেন, ইমদাদুল হক মিলনও লিখছেন বিগত তিন দশক ধরে। কিন্তু এঁদের দু’জনই এই দীর্ঘ জীবনের লেখালেখিতে তাঁদের প্রথম দিকের লেখাগুলোকে অতিক্রম করে গেছেন এমন লেখার সংখ্যা খুব বেশি নয়।
এই লেখকদ্বয়ের একটি সাধারণ গুণ আছে। তাঁরা দু’জনই অত্যন্ত চমৎকার গদ্য রচনা করতে পারেন। এবং এ দু’জনই আশির দশক থেকে প্রায় একই সাথে দু’হাতে লেখা শুরু করেন, এক সময় তেমন কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই।
নূরজাহান-এর মতো উপন্যাস লিখেও মিলনের ব্রান্ডিং রয়ে গেছে রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাসের লেখক হিসাবে
স্বপ্রনোদিত হয়ে জীবন থেকে পাওয়া বোধগুলোর বিচ্ছুরণ ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে তাঁদের লেখায়। এর পরিবর্তে সম্পাদক বা প্রকাশকের ফরমায়েশকে প্রাধান্য দিয়ে নানা রকমের গল্প-উপন্যাস লিখতে থাকেন। তাঁদের দু’জনেরই যাদুমাখা গদ্যে মোহিত হতে থাকে নতুন পাঠক। দিনে দিনে তাঁদের লেখার চাহিদা বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠ হয় অর্থ-যোগ। বারোশ’ টাকার বাড়ি ভাড়ায় থাকা লেথক ইমদাদুল হক মিলন প্রকাশকের কাছ থেকে বস্তাভর্তি দু’লাখ টাকার বান্ডিল পেয়ে দিশেহারা হয়ে যান। সাড়ে ছয় হাজার টাকা বেতনের হুমায়ূন আহমেদ এক উপন্যাসের জন্য দশ লাখ টাকা অগ্রিম পেয়ে হন বিগলিত। তারা প্রকাশকদের চাহিদা মাফিক ক্রমাগত লিখতে থাকেন।
বিগত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের বাংলাভাষার প্রকাশনা শিল্পকে জিইয়ে রাখতে এবং কম্পিউটার ও ইন্টারনেট যুগের তরুণ-তরুণীদের বইমুখী করে রাখার জন্য এই দুই লেখকের ভূমিকাকে  কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। এই দুই লেখকের কথোপকথনের মধ্যেই আছে,

হুমায়ূন ভাই, আমি জানতে চাইছিলাম যে আপনি এতো বড় একজন  লেখক, বাংলা সাহিত্যের প্রেড়্গাপটে আপনার নিজের অবস্থান কোথায়?

‘আমার অবস্থাান ঠিক হবে আমার মৃত্যুর পর। তোমরা সবাই মিলেই ঠিক করবে। এই সময়ে আমি বর্তমানের একজন জনপ্রিয় লেখক। এর বেশি কিছু না।’

( প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ- ইমদাদুল হক মিলন, পৃষ্ঠা ৬১)

মন্তব্য
Loading...