দূরন্ত শৈশব, ১৯৮৫

ছবি তোলার নেশায় আমাকে কবে পেয়েছিলো ঠিক মনে করতে পারি না। তবে আমার যখন ১৪-১৫ বছর বয়স, সে সময় বাবার কাছ থেকে একটা ক্যামেরা পেয়েছিলাম। কোডাক এর ক্যামেরা । এর ভেতর ফিল্ম ঢোকানোর যে ব্যবস্থা ছিলো, আমার তা জানা ছিলো না। আমি জোর করে ক্যামেরা খুলতে গিয়ে প্রথম দিনই ক্যামেরাটা নষ্ট করে ফেলি। সিলেটের কতগুলো স্টুডিওতে ঘুরে ঘুরে কোনো মেকানিক পাইনি ক্যামেরা সারানোর জন্য।

ক্যামেরার প্রতি একটা খায়েস জন্মে আমি যখন দশম শ্রেণিতে। তখন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়ি। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়টুকুতে কলেজের নিয়মকানুন পরীক্ষার্থীদের মধ্যে শিথিল হয়ে যেতো। আমাদের হাউজের দুইজন দুটো ক্যামেরা নিয়ে আসে। তার একটি পিনহোল, টিপ দিলে ছবি ওঠে। আরেকটি ক্যামেরা বড় অদ্ভুদ ছিলো, ইয়াশিকা। ওটাতে ফোকাস করার বিষয় ছিলো। ভিউ ফাইন্ডারে তাকালে একটা গোলাকার চাকতি ভেসে আসতো, তাতে একটা বৃত্তের মধ্যে চারটা ভাগ। উপরে নিচের লাইন সোজা হলে ধরে নিতে হতো যে ফোকাস হয়েছে। এটা আমাকে প্রথম শেখায় এই ক্যামেরার মালিক আহমেদ। আমরা ছবি তুলি, এবং ফিল্মটি খুলে বাড়িতে নিয়ে যাই। আহমেদ তার ফিল্ম কাওকে ধরতে দেয় না। সে ফিল্ম পাঠাবে শারজাহ, তার ভাইয়ের কাছে। সেখান থেকে ছবি হয়ে আসবে। রঙিন ছবি প্রসেস করার মেশিন তখন চট্টগ্রামে আসেনি।
আমরা ৫ জন মিলে একবার একটা রঙিন ফিল্ম কিনি। আহমেদকে তোয়াজ করে তার ক্যামেরা নিয়ে তার কাছে ফিল্ম ভরতে শিখি, ফোকাস করা শিখি, এপারচার-শাটার স্পিড বুঝি না, শুধু বুঝি কড়া রোদে ছবি তুললে ১৬তে, কম রোদে হলে ৮ এ আর ছায়ার মধ্যে তুললে ৪ এ দিয়ে ছবি তুলতে হয়।
এই ফিল্ম  নিয়ে আমি ছুটিতে বাড়ি নিয়ে যাই এবং আমার বন্ধু ছানুর কাছে লোক মারফত পাঠিয়ে দেই দুবাই। মাস দুই পর কলেজের ঠিকানায় একটা প্যাকেট আসে। প্রতিটি ছবি দুই কপি করে প্রিন্ট করা। সবগুলো রঙিন ছবি। কেমন যেন ঝকঝক করে সব কিছু। লাল ফুল, সবুজ পাতা, নীল আকাশ এর আগে আমার নিজের কোনো ছবিতে দেখিনা। আমি মহা আপ্লুত হয়ে পড়ি আরো ছবি তোলার জন্য, কিন্তু ক্যামেরা পাবো কোথায়? কে দেবে আমাকে ছবি তুলে দেবার সুযোগ?
এরপর অবশ্য ছবি তোলার সুযোগ পাই বছর খানেক পর। ক্লাসের সবাই শিক্ষা সফরে যাবে, সঙ্গে যাবে কালেজের ক্যামেরাও। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর জন্য যত ছেলের আগ্রহ, তার পেছনে থাকতে অনুৎসাহীদের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। এই সুযোগে আমি ক্যামেরা হাতাই। আমার গলার মধ্যে ক্যামেরার ফিতা ঝুলিয়ে রাখতেই আমার ভালো লাগে। আমি ক্যামেরায় ফোকাস করা জানি, আমার সমস্য নাই।
এক্সকারশন এর পর ক্যামেরা ফেরত দেয়ার পর আবার ক্যামেরা ছু’তে সময় লাগে আরো প্রায় দু’বছর। অনেক অনুনয় বিনয় করে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী আমার এক চাচাতো ভাইকে দিয়ে আমি একটা ক্যামেরা আনাই। এটা ইয়াশিকা এমএফটু অটো ফোকাস। আমি ব্লাক-এন্ড হোয়াইট একটা ফিল্ম ভরে এটা দিয়ে গ্রামের মানুষের ছবি তুলি। বাড়ির পাশে খালের উপর হাঁসের চলাফেরা, পুকুরে ঝাপ দেয়া শিশু কিশোর, কিংবা গরুর পাল নিয়ে আসা রাখাল বালক।

আমি ব্লাক-এন্ড হোয়াইট একটা ফিল্ম ভরে এটা দিয়ে গ্রামের মানুষের ছবি তুলি, ১৯৮৪

১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ঢাকা চলে আসি। সঙ্গে আমার ইয়াশিকা এমএফটু অটোফোকাস। আমি ঢাকার ছবি তুলি। পত্রিকায় পত্রিকায় ঘুরি ফিচার লেখার জন্য। ফিচারের সঙ্গে ছবি থাকলে ভালো হয়। আমি এই ক্যামেরাতে ছবি তুলতে থাকি।

বাবার জীবদ্দশায় ক্যামেরা পেলামনা। তাঁর মৃত্যুর কয়েকমাস পর আমার জন্য একটা ক্যামেরা এলো। দুবাই থেকে আমার চাচাতো ভাই একটা ক্যামেরা পাঠালেন। ইয়াসিকা এফএম টু, অটোফোকাস। সঙ্গে একটা ম্যানুয়েল।এটা পড়েই বুঝে ফেলি, ছবি তোলা অতীব সহজ একটি কাজ । ক্যামেরার সঙ্গে লাগানো চামড়ার প্যাকেটের বোতাম খুলে ক্যামেরা অন করে একটা বোতামে চাপ দিলেই ছবি ওঠে যায়। আমি এ ক্যামেরা নিয়ে ঢাকা চলে যাই ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। বুয়েটে ক্লাস শুরু হতে আরও দু’মাস বাকী। আমি টিউশনি ধরি আর বিভিন্ন সাপ্তাহিক-পাক্ষিকের অফিসে ঘোরাঘুরি করি, এসাইনমেন্ট নেই। লেখার সঙ্গে ছবির দরকার হলে সব সম্পাদককে বলি, আমার ক্যামেরা আছে, আমি নিজে ছবি তুলে দেবো। এবং যথারীতি আমি নিউমার্কেটের সবচেয়ে সস্তার দোকান খোঁজে বের করে ফেলি। পত্রিকার জন্য সাদাকালো ছবি দরকার, তাই সবচেয়ে সস্তায় সাদাকালো ফিল্ম কিনি ২০-২৫ টাকায়, ১০টাকায় নিগেটিভ প্রসেস করি, ২ টাকায় বি-টু সাইজের ছবি প্রিন্ট করে লেখার সঙ্গে ছবিও জমা দেই। এ কারনে আমার লেখার বিলের সঙ্গে ৪০-৫০টাকা যোগ হয়, আমার চলে যায়।

এ ক্যামেরাতে ছবি তুলতে তুলতে এবং অনেকগুলো ফিল্ম খরচ করতে করতে আমি কিছু জিনিস শিখি। দিনের কোন বেলার আলোয় ছবি তুললে কেমন আসে, রাতের বেলা ছবি কেন কালো হয়ে যায়, ফ্ল্যাশ লাইট কতোটুকু দুরত্ব কভার করে, ক্যামেরার কতটুকু কাছে এলে আর কারো মুখের ছবি তোলা যায় না, এ সব শিখি নিজের ভুল থেকে। সঙ্গে গাইড বইটাও মিলিয়ে নেই। সেখানেও চমৎকার কিছু নির্দেশবলী ছিল, তার কাছ থেকেই জানি। ফটোগ্রাফির প্রথম শিক্ষক ছিলেন আমার –ক্যামেরা ম্যানুয়েল পুস্তকখানী।

১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বুয়েটে আমাদের ক্লাস শুরু হয়। মাস তিনেকের মাথায়ই একটা বড়ো ছুটি পেয়ে গেলাম- এরশাদ ভ্যাকেশন। আমি ক্যামেরা নিয়ে বাড়ি যাই। ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে বিয়ানীবাজার, সেখান থেকে রিকশায় নিজের গ্রামের ইদ্গাহ বাজার, তারপর পায়ে হেঁটে বাড়ি। রিক্সা থেকে নেমেই আমি ক্যামেরাটা ব্যাগ থেকে বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে রাখি। তার দু’টো কারন। এক- আমার একটা ক্যামেরা আছে, সাংবাদিক-সাংবাদিক ভাব, এটা জনগনের জানা ভালো। দুই- হঠাত করে মজার কিছু সামনে পড়ে গেলে ঝটাপট শাটার টেপা যায়। এ শাটার টেপাও অনেক হিসেব করে করতে হয়। ফিল্ম এনেছি ১ রোল, তাতে সাকুল্লে ৩৬ টা ছবি তোলা যাবে। এর বেশী না। সুতরাং বুঝে শুনে শাটার টেপা।

আমি বাড়ির পুকুর পাড়ে এসে যখন পৌঁছই তখন ভর দুপুর । দেখি পুকুরের ঘাট থেকে একজন একজন করে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ছে, সুইমিং পুলে যেমন করে ডাইভ দেয়া হয়, অনেকটা সেরকম। যারা এ ডাইভিং খেলায় মত্ত, তারা আমারই অতীব ঘনিষ্ঠজন- ছোটো ভাই, খালাতো ভাই, চাচাতো ভাই, এবং কারো বয়সই ৭-৮ বছরের বেশী নয় এবং সঙ্গত কারণেই কারো শরীরেই সুইমিং কসটিউম নাই।  তারা বারবার পানিতে নামছে , সাঁতার কেটে আবার পাড়ে উঠে আবার ডাইভ দিচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াই, তাদের দিকে ক্যামেরা তাক করি, আমাকে পাত্তা দেয়ায় মতো সময় তাদের নাই, তারা ডাইভিং-এ ব্যাস্ত। আমি ঠিক করলাম, ছবি তুলবো । অপেক্ষা করছি কখন তাদের দু’জন একসঙ্গে লাফ দেয়। যে মুহুর্তে লাফ দেয়ার জন্য শরীরটা ৪৫ ডিগ্রীর মত একটা কোনে বাঁক নিলো, আমি ক্লিক করে বসি। ফায়ার হয়ে যায়। কিন্তু কী হল, তা বোঝার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয় মাস খানেক সময়। আমার ঢাকা যাওয়া, ফিল্ম প্রসেস করা, বি-টু সাইজে প্রিন্ট নেয়া।

ছবিটা দেখে আমাই চমকিত হই। এটাই চেয়েছিলাম।

এ ছবিটির প্রিন্ট আমার কাছে থাকে অনেকদিন। বহু বছর পর, আবু হাসান শাহরিয়ারকে এ ছবি দেখালাম, তিনি তাঁর ট্যাবলয়েড পত্রিকায় প্রায় অর্ধেক পৃষ্ঠা জুড়ে এ ছবিটি ছাপিয়ে দিলেন। শিরোনাম দিলেন- দুরন্ত শৈশব।

এটাই আমার সংগ্রহে থাকা আমার তোলা সবচেয়ে পুরনো উল্লেখযোগ্য ছবি। ২৯ বছর আগে তোলা এ ছবির পাত্রদের বর্তমান বয়স মধ্য তিরিশ, সবাই বিবাহিত এবং কারো কারো সন্তানের বয়স তাদের ছবির সময়কার বয়েসের চেয়ে বেশী। সেকারনে ছবিটি ফটোশপে কিঞ্চিৎ সম্পাদনা করা হলো।

মন্তব্য
Loading...