লন্ডনী কইন্যা- জিনাত হোসেন

লন্ডনী কইন্যা: বাংলাদেশে জেন্ডার সমতা, নাগরিকত্ব ও সরকার ব্যবস্থাকে পর্যবেক্ষণের দর্পণ

২০১২ সালে লেখা এই উপস্থাপনাটি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জেন্ডার সমতার প্রসঙ্গে নাগরিকত্ব ও সরকার ব্যবস্থাকে দেখার চেষ্টা করে। আর তা দেখতে গিয়ে ’লন্ডনী কইন্যা’ নামক একটি ভিডিও ছবিকে কেস স্টাডি হিসেবে নির্বাচন করে। নির্বাচিত ভিডিও ছবিটি বাংলাদেশের সিলেট এলাকার ঘটমান ঘটনার আলোকে নির্মিত। আর তাই নির্মিত ভিডিও ছবির আলোকে বেরিয়ে আসে চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র। আর সে চিত্রেই জেন্ডার সমতা , নাগরিক অধিকার এবং সরকার ব্যবস্থায় প্রচলিত আইন ও তা প্রয়োগে অসামঞ্জস্যতার ছবি স্পষ্টভাবে প্রতিবিম্বিত হয়।নারীবাদী গবেষনা পদ্ধতি অনুসরন করে কেসস্টাডি ও সংশ্লিষ্ট কলাকুশলীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ভিডিও ছবির চরিত্র গুলো কি করে নারীর সমতা, অধিকার ও স্বাধীনতাকে প্রশ্ন এবং প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে তা এ লেখাটি পর্যালোচনা করে।

আলোচ্য শব্দবিশেষ: জেন্ডার, নাগরিকত্ব, লাল পাসপোর্ট, লন্ডনী কইন্যা।

নারীপুরুষ সমতার ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব ও সরকার ব্যবস্থায় সমতা নিশ্চিত করা একটি প্রাসঙ্গিক দাবী।কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্র নারীর অবস্থান যে পুরুষের অধিনস্ত তা বাস্তবিক অর্থেই সত্য। ১৯৮৫ সালের ইউ এন রিপোর্টেও তার প্রতিফলন দেখা যায় । সেখানে বলা হয় , যদিও নারী পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেক এবং পৃথিবীর সমস্ত কাজের দুই তৃতীয়াংশ সম্পন্ন করে তারাই, কিন্তু মোট আয়ের মাত্র একদশমাংশ তারা ভোগ করে। বেশিরভাগ দেশেই নারী কাজের পারিশ্রমিকে বৈষম্যের শিকার হয়, শিক্ষাক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধায় ও প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। মাহতাব (২০১২) তে ইগলিটজিন এবং রোস (১৯৮৬) এর তথ্য কে উপস্থাপণ করে দেখিয়েছেন নারীরা সরকারী চাকুরীর মাত্র ৬ ভাগ কাজে সম্পৃক্ত। অন্যদিকে,  পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের মাত্র ১ শতাংশ ভোগ করে নারী । তবে এই পরিসংখ্যানের পরবর্তী প্রেক্ষাপট অনেক খানিই পরিবর্তন হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাস্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা নারীর কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করায় উদ্যোগ নিয়েছে। তবু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায় নারীর অবস্থান আগের থেকে পরিবর্তন শুরু হলেও তার কার্যকারীতা খুবই কম । মাহতাব (২০১২) তার লেখায় দেখিয়েছেন, দক্ষিন এশিয়ার ৭ শতাংশ নারী পার্লামেন্টের সদস্য রয়েছে। মাত্র ৯ শতাংশ নারী সদস্য কেবিনেট সদস্য। ৬ ভাগ নারী বিচার বিভাগে কাজ করে। ৯ ভাগ নারী কাজ করে প্রশাসনে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারের মাত্র ২০ শতাংশ নারী সদস্য। এই পরিসংখ্যানের প্রেক্ষিতে বলা যায়, নারীপুরুষ সমতার বিষয়টি সর্বত্র বিধিবদ্ধ হলেও তার কার্যকারিতা আসলে খুবই কম। আবার অনেক ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতার বিষয়টি বিধিবদ্ধ করার ক্ষেত্রেও বৈষম্য দেখা যায়। যেমন , ইউ এন (২০০৩) এর রিপোর্টে বলা হয়, সন্তানের নাগরিকত্ব পাবার ক্ষেত্রে সন্তানের বাবার নাগরিকত্বকে ই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সন্তানের মা অন্য দেশের নাগরিক হলে তার নাগরিকত্ব সন্তানের নাগরিকত্ব নির্ধারনে প্রযোজ্য নয়। অন্যদিকে কোন নারীর কোন অন্যদেশী পুরুষের সাথে বিয়ে হলে সে তাৎক্ষণিকভাবে ঐ দেশের নাগরিকত্ব পাবে এবং সঙ্গে সঙ্গেই নিজ দেশের নাগরিকত্ব হারাবে। শুধু তাই নয় সে দেশে সকল নাগরিক ও সামাজিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হবে। আবার যদি তার স্বামী কোন কারণে তার দেশের নাগরিকত্ব হারায়, তবে স্ত্রী ও নাগরিকত্ব হারাবে। যদি এমনটি হয় যে, তার স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হয়, তবে সে তার স্বামীর দেশের নাগরিক সুবিধা হারাতে পারে এবং তখন যদি তার দেশ তাকে গ্রহণ না করে তবে সে ক্ষেত্রে সে কোন নাগরিক সুবিধা ছাড়াই রাস্ট্রহীন একজন মানুষে পরিণত হবে । অন্যদিকে পুরুষের বেলায় অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রেই এর বিপরীত চিত্র চোখে পড়ে। অনেক দেশে স্বামী তার স্ত্রীর দেশের নাগরিকত্ব পায়না। কোন কোন দেশে স্বামীর নাগরিকত্ব পাওয়াটা অনেক সময় সাপেক্ষ ও ঝামেলা দায়ক। পুরো ব্যাপারটির পিছনে আসলে পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসন প্রতিফলিত হয় সেখানে স্ত্রীকেই স্বামীর দেশে বসবাস করতে হয় আর স্বামী স্ত্রীর সাথে অবস্থান করলে সেটা দৃষ্টিকটু।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এ প্রসঙ্গ কোন কোন ক্ষেত্রে আরো যৌক্তিক। কেননা , অন্যান্য অনেক দেশের মতই বাংলাদেশের সমাজ ও রাস্ট্র ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রের নারী পুরুষ সমতার বিষয়ে দোদুল্যমনতা তৈরী করে। অনেক ক্ষেত্রে তা পুরুষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করে, কখনো বা নারীর সমতার অধিকার কে ভুলন্ঠিত করে। যদিও সরকার কিছু বিষয়ে আইনপ্রণয়নের মাধ্যমে নারী পুরুষ সমতার বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ ২০০৯ এর নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনে নিশ্চিত করা হয়,  মা যদি বাংলাদেশী নাগরিক হয়, সন্তানের নাগরিকত্ব পাবার ক্ষেত্রে  মায়ের  নাগরিকত্ব সন্তান পাবে। তাই বলা যায়, ২০০৯ এর নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনে সন্তানের নাগরিকত্ব পাবার ক্ষেত্রে বাঙালি মায়ের  নাগরিকত্ব সন্তান পেতে পারে, যা জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ যা অন্য অনেক দেশই বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আবার, বাঙালি মেয়ে বিদেশি ছেলে বিয়ে করলে তার স্বামী বাংলাদেশী নাগরিকত্ব পায়না, এ বিধান জেন্ডার সমতাকে ভুলন্ঠিত করে।

কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, নারী সপক্ষে নানান আইন হলেও নারী পুরুষ অসমতার বিষয়টি কি মিমাংসা হচ্ছে? নারীর সপক্ষে যে আইন হয়েছে তা বাস্তবে যথাযথভাবে প্রতিফলন হচ্ছে না। তাই আইন প্রণিত হলেও  তার প্রয়োগ প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে । সরকার ব্যবস্থার বাইরেও প্রথাগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামো অনেক সময়ই নারী পুরুষ সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশাল বাঁধা। এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে নারীর সমতা নিশ্চিত করণে জেন্ডার, নাগরিকত্ব ও সরকার ব্যবস্থাকে বিচার করাটা জরুরী। আর তা বিচার করতে মিডিয়া কে একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা যায়। মিডিয়া সমাজের প্রতিবিম্ব। সমাজে যা কিছু ঘটমান, তা সংবাদ, নাটক, চলচিত্রে ফুটে আসে বার বার। তাই নারীর সমতা নির্ধারনে নাগরিকত্ব ও সরকার ব্যবস্থার প্রেক্ষিত বিবেচনা করতে গিয়েই আশ্রয় নিয়েছি বাংলাদেশে নির্মিত একটি ভিডিও ছবির, নাম ’লন্ডনী কইন্যা’। ভিডিও ছবিতে ফুটে উঠেছে বিদেশী নাগরিকত্ব পাওয়া এক নারীর নাগরিকত্বের বিড়ম্বনায় মানবিক অধিকার হারানোর উপাখ্যান। আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যদিও নারীর সপক্ষে নানা আইন প্রণিত হয়েছে, তদুপরি সামাজিক অনেক ব্যবস্থাই আইনের বাইরে থেকে জেন্ডার অসমতাকে তরান্বিত করতে পারে, সে বিষয়টি সম্ভবত আগে গবেষণায় উঠে আসেনি। তাই সীমিত পরিসরে একটি দেশের একটি অঞ্চলের একটি ঘটনার মাধ্যমে জেন্ডার সমতা, নাগরিক অধিকার ও সরকার ব্যবস্থাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারলে তা হতে পারে বাস্তবসম্মত।  আর সে প্রয়াস থেকেই এই গবেষণাটি পরিচালনা করার তাগিদ পাই।

গবেষণা উদ্দেশ্য:

গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হল ’লন্ডনী কইন্যা’ ভিডিও ছবির আলোকে বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থায় নারীর নাগরিকত্ব, আইন ও  সমতার প্রেক্ষিতে নারীর অবস্থান কে মূল্যায়ন করা।

গবেষণা প্রশ্ন:

গবেষণা টি প্রশ্ন করে ’লন্ডনী কইন্যা’ ভিডিও ছবির আলোকে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থায় নারীর নাগরিকত্ব, আইন ও সমতার প্রেক্ষাপট টি কেমন?

গবেষণার পদ্ধতি:

গবেষণার মূল উদ্দেশ্য কে  বাস্তবায়ন করতে ’লন্ডনী কইন্যা’ নামক একটা ভিডিও ছবি নেয়া হয়েছে। যে ছবিকে কেস স্টাডি ধরে তার প্রেক্ষিতে গবেষণা উদ্দেশ্য ও প্রশ্ন কে বাস্তবে পর্যালচনা করা হয়েছে। এছাড়া ছবিটির সাথে বাস্তবের মেলবন্ধন বোঝার জন্য ভিডিও ছবিটির কাহিনীকার ও পরিচালকের সাক্ষাৎকার ও নেয়া হয়েছে। পুরো গবেষণা পদ্ধতি নারীবাদী গবেষণা পদ্ধতিকে (ঋবসরহরংঃ জবংবধৎপয গবঃযড়ফড়ষড়মু) কে অনুসরণ করে কেননা, নারী বাদী গবেষণা পদ্ধতি হল এমন একটি গবেষণা পদ্ধতি যেখানে নারীকে সমতার প্রেক্ষিতে দেখা হয়। নারীকে তার অবস্থা ও অবস্থানের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করে সনাতনী পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে  একটি নতুন ধারণা এবং ফলাফলের জন্ম দেয় যেখানে অসমতা ও বৈষম্যহীনতা কাজ করে।

লন্ডনী কইন্যার রচনাকাল, ১৯৯৬

’লন্ডনী কইন্য’ ভিডিও ছবির মূল বক্তব্য:

ভিডিও ছবির নাম: লন্ডনী কইন্যা

রচনা: শাকুর মজিদ

পরিচালনা: তৌকির আহমেদ

ব্যাপ্তি:  ৬২ মিনিট

প্রচারিত চ্যানেল: বাংলাদেশ টেলিভিশন

অভিনয়: শমী কায়সার, তৌকির আহমেদ

ভিডিও ছবিটির কাহিনী আবর্তিত  ব্রিটিশ বাংলাদেশী এক নারীর জীবনের নানান টানাপোড়েন নিয়ে। জরিনা বেগম (জরি), জন্ম বাংলাদেশে হলেও ছয়মাস বয়সেই বাবা মায়ের সাথে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে । বেড়ে ওঠেন সেখানে। পড়াশুনা শেষ করেন। একসময় ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পান, পান ’লাল পাসপোর্ট’। লন্ডনে থাকা কালীন সময়েই  তার বিয়ে হয়ে সৌদি আরবের ইমিগ্রান্ড একজন বাঙালিকে। ছেলেটি ভিসিট ভিসায় লন্ডনে আসে।  জরিকে বিয়ে করার ব্যপারে তার কথাবার্তা হয় জরীর মাবার সাথে। জরির বাবা মা রাজিও হয়ে যায়। বিয়ে হয় জরির। নতুন করে নতুন জীবনে বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে ঘর বাধে জরি। কিন্তু স্বপ্ন দেখার শুরুতেই যেন স্বপ্ন ভঙ্গের সূচনা। জরির স্বামীর উদ্দেশ্য ছিল জরীকে বিয়ে করে ইংল্যান্ডে পাকাপাকি ভাবে থাকার রাস্তাটাকে সহজ করা। তাই তড়িঘড়ি করে জরি কে বিয়ে। কয়েকমাস যেতে না যেতেই জরীর স্বামী বাংলাদেশ থেকে তার প্রেমিকাকে নিয়ে আসে লন্ডনে। জরী কে সে তালাক দেবে। বিয়ে করবে তার পুরানো প্রেমিকা কে। কিন্তু জরীর প্রতি সে কৃতঞ্জ। লন্ডনে স্থায়ী ভাবে থাকার সব ব্যবস্থা তো জরীর কারণেই । তাই সম্পূর্ণ দেন মোহর পরিশোধ করে যেন  ঋণশোধের প্রয়াস দেখালেন। আর তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে খুশি জরীর পরিবার, উপরি পাওনা হিসেবে দেনমোহরের মোটা অঙ্কের টাকা তো আছেই।

অনেক দিন পর জরী দেশে এসেছে। তার গ্রামের লোকজন উৎসাহ নিয়ে তাকে দেখছে। ’লন্ডনী কইন্যা’ বলে কথা। বাড়িতে ঘটকের আনাগোনা বাড়ে। নানা জায়গা থেকে বিয়ের প্র¯তাব আসে । জরীকে বিয়ে করা মানে ’লাল পাসপোর্টে’র অধিকারী, ব্রিটিশ নাগরিক হবার লোভনীয় সুযোগ।  তাই পাত্রপক্ষের ঢল  পড়ে যায়। কিন্তু জরীর জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজে পাওয়াটা কষ্টকর হয়ে যায়। শিক্ষিত সুন্দরী ও লাল পাসপোর্টধারী মেয়ের জন্য দেশে যোগ্য পাত্র পাওয়া কঠিন বৈকি। অন্যদিকে জরীর দামদর চলতে থাকে। দেনমোহরের টাকায় জরীকে মাপতে প্রতিযোগিতা চলে পাত্রপক্ষদের মধ্যে। নিলামে উঠা কোন জিনিসের মত জরীকেও যেন হতে হয় কোন পণ্য। জরীর বাবা মা ও মেয়ের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব কে পুঁজি করে দেনমোহরের পরিমান বাড়াতে থাকে । লন্ডন থেকে বাংলাদেশে আসা বাবদ খরচা টা কম নয়। তাছাড়া জরীকে লালন পালন ও পড়াশুনা করানো বাবদ অনেক খরচ ও অনেক। সে টাকা উসুল করার উপযুক্ত সময় তো এখনি। তাছাড়া, জরী সুন্দরী, শিক্ষিতা। তাকে বিয়ে করা মানে একদিকে যোগ্য স্ত্রী পাওয়া, অন্যদিকে লন্ডনে পাকাপোক্তভাবে থাকার বিরল সুযোগ পাওয়া ।

কিন্তু জরী, যে মেয়ে বাংলাদেশের মাটিতে আপন করেছে পরম মমতায়, সে তো এভাবে চিন্তা করতে পারেনা। সে তার গ্রামের একটা স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করে। সেখানেই পরিচয় হয় এক স্কুল শিক্ষকের সাথে। তার সাথে বন্ধত্ব হয়, অন্তরঙ্গতা বাড়ে। এদিকে তাদের এই মেলামেশা গ্রামের মানুষের চোখে পড়ে। তারা মা¯টারের প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে ওঠে।  নানা চক্রান্তে কোনঠাসা অব¯থায় স্কুল শিক্ষক সিদ্ধান্ত নেন গ্রামে থেকে চলে যাবার।

কি করবে জরী? পরাজয় মেনে নেবে পরিবার আর সমাজের কাছে! নাকি নতুন পথে নতুন মানুষের খোঁজে পাড়ি জমাবে।এবার আর জরী হার মানেনা ,  জরী পাড়ি জমায়, মাষ্টারের কাছে চলে যায়। যাবার আগে রেখে যায় তার ’লাল পাসপোর্ট’,  চিঠি আর তার এক গরীব আত্মীয়ার জন্য মোটা অঙ্কের চেক যার স্বামী যৌতুকের দাবীতে তাকে তালাক দিয়েছে।

জরী তার নতুন জীবন শুরু করে, নতুন মানুষের হাত ধরে।

’লন্ডনী কইন্যা’ ভিডিও ছবির পর্যালোচনা:

লন্ডনী কইন্যা নাটকে শমি কায়সায় ও তৌকীর আহমেদ

’লন্ডনী কইন্যা’ ভিডিও ছবিটি বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে নির্মিত। ব্রিটেনে বাংলাদেশের অধিবাসী ব্যবসায়ীদের সিংহভাগই এ এলাকার। মূলত তার হোটেল ব্যবসার সাথে জড়িত।কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ওখানে তারা অর্থ উপার্জন করে এবং তা দেশে পাঠায়। তাই যখন অল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশে আসে, তখন তাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সীমা থাকেনা। তাই সিলেট এলাকার মানুষের মধ্যে ইংল্যান্ডে যাবার আগ্রহ অপরিসীম। আর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব মানে তো সোনার  হরিণ। তাই ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাওয়া কাউকে বিয়ে করাটা কে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাবার শর্টকার্ট রাস্তা ভাবেন অনেকেই। তাই ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাওয়া মেয়েগুলো পাত্রপক্ষের লোভী আচরনের শিকার হন। ’লন্ডনী কইন্যা’ ভিডিও ছবিটি এরকম একটা বাস্তবতারই স্বার্থক প্রতিফলন।

ভিডিও ছবিটিকে আমরা যদি তিনটি পেক্ষাপটে দেখি তাহলে সমাজের এই একপেশী বাস্তবতার বিষয় টি আরো পরি¯কার হবে:

’লন্ডণী কইন্যা’- জেন্ডার সমতার পেক্ষাপট

জোরপূর্বক বিয়ে:

’লন্ডনী কইন্যা’ ভিডিও ছবিটি মূলত একজন ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাওয়া একজন নারীর জীবনে বিবাহ সংক্রাšত জটিলতার গল্প।  ভিডিও ছবিটিতে দেখা যায়,   তার প্রথম বিয়ে হয় তার বাবা মায়ের ভুল সিদ্ধান্তে বিয়ে টা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল তার উপর। এর পর প্রথম বিবাহবিচ্ছেদের পর তাকে দেশে নিয়ে এসে আবারো জোর পূর্বক বিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়।

লন্ডনী কইন্যা নাটকে সমি কায়সার ও শিবু ভট্টাচার্য

আমরা দেখি যে, বাঙালি একজন মেয়ে শিক্ষিত এবং আত্মনির্ভরশীল হবার পরও বিয়ের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তার উপর কিভাবে সমাজ ও পরিবার তার উপর কি করে চাপিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, পরিবারের একতরফা ভুল সিদ্ধাšেতর শিকার মেয়েটির জীবনের দুর্বিসহ অভিজ্ঞতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। ভিডিও ছবিটিতে আমরা দেখি মেয়েটির পরিবার ঘটা করে একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর  কি একপেশে মনোভাব দেখালেন বাংলাদেশে খন্ডকালীন সময়ে ফিরে এসেও।

সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগতা:

জরি তার নিজের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত কখনোই নিজে নিতে পারে নি। প্রথম বিয়ের সিদ্ধান্তটা তার নিজের ছিল না। পারিবারিকভাবে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ততে বলি হতে হয় তাকে। যখন তার বিয়ে ভেঙে যায়, তখন ও সে কোন প্রতিবাদ করতে পারে নি। একজন মেয়ে , যে কিনা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেয়েছে , পুরোপুরি আত্মনির্ভরশীল, তদুপরি, বিয়ে কিংবা তালাক সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোতে সে পরিবার ও সমাজের ট্রাডিশনাল ধারণা  থেকে বেরুতে পারেনা। বিয়েটা সে করে তার বাবার ইচ্ছায় আর তালাক টা তার স্বামীর ইচ্ছায়। তাহলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, উচ্চশিক্ষা ও আত্মনির্ভরশীল হবার পরও সমাজ একজন মেয়ে তার নিজের সিদ্ধান্ত  গ্রহণের ক্ষমতা থেকে দূরে রাখে।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন:

পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন শাখা প্রশাখা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে ভিডিও ছবিটিতে । পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা মেয়েদের চলাফেরার উপর যে সব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তা এ ভিডিও ছবিতে স্পষ্ট। জরী একজন আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী  নারী  হওয়া সত্তে¡ও  জরীর মা গ্রামে আসার পর জরীর চলাফেরার উপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই জরীদের পরিবারের আরেক সদস্য হালিমাকে তার স্বামী তালাক দিয়েছে যৌতুক না দিতে পারার অপরাধে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কি করে যৌতুক প্রথাকে পিতৃতন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তার প্রমাণ মেলে ’লন্ডনী কইন্যা’ তে।

’লন্ডনী কইন্যা’- নাগরিকত্বের প্রক্ষাপট

নারী কি করে একটা লাল পাসপোর্টে পরিণত হয়?:

জরী ব্রিটিশ নাগরিকত্ব নিয়ে ’লাল পাসপোর্টে’ পরিণত হয় । পাসপোর্টের লোভেই তার প্রথম স্বামী তাকে বিয়ে করে। কিন্তু যখনি তার স্বামী ব্রিটেনে থাকার অনুমতি পেয়ে যায় , তখনি সে জরী কে ডিভোর্স দেয়। তার মানে ,  জরীর স্বামী জরীকে বিয়ে করেনি, বিয়ে করেছিল লালপাসপোর্টকে। অত:পর তার পরিবার যখন তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে, তখন ও লালপাসপোর্টকে পুঁজি করেই বানিজ্য চলে তাকে বিয়ে দেবার। দরকাষাকষি চলতে থাকে । কত দেনমোহরে তার লালপাসপোর্টের বিনিময়ে তাকে বিয়ে করবে?

নারী কি করে পণ্য হয়?:

লালপাসপোর্টের নামে একজন নারী পণ্যের মত বিক্রয় হন। জরীর নাগরিকত্বকে দেন মোহরের বিনিময়ে বিক্রি করা হল প্রথম বিয়েতে। তার পর আবারো দ্বিতীয় বিয়েতে ’ব্রিটিশ নাগরিকত্ব’কে বিক্রি করা চেষ্টা। আবার হালিমার ক্ষেত্রে আমরা দেখি ভিন্ন চিত্র। তাকে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেয়া  তারপর পাত্রের চাহিদা অনুযায়ী যৌতুক দিতে না পারায় তালাক। আবার ও নারীকে পণ্যে পরিণত হল। পণ্যদ্রব্য না পাওয়াতে জীবনের চরম শাস্তিটা ভোগ করল একজন নারী । তার মানে নারী,  তা সে যে অবস্থান ই থাকুক না কেন, কি সে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, ধনী কি গরীব সমাজ তাকে পণ্য বানায় বা পণ্যের মত তাকে বিক্রি করে বা পণ্যদ্রব্যের সাথে তুলনা করে।

বাংলাদেশী হয়েও ব্রিটিশ নাগরিকত্ব:

বাংলাদেশী মেয়ে হওয়া সত্তে¡ও তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব সমাজে তার উচ্চতাকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুনে। ব্রিটিশ নাগরিকত্বে চাকচিক্যতায় সে তার বাংলাদেশী পরিচয় কে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলে ।সে হয়ে যায় ’লন্ডনী কইন্যা’। আর তাইতো গ্রামবাসী ভীড় করে ’লন্ডনী কইন্যা’ কে দেখার জন্য।  ’লন্ডনী কইন্যা’ কে বিয়ে করার জন্য পাত্রপক্ষের লাইন পড়ে যায়। তাই সহজেই বলা যায়, ব্রিটিশ নাগরিকত্বেও গুরুত্ব যেন স্বদেশী নাগরিকতে¦র গুরুত্বের থেকে অনেক বেশি।

আমরা কতখানি ব্রিটিশ হতে পারি বা চাই?

ব্রিটেনে যাওয়া ও সেখানে বসবাস করাটা বাংলাদেশী দের কাছে যেন একটা স্বপ্ন । কেউবা লন্ডনে যাবার জন্য জায়গা বিক্রি করে , কেউ সঞ্চিত টাকা পয়সা খরচ করে, কেউ গয়নাগাটি,  কেউ বা  আবার ঋণ নেয়। তবুও  ব্রিটিশ বাসিন্দা হওয়া চাই। আর তা হবার সবচেয়ে সহজ উপায় হল কোন ব্রিটিশ নাগরিকত্বের মেয়েকে বিয়ে করা। আর এই শর্টকাট ওয়েতে যাওয়ার জন্য কখনো পাত্ররা ই ংরেজি চর্চা করে, কখনো মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করে। লন্ডনী কইন্যা বিয়ে করা মানেই তো লন্ডন যাবা ও স্থায়ী ভাবে থাকার সুযোগ। তাই এ সুযোগ হাত ছাড়া করতে চান না কেউই।

’লন্ডনী কইন্যা’- সরকার ব্যবস্থার প্রেক্ষাপট

নাগরিকত্ব ও সরকার ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা দেয়, এর দুটোর উৎপত্তি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মূলে গ্রথিত। আর সেই প্রেক্ষাপটে লন্ডনী কইন্যা ভিডিও ছবিটিতে জেন্ডার অসমতা, নাগরিকত্ব ও সরকার ব্যবস্থায় পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বিষয়টি পরিস্কার হয়ে ফুটে উঠেছে। আমরা দেখি যে, শিক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানে সমুন্নত থাকার পর ও কি করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে মেয়েটি জেন্ডার ভিত্তিক পক্ষাপাতিত্বেও শিকার হয়। কি করে, জীবনের প্রতিটি ¯তরে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব আষ্টেপিষ্টে তার জীবনকে জড়িয়ে রাখে।  সমাজের এই মনোভাব আবার অবস্থান ভেদে একেক নারীর উপর একেক রকম প্রভাব রাখে ।জরী শুধু মাত্র ব্রিটিশ নাগরিক হবার কারণে ই তাকে মোটা অঙ্কেও দেনমোহরের বিনিময়ে বিয়ের প্র¯তাব দেয়া হয়। নিলামে উঠা পণ্যের মত তাকে বিয়ে করতে দরকষাকষির কমতি নাই। তাই সমাজের উচ্চ অবস্থানে থাকার পর ও নারী পিতৃতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বের হতে পারে না, আবার পণ্যের মত দরকষাকষির মুখোমুখি হয়। অন্যদিকে জরীর আত্মীয়া হালিমার ক্ষেত্রে আমরা দেখি ভিন্ন চিত্র। হালিমা বিত্তশালী কিংবা শিক্ষিত নয়। তাই বিয়ের সময়ই পাত্রপক্ষের হাজারো চাহিদা পূরণ করতে হয় বরপক্ষকে। বিয়ের পর ও উপরি চাহিদা পূরণ করতে না পারায় তাকাকে তালাক দেয়া হয়। স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে এখন অন্যের বাড়িতে সে আশ্রিতার মত দিন কাটাচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজব্যবস্থা নারীকে ঠিক সে ভাবেই উপস্থাপণ করে যে ভাবে উপস্থাপণ করলে তার স্বার্থ রক্ষা হয়। কিন্তু কি ধণী কি গরীব, কি শিক্ষিত , কি অশিক্ষিত , সব ক্ষেত্রেই সিদ্ধাšতটা পুরুষের সুবিধানুযায়ী নারীর উপর চাপিয়ে দেয়া হয়।

তাই বলা যায় লন্ডনী কইন্যা দুভাবে, দুরকম চিত্রে  নারীর অবস্থান কে  পুরুষ তন্ত্রের প্রেক্ষাপটে দেখার চেষ্টা করে। যার একপাশে অবহেলিত , সুবিধাবঞ্চিত, নির্যাতিত নারীর প্রতিবিম্ব, অন্যদিকে সাবলম্বী , শিক্ষিত ও আত্মবিশ্বাসী নারীর প্রতিবিম্ব। কিšতু সব অবসথায় আয়নাটা স্বয়ং  পুরুষ বা পুরুষতন্ত্রকে ধারন করা কাঁচের দেয়াল , যাকে ভেদ করে জেন্ডার সমতা প্রবেশ করতে পারেনা, যার পৃষ্ঠে সমতা, অধিকার, স্বাধীনতা কথা গুলোতে পুরুষত্বের মুখচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হয়। তাই আমরা যখন তাকে দেখি তখন পুরুষের একপেশে পক্ষপাততুষ্ট মনোভাব নিয়েই দেখি। আর এভাবে সমাজ নারীকে দেখে পুরুষের আবহে, পুরুষের দৃষ্টিকোন থেকে ,  নারীর সতন্ত্রতার বাইরে থেকে।

তথ্যসূত্র:

মাহতাব, এন. (২০১২). উইমেন, জেন্ডার এ্যন্ড ডেভেলপমেন্ট কনটেমপোরারি ইস্যুস. ঢাকা: এ এইচ ডি পি এইচ।

উইমেন ২০০০ এ্যন্ড বিয়ন্ড. (২০০৩). উইমেন, ন্যাশনালিটি এন্ড সিটিজেনশিপ. উইনাইটেড নেশন: ডিভিশন ফর দি অ্যডভান্সমেন্ড অফ উইমেন, ডিপার্টমেন্ট অফ ইকোনোমিক এন্ড সোসাল অ্যফেয়ারস।

মন্তব্য
Loading...