করিমুন্নিসা- ফারুক আহমদ

করিমুন্নিসা- এক স্বাধীনচেতা সংগ্রামী নারীর উপাখ্যান

এক দেশে ছিল এক রাজা, তার ছিল এক পরমা সুন্দরী স্ত্রী। হাতিশালায় হাতি ছিল, ঘোড়াশালায় ঘোড়া। সোনা-দানা, হীরা-জহরৎ এবং মণি-মুক্তার কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু রাজার মনে বড় দুঃখ। কারণ তার ছিল না কোনো পুত্র সন্তান। তারপর…।

হ্যাঁ, মুঘল সম্রাট আকবরকে যেমন গল্প শোনাতেন বীরবল, নদীয়ার রাজা কৃঞ্চচন্দ্রকে গোপাল ভাঁড়, তেমনি আমাদের গল্প শোনাতেন আমাদের দাদি। অর্থাৎ আমাদের ছোট দাদার তিন নম্বর স্ত্রী। পর পর দুই স্ত্রী মারা গেলে দাদা এই দাদীকে ঘরে এনেছিলেন। দাদীর আগেও একটি বিয়ে হয়েছিল কিন্তু কোনো সন্তান না হওয়ায় স্বামী তাকে তালাক দেন। আমাদের দাদার স্ত্রী হয়ে আসার পরও তাঁর কোনো সন্তানাদি হয়নি। তাই গল্পের নিঃসন্তান রাজা-রাণীর কাহিনী বলতে গিয়ে নিজেও যেন হয়ে যেতেন তাদের একজন। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে অত্যন্ত দরদ দিয়ে আমাদেরকে সেই সকল রাজা-রাণীর গল্প শোনাতে শোনাতে যখন ভারাক্রান্ত হয়ে থেমে যেতেন, তখন ধৈর্যহারা আমরা বলতাম, দাদী তারপর…তারপর…।

এভাবে একদিন গ্রীষ্মের দুপুররাতে উঠোনে মাদুর পেতে বসে এই দাদীর মুখ থেকেই শুনেছিলাম ইটার দেওয়ান মোহাম্মদ মনসুর ওরফে কটুমিয়া এবং তার স্ত্রী করিমুন্নিসার গ্রাম্য গীত-কাহিনী। দাদি একটি গানের কয়েকটি কলি গেয়ে তারপর গল্পটি শুরু করেন। গানটি নাকি কটুমিয়ার মায়ের গাওয়া। যথা, ‘ইটায় আছলা কটুমিয়া/লংলায় করলা বিয়া/বড় সাধ আছিল গো মিয়ার লংলা দেখতা গিয়া/ করিমুন্নিসা গো মনের সাধ পুরাইলায়নি…।’

করিমুন্নেসা চরিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয়কারী তারিনকে চরিত্র বুঝিয়ে দিচ্ছেন পরিচালক শাকুর মজিদ। পাশে প্রধান সহকারি পরিচালক জুয়েল আজীম

কাহিনীটা হলো, রাজা সুবিদনারায়ন-এর চতুর্থপুত্র ঈশা খাঁ বংশীয় দেওয়ান মোহাম্মদ মনসুর ওরফে কটুুমিয়া ইটা পরগণার কানাইটিকর গ্রামের নজম্ব^র আলি চৌধুরীর কন্যা করিমুন্নিসার রুপে-গুণে  মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কনে পক্ষ বরের বংশগৌরব এবং প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান। সে সময় কনের মতামত নেওয়ার কোনো রেওয়াজ ছিল না। এদিকে এ বিয়েতে করিমুন্নিসার মত ছিল না। ফলে জোর করে বিয়ে দিলেও করিমুন্নিসার মন উতলা হয়ে থাকে কানুর জন্য। তিনি পথ খোঁজতে থাকেন কিভাবে এ পাতানো বিবাহবন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়। কিন্তু মুক্ত হওয়া সহজ ছিল না। তাই করিমুন্নিসাকে বাধ্য হয়ে কটুমিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করতে হয়। এবং হত্যার স্থান হিসেবে বেচে নেয়া হয় কানাইটিকর গ্রামের বাপের বাড়ীকে। অর্থাৎ ফিরাযাত্রায় বাপের বাড়ি নাইওর গিয়ে অসুস্থতার অজুহাতে স্বামীর বাড়ী ফিরে  আসতে দেরী  করেন। কটুমিয়া নববধূও বিরহ জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ১৮৭০ সালে (১২৭৭ বাংলার শ্রাবণ মাসে) নিজেই করিমুন্নিসাকে নাইওর থেকে আনতে যান। আর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেই রাতেই করিমুন্নিসা ও তাঁর প্রেমিকের যোগসাজসে কটুমিয়াকে প্রথমে বিষপান করিয়ে পরে গলা চেপে (আঞ্চলিক ভাষায়, গলায় ছিয়া ফেলে) শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে; পরের দিন ভোরে প্রচার করা হয় যে, ওলাওঠা রোগে (কলেরা) আক্রান্ত হয়ে কটুমিয়ার মৃত্যু হয়েছে। ওদিকে গোসল দেয়ার সময় লোকেরা কটুমিয়ার গলায় ক্ষত চিহ্ন দেখতে পান। ফলে তাদের সন্দেহ জাগে এবং এ নিয়ে থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ময়নাতদন্তে ধরা পড়ে যে কটুমিয়াকে প্রথমে বিষপ্রয়োগ করে পরে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। করিমুন্নিসাকে আসামী করে শুরু হয় মামলা। কিন্তু অনেক চেষ্টার পর আসামীকে ধরা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে সরকারিভাবে করিমুন্নিসাকে ধরার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। তখন সুনামগঞ্জ থানার দারোগা ছিলেন গোলাপগঞ্জ থানার ভাদেশ্বর পরগণার দক্ষিণভাগ গ্রামের আহসান চৌধুরী। তিনি এ মামলাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তদন্তভার গ্রহণ করেন। কিছু দিন পর করিমুন্নিসাকে ধরা সহজ নয় বুঝতে পেরে তিনি পীরের ছদ্মবেশ ধারণ করেন। আহসান রেজা কলকাতা হুগলী মাদ্রাসা থেকে আলীম পাশ। ফলে পীরের নিঁখুত অভিনয় করা তার পক্ষে ছিল সহজ, কেননা, তাবিজ-কবজ ও ঝাড়ফুঁক দেয়া, কিংবা সুরা-কেরাত পড়া ওয়াজ-নসিহত করা ইত্যাদিতে তাঁকে ভণ্ড হিসেবে ধরার কোনো উপায় ছিল না। জনশ্র“তি আছে যে, তাঁর সেই অভিনয় থেকে নাকি অনেকে অনেক উপকার লাভও করেন। (ধারণা করা হয় উপকারীরা ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের লোক) ফলে চারিদিকে পীরের ধন্য ধন্য পড়ে যায়। ওদিকে স্বামীকে নিজ হাতে হত্যা থেকে পাপবোধ ভীত হয়ে, থানা পুলিশের তাড়া খেয়ে এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম পালাতে পালাতে করিমুন্নিসা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন। তাঁর পরিবারও এ মামলা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল। ফলে করিমুন্নিসা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। একসময় করিমুন্নিসার কানে খবর পৌছে যে, পাশের গ্রামে এক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী পীর এসেছেন, তিনি সকল মুসকিলের আসান করতে পারেন। খবর পেয়ে করিমুন্নিসা তাকে ডেকে পাঠান মানসিক যন্ত্রণা এবং মামলা নামক আপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু কারো মুসকিল আসান করানোর আগে পীরের শর্ত ছিল প্রথমে জীবনের পাপের কাহিনী খুলে বলতে হবে। নতুবা তিনি কারো জন্য কিছুই করতে পারবে না। আর করলেও কাজের কাজ কিছুই হবে না। সে জন্য করিমুন্নিসা পীরকে  বিশ্বাস করে তাঁর গত জীবনের পাপের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেন। পীরও বুঝতে পারেন তার সাফল্য আসন্ন। তিনি পরবর্তী অমাবশ্যার রাতে করিমুন্নিসার সকল মুসকিল আসান করার আশ্বাস দিয়ে থানায় খবর পাঠান-কীভাবে কী করতে হবে। নির্ধারিত রাতে করিমুন্নিসা পীরের কাছে এলে, নিয়মমাফিক পীর পর্দার আড়াল থেকে তাঁর ডান হাত কাপড় দিয়ে মুড়ে পীরের হাতে রাখার নির্দেশ দেন। করিমুন্নিসা ডান হাত বাড়িয়ে দিতেই পীর শক্ত করে ধরে হুইসেল ফুৎকার ছাড়েন, সাথে সাথে পুলিশ দল এসে করিমু্িন্নসাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আহসান রেজা চোধুরী তাঁর সাফল্যের জন্য ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হন।

সিলেট জজকোর্টে মামলা চলাকালীন সময়ে করিমুন্নিসার পক্ষে কোনো কৌসুলী ছিল না। তৎকালীন ইংরেজ জজ কবার্ণ সাহেবের আদালতে করিমুন্নিসা কানুরাম দাস এবং তার আরো দুজন সহযোগীসহ মোট চার জনকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ হয়।

করিমুন্নেসার স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেন শুভ্র দেব

জানা যায়, ফাঁসির আগে শেষ সাধ কি জানতে চাওয়া হলে করিমুন্নিসা নাকি বলেছিলেন, তিনি তার রূপের বাটায় পান খেতে চান। তাঁর সেই সাধ পূরণ হয়েছিল  কি না তা জানা যায়নি। ফাঁসির পর করিমুন্নিসার মৃত্যুদেহ গ্রহণের কোনো লোক ছিল না। ফলে বেওয়ারিশ হিসেবে তাঁর মৃত্যুদেহ সিলেট শহরের অদূরে ষোলঘর মৌজায় দাফন করা হয়। সিলেটের ইতিহাসে এক সাথে চারজন লোকের ফাঁসির ঘটনা ছিল সেই প্রথম। সেজন্য ঘটনাটি সারাদেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। করিমুনকে ধরার পরে কলংকিনী হিসেবে তাঁর চুল কেটে আলাদা করা হয়েছিল। ফাঁসির পরে দীর্ঘদিন তাঁর সেই চুলগুচ্ছ সিলেটের চাঁদনিঘাটে আলী আমজাদের ঘড়িঘরের ভিতরে রাখা ছিল। লোক-কবিরা এ ঘটনাকে নিয়ে রচনা করেন গান-কবিতা। এবং সেই থেকে আজ পর্যন্ত কাহিনীটি গল্পের মতো বলা হয়ে থাকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের দেশের পূরাবৃত্ত, ভাষাতত্ত¡, লোকবিবরণ প্রভৃতি সমস্তই এ পর্যন্ত বিদেশী পণ্ডিতেরা সংগ্রহ এবং আলোচনা করিয়া আসিয়াছেন। …দেশে থাকিয়া দেশের বিবরণ সংগ্রহ করিতে আমরা একেবারে উদাসীন, এমন লজ্জা আর নাই…।’

শাকুর মজিদ যখন সেই লজ্জা নিবারণে হাত দিয়েছেন, তার টেলিফিল্মের মাধ্যমে, এ জন্য অতি অবশ্যই তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। বলা বাহুল্য, এখানে পুরো কাহিনীটি বলার প্রয়োজন ছিল না। তবুও উলে­খ করা হলো একটি দায় থেকে; আর তা হলো, সিলেটের মানুষ এ ঘটনাকে সিলেটের আঞ্চলিক ঘটনা হিসেবে জানলেও সিলেট ছাড়া দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষ এ ঘটনাকে ময়মনসিংহের কাহিনী বলে জানেন। কারণ ড. দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ময়মনসিংহ গীতিকায় কাহিনীটাকে ময়মনসিংহের এবং লোকবিজ্ঞানী ড. আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর লোকসাহিত্য গ্রন্থের দ্বিতীয় খে  ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ এলাকার কাহিনী বলে লিপিবদ্ধ করেছেন। সুতারাং কাহিনীটি যে ময়মনসিংহ জেলার নয় এবং কাহিনীটি কী, তা যে সকল পাঠক জানেন না, তাদেরকে অবহিত করা। যে ইতিকাহিনীটিকে নিয়েই টেলিফিল্ম তৈরি করেছেন নাট্যকার শাকুর মজিদ, নাম ‘ করিমুন্নিসা’।

স্বামী ও প্রেমিকের মাঝে করিমুন্নেসা । শুভ্রদেব, তারিন ও জয়

লেখক উলে­খ করেছেন যে, ‘প্রকৃত ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে এই ঘটনার মিল খুবই সামান্যই’ কথাগুলো নাট্যকারের বিনয়-জ্ঞাপক, যা না বললেও চলতো। কারণ ইতিহাস হচ্ছে, কালানুক্রমিক অতীত ঘটনা অর্থাৎ যখন যা ঘটেছিল তখন তার বিবরণ।  পক্ষান্তরে ইতিকথা ইতিহাসাশ্রয়ী হলেও কিংবদন্তিনির্ভর। সে হিসেবে করিমুন্নিসার গ্রাম্যগীতিটা ইতিহাস নয়। কারণ তা ইতিহাস হিসেবে কোনো গ্রন্থে লিখে রাখা হয়নি। ইতিহাস হিসেবে যদি কিছু থেকেও থাকে, তাহলে তা হচ্ছে সিলেট জজকোর্টের ফাইলপত্রে, সাধারণের নাগালের বাইরে। সুতারাং করিমুন্নিসা যে কাহিনী আমরা শুনে থাকি তা আসলে ইতিহাস নয়, কিংবদন্তিনির্ভর ইতিকাহিনী। সে কাহিনীকে লেখক ঐ সময়ের সামাজিত ইতিহাসের আলোকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে হৃদয়গ্রাহী করে নিপুণভাবে টেলিফিল্মে হাজির করেছেন। তেমনি সময় ও ঐতিহ্যের সাথে মিল রেখে, বাস্তব সম্মতভাবে বিভিন্ন লোকেশানে নাটকটি চিত্রগ্রহণ করা হয়েছে। যে করিমুন্নিসাকে এতকাল মানুষ ঘৃণার সাথে একজন ব্যভিচারিনী, কলংকিনী, বারবনিতা, উপ-পতিগ্রহণকারী ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত করতো। নারীর কলংকে বিশ্বাস করে শাকুর মজিদও কি এই একবিংশ শতাব্দিতে তা করতে পারেন? না, পারেন না; কারণ তিনি বাঙালি। বাঙালি শুধু রামের উপাসক নয় রাবণেরও। তাই সঙ্গত কারণেই মাইকেল মধুসূদন দত্তের উত্তরসূরী শাকুর মজিদ করিমুন্নিসাকে একজন প্রেমময়ী, সংগ্রামী এবং হৃদয়বান মহিলা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। অর্থাৎ ঘটনাকে বিষয় হিসেবে তুলে ধরে বিভিন্ন চরিত্রকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন যে, জমিদারদের অত্যাচার, নাচঘরে বাঈজি নাচানো, মদ খেয়ে বুদ হয়ে প্রলাপ বকা, ইচ্ছামত একের পর এক বিয়ে করা, গরিব দুঃখী প্রজা, দাসী-বাদীদের নীপিড়ন-নির্যাতন করে উল­াস প্রকাশ এবং জমিদারি বাড়ানোর স্বপ্ন দেখা ব্যতিত (দু-একজন ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তি ছাড়া) যাদের জীবনে আর কোনো স্বপ্ন নেই। সেই সামান্তবাদী অচলায়তন থেকে করিমুন্নিসা মুক্তি চায়, চায় আরও দশজনের মতো মুক্ত সাধারণ জীবন, বাঁধতে চায় মনের মানুষকে নিয়ে একটি সুখের নীড়। কিন্ত সেই অচলায়তন থেকে বের হয়ে আসা সহজ ছিল না। কারণ জমিদারের কাছে জমিদার ছাড়া আর কারো কথার কোনো মূল্য নেই, নেই পরিবার পরিজনের কোনো মৌলিক অধিকার; তাদের কাছে পাপ-পূণ্য বলেও কিছু নেই। কাম চরিতার্থ করার সময় তারা স্ত্রীকে যেমন ভালবাসে, তেমনি ভালবাসে দাসীবাদী কিংবা বাঈজীকে। এজন্য করিমুন্নিসার খেদোক্তি, ‘জমিদারের ঘরে জন্ম হওয়াই আমার ঠিক হয় নাই’। ‘জন্ম যেন তাঁর আজন্ম পাপ’।

অর্থাৎ লেখক করিমুন্নিসাকে একজন স্বাধীনচেতা সংগ্রামী নারী হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। যার একটি সরল মন আছে, সাদ-আহলাদ আছে, মানবিক গুণাবলী আছে, আছে মধ্যযুগীয় সামান্তবাদী ঘূণেধরা সমাজব্যবস্থা থেকে বের হয়ে স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে একজন পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে ওঠে জীবন-যাপনের অদম্য স্পৃহা এবং তা বাস্তবায়নের প্রাণান্তর চেষ্টা। আর সে চেষ্টা বাস্তবে রূপান্তরিত করতে না দিয়ে সমাজ করিমুন্নিসার মতো একজন সহজ-সরল নারীকেও হিংস্র করে তুলেছিল, বাধ্য করেছিল নর হত্যায়। এটা কি তাঁর অপরাধ? হয়তো হ্যাঁ, হয়তোবা না! কেন না, ন্যায়-অন্যায়ের হিসাবকে কোনো প্রচলিত ছকে ফেলে বিচার করা অসম্ভব।

সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘অপরাধের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে সমাজ, আর সেই সমাজে একজন অপরাধী তার কর্তব্য সম্পাদন করে মাত্র।’ তাহলে, করিমুন্নিসা কী তার কর্তব্য সম্পাদন করেছিলেন? নাট্যকার অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো আভাস দেননি। কারণ ইতোপূর্বে ‘লন্ডনী কইন্যা’ টেলিফিল্ম তৈরি করে হয়তো তাঁর ধারণা হয়েছে, ‘প্রগতির কথা মুখে মুখে শুধু, সমাজ এখনও সে-ই’, তাই আজও সত্য কথা সত্য করে বলা কঠিন। ফলে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, যে কোনো হত্যাকাণ্ডই অপরাধ, সে হিসেবে করিমুন্নিসাও সমাজ এবং আইনের চোখে অপরাধী এবং এজন্য তাঁর শাস্তিও হয়েছে। কিন্ত তা বড় অমানবিক ভাবে অর্থাৎ করিমুন্নিসার অপরাধের জন্য সমাজ তাঁর চুল কেটেছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো আইনজীবী নিয়োগ না করে বরং একতরফাভাবে বিচার নামক প্রহসনের মাধ্যমে তাঁর প্রাণদণ্ড দিয়েছে; এমনকি সেদিন তাঁর মৃত দেহটি গ্রহণ করে সৎকার করার মতো কোনো মানুষ ছিল না, তাই বেওয়ারিশ হিসেবেই তাঁর লাশ দাফন করা হয়। বিবেকহীন সমাজ সেই দৃশ্যটি উপভোগ করেছে এবং তিলকে তাল করে প্রচার করেছে। এর পরেও জয় ঠিকই হয়েছিল করিমুন্নিসার। কারণ সে বিবেকের কাছে হার মেনেছে সত্যি, কিন্তু সামন্তবাদী সমাজের কাছে হার মানেনি। তাঁর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধসে পড়ে বিলীন হয়ে গেছে ইটার জমিদার কটুমিয়া এবং লংলায় নজম্বর আলি চৌধুরীর তথাকথিত অভিজাত দুটি পরিবার; এটাই বা কম কীসের।

নিসা ও শুভ্রদেব

লেখক মূল ঘটনাকে নায়িকা করিমুন্নিসার মুখ দিয়ে বলিয়ে ফ্লাসব্যাকে কাহিনী দেখিয়েছেন। তবে করিমুন্নিসার পরিবর্তে যদি ঐ গল্পের আসর বসিয়ে প্রবীণ কোনো পুরুষ বা মহিলার মুখ দিয়ে কাহিনীটি শুনিয়ে ফ্লাসব্যাকে পুরো কাহিনী তুলে ধরতেন, তাহলে হয়তো আরও হৃদয়গ্রাহী এবং বাস্তবসম্মত হতো বলেই মনে হয়। এছাড়া গ্রামের পরিবেশ ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে অতিমাত্রায় পাখির কিচিরমিচির শব্দ ছিল অনেকটা পীড়াদায়ক।

নাটকে যে তিনটি গ্রন্থ থেকে তথ্য গ্রহণ করা হয়েছে বলে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়, এর একটিকে বলা হয়েছে শ্রী অচ্যুৎচরণ চৌধুরী লিখিত ‘শ্রীহট্ট দর্পণ’। প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থটি হবে ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ (পূর্বাংশ)’। এছাড়া করিমুন্নিসার পিতার নাম ‘গজর আলী চৌধুরী’ নয় ‘নজর আলী চৌধুরী’। বলা বাহুল্য, শাকুর মজিদ একজন সফল নাট্যকার হিসেবে অনেক নাটক লিখেছেন। সেগুলোর মধ্যে ‘লন্ডনী কইন্যা’ নামক বাস্তবভিত্তিক অনন্য নাটকটি লিখে বিতর্কের ঝড় তুললেও সুধী সমাজে বিপুলভাবে প্রশংসিত হন। ‘করিমুন্নিসা’ টেলিফিল্ম-এ তাঁর মুন্সিয়ানার ছাপ সুস্পষ্ট এবং এ টেলিফিল্মেও দর্শকরা করিমুন্নিসার ভাগ্যের সাথে ‘লন্ডনী কইন্যা’র নিয়তির কিছুটা হলেও মিল খুঁজে পাবেন, পাবেন ভিন্ন সাধ; সেই সাথে বর্তমানের সাথে প্রায় দেড়-শতাব্দি আগেকার সমাজ-সংস্কারের তুলনা করে নিজেরাই বুঝতে পারবেন, আমরা সামাজিকভাবে কতটা সংস্কারমুক্ত হয়েছি বা অগ্রসর হয়েছি।

নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন, করিমুন্নিসা-তারিন, কটুমিয়া-শুভ্রদেব, করিমুন্নিসার পিতা-খলিলুল­াহ খান, করিমুন্নিসার বড় মা-শিরিন আলম, ছোট মা-সুতপা, বাঈজী,-সাব্রিনা নিসা, করিমুন্নিসার প্রেমিক স্বামী (আবুল কালাম) -শাহরিয়ার নাজিম জয়, নায়েব-ভবতোষ রানা, করিম-রফিকুল হাসান, ইমাম-শেখ ওয়াহিদুর রহমান, তালুকদার-শামীম ভিস্তা, দারোগা ও দরবেশ-কায়েস চৌধুরী ও করিমুন্নিসার শাশুড়ির চরিত্রে শবরীদাস গুপ্তা। নাটকটিতে সিলেটি আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার এবং প্রত্যেকের অভিনয় ছিল চমৎকার। লেখক-পরিচালক শাকুর মজিদের ‘লন্ডনী কইন্যা’-র মতো এ নাটকটিও যে দর্শক নন্দিত হবে এ আশাবাদ নির্দ্বিধায় প্রকাশ করা যায়।

প্রকাশ : সাপ্তাহিক জনমত, ২৮ মে-০৩ জুন ২০০৪।

লেখক পরিচিতি ঃ যুক্তরাজ্য প্রবাসী, গীতিকার ও নাট্যকার।

করিমুন্নেসার গবেষনা- কাহিনীর সন্ধানে

করিমুন্নেসার নির্মানের চিত্র 

 

 

 

মন্তব্য
Loading...