লন্ডনী কইন্যা – ওয়াহিদুল হক

নাম হতে পারতো- লাল পাসপোর্ট

পরিচ্ছন্ন একটি টেলিফিল্মে মানবদশার একটি বড় দিককে উন্মোচন করবার চেষ্টা করা হয়েছে সম্প্রতি। নারীর স্বরূপ ও এই স্বরূপের উপলব্ধিতে নারীর পৌঁছানোর সাধনা টেলিফিল্ম জাতীয় বিনোদন বটিকার উপযুক্ত বিষয় হতে পারে না। সাহস করেছেন শাকুর মজিদ। সাহস করেছেন সম্ভবত নবীন বলে। তিনি ক্রমে প্রবীণ হোন, কিন্তু সাহসটি যেন তাঁকে ত্যাগ না করে। তাঁর সাহসের পুরস্কার তিনি পেয়েছেন অভাবিত মহল থেকে, অপ্রত্যাশিত রকমে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী একটা যেন আন্দোলনই হচ্ছে সিলেটের শাকুরের ‘লন্ডনী কইন্যা’ নিয়ে। শাকুর বিয়ানীবাজার এলাকার চৌদ্দপুরুষের বাসসূত্রে খাঁটিতম শ্রীহট্টের সন্তান, সিলেটে অবাঞ্চিত ঘোষিত হয়েছেন। তাঁর ছবিটি নিষিদ্ধ করেছে কিছু লোক। এ কিছুই নয়, শাকুর এই প্রতিবাদ ও নিন্দার আপাত-আন্দোলনকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করলেই ভালো করবেন। কিন্তু তাঁর গায়ে লাগছে তা, মাখবেন না চেষ্টা করে এড়িয়ে যেতে পারছেন না। কারণ তিনি নিজেও সিলেট বিষয়ে স্পর্শকাতর, অন্য সকল সিলেটিদের মতই। কতিপয় সিলেটবাসী শাকুরের ছবিকে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে যে ধরণের অশিক্ষা, মূর্খতা, পশ্চাৎপদ সংকীর্ণতার পরিচয় দিচ্ছে তা সিলেটের জন্য নিতান্তই অগৌরবের বলে শাকুরকে তা আঘাত করেছে। তিনি হয়তো ভাবতে বসেছেন, ভালো জাতের সিলেট ন্যাশনালিস্ট বলেই সিলেটের এই ঘাটতি পূরণের জন্য কী করা যায়। সিলেটে গত ত্রিশ-চলি­শ বছরে কোন প্রথম সারির কবি-সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশ করেনি। সৈয়দ মুজতবা আলী শেষ নন্দিত গদ্যলেখক, আর নেই। সিলেটবাসী অনেকের ধারণা এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা লিখতেন আর তারপর কবি দিলওয়ার। মনন চর্চার এই ঊষর মরুতে সাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্র কিংবা যে কোন সৃজনশীল কীর্তির ব্যাপারে, সংস্কৃতির বৃহত্তর অঙ্গনে কোন ইতিমূলক ঘটনার ব্যাপারে কোনই শিক্ষিত প্রতিক্রিয়া আশা করা যায় না। ব্যতিক্রমতো আছেই, তাদের কথা বলছি না। এককালের সাহিত্য সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল শ্রীহট্ট।

দীর্ঘকাল ধরে, শ্রীচৈতন্যের জন্মের আগে থেকে তো বটেই-অন্তত ছয়শ’ বছর। তার ধারা কি একেবারে বিলীন হয়েছে আধুনিক লোনডোনি সিলেটে? হতে পারে না। কিন্তু শীর্ণতোয়া সে চলেছে অন্তঃশীলা, অপ্রকাশ্যে। সেও অনেকদিন ধরে। আমি প্রত্যক্ষ পরিচয়ে সিলেটের অনেক শীলিত মননের মানুষকে জানি। কিন্তু সিলেটের উচ্চকণ্ঠ যে-প্রকাশ নিজেকে সিলেটের সকলের কণ্ঠ বলে দাবী করে, এঁদের কণ্ঠ সেখানে নেই, থাকার কথাও নয়। যাও-বা সাহিত্য-সংস্কৃতির এলাকায় তাঁরা প্রকাশ হতেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যে রুচিহীন, পুরোপুরি রাজনৈতিক খেলা খেলল স্বার্থান্ধ কিছু মানুষ, তারপর নিজের মান নিজের কাছে করে তাঁরা আছেন চুপচাপ, সরে। শাকুরের ছবির ব্যাপারে যে উদগ্র স্থুলতার পরিচয় পাওয়া গেল পত্রপত্রিকায়, তা কোন সাহিত্য সৌন্দর্যপ্রেমির নয়, নয় কোন নাটক চলচ্চিত্র রসিকের। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় হলের নামকরণ বিরোধীরা যেমন নয় কোন শিক্ষাসংস্কৃতিপ্রেমী। নামকরণ বিরোধী আন্দোলনটি এমন করে একটি সংস্কৃতি বিরোধী পরিবেশ তৈরি করেছে যাতে করে শাকুরের পরিচ্ছন্ন ছবিটির অন্যায় রকম কদর্থ করা সম্ভব হয়েছে। অসম্ভব নয় এই দুইয়ের পিছনের কিছু একই মানুষ কাজ করছেন প্রধানত। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীই যখন জানেন না তিনি সিলেটের কী ক্ষতি করলেন, এদের কারোর পক্ষে তা বুঝবার কথা নয়।

লন্ডন থেকে প্লেন এসে নামে সিলেটে, নামে জরি অর্থাৎ শমী কায়সার, জরির বাপ-মা। আত্মীয়তার দাবি নিয়ে বয়স্ক লোক তাদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে, গাড়ি এনেছে তারা। জরি শিক্ষিত এবং কালচার্ড বাঙালি মেয়ে লন্ডনের বিএ, এমএ-স্কুল শিক্ষিকা। ওদের তাড়ায় দাদা-বাড়ি পৌঁছে সে ওদেরি অষ্টপ্রহর জ্বালাতনের বিষয় হয়। গ্রামের একাধিক বেকার যুবক বিলেত চলে যাবার চেষ্টায় কাটিয়ে দিচ্ছে। পাঁচ লাখ দশ লাখ যা লাগে। জ্বালাতনকারীরা তাদের গুরুজন। জরিকে বিয়ে যে করবে সে পাবে ব্রিটিশ ভিসা ও পরে পাসপোর্ট। প্রতিদ্ব›িদ্বতায় দর উঠতে থাকে জরির। ঠিক জরির নয়, জরির বাপের চাহিদার। গল্পের আশ্চর্য এক শেখভীয় মোড় এখানে, প্রায় মিসেস ওয়ারেন’স প্রোফেশনের মতই আত্মাহীন নিষ্ঠুর। জরির বাপ-মা তো তাকে এই সিলেটি গণ্ড  গ্রামে নিয়ে এসেছেন বেচবারই জন্যে। লন্ডনে নিজেদের কেটারিং ব্যবসার সংকট কাটাবার জন্যে চাই প্রচুর নতুন বিনিয়োগ। সেই অর্থ সংগ্রহে এসেছেন তাঁরা। ছেলে কেমন কোন কথা নয়, কত পাওয়া যাবে সেটাই তাঁদের বিবেচ্য, বলেনও তাঁরা তাই, খুব খোলামেলা। জরির চোখ খুলে যায়। বুঝতে পারে সে মানুষ নয়, নয় নারী, সে কেবলই একটা লাল পাসপোর্ট। কী করে তা মেনে নেবে সে। বিলেতে সে আরেকবার সে পাসপোর্ট হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ভিসা পেয়ে গিয়ে আগের স্বামী তাকে ত্যাগ করে পূর্ব-প্রণয়িনীকে করেছে বিয়ে, কোর্টে সব মিটমাট হবার পরে, জানিয়েছে সে তাকে ধন্যবাদ। আবার সেই পাসপোর্ট হতে চলেছে সে এবং হতে যাচ্ছে বিক্রি।

গ্রামে প্রাইমারি আরম্ভ হয়েছে একটি, অনুমোদন নেই এখনও। তাতে একজনই মাস্টার হামিদুর রহমান, ঢাকা থেকে এম.এ. করেছে। অন্য কোন চাকরি পাবার আগে এটা পেয়ে গিয়ে তার প্রিয় গ্রামীণ পরিবেশে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাটাচ্ছে দিন। জরির পরিচয় তার সঙ্গে। গ্রাম্য নোংরামি থেকে কত সে দূরে। জরির সুস্থ লাগে। স্বস্তির শ্বাস নিতে পারে সে। চলছে তার বিয়ের আয়োজন, নিচ ষড়যন্ত্রের শিকার হিসেবে। তবু সে মুখ ফুটে বলতে পারে না, তুমি তো পারো উদ্ধার করতে। হামিদ সত্যিই ভালো ছেলে, সম্ভবত বাংলা ছবিটবি একেবারে দেখেনি। এই রকম একটা কিছু সম্ভবত তার সুশীল মাথায় আসে না। পাড়ার ছেলেরা তাকে লন্ডনী কইন্যার সঙ্গে জড়িয়ে বাজে ধ্বনি দিলে, সে পালায়।

পালায় জরিও। বিয়ের আসর থেকে। বাড়ির কাজের মেয়ে হালিমার আশি হাজার টাকা দরকার, তাহলে তার দুবাইওয়ালা বর তাকে নেয়। সেই টাকার একটি চেক রেখে যায় সে। আর তার গৃহত্যাগের চিঠি। রঞ্জুও বিয়ের লাইন দিয়েছিল, জরির হিতোপদেশ শুনে তা ত্যাগ করে জরির ভাই হয়েছে, বন্ধু হয়েছে, জরির কথামত গ্রামেই কিছু বড় কাজে হাত দিয়েছে। সে নিয়ে যায় জরিকে তার মোটরবাইকে করে মাস্টারের বাড়ি। সে নেই, চিঠি আছে একটা। ছুটে স্টেশনে। নাটক-নাটক। চরম মুহূর্ত। পেয়ে যায়, হাত ধরে হামিদকে নামায় জরি ট্রেন থেকে। মিষ্টি ছোট একটা প্রেমের গল্প। পুরোপুরি লোকেশনে, আউটডোরে। বাংলার শ্যামল প্রকৃতি ঝাঁপিয়ে ছুটে ঢুকেছে ফ্রেমের ভিতর। যা দেখি কোথায়ও নেই। কৃত্রিম কিছু, বানিয়ে তোলা কিছু। শমীর অনভ্যস্ত সিলেটি মাত বড় মিষ্টি লাগে, আরেকবার ভক্ত হই এই উপভাষার।

গল্প বড়, জায়গা ছোট চরিত্রগুলি দাঁড়াবার জায়গা পায় না। তবু শমী সুন্দর দাঁড়ান, হামিদ অর্থাৎ তৌকির দাঁড়াতে পারেন না যেন, দোষ হতেই পারে নাট্যকারের। এই একটা দৃশ্য হয়ে পড়ে যেন এক-একটা স্কিট। বহমানতা মার খায়, গল্পের ডোলটি কেমন শ্রীহীন হয়। তবু, এরি ভিতর, সবকিছু খুব কনভিনসিং বলে সবটা মিলে সুন্দর দাঁড়ায়, শমীর মতো এবং শাকুর মজিদ, তাঁর মাপে শামিল হয়ে যান ইবসেন (আ ডল’স হাউস), রবীন্দ্রনাথের (চিত্রাঙ্গদা) সারিতে। তাঁর নারীও ঘোষণা করে সে ব্যবহৃত হবার মত একটা জুৎমত কল মাত্র নয়, সে ব্যক্তি, বিশ্বব্রম্মাণ্ডের সর্বাপেক্ষা মহিমময় যে মানব-ব্যক্তিত্ব, তার যোগ্য প্রতিভূ।

আমার ভালো লাগে এই রকমটা জায়গায় ঢুকে পড়েও শাকুর লোভ সামলেছেন। মতবাদের মারপ্যাঁচ বাঁচিয়ে শমীকেও শমীর মাপে রেখে একটি টেলিফিল্ম করেছেন বিটিভির মাপের। এ কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি ‘লন্ডনী কইন্যা’ প্রচার করে বিটিভি তার মান বাড়িয়েছে। শাকুর নারীর বিরুদ্ধে সমাজের অমানবিকতার চিরন্তন ছবির একটি নতুন মাত্রা উন্মোচন করেছেন তার নিতান্ত জানাচেনা এক সমস্যার ভিত্তি দিয়ে।

সিলেটে যুবকদের ভিতরে একটা প্রধান প্রেরণা বিলেত যাবার। হবে না কেন? সেই  ১৯৫২-তে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পাসপোর্ট ভিসা প্রবর্তন হলে কলকাতা গিয়ে জাহাজে লশকরের কাজ নেওয়া বন্ধ হয় সিলেটের মানুষদের। একজন দু’জন জাহাজ পালিয়ে যারা বিলেতে ঢুকেছিলেন, বাসন ধোবার চাকরি পেয়েছিলেন প্রথম মহাযুদ্ধকালের ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বীরস্বামীতে (ঠববৎধংধিসু)। ওরাই সিলেটি রেস্টুরেন্ট ব্যবসার পথিকৃৎ। সেই থেকে সিলেটের গ্রামঞ্চল থেকে মানুষ সরাসরি যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের নানা শহরে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি অর্থাৎ দশ বারো বছরেই এক লন্ডন শহরেই সিলেটি রেঁস্তোরা সংখ্যা দ্াড়ায় কমবেশি তিনহাজার। এখন বিলেতে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট মানে সিলেটি খাবারের দোকান, ইন্ডিয়ান নয় সচরাচর। তো মানুষ যাচ্ছে, সিলেটের গ্রাম থেকে। একলাখ যাচ্ছে, দু’লাখ, তিন লাখ, চারলাখ, পাঁচ লাখ। যুক্তরাজ্যে হয়তো ছয় লক্ষ বাংলাদেশীয় বাঙালি আছে। তার সম্ভবত প্রায়ই সিলেট থেকে আসা। সিলেটের গ্রামাঞ্চলে পয়সা পৌঁছেছে। ছেলেপুলেরা আর গ্রাম্য হচ্ছেনা, ক্ষেতে যাচ্ছে না হাল-লাঙল নিয়ে। কী করবে তারা তাহ’লে? অন্যতম কিছু যোগ্যতা আহরণ করা হয়ে উঠেনি তাদের। তাই জিনসে-গেঞ্জিতে গ্রাম্যপথে ধুলো ওড়ানো আর বিলেতে ভিসার স্বপ্ন দেখা ছাড়া কাজ বিশেষ কিছু নেই। এই ভিসা-পাগলামি, ভিসার অভাবেও কোনমতে বিদেশ পাচার হবার পাগলামি এ তো আর এখন সিলেটে আবদ্ধ নেই। সারা বাংলাদেশ এই জ্বরে কাঁপছে এখন। যত সম্ভব-অসম্ভব উপায়ে তারা বিদেশ যাবার চেষ্টা করে, অভাবিত সব বিপদে পড়ে। থাইল্যান্ড-মালেশিয়ার মধ্যবর্তী অরণ্যে এই সেদিনও ত্রিশ-চলি­শ হাজার বঙ্গ সন্তান ঘুরে বেড়াচ্ছিল, বন্যজন্তুর মতই ট্রাভেল-পেপার্সবিহীন হয়ে।

একটা বিলেতি পাসপোর্টধারী মেয়েকে বিয়ে করে তার স্বামীত্বের সূত্রে অত্যন্ত একটা বৈধ উপায়। এবং এর মধ্যে আপত্তিকর কিছুই থাকতে পারে না। মেয়েরা তো জন্মায় বিয়ের জন্যেই, অতো সেন্টিমেন্টাল হবার কী আছে এ নিয়ে? শাকুর মজিদ হননি। একটা কথা বলেননি লাল পাসপোর্টধারিণীকে বিয়ে করবার প্রতিযোগিতার অমানবিকতা নিয়ে। কারণ কঠিন বাস্তব এ। বেকার পরিণয়প্রার্থী যুবকদের মন্দ বলেননি তিনি, মন্দ বলেননি তাদের বাপদেরকেও। শুধু কী ঘটে তাই, ক্লিনিক্যালি, তুলে ধরেছেন। শাকুরের কিংবা আমারতো এখানে মন্দ কিছু দেখবার অধিকার নেই বিয়ে তো এই রকমই নয়, আমাদেরও হয়েছে। শাকুর একটা জায়গায় আর ব্যক্তি শাকুর থাকলেন না। সমস্যাটাকে দেখলেন জরি হয়ে, নিজেকে অতিক্রম করলেন তিন। একটি বিকশিতচিত্ত নারীর দিক থেকেই কেবল এই লাল পাসপোর্টধারিণীকে বিয়ে, তথা পাসপোর্টটাকেই বিয়ে অমানবিক। এবং শাকুর তা দেখিয়েছেন জরির দিক থেকেও, বলিয়েছেন জরির মুখ দিয়ে।

সাহিত্যের সমাজের সমস্যা চলেই আসে, আসে ব্যক্তির অন্তর্জীবনের সমস্যা, অঞ্চলের ইতিহাস-ভূগোলঘটিত সমস্যা। সব উঠে আসে সত্যের পথে, অন্যতর, সম্ভবত অধিক কল্যাণবহ, বিকাশসম্ভব সত্যে নিয়ে যাবার জন্য। সিলেটের মহাক্ষিপ্ত অসাহিত্যিক ভাইয়েরা কেন ভাবলেন ছবির ঐ গ্রামের, কিংবা সিলেটের, সমস্ত যুবক অপেক্ষায় থাকে লন্ডনী কইন্যার, তার পাসপোর্টটির লালচে। তিনটি বোধহয় ছেলে পাওয়া যায় এই রকম। তার মধ্যে রঞ্জু জীবনে পথ খুঁজে পায় জরির ভালোবাসাময় পরামর্শে। দুই ছেলের গার্জেনদের মধ্যে একজন জেতে। তো কি সিলেটের সমস্ত যুবক পাসপোর্টধারিণী শিকারী হয়ে গেল? সব গল্প উপন্যাসেই তো ভিলেন থাকে। তাদের যে জায়গায় বাড়ি, সে জায়গার মানুষেরা কি এখন আন্দোলন আরম্ভ করবে, তাদের অঞ্চলের মনুষদের অপযশ করা হচ্ছে বলে? ভারি মজা তো!

লন্ডনী কইন্যা নাটকে শমী কায়সার ও শিবু ভট্টাচার্য

ব্রিটিশ সরকার সকল রকমভাবে চাইছে অভিবাসী স্রোত নিয়ন্ত্রণ করতে। তাতে তাদের অপরাধ কী? তারা যদি বলে তাদের ইমিগ্রেশন আইনকে ফাঁকি দেবার জন্য সিলেটি ছেলেরা লাল পাসপোর্টধারিদের জোর করে বিয়ে করে বিলেতে ঢুকছে এবং তা বন্ধ করতে চায়সেটা তাদের ব্যাপার। তারা তা করতে চাইতেই পারে। কিন্তু আহাম্মুকি করবে তারা সেক্ষেত্রে। ‘জোর-করে-বিয়ে’ প্রমাণ করা খুব শক্ত। সকল লন্ডনী কইন্যাই শাকুরের মানসকন্যা জরির মতো বিএ এমএ পাশ করে, শিক্ষিকার চাকরি করে, সিলেটে ফিরে আসে না অশিক্ষিত মূর্খ অযোগ্য ছেলে বিয়ে করবার জন্যে। আসে যারা তাদের জোর করে বিয়ে দিতে হয় না। মুসলিম পরিবারে যেমন করে বিয়ে হয়, তেমন করে তাদেরও। বাপ-মার লাভ-লোকসানের হিসেবকে মেয়েরা শিরোধার্য করে এসেছে চিরকাল, সিলেটে তা করে যাবে অনাগত বহুদিন পর্যন্ত। জোরের প্রশ্নটি নেই কোথাও যে ব্রিটিশ সরকার প্রমাণ করবে। আর ব্রিটিশ সরকার কী করবে না করবে বিলেতে বসে তাই দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে আমার লেখকের কলম, নিবারণ বন্ধ হবে আমার সামাজিক সমস্যার? সিলেটের অদূরদর্শী নিতান্ত কিছু শিক্ষিত মানুষ এই ধুয়া তুলছেন যে ব্রিটিশ সরকার তাদেরই সন্তান শাকুর মজিদকে টাকা খাইয়ে এই ছবি করিয়েছে যাতে তারা ঐ আইন করতে পারে। এ যদি কোনোভাবে সম্ভব হয় তবে শাকুর হবে সিলেটের গৌরব। চিনল কী করে ব্রিটিশ সরকার এই অসাধারণ প্রতিভাকে? তাকে আগাম টাকা দিয়েছে, এমন কদর করেছে তার প্রতিভার। রানীর জন্মদিনে নিদেনপক্ষে একটা ওবিই এমবিই না ছিঁড়ে পারে না। শাকুরের অর্থ প্রাপ্তির মতো উদ্ভট চিন্তা তারাই করতে পারে যারা বিশ্বাস করতে পারে রবীন্দ্রনাথ তার দিদি স্বর্ণকুমারীকে দিয়ে নজরুলকে বিষ খাইয়ে পাগল করেছিলেন পথের কাঁটা সরাতে। রবীন্দ্রনাথের আটত্রিশ বছরের ছোট নজরুল সম্ভবত স্বর্ণকুমারীর চাইতে ষাট-সত্তর বছরের ছোট। তিনি বাক-হারা হবার আগেই রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন, স্বর্ণকুমারী মারা গেছেন তার কয়েক যুগ আগে।

শাকুর কোথাও তাঁর গ্রামের মানুষদের অশ্রদ্ধার চোখে দেখেননি। দেখলেই বা কী হত? অশ্রদ্ধেয় কিছু থাকলে তো তাই করতে হবে। সেই তো লেখকের কাজ। শাকুর সিলেটের গ্রামজীবনকে পটভূমি করে সিলেটি একটা সমস্যাকে আলতোভাবে, প্রায়জা করেই, ঢুকিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত বলেছেন নারীর মর্যাদার কথা, নারীরই আত্মোপলব্ধির ভিতর দিয়ে। মানুষের এই চিরকালীন একটা সমস্যা, মানবদশারই যেন একটা বৈকল, এই লিঙ্গ-বৈষম্য এবং তার চাপে উভয় লিঙ্গের মানুষের অপূর্ণ বিকাশের ‘বিধিলিপি’-এর মধ্যে সিলেটকে পূর্ণ প্রাসঙ্গিকতায় বসিয়ে শাকুর জন্মভূমি সিলেটকে এমন গৌরব দিলেন যা দশটা পঞ্চাশটা হুমায়ূন পারবেন না।

শাকুর সাহস করেছেন। তাঁর শিল্প রসোত্তীর্ণ হয়েছে বলেই কাউকে কাউকে আঘাত করেছে। তাঁর হাত আছে-কল্পনা, সাহসটির ক্ষয় না হলে অনেক কিছু আমরা আশা করতে পারি তাঁর কাছ থেকে। তাঁর ছবিটা এক ধরনের ফিল্ম তো বটে। বাংলা ছবির বীভৎসতম দিনে যে স্বর্গের ছবি নিয়ে এল তাঁর লন্ডনী কইন্যা।

ক্ষিপ্ত কতিপয় সিলেটবাসীকে আমার সমবেদনা এক বিষয়ে। জরিকে অর্থাৎ শ্রীহট্ট সুন্দরীকে কেন পাবে ময়মনসিংহের ব্যাঙ্গালি। হতেই তো পারতো সে আরেক সিলেটি। পুরুষ প্রধান সমাজ দশ হাজার বছর ধরে এই রকম করেই হয়ে এসেছে। মুসলমান ছেলে হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করলে মুসলমানদের খুব আহ্লাদ হয়, মুসলমান মেয়ে হিন্দুতে নিলে হয় কুপিত। এতে সিলেটি যুবকদের ঈর্ষাজনিত বেদনা হতেই পারে, সেই বেদনা আমাকেও ছুঁয়েছে। ট্রেন ধরতে গিয়ে মিস করে জরি ভালো মানুষ রঞ্জুর দিকেই ফিরতেই পারত, এই রকম কল্পনার সঙ্গে আমার আন্তরিক সায় আছে। ক্ষিপ্ত মানুষগুলোর কলজেয় মলম দিতে পারাটা এমন কিছু খারাপ কাজ হয় না।

শুধু তাতে সাহিত্য হয়তো থাকে না। স্রষ্টার স্বাধীনতাকে স্বীকার করলেই সৃষ্টি পাওয়া যাবে। সিলেটের সবকিছু অসুস্থ করেছে কয়টা মানুষ। সিলেটবাসীকে এ কাটিয়ে উঠতেই হবে, নিজের জ্ঞানে নিজের চেষ্টায়।

ছবির নাম হতেই পারত ‘লাল পাসপোর্ট’। কিন্তু পাসপোর্টটা কোনো বিষয় নয় শাকুরের জন্যে, বিষয় কন্যাটি, তার আত্মোপলব্ধিটি। ছবির নামকরণ তাই সার্থক হয়েছে এবং শাকুরকে আরেকটু ঠেলেছে বিপদের দিকে। শাকুরের সকল কাঁটা ধন্য করে ফুল ফুটুক, সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠুক।

প্রকাশ : দৈনিক ভোরের কাগজ, ২৫মে ২০০০ ইংরেজি।
লেখক : প্রয়াত সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

 

 

মন্তব্য
Loading...