নাইওরী – উৎকর্ষের সন্ধানে ভিডিও চলচ্চিত্র
আনিসুল হক
নির্দেশক তৌকির আহমেদ আর রচয়িতা শাকুর মাজিদ একে বলেছেন চলচ্চিত্র ! কথাটা সচেতনভাবে বলা। আমরা আমাদের শ্রবণদর্শন মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অসংখ্য কাজ দেখি, এর মধ্যে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠার আকাঙক্ষা খুব কমসংখ্যকেরই থাকে-যোগ্যতা তো পরের ব্যাপার। তৌকির-শাকুরের নাইওরী সচেতনভাবে চলচ্চিত্র হযে উঠতে চেয়েছে। বেটাকমে ধারণ করা হলেও উদ্দেশ্যের মধ্যেই রয়ে গেছে তার অর্ধেকটা জিত। সাফল্যের বাকিটা অর্জিত হয়েছে কাজের মাধ্যমে। চমৎকার কাহিনী লিখেছেন শাকুর মজিদ। ভাটি অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে রচিত এক বংশীবাদক ভৃত্যের সঙ্গে গৃহকর্তার বড় মেয়ের দুনির্বার প্রেমের চিরন্তন গল্প।

বাঁশি আমাদের লোকপুরাণের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এখনো আমাদের রক্তে তা টান ধরায়,নাইওয়ারীতেও বাঁশি টেনেছে-ঘর ছেড়ে বটতলায় টেনে নিয়ে গেছে কুলনারী বিপাশাকে,আর টেনেছে দর্শকদের। শাকুর কীভাবে গল্প ফাঁদছেন কীভাবে একটার পর একটা ঘটনা জুড়ছেন,সংলাপে-সচলতায় -নীরবতায়-স্থিরতায় কীভাবে গল্প তার নিজের ঘোর তৈরী করে দর্শকদের গল্পের পাকে জড়িয়ে ধরছে,ভালো করে খেয়াল করলে অভিভূত হতে হয় । বিপাশার বিয়ে হয়ে গেছে দূরবর্তী অঞ্চলে। তিনি তার বাবার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান,কিন্তু করবেন কী করে? বার্তাবাহকের কাজ করল একজন ভিক্ষুক। এই যে কাহিনীর প্রয়োজন মেটানোর জন্য ছোট ছোট সংযোগ দৃশ্যগুলো দরকার হয়, সেসবও সুচিন্তিত ও সুপ্রযুক্ত। প্রেমিক যুগল বিপাশা ও আজিজুল হাকিম,কেউ কিন্তু কাউকে একবারও বলে না ভালোবাসি- দৃশ্যে, পরিস্থিতিতে, নীরবতায় ,বিব্রত ভঙ্গিতে, অভিভাবকদের উৎকণ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হয় দুর্মর ভালোবাসা। বাহবা শাকুর । এরপর তৌকির! তৌকির নাইওয়ারীতে এসে তার সর্বোত্তম কাজটা দেখাতে পেরেছেন- তেমনি আমার কাছে মনে হয়েছে-আমাদের অডিও ভিজুয়াল মাধ্যমেরই এগিয়ে যাওয়ার একটা সাক্ষাৎ প্রমাণ হলো নাইওরী। কী লোকেশেন নির্বাচন ,কী পাত্রপাত্রী বাছাই সর্বত্র মনোযোগের ছাপ-বোঝাই যাচ্ছে প্রতিটা শট ধরে ভেবে ফ্রেম ঠিক করে তারপর নেওয়া হয়েছে-আর কী যে চমৎকার ক্যামেরার কাজ। অভিনন্দন চিত্রগ্রাহক রফিকুল বারী চৌধুরীকে,আমাদের মুগ্ধতা আকাশ ছোঁয়া। যখন তুলনা করে দেখি ভাটি অঞ্চলের কাহিনী নিয়ে নির্মিত অপরাপর চলচ্চিত্রে ওই অঞ্চলের নিসর্গ- জীবনচর্যাটা বোঝা যায়না, কিন্তু নাইওরীতে ভাটি অঞ্চলের আদিগন্ত জল, শাপলা, কচুরিপানা, নৌকাযোগে যাতায়াত,আবার পানি শুকিয়ে গেলে পড়ে থাকা ধুধু মাঠ-এত সুন্দরভাবে লোকেশনকে ব্যবহার করা হয়েছে যে,চোখ ও মন ভরে যায়।অভিনয়েও ভালো করেছেন শিল্পীরা। আজিজুল হাকিম যে একজন বড় মাপের অভিনেতা, নাইওরী তা আবার মনে করিয়ে দেবে। আগাগোড়া বিপাশা অসামান্য, তৌকিরও চরিত্রানুযায়ী ফুটিয়ে তুলেছেন একজন অনিচ্ছুক স্ত্রীর অসহায় স্বামীর কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা। দিলারা জামান, রহমন আলী,সিলেটের রওশন আরা মনির , এক ঝলকের দেখায় ¯মৃতিতে গেঁথে থাকা সুমাইয়রা রহমান শিমুল,কিশোর অভিনেতা সুভাশীষ দেব টিটু-সবাই চরিত্রানুগ,অনবদ্য। নাইওরী’তে আপস করা হয়নি,ছাড় দেওয়া হয়নি, প্রডাকশনে গিয়ে-বৃষ্টির দৃশ্য কিংবা ময়না পাখির ছটফটানি দেখলে সেটা বোঝা যায়। নাইওরীর সবই ১০০ ভাগ ভালো তা হয়তো নয়। সমালোচকরা নিশ্চয় এর ঊনতার দিকগুলো খুঁজে বের করতে পারবেন -কেউ কেউ যেমন বলেছেন,আজিজুল হাকিমের কণ্ঠে শেষ গানটা ওটা তেমন সুপ্রযুক্ত হয়নি-আমরা এসব প্রসঙ্গ আনব না, কেউ যখন এ মাধ্যমে চাকচিক্য, ঠাটঁবাট দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে, লোক ঠকিয়ে হাততালি পাওয়ার রাস্তা সচেতনভাবে বর্জন করে চলচ্চিত্রের ভাষাতেই উৎকর্ষ লাভ করার ঝুঁিক নেয়,তখন আমরা তাকে দুহাত তুলে অভিনন্দন জানাতে চাই। এ এক প্রত্যয় উদ্যেককারী, আশা জাগানিয়া প্রডাকশন।