মিং রাজের দেশে- সামিয়া কামাল

মিং রাজার চীন দেশের গল্প

নতুন কোনো শহরে একাকী ঘুম থেকে জাগা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আনন্দের অনুভূতি।’

-ফ্রেয়া স্টাক

প্রকাশক- উতস প্রকাশনী, প্রচ্ছদ- শাকুর মজিদ, প্রথম প্রকাশ – ২০১১

কিন্তু সিসিটিভির প্রোজেক্ট (ভ্রমণচিত্র নির্মাণ) এর কাজে তিনজনের কর্মঠ একটি দল যখন বেইজিং-এ এসে পৌছাল, তখনো ঢাকার ঘড়িতে রাত দশটা, আর স্থানীয় সময়ে সেটা মধ্য রাত। একবর্ণ ইংরেজিকে সম্বল করে এই তিনজনের দলকে এক নারী নির্দেশনা দিয়ে কাস্টমস করিয়ে নিলেন তাদের ক্যামেরার। এর আগপর্যন্ত কারো সাথেই সেভাবে ভাষা বা ভাবের বিনিময় সম্ভব হয়নি। তিন জনের টিম যখন কিছুটা হতাশ এবং ক্লান্ত ঠিক তখন দৃশ্যপটে প্রবেশ করল এক স্যান্ডো গেঞ্জি পরা যুবক।হ্যান্ডশেক করে বলে- “মাই নেইম ইজ কু”।

এই অব্দি পাঠক হিসেবে আমি নিজের মত করে বেইজিং এর এয়ার পোর্ট এবং আনুসাঙ্গিক বিষয়গুলো সম্পর্কে নিজ ধারনার অবয়ব মিশিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম ‘মিং রাজের দেশে’ শিরোনামের ভ্রমণকাহিনী, কিন্তু পাতা ওল্টাতেই দেখি কু নামের যুবকের একটি ছবি দেওয়া আছে। তখন থেকেই মনে হতে থাকল, গতাগুনগতিক ভ্রমণকাহিনী থেকে এই গ্রন্থটি বেশ অনেকটাই আলাদা। কেবল বই এর সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য চিত্র সঙ্গুক্ত করা হয়নি, বরং পাঠকের সাথে ভ্রমণের অনুভূতিকে প্রগাঢ় করাই এই চিত্রগুলোর কাজ।

ফিরে আসি ফ্রেয়া স্টাক এর উক্তিতে, ‘নতুন কোনো শহরে একাকী ঘুম থেকে জাগা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আনন্দের অনুভূতি।’

“সকাল আটটায় ঘুম ভাঙল, কিন্তু আমার মোবাইল ফোনের ঘড়িতে তখন ভোর ৬টা, বাংলাদেশ সময় (তখনকার ডিজিটাল টাইম, অরিজিনাল টাইম ভোর ৫টা)। এতো ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস নেই আমার। কিন্তু এখানে দেখি বিপদেই পড়ে গেলাম। কু চেয়েছিল ওদের সময় সকাল সাড়ে ৬টায় আমরা ব্রেকফাস্ট করব, ৭টায় হোটেল থেকে বেড়িয়ে সাড়ে সাতটায় পৌছব সিসিটিভির অফিসে, কিন্তু অনেক বলে কয়ে তাকে রাজি করান হল। মনে হল এই বেড়ানোর কাজটা বড় কষ্টকরই হবে। এতো নিয়ম করে কি আর বিদেশ বেড়ানো যায়?” (ভ্রমণ সমগ্র ২য় খন্ড পৃঃ১৫)

কিন্তু লেখক ও তাঁর দল যখন  “চীন দেখা” শুরু করলেন, তখন থেকেই তাদের ক্লান্তি এবং হতাশা কেটে সেখানে স্থান করে নিতে থাকে বিস্ময় আর মুগ্ধতা। এবং গতানুগতিক চীন দেশ সম্পর্কে গড়ে ওঠা ধারনাগুলো একটু একটু করে নড়েচড়ে সেখানে স্থান করে নেয় নতুন এবং অত্যাধুনিক এক চীন।

লেখকের বই থেকে কতোগুলো চ্যাপ্টার পড়ে তা নিয়ে লিখছি।

সিসিটিভি

অত্যন্ত দূরদর্শি এই প্রতিষ্ঠানটি অনেক আগে থেকেই আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখলেও, চীনের রক্ষনশীল নীতির কারনে তাদের প্রচার এবং প্রসার সেভাবে নজরে আসেনি। কিন্তু সময় সবকিছুর পরিবর্তন ঘটায়। রক্ষনশীলতায় অনেকটাই কেটে যাওয়ায় বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বেড়েছে, এবং অনেক কিছুই তারা গ্রহণ করতে শিখেছে। জীবনযাত্রা, নির্মাণ শৈলী এবং সংস্কৃতি সব কিছুতেই লেগেছে পশ্চিমী মিশেল।

“সিসিটিভি থেকে একসঙ্গে ১৬টি চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রচার হয়। মাত্র ২৮  বছরে এই সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ এখন নজর দিয়েছে তাদের নেটয়ার্ক বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে।”

লেখকদের কথা হয় সিসিটিভি-৯ এর সহকারী কন্ট্রোলার ইয়াং ফুকিং এর সাথে। তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে উন্নয়নশীল দেশের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। আমরা উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক সেতু তৈরি করতে চাই”

তিনি আরো বলেন, “এখন যদিও যথাযথ খবরের জন্য আমরা কোনোকোনো পশ্চিমদেশীয় টেলিভিশনের সংবাদের দিকে তাকিয়ে থাকি , কিন্তু এটা খুবই সত্যি যে, সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন সারা পৃথিবী তাকিয়ে থাকবে চীনের সংবাদের দিকে; এবং সিসিটিভি সেজন্য তৈরিও হচ্ছে।” (ভ্রমণ সমগ্র ২য় খন্ড পৃঃ ১৭)

সিআরআই এবং রেডিও পিকিং এর স্মৃতি

আমি নিজে কাজ করি বেতারে, এক সময়ে রেডিও পিকিং থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় চীনাদের কন্ঠে খবর প্রচারিত হত। আমরা সেই খবর শুনতাম আর ভাবতাম কী করে চীনারা এরকম বাংলা উচ্চারনে কথা বলতে পারে।  লেখক তাঁর দলসহ সেই রেডিও পিকিং এ যান, এবং খুঁজে পান ইয়াং শুয়েমিং নাম্নি একজন নারীকে যার বাংলা নাম- স্বর্ণা। যারা বাংলা বিভাগে কাজ করে তাদের সবাইকেই একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে বাংলাদেশে আসতে হয়েছে। এদেশের মানুষের সাথে মিশতে হয়েছে। তারা সকলেই এই ভাষাকে ভালোবেসে একটি করে বাংলা নাম ধারন করেছে, “এদের নাম শিখা, প্রেমা, মুক্তা, সুবর্ণা- এসব।” (ভ্রমণ সমগ্র ২য় খণ্ড পৃঃ ১৯) এবং যে কোন বাংলাদেশীদের সাথে তারা সাবলিল ভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলে। লেখক ও তাঁর দল অনেকটা অনুরোধ করে  পেলেন স্বর্ণা নামের মিষ্টভাষী একটি মেয়েকে পরবর্তী তিন দিনের জন্য। নিজ ভাষায় কথা বলতে পারা একজন মানুষকে ভিনদেশে পাশে পাওয়া বিশাল আশির্বাদ, সেটা লেখকের ভাষায় “সি আর আই দেখা আমাদের শেষ হয়ে যায় কিন্তু আমরা স্বর্ণাকে ছাড়িনা। তার পরিচালক কে আমরা অনু্রোধ করি, সামনে যে তিনটা দিন আমরা বেইজিং-এ থাকব, এই সময়টাতে স্বর্ণা যদি আমাদের সঙ্গে থাকে, তাহলে আমাদের অনেক সুবিধা, বিশেষ করে আমার। ক্যামেরার সামনে বাংলাভাষী একজন চৈনিক যদি চীন সম্পর্কে বাংলায় কথা বলে সেটা আমার জন্য অনেক সুবিধা।”

চীনের দেয়াল

চীনের দেয়ালে শাকুর মজিদ ২০০৬

চীনের দেয়াল নিয়ে অনেক বেশি সাহিত্য, ইতিহাস, বিফলতা এবং কিছু কষ্টের উপাখ্যান আমরা জানি, লেখক এই অধ্যায়টিতে খুব বেশি আবেগের বহিঃপ্রকাশ করেননি। তাছাড়া তাদের দলটিকে চীনের দেওয়ালের যে অংশটি দেখান হয় সেটিকে বলা চলে প্রাচীরের নব নির্মিত একটি অংশ। দিনটি ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন আর মেঘলা। চীনের প্রাচীর নিয়ে না ভেবে, ক্যামেরায় ভিউ কেমন আসবে সেই ভাবনাই লেখককে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তাই স্বর্ণা যখন জানতে চাইল “এমন একটা প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষীকে তুমি তোমার নিজ হাতে স্পর্শ করছ, তোমার কোন ফিলিংস হচ্ছে না?

আমি স্বর্ণার কথায় সায় দিতে পারিনা। আমার দুহাতে দুই ক্যামেরা। আমার মাথার মধ্যে লাইট আর ভিস্তা। স্বর্ণাকে ঠিক কোন জায়গায় দাঁড় করালে ওর কমেন্ট্রি সবচেয়ে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারি, আমার মাথায় শুধু এটাই কাজ করছে।” (ভ্রমণ সমগ্র ২য় খণ্ড পৃঃ ২৫)।

যদিও এই অধ্যায়টিতে আবেগের আড়ম্বর নেই, কিন্তু আছে  প্রাচীর নিয়ে অনেকগুলো তথ্য এবং ইতিহাসের কথা। কিন্তু লেখক তাঁর আবেগ প্রকাশ করলেন অন্য একটি পয়েন্টে। যা, পাঠক হিসেবে আমাকেও খুব স্পর্শ করেছে।

“একটুখানি জিরোবার জন্য এক পাথরের সিঁড়ির ওপর বসেছি। তার দেয়ালের দিকে চোখ গেল। অসংখ্য পর্যটক এ দেয়ালের গায়ে তাদের নাম লিখে রেখেছেন। কেউ নামের সঙ্গে যোগ চিহ্ন দিয়ে লিখেছেন অপর একটি নামও। তার দু-একটি ইংরেজীতে, বেশিরভাগই চীনা ভাষার, অন্য ভাষায়ও আছে। দেয়ালের গায়ে নাম লিখে রাখার এমন অভ্যাস আমার মনেহয় সার্বজনীন। এটা পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক পর্যটন জনপদে আমি দেখেছি। লালবাগের কেল্লা থেকে শুরু করে স্টোনহেঞ্চ, গ্রান্ডক্যানিয়ান, তাজমহল বা পিরামিডের দেয়াল-কোনোটির দেয়ালই এই হস্তচিহ্নবিলাসীদের উৎপাত থেকে মুক্ত ছিলনা। চীনের প্রাচীরে লেখার জায়গা আরো বেশি, এখানে কেন থাকবে না?” (ভ্রমণ সমগ্র ২য় খণ্ড পৃঃ ২৭)

সরকারী অতিথি হয়ে চীন দেশ ভ্রমণে এসেছেন তাঁরা, চাইলেই শিডিউলের ব্যত্যয় করা চলবে না। তাই, যখন বলা হল চীনের প্রাচীরের পর দলটিকে নিয়ে যাওয়া হবে যেসব রাজা এই প্রাচীর বানিয়েছেন তাদের সমাধিসৌধে তখন কিন্তু লেখকের সেখানে কোন উৎসাহ দেখা গেলনা।

“আমি বলি, রাজারাজড়াদের কবরখানাতে আমার কোনো আগ্রহ নেই, আমাদেরকে নিয়ে বেইজিং চল। কু রাজি হ্য় না। বলে, আমাদেরকে সিডিউল দিয়েছে সিসিটিভি, সেখান থেকে নড়া যাবে না।” (ভ্রমণ সমগ্র ২য় খণ্ড পৃঃ ৩০)। অতএব পরবর্তী গন্তব্য ‘মাটির নিচের সমাধিসৌধ’।

সেই সমাধির ইতিহাসের সাথেও জুড়ে আছে নিপীড়ন, নির্যাতন এবং বেশ অনেকখানি পেশীশক্তির প্রভাব। রাজার মৃত্যুর সাথে সাথে জ্যন্ত পুড়িয়ে মারা হত রানী এবং সহচরীদের। রাজ কোষাগার থেকে সাপ্লাই দেওয়া হত মনি মুক্তা, উন্নত পানীয় এবং নানা রকম উত্তম বস্তুর। কয়েক শ বছর পরেও সেই কবর খুঁড়ে দেখা যায় সেই সব পানীয় অক্ষত রয়ে গেছে পিপাতে। রাজারা সেটা ব্যবহার করতে পারেননি। বেশ দীর্ঘ বর্ননা এবং তথ্য উপাত্ত সম্বলিত এই অধ্যায় এর শেষ প্রান্তে এসে লেখকের একটি মতামত আমাকে চমকে দেয়,

“অতি আশ্চর্যজনক জিনিসও মানুষকে খুব বেশিক্ষণ আঁটকে রাখতে পারেনা।… কবর সে যতই কাহিনির জন্ম দিক, তাকে নিয়ে খুব বেশি সময় কাটানো যায় না।(ভ্রমণ সমগ্র ২ পৃঃ ৩৫)

তিয়ানআনমেন চত্বর

ঐশ্বর্যমন্ডিত চীনের ইতিহাস প্রায় ৭শ বছরের। এখানে মিং রাজাদের প্রভাব সবচেয়ে অধিক। এখানে যেমন আছে গৌরবময় অধ্যায়, তেমনি আছে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ। ‘ফরবিডেন সিটি’ তেমন একটি নিদর্শন। ফরবিডেন সিটিতে প্রবেশের আগেই তিয়ানআনমেন স্কয়ার বা চত্বর। এই চত্বরটি দেখার জন্য প্রতিদিন হাজার মানুষের ভিড় লেগে থাকে। এবং এখানের হল অব পিপলস এর এর ভেতরেই মাও সেতুং এর মরদেহ রাখা। মাও সে তুং চীনের অপর নাম। তিয়ানআনমেন স্কয়ার এর সবটা জুড়ে তিনি আছেন। লেখকের ভাষ্যতে-

“তিয়ানআনমেন স্কয়ারের সর্বত্রই মাও আছেন। কোথাও তাঁর ছবি, কোথাও তাঁর মূর্তি, কোথাও তাঁর নিজ হাতে লেখা কোন বানী।” (ভ্রমণ সমগ্র ২য় খণ্ড পৃঃ ৪০)

সাংহাইতে শাকুর মজিদ ২০০৬

মাও সে তুং এর মৃত দেহ অবিকৃত ভাবে ১৯৭৬ সাল থেকে একটি কাঁচের কফিনে সংরক্ষিত আছে, এই তথ্যটি চমকপ্রদ। কিন্তু এই সংরক্ষণের উপায়টি খুব একটা স্পষ্ট ভাবে প্রকাশিত নয়। চীনাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের পর্যাপ্ততা এই উপায় নির্ণয়ের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু লেখককে মাও সেতুং এর মৃতদেহ দর্শনের চাইতেও অনেক বেশি আকর্ষণ করল চীনা ঘুড়ি। তিয়ানআনমেন স্কয়ার পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের জন্যেও একটি উন্মুক্ত স্থান, যেখানে অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসে, ঘুড়ি ওড়ায়। আছে বাহারি রেস্তোরা, চা এর দোকান। সব কিছু মিলিয়ে বেইজিং এর মূল আকর্ষণ এটি।

লাও সির চায়ের দোকান

লাও সি চায়ের দোকান এর অধ্যায়টি আসলেই অন্যরকম। কলকাতার যেমন কফি হাউস, তেমনি বেইজিং এর লাও সি চায়ের দোকান। বাড়িটি ৮০-৯০ বছরের পুরনো, তিন তলা। এই দোকান অথবা ক্যাফে খোলার ১৫ মিনিট আগে থেকে লেখক ও তাঁর দলের সকলে অপেক্ষমান থাকেন সেখানে। সময় তখন সন্ধ্যা ৬টা। স্বর্ণা জানায় আজ এখানেই ডিনার এবং কনসার্ট দেখা হবে এবং চা পান করা হবে। অপেক্ষমান অবস্থায় এই দোকানের ইতিহাসের খানিকটা জানা হয় তাঁদের।

“এই চায়ের দোকানের মালিকের নাম ইয়েন সেংসি। কুড়ি বছর আগেও তিনি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা বিক্রি করতেন। দু’পয়শা কাপের চা। কিন্তু এই ভদ্রলোকের নাটক করার অভ্যাস ছিল। মঞ্চে তিনি অপেরায় অভিনয় করতেন। এক সময় চিন্তা করলেন- এমন একটা চা এর দোকান কি বানানো যা, যেখানে চা বিক্রি হবে আবার অপেরাও হবে? সেই চিন্তা থেকে ১৯৮৮ সালে তৈরি হল এই টি হাউসটি। নাম দিলেন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক- নাট্যকার লাও সি’র বিখ্যাত নাটক ‘টি হাউস’- এর নামে। সেই থেকে বেইজিং এর সংস্কৃতিপিপাসু পর্যটকদের কাছে এই চায়ের দোকানটি বড় জনপ্রিয়।”(ভ্রমণ সমগ্র ২ পৃঃ ৫১)

বাহারি চায়ের পাত্র, এবং হোলদেটে এক পানীয়, শৌখিন এবং বেশ মূল্যবান চা। সামান্য কিছু খাবার আর চমৎকার পরিবেশনা। নাচ, গান, এক্রোব্যাট, জাদু সব কিছু শো’টির নাম সেন্টাকো। এক সময়ে পরিবেশনা শেষ হল। এবারে টি হাউস ঘুরে দেখার পালা। এক এক তলার বৈশিষ্ট এক এক রকম। দ্বিতীয় তলায় আছে ইন্ডিভিজুয়াল টি লাউঞ্জ। এবং তৃতীয় তলাটিকে বলা যায় ছোটখাটো একটি জাদুঘর। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চা-জাদুঘর তখনো লেখকদের দেখা বাকি রয়ে গেছে। আর সেটা হল হাংজো তে। চা নিয়ে আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে। বাহারি চা এর কাপ, চা এর পরিবেশনা সহ প্রাসঙ্গিক একাধিক ছবি দিয়ে মিং রাজের দেশে শি্রোনামের লেখাটির এই অধ্যায়টি অত্যন্ত সুখ পাঠ্য ছিল আমার কাছে।

সাংহাই

‘পার্ল অব ইস্ট’ ছিল সাংহাই এর পাশে এডজেক্টিভ হিসেবে। আসলেই তাই। এই শহর কসমোপলিটন।  ব্যবসা বাণিজ্য দালান, রাস্তা  এবং জীবনযাত্রায় এখানে ট্র্যাডিশানের ছাপ কম বরং আধুনিকতার ছাপ অনেক বেশি। স্বর্ণা বেইজিংএ রয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় কথা বলার আপাতত চৈনিক কোন সাথী নেই কিন্তু সফরসঙ্গী কু জানালো, এখানে যে কোন স্কুলের ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়ে ইংরেজীতে কথা বলতে পারে। এবং স্থানীয়রা অনেকেই ইংরেজী ভাষায় দক্ষ। লেখক ও তাঁর দলের চীন ভ্রমণের উদ্দেশ্য একটি ভ্রমণ চিত্র নির্মান করছেন, তাই তাঁদের অবিরাম পথ চলতে হয়। চীনের দর্শনীয় সম্ভাব্য সকল স্থাপনা তাঁদের দেখে নিতে হয়। ফুটেজ ধারণ করতে হয়। তিন জনের কাছে থাকে পাঁচটি ক্যামেরা যার মাঝে দুটি ভিডিও  এবং একটি স্টিল ক্যেমেরা। এই সব আনুসাঙ্গিক  সাথে নিয়ে তাঁরা নেমে পড়েন সাংহাইতে।

কিন্তু কেন যেন সাংহাই এর ভ্রমণের বিবরন আমাকে তেমন ভাবে টানেনি। ঔপনিবেশিকতার  ইতিহাস ছিল বলেই এই শহর কালক্রমে এতোটা আধুনিক হয়ে ওঠে। এর মাঝে সমাজতন্ত্র ঢুকে পড়ায় এর জৌলুশ যায়  কমে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংস্থাগুলো সরে যেতে থাকায় অর্থনৈতিক দুর্বলতার মুখোমুখি হতে হয়। তারপর আবার ফিরে দাঁড়ানোর পালা। এইসব মিলিয়েই সাংহাই এর বুন্দ (বাঁধ)এবং এর আসেপাশের গল্প। সব কসমোপলিটন সিটির মতোই আমার কাছে সাংহাই কে বেশ খানিকটা বৈশিষ্টহীন মনে হয়েছে।

পার্ল টাওয়ার সাংহাই এর অবধারিত আইকন। কিন্তু লেখকের এই টাওয়ার দেখা নিয়েও বিপত্তি

“এমনিতে খুব উঁচু টাওয়ারের ওপরে ওঠার রোমাঞ্চ আমি এখন আর বোধ করিনা। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার, কুয়ালালামপুরের কে এল টাওয়ার বা টুইন টাওয়ারের চূড়ায় আমার ওঠা আছে। নিচে থেকে উপরকে যতটা রোমাঞ্চকর মনে হয়, উপরে ওঠার পর সেরকম কিছু মনে হয়না। সবগুলো টাওয়ারের ওপরেই একটা ডেক থাকে। কাঁচ দিয়ে ঢাকা। এর ভেতর দিয়ে নিচের শহরটাকে দেখা-এইতো!” (ভ্রমণ সমগ্র ২য় খণ্ড পৃঃ ৬৩)

লেখক পার্ল টাওয়ারের নির্মান শৈলী এবং অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের বিবরণ দিয়েছেন বেশ যত্নের সাথে। সেখানে তথ্য, উপাত্ব এবং নিজস্ব মতামত আছে; আছে বিশ্লেষণ।এক একটি গোলোকের বিবরন পড়ে অবাক না হয়ে পারিনা। দুর্মূল্যের রেস্তরা থেকে শুরু করে সুভেনির শপ সবই আছে! আমাকে অবাক করেছে পৃথিবীর সবচেয়ে উপরে ছোট্ট ডাক ঘরের বিবরন পড়ে। মন খারাপ হয়, ভ্রমণ সমগ্র গ্রন্থটিতে এই ডাকঘরের ছবি না থাকায়।

সিনতিয়ানতি

এক সময়ের প্রায় মৃতপূরী এখন প্যারিসের মত টুরিস্ট স্পট হয় ওথার গল্প আছে এই অধ্যায়ে। সে সাথে আছে নির্মাণ শইলির বিবরণ।

“সিনতিয়ানতির ডিজাইনে প্রাচ্যের সাথে পশ্চিমা ধারার সংমিশ্রণটি চোখে পড়ার মত। এখন সিনতিয়ানতি শুধু চীনের জন্য নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্যেই একটি অনন্য নিদর্শন।। ২ হাজার ২ সালে শেষ হয় আড়াই লাখ বর্গফুট এলাকা জুড়ে সংস্কারের কাজ। তারপর থেকে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এলাকাটি।” (ভ্রমণ সমগ্র ২ পৃঃ ৭০)

সাংহাই এর পিপলস স্কয়ার এক বিশাল চত্বর। এখানে আছে জাদুঘর যা প্রাচীন চীনের তেপায়া চুলার আদোলে তৈরি। আছে গ্রপ থিয়েটার। কিন্তু এতো সব কিছুর পরেও মানুষ এখানে আসে বিশেষ একটি কারনে।

“শিশুদের এমন প্রাণের আয়োজন দেখে যেন ছেলেমানুষি পেয়ে বসে ছেলেবুড়ো সবার। সাবানের পানি দিয়ে রঙিন বল বানানো শিশুদের ভারি পছন্দ। পুরো এলাকাটাতে ভাসতে থাকে রঙিন বল। আর শিশুদের এই পছন্দের সুযোগ নিচ্ছে ছোট বড় ব্যবসায়ীরা। দেদারসে বিক্রি হচ্ছে এই খেলনা। মা-বাবাদেরও না নেই। বাচ্চার পছন্দ বলে কথা।” (ভ্রমণ সমগ্র ২ পৃঃ ৭১)

এখানেই আছে ডান্সিং ফোয়ারা যেখানে কৃত্রিম ঝরনায় স্নাত হয় শিশুরা। পিপলস স্কয়ার এক উন্মুক্ত উদ্যান, এখানে মানুষ ঘুড়ি ওড়ায়, উন্মুক্ত বেঞ্চে বসে থাকে, চারদিকে বড় বড় স্পিকারে বাজতে থাকে চমৎকার সুর। এতো সব কিছুর পরেও এই পিপলস স্কয়ার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হাজির হয় অন্যরূপে। এটা হয়ে যায় এক ‘বিয়ের হাট’!

রাতের সাংহাই এবং নানজিং রোড নিয়ে লেখক সুবিশাল বর্ণনা দিলেও আমি খুব বেশি উল্লেখযোগ্য কিছু খুঁজে পাইনি। কিছু দালালের খপ্পরে পড়া এবং উইন্ডো শপিং এর স্ট্রিট মার্কেট। চীনাদের যে কোন জিনিসের রেপ্লিকা তৈরির দক্ষতা। মার্কেট গুলোতে চমৎকার পণ্যের সম্ভার এবং  দর দামের দক্ষতা না থাকলে ঠকে যাবার ভয়। মূলত এই বিষয় গুলো নিয়েই কথা হয়েছে। যে কোন জনবহুল বাণিজ্যিক শহর দিনের চেয়ে রাতে বেশি সুন্দর আর জৌলুস ধরে রাখে। সাংহাই তেও যে একই ঘটনা ঘটবে তা আর নতুন কি!

সিতাং

শহর দেখার পরে এবার দূর গ্রাম এবং শহরতলি দেখতে যাবার পালা। গাড়ি চলছে হাইওয়েতে। লেখকের খুব ইচ্ছে হল সাধারন একটি গ্রাম কভার করবে।  সেটা নিয়ে তাঁদের সফর সঙ্গী ‘কু’ কে বেশ কয়েকবার তাগাদা দিতে হল। এক সময় নির্ধারন হল তাঁরা ওয়াটার ভিলেজ দেখতে যাবে। কদিন আগে টম ক্রূজ এখানে এসে মিশন ইম্পসিবলের শুটিং করে গেছে। কিন্তু গ্রাম কই! বেশ কিছু ঘুপচি ঘুপচি ঘর। এঘর সেঘর ঘুরতে ঘুরতে এক সময় একটা গোল আকৃতির ব্রিজের কাছে এসে ওঠেন লেখক সেখানে তার বাকি দুই সফর সঙ্গী এবং কু কে পেয়ে যান। তাঁরা সকলেই মুগ্ধ হয়ে সেই ব্রিজ এবং খালটি দেখছে। পাশে একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে এম আই থ্রির ইথেন হান্ট অর্থাৎ টম ক্রুজ একটি শট দিয়েছিল। লেখকের মতে,

“এম আই থ্রির প্রোডিউসার এমনি এমনি এই লোকেশান সিলেক্ট করেনি। জায়গাটি কেবল যথেষ্ট সুন্দরই নয়, এ জায়গার মত বেশ কিছু ছবি আছে ভিউকার্ড, পোস্টারে, ক্যালেন্ডারে। ” (ভ্রমণ সমগ্র-২ পৃঃ ৮৯)

সিসিটিভির প্রতিনিধি তাঁদেরকে আধা ঘন্টা সময় দেন নিজের মত গ্রামটি ঘুরে দেখার। দুপুরের খাবার জন্য স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টকেও নির্ধারন করেন।

গ্রামটির প্রধান বিশিষ্ট এর চার দিকে জল আর জল। এপারের সাথে ওপারের সংযুক্তি ঘটিয়েছে কতগুলি কংক্রিট ব্রিজ। প্রায় সব গুলো ঘরের ছাদ টালি দিয়ে তৈরী। প্রতিটি ঘর একে অপরের সাথে লাগোয়া, তাই দেখে মনে হয় যেন পুরো গ্রামটাই একটা ঘর। অনেকেই ঘরের সাথে বাহারি জিনিসের পশরা নিয়ে বসেছে। দর দাম করেই কিনতে হয়। দর দাম হয় ক্যাল্কুলেটারে। সময় হয় মধাহ্ন ভোজের।

চীনের খাবার

প্রতিটি দেশের খাবারের মাঝেই কিছু বৈচিত্র থাকে। চীনা খাবারের মূল বৈচিত্র হল, এরা খাবার কে মনে করে শিল্প। খাবারের রঙ, ঘ্রাণ, স্পর্শ, স্বাদ এমনকি খাবারের শব্দের মাঝেও এরা শিল্পকে ধারণ করতে পারে।সব কিছুর পরেও চীনা খাবারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় এর পুষ্টিমান। তাই এই দেশের পুরুষের গড় আয়ু ৮০ বছর এবং মহিলাদের ৮২ বছর।

চীনারা খাবার খায় বাঁশ বা কাঠের তৈরি কাঠি দিয়ে। সেই কাঠি দিয়ে খাবার গ্রহণ রপ্ত করতে যেয়ে লেখককে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, এবং দু-এক বেলা উপাস থাকার পরিস্থিতেও তিনি পড়েন। বেইজিংএ অবস্থান কালে স্বর্না লেখক কে কাঠি দিয়ে খাবার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিল।

“পশ্চিমারা খাওয়া শিখেছে পশুর কাছ থেকে। পশু এক হাতে থাবা দিয়ে ধরে রাখে, ওপর হাতে তুলে নিয়ে মুখে পোরে। এজন্য তাঁরা ছুরি-চামচ দিয়ে মুখে পোরে খায়। আর চীনারা খেতে শিখেছে পাখির কাছ থেকে। পাখি যেমন দুই ঠোঁট দিয়ে খায়, চীনারও দুটো কাঠি জোড়া লাগিয়ে, ঠোঁট বানিয়ে খায়।” (ভ্রমণ সমগ্র-২য় খণ্ড পৃঃ ৯৫)

এই অধ্যায়টি পড়ে চীনাদের খাবার বিষয়ের বেশ কিছু আকর্ষণীয় তথ্য জানতে পারলাম। চীনারা তাজা খাবার খেতে পছন্দ করে। হোটেল বা রেস্তরায় অধিকাংশ টেবিল গুলো ৬ থেকে ৮ জনের বসার উপযোগী যেটা প্রমান করে চীনারা দলবেঁধে খাবার খেতে ভালোবাসে। থান্ডা পানি হজমে সহায়ক নয় এটা চীনাদের আদিকালের বিশ্বাস। আর তাই খাবারের সাথে উষ্ণ পানি, কিংবা চা অথবা স্যুপ খাওয়ার রীতি সুপ্রচলিত। সর্বভূক হিসেবেও এদের সুনাম আছে। বিচিত্র  শাক-সবজি, লতা-পাতা এবং প্রায় সব রকমের প্রানী এদের খাদ্যতালিকার অংশ। খাবারের দুটি অংশা, ‘জুশি’ জেটা ভাত বা নুডুলস আর ‘চাই’ হল শাকসবজি এবং প্রোটিনের অংশ।

খাদ্য গ্রহনের সময়টিও উল্লেখযোগ্য, সকালের নাস্তা ভোর ৬টা থেকে ৭টায় শেষ হয়। দুপুরের খাবার ১১টা থেকে ১২ টার মধ্যে আর রাতের ডিনার ৬টা থেকে ৭টায়। রাতের খাবার গ্রহণের অন্তত তিন ঘন্টা পর তারা ঘুমোতে যায়।

এখনো অনেকটা পথ বাকি, যাত্রা পথে নানা খাবার খেতে হবে এগিয়ে যেতে হবে নতুন গন্তব্যে। এবারের স্পট হাংজো।

হাংজো ওয়েস্ট লেক

সফর সঙ্গী হিসেবে কু সাথে থাকলেও চেং নামের একজন নতুন গাইড নেওয়া হল। সেই গাইড গাড়িতে উঠেই একটি কথা বলে লেখকদের মুগ্ধ করে দিলেন, “দেয়ার ইজ আ চাইনিজ সেইং- দ্যাট, আপ এভাব দি হ্যাভেন, গ্রাউন্ড বিলো ইজ হাংজো”।

কেবল এই চৈনিক উক্তি নয়, ভূ-পর্যটক মার্কো পলো চীনে বেড়াতে এসে এই শহরটিকে দেখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এখানে একটি লেক আছে। লেখকদের কাছে বিচিত্রহীন একটি খাল মনে হলেও তাঁরা জানতে পারলেন এই এলাকার কৃষি কাজে এই লেকটি অনেক বড় ভুমিকা রেখে এসেছে শতাব্দী ধরেই। কিন্তু একটু একটু করে ফুলের পাঁপড়ি উন্মচনের মত করে লেক এবং এর ইতিহাস লেখককে মুগ্ধ করে, এই সংক্ষিপ্ত সফরে তাঁর তৃষ্ণা মেটেনা। তিনি কু’কে জানান, “কাল ভোর ছয়টায় আমার গাড়ি লাগবে। আমি একাই আসব এখানে।” (ভ্রমণ সমগ্র-২য় খণ্ড পৃঃ ১০২)

কুয়াশায় আচ্ছন্ন হাংজোর ছবি নাকি ভালো আসবেনা, এই ভেবে দলের অন্য কেউ সেই ভোরে ছবি তুলতে যাননি। কিন্তু লেখক ঠিকই চলে গেলেই।

“ভোর বেলায় হাংজো অন্যরকম এক সৌন্দর্য নিয়ে আমার কাছে  এসে হাজির হল।এই লেকে কিছু বিশাল আকৃতির পদ্ম ফুল দেখে মুগ্ধ হলাম। কেবল ফুল নয় পাতাগুলোও বেশ বড়। দুই থেকে তিন ফুট ব্যাসের পাতা। এই লেকের পাড়ে বেশ কিছু তুঁত গাছ আছে। সেই তুঁত গাছে রেশম পোকা বাসা বাঁধে।” (ভ্রমণ সমগ্র-২য় খণ্ড পৃঃ ১০৫)

রেশম নগরী

সিল্ক, চীনাদের অহংকারের বিষয়। পড়ে অবাক হলাম, আবিষ্কারের পর প্রায় তিনশ বছর তাঁরা এই উপায় নানা ভাবে গোপন রেখেছিল বিশ্ববাসীর কাছ থেকে। এখন চীনারা অনেক উন্মুক্ত, রেশম নগরীর জাদুঘরে গিয়েই সেটা বুঝতে পারলেন লেখক। মুগ্ধ হয়ে রেশম নগরী এবং জাদুঘর দেখলেন, সে সাথে বিপণী বিতান গুলোতে সিল্ক পণ্যের উচ্চমূল্য দেখেও বেশ অবাক হলেন।

ভ্রমণের ওপর এই গ্রন্থটি পড়ে আমার মনে হতে থাকে, কেবল হাংজো নিয়েই একটি বই লিখে ফেলা যায়। এখনো চীনের চা নিয়ে অনেক কিছু জানার বাকি, দেখার বাকি লেখকদের। এবারে আসা যাক চা জাদুঘরে।

চায়ের চীন

চীনাদের কাছ থেকে যে সারা বিশ্ব চা পান শিখেছে এটা সার্বজনীন।চীনারা চা পাতার নির্যাস ব্যবহার করে আসছে প্রায় ছয় হাজার বছর থেকে। আর চীনে, চা এর উদ্ভব হয় হাংজো এলাকায়। এই চা’এর বিশ্বায়ন করে ব্রিটিশরা। এক সময়ে লেখক জাদুঘর দর্শনে যান। সেখানে কু’র বলা কিছু তথ্য অত্যন্ত চমকপ্রদ ছিল।

পাতার বয়স ও পরিপক্কতা ভেদে চা এর স্বাদ এবং মূল্য নির্ধারিত হয়। ওয়াইট টি নামের যে চা, সেটা চা গাছের একেবারেই কচি পাতা, যেখানে অক্সিডেশান করা হয়নি। বাংলাদেশি মূল্যে ১ কেজি ওয়াইট টি এর দাম আসে ৩৩ হাজার টাকা। এটাকে ‘বালিকা চা’ও বলা হয়। ওয়াইট টির পর গ্রিন টি’র স্থান, ‘তরুণী চা’। সামান্য মাত্রার অক্সিডেশান থাকে। এভাবে অক্সিডেশানের মাত্রা বাড়িয়ে তৈরি হয় উলং টি। শেষ ধাপ হল ব্লাক টি। ব্রিটিশদের কাছে এই চা টাই সবচেয়ে প্রিয়।

জাদুঘর দেখা শেষ। হাংজো এর অধ্যাটিও শেষের পথে। লেখকের মন চাইল হাজোং এর পুরনো শহরটি আবার একটু দেখে যেতে। ভালো মানের চা এবং চা’এর তৈজস কেনাও এর অন্যতম উদ্দ্যেশ্য। একটি দোকানের সামনে মিষ্টি সুরে এক তরুণীকে গান গাইতে দেখে লেখক থেমে গেলেন। তাঁর আর বাজার ঘুরে দেখা হলনা। লেখক মেতে উঠলেন সেই তরুনী যার ইংরেজি নাম ক্যান্ডি এবং তার  বাঁশিবাদক  বাবার সাথে আলাপ চারিতায়। ক্যান্ডি কিছু ইংরেজি জানে, সেই জ্ঞান থেকেই অনুবাদ করে দিল মিষ্টি জ্ঞান টার।

“নদীর দিকে চেয়ে মেয়েটি নদীকে ডাকছে, নদী যেন তাঁর স্রোতের সঙ্গে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।”   (ভ্রমণ সমগ্র-২ পৃঃ ১১৫)

মনেহয় পৃথিবীর সব পল্লীগীতিগুলো একরকম, যেখানে থাকে বহমান নদীর কথা, একাকিত্বের কথা। ক্যান্ডি এবং তার বাবার কাছ থেকে চা এর পাত্র কিনে, এই মিষ্টি গানটির দুটো ফুটেজ এবং অনেকটুকু মিষ্টি সুর বুকের ভেতর ধারণ করে লেখক এবং তাঁর দলের ‘মিং রাজের দেশে’, শিরোনামের লেখার সমাপ্তি ঘটে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য
Loading...