ক্লাস সেভেন ১৯৭৮-মোফাজ্জল করিম

 ক্লাস সেভেন ১৯৭৮: কুসুমফোটার কাল

শাকুর মজিদ ১৯৭৮ সালে, ডানে

শাকুর মজিদের ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’ পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, ওটা কি শাকুরের ক্লাস সেভেন, না আমার ক্লাস সেভেন। বইটির পাতায় পাতায় যে কিশোরবেলার চিত্র ফুটে উঠেছে তা আমার বা অন্য যে কোন কারো কুসুমফোটার কাল হতে পারে। বইটির নাম যদি ক্লাস সেভেন ১৯৫২ হতো তা হলেও আমি আপত্তি করতাম না ;’ ৫২ সালে আমি ক্লাস সেভেনের ছাত্র ছিলাম। অবশ্য আমাদের স্কুল কোন ক্যাডেট কলেজ ছিল না, ওটা ছিল বগুড়া জিলা স্কুল। ওটা কোন আবাসিক স্কুল নয়, আমিও থাকতাম না কোন ছাত্রাবাসে। আমাদের জীবন এমন কোন লৌহকপাটের অন্তরালের হুইসেলবাজা ঘন্টিবাজা বন্দীত্বের নিয়ম-কানুনের নিগড়ে বাঁধা ছিল না। তবুও যাহা বাহান্ন তাহা তেপ্পান্ন, থুড়ি আটাত্তর।
বইটিতে একটি মেধাবী কিশোরের জীবনের একটি বিশেষ সময়ের কাহিনী তারই মুখে বর্ণনা করা হয়েছে। সে কাহিনী বিস্তৃত দু’টি স্থানে : একটি বাংলাদেশের সিলেট জেলার এক অজ্ঞাত অবজ্ঞাত গ্রাম মাথিউরা, আরেকটি চাটগাঁর ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ। মাথিউরা হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীর প্রথম বালক শাকুরের মনে প্রবল আকাক্সক্ষা, চোখে উথাল-পাথাল স্বপ্ন, সে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়বে। তার বাবার ইচ্ছাও তাই। একদিন পত্রিকার পাতায় ভর্তি পরীক্ষার ফল বেরুলো। দেখা গেল, সবাইকে চমকে দিয়ে সেই অজ্ঞাতকুলশীল গ্রামের হাইস্কুলের রোগা-পাতলা ছেলেটি পাশ করেছে ভর্তি-পরীক্ষায়। সেই থেকে শুরু এক নতুন জীবনের, সেই থেকে বদলে গেল চেনা জগতটাই।

শাকুরের বইয়ের সবচেয়ে মজার দিক হল, আমরা যারা কোনদিন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ত্রিসীমানাও মাড়াইনি তাদেরও মনে হবে আমরাই যেন শহীদুল­াহ হাউসের বাসিন্দা, আমরাই যেন ‘গেমস্’- এর জন্য ছুটে যাচ্ছি মাঠে, খেতে বসেছি ডাইনিং হলে, ভয়ে সিঁটকে আছি কোথায় কোন সিনিয়র ভাইয়ের হাতে ধরা খেয়ে তুচ্ছ কারণে ফ্রন্ট রোল-ব্যাক রোল বা অন্য কোন শাস্তি ভোগ করতে হয়। আমার খুব কষ্ট লেগেছে শাকুর যখন প্রথমবার ছুটিতে বাড়ি গেল কলেজ থেকে তখন তার সেই ‘ওডিসি’-র বর্র্ণনা শুনে। কলেজ থেকে চাটগাঁ, চাটগাঁ টু শ্রীমঙ্গল, শ্রীমঙ্গল টু বিয়ানিবাজার ইত্যাদি হয়ে কখনো ট্রেনে, কখনো বাসে, আবার কখনো পায়ে হেঁটে অথবা নৌকায় দু’দিন পর মাথিউরা। যে মাথিউরার চারপাশটাতে বলতে গেলে বারমাসই থৈ থৈ পানি আমার নিজের গ্রাম কুলাউড়া উপজেলার বেরকুড়ি গ্রামের মত। অনেকদিন, হ্যাঁ, মা’কে ছেড়ে দু’মাস তো অনেকদিনই, পর বাড়ি ফিরে মায়ের দেখা পাওয়ার পরের অনুভূতি, তার ও তার মায়ের, এটা,‘ আমার মনে হয় শাকুর আমাদের একটু বিশদভাবে জানালেই পারতেন। সব কিছু ছাড়িয়ে কিশোর শাকুরের সংবেদনশীল মনের ছাপ আমরা পাই বইয়ের পাতায় পাতায়। কখনো তা তার বাশার ভাইয়ের সঙ্গে চির বিচ্ছেদব্যথা, কখনো সহপাঠী দলিলের কলেজত্যাগে বাধ্য হওয়ার দৃশ্যে।
আরেকবার আমার কষ্ট লেগেছে যখন জানলাম আমাদের নায়ক শাকুর প্রথম টার্মের পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করেছে। নায়কের ১৯ নম্বর হওয়া মানায় না, মেনেও নেয়া যায় না। পড়তে পড়তে দোয়া করলাম মনে মনে শাকুর যেন পরের পরীক্ষায় ভাল করে। পাঠকের যা হয় আর কি। নায়কের কষ্টে কষ্ট পাওয়া, খুশিতে খুশি হওয়া, নায়কের মঙ্গল কামনা করা।
আবারও বলি, ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’-এর প্রচ্ছদে আঁকা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আমরা শুধু শাকুরের ক্লাস সেভেনের দিনগুলোকেই দেখি না, আমাদের সবার ক্লাস সেভেনকেও যেন আমরা দেখতে পাই উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রার মত শাদা শাদা ডানা মেলে ওড়াউড়ি করছে ঐ দূর নীল আকাশে।
অন্যপ্রকাশের মনকাড়া কাগজ, ছাপা সবই সুন্দর, মন-খারাপ-করা ছাপার ভুল নেই বললেই চলে। তবে সবচেয়ে সুন্দর, ভারী সুন্দর, প্রচ্ছদটি।
শাকুর, আপনি সেভেন-এর পর এইট, নাইন, টেন, টুয়েলভ লিখবেন কবে ? প্রত্যাশায় আছি। দেরি করবেন না কিন্তু।
আমি না বললেও জানি অগণিত পাঠক আগ্রহ নিয়ে পড়বেন বইটি। বিশেষত শিশু-কিশোররা। দাম ? ১৩০ টাকা ঠিকই আছে। চিনেবাদামের কেজিই তো এখন ১২০ টাকা !

.. .. .. .. .. .. .. .. ..

মন্তব্য
Loading...