ক্লাস সেভেন ১৯৭৮- আলম খোরশেদ

ক্লাস সেভেনের মিস্টার শাকুর

শাকুর মজিদের নামটার সঙ্গে পরিচয় প্রধানত টিভি নাটকের সূত্রে। তিনি পেশায় স্থপতি এ-খবরটাও জানা ছিল। আর ’আমিরাতে তেরো রাত’ নামে তার একখানা অনুপ্রাসধ্বনিত ভ্রমণপুস্তিকাও সম্ভবত চোখে পড়েছিল কোথাও। কিন্তু তিনি যে অন্য এক সূত্রে আমার পরমাত্মীয়, সেটা আবি®কৃত হলো এই তো সেদিন, ফৌজদারহাট কেডেট কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে। সেখানে তার সঙ্গে পরিচয় হবার পর পরম বিস্ময়ের সঙ্গে জানলাম তিনিও আমার মত এই দেশবিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র। আমি যে-বছর পাঠ সাঙ্গ করে এই কলেজের চৌকাঠ ডিঙোই সেই ১৯৭৮ সালেই সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী হিসাবে ভীরু পায়ে সেখানে প্রবেশ করেছিল আজকের এই খ্যাতিমান নাট্যকার ও স্থপতি শাকুর মজিদ। এবং আরো আশ্চর্যের বিষয় সে নাকি স¤প্রতি কেডেট কলেজে তার সেই সপ্তম শ্রেণির অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে একখানি বই লিখে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে! বইটার নাম ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’। সেদিনের পুনর্মিলনীতে সমবেত প্রায় সকলের হাতেই দেখি এই বই। একাধারে কলেজ-অগ্রজ এবং অগ্রজ লেখক হবার সুবাদে একখানা বই তার কাছ থেকে উপহার পেয়ে কৃতার্থ হই।


বাড়ি ফিরে প্রায় এক বসায় পড়ে ফেলা গেল বইটি। এর পেছনে গ্রন্থটির বিষয়-উপজীব্যর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতি-কৌতূহলের সম্পর্কটি প্রধান হলেও লেখকের গদ্যশৈলীর আকর্ষণ ও দুর্লভ প্রসাদগুণের ভূমিকাও একেবারে কম ছিল না। শাকুর যে সময়টির কথা লিখেছে তার এই বইয়ে সেটি আজ থেকে পাক্কা ত্রিশ বছর আগেকার কথা। সঙ্গত কারণেই এর অনেক কিছুই স্মৃতির ঝাঁপি থেকে খসে পড়েছিল। কিন্তু শাকুরের স্বাদু আর সানুপুঙ্খ বর্ণনার মাহাত্ম্যে সেসব এমন স্বচ্ছ, স্পষ্ট ও প্রায় স্পৃশ্যরূপে চোখের সামনে পুনরায় ধরা দেয় যে মনে হয়, ১৯৭৮ নয়, তার থেকে আরো ছয় বছর পিছিয়ে, ১৯৭২ সালে কলেজে প্রবেশ করা সপ্তম শ্রেণির আরেক কিশোর শিক্ষার্থী, অর্থাৎ আমারই কোন না-লেখা দিনলিপি বুঝি পাঠ করছি আমি। এই গ্রন্থের সবচেয়ে শক্তিমত্তার জায়গাটি সম্ভবত শাকুরের অসাধারণ সারল্য আর পরিহাসপ্রিয়তা। সিলেটের এক অজপাড়াগাঁর ছেলে শাকুর। মুখভরা তার মুজতবা-কথিত কমলালেবুর ঘ্রাণ অর্থাৎ সিলেটি আঞ্চলিক ভাষার টান। তদুপরি সে সাধু ভাষায় কথা বলে, রেডিও ছাড়া সে নাকি চলিত বাংলার কথাই শোনে নি কারো মুখে। সেই শাকুর কেডেট কলেজের মত অভিজাত, ধোপদুরস্ত এক প্রতিষ্ঠানে পড়তে এসে যে নাকানিচোবানি খেয়েছে সেসব কথা সে অকপটে কবুল করেছে, কোন রাখঢাক না করেই। আর সবকিছুতেই প্রসন্ন কৌতুক ও পরিহাসের প্রলেপ মাখিয়ে দিতে পারঙ্গম সে, যা তার লেখাকে করে তোলে সরস ও আদ্যন্ত উপভোগ্য।


শাকুরের লেখার কল্যাণে আমি ফিরে পেয়েছি আমার ফেলে আসা সেই সুবর্ণ দিনগুলোর অজস্র হিরন্ময় স্মৃতি। তার লেখা আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের, বিশেষ করে ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, যেমন নাসির স্যার, হাসান স্যার, নজরুল ইসলাম স্যার, রফি ইমাম স্যার, ওহাবুজ্জামান স্যার প্রমুখের কথা। আমার জীবনে তাঁদের অপরিমেয় অবদানের জন্য এই সুযোগে সেইসব দেবতুল্য শিক্ষকদের জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি। মজার ব্যাপার হলো, বইখানা পড়তে গিয়ে এক জায়গায় নিজের নামোলে­খ দেখতে পেয়ে অনাবিল পুলক অনুভব করেছি। শাকুরের বর্ণনা থেকে জানতে পারি সে আমাদের প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া ‘পোয়েট্রি সোসাইটির’ সদস্য ছিল এবং এই সূত্রেই সে পোয়েট্রি সোসাইটি থেকে প্রকাশিত কবিতা মাসিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসাবে এই অধমের নামটি বেশ সমীহাভরে উলে­খ করেছে। সে কি জানতো একদিন তার বইয়ের আলোচনা লেখার কাজে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসবেন সেই অদেখা অগ্রজ সম্পাদক! তা সমালোচনার প্রসঙ্গ যখন উঠলোই তখন বলি, শাকুরের সঙ্গে কথা বলে তার মুখে কোন কমলালেবুর গন্ধ পাই নি বটে, তবে তার বইয়ে কিন্তু ‘বুলায়’, ‘ঝুলানো’, ‘চুবানি’, ‘উঠাতে’ জাতীয় শব্দের খোসা ভেদ করে সেই সুঘ্রাণ মাঝেমধ্যেই ভেসে ওঠে। কিন্তু এহ বাহ্য, বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে কেডেট কলেজসমূহের যে অনন্য ও অবিকল্প অবস্থান সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য এই বইটি কেডেট কলেজের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সম্পর্করহিত সকলেরই অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। বিশেষ করে এই মুহূর্তে ক্লাস সিক্স-এ পড়া যেসব কিশোর কেডেট কলেজে ভর্তি হবার স্বপ্ন দেখছে, এই গ্রন্থপাঠ তাদেরকে সেই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

মন্তব্য
Loading...