ডায়েরি মানুষের জীবনের টুকরো টুকরো স্মৃতির সংগ্রহশালা। বয়ে চলা জীবনের ফাঁকে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা, অনুভূতি, না বলা কথা কিংবা আনন্দ আর বেদনার কাব্য মানুষ লিখে রাখে ডায়েরির পাতায়। ডায়েরির একেকটি পাতা যেন একেকটি স্মৃতির শহর। কিন্তু যদি সে শহরটি হয় সেনা নিয়ন্ত্রিত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তবে তার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে অজস্র স্মৃতি। যে স্মৃতিগুলো অন্যসব স্মৃতি থেকে আলাদা। শাকুর মজিদের “ক্যাডেটের ডায়েরি” তেমনি এক অনন্য রোজনামচা যেখানে উঠে এসেছে ক্যাডেট জীবনের বিচিত্র ঘটনাবলি। কৈশোরে বাবা মাকে ছেড়ে যে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে হয় আধাসামরিক চৌহদ্দিতে, সেখানে মনের কথাগুলো লিখে রাখার সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম ডায়েরি। ছোট ছোট অভিমান, অনুযোগ, আক্ষেপ, মজার ঘটনা, অভিজ্ঞতা , দৈনন্দিন কার্যক্রম, বন্ধুত্ব, দুষ্টুমি, অ্যাডভেঞ্চার, কঠোর নিয়মাবুর্তিতা, সবকিছু মিলিয়েই এ জীবন। আর সে জীবনের না না ঘটনা যখন লিপিবদ্ধ হয় ডায়েরির পাতায় তখন তা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। বইয়ের শুরুতে জানা যায় ক্যাডেট কলেজে পড়ার প্রথম দিন থেকেই তাঁকে ডায়েরি লেখানোর অভ্যাস করানো হয়েছিল। শিক্ষক আক্কাস আলীর কাছ থেকে ডায়েরি লেখার অনুপ্রেরণা পান ক্যাডেট জীবনের একদম প্রথমেই। যদিও মূল ডায়েরি শুরু হয় ১৯৮০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে, যখন তিনি নবম শ্রেণির একজন ক্যাডেট। শুরুটা হয় ভ্রমন কাহিনী দিয়ে। কোন এক শীতের ছুটি শেষে কলেজে প্রত্যাবর্তনের পর নতুন ক্লাসে নতুন করে জীবন শুরু করার মধ্য দিয়ে ডায়েরির সূচনা। এরপর ক্রমান্বয়ে এক কিশোরের সাথে পরিচয় ঘটে, যে কখনো তার পরিবার নিয়ে চিন্তিত, কখনো বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া সামান্য কষ্টে ম্রিয়মাণ। কারো কাছেই যখন সে মনের কথা গুলো বলতে পারছে না, তখন ডায়েরিই হয়ে উঠছে তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। তিনি লেখেন, আজ “ম” আমার সঙ্গে বেইমানি করল। আমি নতুন দুইটা খাতা তার কাছে রাখতে দিয়েছিলাম গত টার্মে। আজ যখন খাতা গুলো চাইলাম, বলে কি না ওগুলো ফেরত দিয়ে দিয়েছি। ও একটা মিথ্যাবাদী। আমি ওকে উচিৎ শিক্ষা দেব। অথচ আজ অংক পরীক্ষায় আমি ওকে ৫০ নম্বরের অংক দেখিয়েছি।( ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮০)
এখানে চিরচেনা এক অভিমানী কিশোরের দেখা মেলে, যার পরানের গহীন ভেতরে হাহাকারগুলো যেন এক হয়ে মিশে আছে। বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া দুঃখ লিখে রাখছে ডায়েরির পাতায়। দেখা মেলে পরিবারের চিন্তায় বিভোর এক কিশোরকে। যে তাঁর দৈনন্দিন না না কাজের ভিড়েও পরিবারের সদস্যদের ভালো মন্দ নিয়ে ভাবছে। তিনি লেখেন, শনিবারে সূর্য গ্রহন হবে। সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। বাড়ির জন্য চিন্তা করছি। বাড়িতে খবর পাঠাই কি করে? এখন চিঠি লিখলে শনিবারের আগেতো পাবে না। বাড়িতে ওরা যদি সূর্যের দিকে তাকায়, তবে তাদের রেটিনা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। (১৪ ফেব্রুয়ারি,১৯৮০)। আবার কখনো মা, কখনো বাবা, কখনো ছোট ভাই কিংবা বোনের জন্য তার প্রাণ কেঁদে মরে। প্রতিটি অনুভূতিই প্রবল হয়ে ধরা দেয় তাঁর কাছে। নতুন ক্লাসে উঠলে ক্যাডেটদের নতুন অ্যাপুলেট দেয়া হয়। সে আনন্দের কথাও লিখতে ভোলেননি ডায়েরিতে। মূলত ক্যাডেট কলেজের দৈনন্দিন জীবনের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে পি টি, প্যারেড, খেলাধুলা, শরীরচর্চাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। তাই ডায়েরির অধিকাংশ জায়গাতেই প্রাধান্য পেয়েছে এসবের কথা। কোন কোন দিনের সূচনা হয়েছে পিটি হয়েছে কি না, প্যারেড কেমন হলো, শীতের মাঝেও খুব সকালে দৌড়াতে কষ্ট হয়েছে এসবের মাধ্যমে। এর ফাকে ফাকে আছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার কথা। কখন কোন হাউস বিজয়ী হলো। এসব। বলাবাহুল্য ক্যাডেটদের আবাসিক বিল্ডিং গুলোকে হাউস বলা হয়। এবং বিভিন্ন হাউসের ক্যাডেটদের মাঝে না না প্রতিযোগিতা হয় বছর ব্যাপি। এছাড়া প্রথম বারের মতো ক্রিকেট ব্যাট হাতে ধরা, প্রথম সিগারেট খাওয়ার অনুভূতি, প্রথম স্টেজে ওঠার অনুভূতি, প্রথম মেরিন অ্যাকাডেমি ভ্রমন সবকিছুই স্থান পেয়েছে ডায়েরিতে। কখনো তিনি পানিশমেন্ট দিচ্ছেন, কখনো পানিশমেন্ট খাচ্ছেন। সবই লিখেছেন অকপটে। ডায়েরি যেন হয়ে উঠেছে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এক অদম্য মেধাবী কিশোরের দেখা পাওয়া যায় ডায়েরিতে। যে বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি লেখাপড়াতেও বেশ মনোযোগি। অবসরে যিনি অংক করতে বসে যান, কিংবা ভবিষ্যতে কি করবেন তা নিয়েও ভাবেন। কখনো তিনি প্রতিজ্ঞা নিচ্ছেন ভালো রেজাল্ট করার, আবার সফলও হচ্ছেন। বোর্ড পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করছেন। কোন পরীক্ষায় কতো নাম্বার পাচ্ছেন তাও লিখেছেন ডায়েরিতে। কখনো কখনো ডায়েরির নিষ্প্রাণ পাতা জুড়ে দারুণ হাহাকার। প্রতি মাসে একবার ক্যাডেট কলেজে অভিভাবক সাক্ষাতকার দিবস হয়। যা “প্যারেন্টস ডে” নামে পরিচিত। এ সময়ে ক্যাডেটদের অভিভাবকেরা খাবার নিয়ে ক্যাডেটদের সাথে দেখা করতে আসে। লেখকের বাবার জাহাজের চাকুরীর সুবাদে প্রায়ই তিনি দেশের বাইরে থাকতেন। তাই এদিন লেখককে দেখতে কেউ আসতো না। স্বভাবতই তাঁর মন খারাপ হতো। তিনি ডায়েরিতে লিখে রাখতেন এভাবে,
আজ মাসের শেষ রোববার। প্যারেন্টস ডে। মনে মনে ভেবেছিলাম আমার কেউ হয়তো আসতে পারেন। না, কেউ এলেন না। কে-ই বা আসবে? প্যারেন্টস ডে-তে প্যারেড গ্রাউন্ড ভরে যায় গাড়িতে। ক্যাডেটদের বাবা মা গাড়ি করে আসেন। গাড়িতে বসে বসে ছেলেরা খায়। আমি তাকাই না। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।
এই অংশটুকু পড়ে মন ভিজে যায়। সেনা শাসনে আবদ্ধ কিশোরের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হয়। নিজে ক্যাডেট থাকার কারণে আরো বেশি খারাপ লাগা কাজ করে। কারণ প্রতিটি ক্যাডেটের অনুভূতিগুলো একই রকম। ডায়েরি ফিরিয়ে নিয়ে যায় স্মৃতিময় সেসব দিনগুলোতে। মনে হয় এ যেন আমার ক্যাডেট জীবনেরই ডায়েরি। মুজা দিয়ে বল বানিয়ে রুম ক্রিকেট খেলা, রাতের অন্ধকারে ডাব চুরি, একটু সিনিয়র হলে প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে কলেজের বাইরে যাওয়া, সবকিছুই লেখা আছে ডায়েরিতে। আবেগতাড়িত ভাষায়। কঠোর নিয়মের মাঝে থেকেও কৈশোরের এই অ্যাডভেঞ্চারগুলো মনকে আন্দোলিত করে। লেখক এসেছিলেন নিতান্তই গ্রাম থেকে। শহুরে ছেলেদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তাকে নিত্য নিয়ত সমৃদ্ধ করতে হয় নিজেকে, সেসবের কথাও লিখেছেন ডায়েরিতে। লিখেছেন নিয়ম ভাঙার কথা। বাধ্যতামূলক মাগরিবের নামাজে না গিয়ে লুকিয়ে থেকে ধরা পড়ার কথা, কিংবা বন্ধুর কাছে কাগজ চেয়ে না পেয়ে বেদনায় মুষড়ে যাবার কথা। সপ্তাহে একবার নিয়মিত সিনেমা দেখানো হতো ক্যাডেট কলেজে। সিনেমা দেখে তার অনুভূতি লিখে রাখছেন। আবার ছুটিতে এলে সিনেমা হলে সিনেমা দেখছেন বন্ধুদের সাথে। পুরনো বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠছেন, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছেন, আবার ছুটি শেষে কলেজে ফিরে আসার সময়ে বিদায়ের শোকে মুহ্যমান হয়ে যাচ্ছেন। সবকিছুর নিরব সাক্ষী যেন ডায়েরি। আবার কখনো কিশোর ডায়েরি লেখক যেন দার্শনিক হয়ে ওঠে। জীবন সম্পর্কে না না প্রশ্ন তাকে ঘিরে ধরে। তিনি লেখেন, আমাদের জীবনটা কী? কোথা থেকে এসেছে? বিরাট নীল আকাশের নিচে চলার জন্য আমরা কোথা থেকে শক্তি পাই? বুঝতে পারি না। (৪ এপ্রিল, ১৯৮০)
পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী এক কিশোর কখনো বাবার চিঠির জন্য অপেক্ষা করে, কখনো বাসা থেকে চিঠি না এলে উৎকণ্ঠায় ভোগে। কখনো জুনিয়রকে কঠিন পানিশমেন্ট দিয়ে অনুতপ্ত হয়। এ যেন মানব মনের বিচিত্রতা। যে মন কখনোই স্থির নয়। তাই শেকল বন্দি যান্ত্রিক জীবনেও নস্টালজিক হয়ে যায়। তিনি লেখেন,
আজ সকালে বৃষ্টি হলো। পিটি হয়নি। বৃষ্টি হলেই বাড়ির কথা মনে পড়ে। আমাদের টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে। আমি দাদার সঙ্গে বসে গল্প করি। দাদা কলকাতার গল্প শোনান। কতদিন দাদার গল্প শুনি না।
পুরো ক্যাডেট জীবনের খণ্ড চিত্র তাঁর এই ডায়েরি। এক ব্যাচের বিদায়, অন্য ব্যাচের আগমন। শিক্ষা সফরে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা, ক্লাব সোসাইটি, পরীক্ষা, অধ্যক্ষের বিদায়, নতুন অধ্যক্ষের আগমন, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়া, বিভিন্ন মঞ্চ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া, বন্ধুদের সাথে বাজি ধরা, আড্ডা মুখর রাত, সবকিছু তুলে ধরেছেন ডায়েরিতে। সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনারও দেখা মেলে এখানে। জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ড, সামরিক শাসন, এরশাদের রাষ্ট্র পরিচালনাসহ সকল বিষয়েরই খোঁজ খবর রাখতো এ কিশোর। তার দেখা মেলে ডায়েরির পাতায় পাতায়। এছাড়া এক সংস্কৃতিমনা বন্ধুপ্রিয় কিশোরকে পাওয়া যায়। যে কলম বন্ধুর কাছে চিঠি লেখে, ঈদ সংখ্যা পড়ে, সিনেমার নায়ক নায়িকার অটোগ্রাফ সম্বলিত টাকা সযত্নে রেখে দেয়। যে কিশোরের স্বপ্নালু চোখে দোলা দেয় বড় উপন্যাসিক হবার স্বপ্ন। আবার কাপ্তাই বাঁধে বেড়াতে গেলে তাঁর ছোড়া ইটের আঘাতে বন্ধুর মাথা কেটে রক্ত বের হলে অনুতপ্ত হন তিনি। মাঝে মাঝে ক্যাডেট কলেজের নিয়ম কানুনের ওপর বিরক্ত হন তিনি। তাও লেখেন অকপটে। লেখেন নিজের দারিদ্র্যের কথা। ফটোগ্রাফির শখ থেকে ক্যামেরার প্রতি আসক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে ক্যামেরা আর পাওয়া হয় না তার। তাই তিনি প্রতীজ্ঞা করেন, তিনি যখন বাবা হবেন তখন তার ছেলেকে প্রথমেই ক্যামেরা কিনে দেবেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিবাহিনীর কাছে বন্দী থাকা অবস্থায় আনা ফ্রাঙ্ক যেমন তার কিশোরি মনের অনুভূতিগুলো লিখে গেছেন ডায়েরিতে, সেভাবে শাকুর মজিদও সেনা নিয়ন্ত্রিত চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে লিখেছেন তার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো। নবম শ্রেণিতে যে ডায়েরি লেখা শুরু করেন সে ডায়েরি শেষ হয় ২৪ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে, তখন তিনি দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়েন। যদিও এরপরেও তিনি ডায়েরি লিখেছিলেন কিন্তু তা হারিয়ে ফেলায় বইয়ে সংযুক্ত করতে পারেন নি। ডায়েরি ছাড়াও বইয়ে আছে লেখকের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের কিছু আলোকচিত্র, ক্যাডেট থাকাকালীন কিছু ছবি, তৎকালীন শিক্ষকদের ছবি এবং কলেজের বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত লেখকের কিছু লেখা। সবমিলিয়ে “ক্যাডেটের ডায়েরি” ক্যাডেট জীবনের এক অনন্য স্মৃতিস্মারক, অনবদ্য দলিল। যেকোন ক্যাডেটের জীবনের সাথেই যা হুবহু মিলে যাবে। এছাড়া ভবিষ্যতে যারা ক্যাডেট কলেজে অধ্যয়ন করতে চায়, তাদের জন্যেও এটি এক অসাধারণ বই। ত্রিশ বছর আগে তিনি ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়েছেন। জীবনানন্দের কুড়ি বছর পরে কবিতার মতো তার জীবনও বয়ে গেছে প্রবাহমান ধারায়। কিশোর বয়সে যে স্বপ্ন তিনি লিখেছেন ডায়েরিতে তা সবই বাস্তবায়ন করেছেন। জীবন পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ডায়েরিটি তাই অনন্য অনুপ্রেরণাও বটে।
অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত বইটির মূল্য ২২৫ টাকা।