ক্যাডেটের ডায়েরি – মোঃ সাইদুল হক

ওটা সব ক্যাডেটেরই ডায়েরি

আলোচনাঃ  ক্যাডেটের ডায়েরি
লেখকঃ শাকুর মজিদ
প্রকাশকঃ  অন্যপ্রকাশ, প্রচ্ছদঃ মাসুম রহমান, পৃষ্টা সংখা ১৩৬, মূল্যঃ ২২৫ টাকা

ডায়েরি  তো আমারও ছিলো, প্রতিবছরই একাধিক ডায়েরি  আমি কলেজে নিয়ে গেছি। কোথায় সেগুলো চলে গেছে বলতে পারবো না। ক্লাস সেভেনে প্রথম প্রথম দুই চার দিন এলো মেলো কিছু লেখার চেষ্টা করেছি কিন্তু তারপরে আর হয়নি, হয়না আমার মতো হাজার জনের। কিন্তু শাকুর ভাইয়ের হয়েছিলো, কিভাবে টানা ছয় বছর প্রতিদিনের দুই একটা ঘটনা চার পাঁচ লাইনে হলেও লিখে গেছেন, এটা অবাক করেছে আমাকে। আরো অবাক হয়েছি প্রতি বছরের শুরুতেই ঐ শ্রেণীতে থাকাকালীন সময়ের একটি একক ছবি ডায়রীতে সংযুক্ত করায়। এভাবে কি আসলে কেউ কখনও চিন্তা করেছে? সেই বিবেচনায় অবশ্যই এটি একটি ব্যতিক্রমী ডায়েরি ।

সাধারন একজন মানুষের একটাই জীবন থাকে, যেটাকে তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বয়ে চলে। একজন ক্যাডেটের দুইটা জীবন, সাধারন জীবন ও ক্যাডেট জীবন, দুটোকেই বয়ে নিয়ে চলতে হয়। শাকুর ভাই ছুটিতে থাকা সময়ের ঘটনাবলীও লিখে রেখেছন, এটা আমার কাছে অনবদ্য মনে হয়েছে। তার পারিবারিক জীবন, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির আনন্দ বেদনা, সমকালীন কিছু রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সামান্য ঝলক, একজন ক্যাডেটের মনোজগতের দ্বন্দ্ব এবং সেটাকে জয় করে ফেলা, সাথে সমকালীন বিনোদন ব্যাবস্থার একটি চিত্র সহজেই ধরতে পারা যায়।

শাকুর মজিদ লিখেছেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের গল্প, সেটা ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সালের । আর আমি তাঁর ১০ বছর পরে এ সময়টা কাটিয়েছি রংপুর ক্যাডেট কলেজে । সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটা ডায়েরি তে ভালোভাবেই বুঝা যায়। তিনি গল্পের বই পড়তেন, প্রচুর বাংলা সিনেমার নাম উল্লেখ করে গেছেন, নাটকের নামও তিনি বলেছেন। কলেজের বিভিন্ন মাগাজিনে লেখার কথাও উল্লেখ করেছেন। ডায়েরি র শেষে বিশেষ কয়েকটি লেখাও তিনি সংযুক্ত করেছেন। ক্লাস ইলেভেনের শিক্ষা সফর দুর্দান্ত মনে হয়েছে। এতো কম বয়সে সাহিত্যিক একটা পরিপক্কতা আয়াত্ত করতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো ডায়েরি  লেখার অভ্যাসটা বজায় রাখতে পেরেছিলেন।

শাকুর মজিদ, লুতফুল হাসান, শামিম হাসান, ১৯৮২

শাকুর ভাইয়ের ডায়েরি  আমাকে ভুলে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনাবলী পুনরায় মনে করিয়ে দিয়েছে, মনে করতে পেরে কখনও কখনও রোমাঞ্চিত হয়েছি। এটা ভেবে যে, আমার সাথেও একই ঘটনা ঘটেছিলো। শুধু তিনি লিখেছিলেন স্বজ্ঞানে, আমি ওইটা পড়েছি নস্টালজিয়ায়। টাইম মেশিনে একটা সময় ভ্রমন করার মতো, নিজের ডায়েরি  পড়লে হয়তো আমি বড়জোর ৮৮ সাল পর্যন্ত যেতে পারতাম। এই মেশিনটা আমাকে ৭৮ সালের একজন ক্যাডেট বানিয়ে দিয়েছিলো, আমি নিজের চেয়েও ১০ বছরের পুরাতন একজন ক্যাডেট হয়ে গিয়েছিলাম। ফৌজদারহাট কিংবা রংপুর, এই শব্দ দুটি মাথায় আনতে পারিনি। শুধু মনে হয়েছে ফেলে আসা সেই দিনগুলির কথা, আমার কৈশোর এবং যৌবনের শুরু ঐ ডায়েরি তেই।

শাকুর মজিদের এ ডায়েরি পড়া শেষে আমার মনে হয়েছিলো, এটা তো আমার ডায়েরি  ছিলো, সিনিয়র হওয়ার ফায়দা নিয়া কোন অপরাধে আমার কাছ থেকে সেটা তিনি সীজ করে নিয়েছিলেন। কারন স্থান ও তারিখের বদল ছাড়া ঘটনার বিবরণের কোনও তফাৎ নাই । ওটা শাকুর মজিদের না কি আমার ডায়েরি, আমি এখনো নিশ্চিত নই । আমার ধারনা যারা এটা পড়বে তারাও ধন্ধে পড়ে যাবে। আমার মতো আরও হাজার হাজার আছে যারা দিনগুলি খুঁজে ফেরে।

পাঠ্য হওয়ার কারনে কোন এক ক্লাসে একটা ইংরেজী কবিতা পড়েছিলাম ‘The Arrow and the Song’ নামে। ঐ সময়ে কবিতাটির ভাব ধরতে পারিনি, ‘ক্যাডেটের ডায়েরি ’ পড়ার পরে ধরতে পেরেছি। আকাশে হারিয়ে যাওয়া তীর এবং বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া গান, দুটোই অনেক দিন পরে খুঁজে পেলাম, অপরিবর্তিত অবস্থায়, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, একটি ডায়েরি তে এবং ডায়েরি  লেখকের হৃদয়ে। যারা খুঁজতে চায় তাদের এখানেই খোঁজা উচিৎ, অন্য কোথাও নয়।

ক্যাডেটদের অস্তিত্বহীন নিজস্ব একটা জগত আছে যেখানে বাইরের কেউ প্রবেশ করতে পারে না। এমনকি বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তানেরাও পারে না। সাধারন মানুষের পক্ষে জগতটা বোঝা মুশকিল, এমনকি এটা ব্যাখ্যা করাও মুশকিল। শুধুমাত্র ক্যাডেট হলেই সেটা অনুভব করা যায়। ডয়েরিটা আমি অনুভব করার চেষ্টা করছি, কারন এর ভিতরে গোপনে কোথাও লেখা আছে…

বাড্ডুটা বান্ধিয়া, দিলাম রে ছাড়িয়া, গগনে ঘুড্ডি উইড়া যায়… যায় রে… গগনে গুড্ডি উইড়া যায়…

মোঃ সাইদুল হক

প্রাক্তন ক্যাডেট, রংপুর ক্যাডেট কলেজ, (১৯৮৮-৯৪)

মন্তব্য
Loading...