অষ্টভ্রমণ- শফিক হাসান

শাকুর মজিদের পর্যটন : ভ্রমণের মহাকাব্যিক আখ্যান

বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্যভাবে ভ্রমণ সাহিত্যের বিকাশ এবং বিস্তারের বয়স এক দশকও নয়। যদিও চর্চা চলছে অনেক আগ থেকেই। অনেকটা নীরবে-নিভৃতেই সাহিত্যের এ শাখা ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ ওঠেছে। হালে প্রতিবছর বইমেলায় প্রায় শ’ খানেক ভ্রমণবই প্রকাশিত হয়। ভ্রমণবই প্রকাশের শুরুর দিনগুলোর চিন্তা করলে এ সংখ্যা বিস্ময়কর। সংখ্যা বৃদ্ধিই প্রমাণ করে দেশে ভ্রমণসাহিত্যপ্রেমী পাঠকের সংখ্যা বাড়ছে। এবং সেটা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। পাঠকদের চাহিদার কথা চিন্তা করে এগিয়ে এসেছেন প্রকাশকরাও। তবে ভ্রমণের বইয়ের সংখ্যা বাড়লেও সিরিয়াস ধারার ভ্রমণ লেখক তেমন একটা বাড়েনি বললেই চলে। কেউ কেউ সখের ভ্রমণ শেষে লব্ধ অভিজ্ঞতাকে বাণীবদ্ধ করে বইয়ে রূপ দেন। সত্যিকার অর্থে লেখক না হওয়ায় এসব বইয়ে সবসময় সাহিত্যমান রক্ষিত হয় না। কিছু থাকে কাঁচা হাতের লেখা, অপরিণত চোখে দেখা। এর বাইরে যারা নিয়মিত লেখেন এবং লেখক হিসেবে খ্যাতি আছে, বাংলাদেশের পর্যটন নিয়েও চিন্তাভাবনা করেন এরকমও একটা শ্রেণি আছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা তো বলাই বাহুল্য। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ভ্রমণসাহিত্যধারা বেগবান করতে ভূমিকা রেখে চলেছেন হাসনাত আবদুল হাই, বরেন চক্রবর্তী, মৃতুঞ্জয় রায়, মঈনুস সুলতান, নির্মলেন্দু গুণ, রাবেয়া খাতুন, মিতালী হোসেন, আসাদ চৌধুরী, আহসান হাবীব, হুমায়ূন আহমেদ, লিয়াকত হোসেন খোকন, আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল প্রমুখ। এ ধারার লেখকদের মধ্যে অন্যতম শাকুর মজিদ। হাতেগোনা ভ্রমণলেখকদের মধ্যে বিগত কয়েক বছর ধরে আলো ছড়াচ্ছেন তিনি। অবশ্য শাকুর মজিদকে শুধু ভ্রমণলেখকের তকমা দিয়ে আবদ্ধ করা যাবে না, তাঁর প্রতিভা বহুধা বিভক্ত। তাঁর শিল্পিত মানস চষে বেড়ায় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্র। কি আলোকচিত্রে, কি নাটক-চলচ্চিত্র-প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে, কি সৃজনশীল সাহিত্যকর্মে- সবখানেই অনন্য। এছাড়াও তাঁর স্থপতি পরিচয়টাও কম ওজনদার নয়। তবে নানা শিল্পমাধ্যমের পরিব্রাজক শাকুর মজিদ যেন ভ্রমণেই অধিক সমর্পিত। টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য ধারাবাহিক অনুষ্ঠান নির্মাণ, বছরজুড়ে এদেশে-ওদেশে ঘুরে বেড়ানো; সেই ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করা বিভিন্ন পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনী বা আস্ত বই লেখার মাধ্যমে। কোনো দেশ ভ্রমণ করে, ভ্রমণলব্ধ অভিজ্ঞতা বই আকারে পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ধারাবাহিকতা শুরু হয় ২০০৩ সালে। এ বছর থেকেই শুরু হয় তাঁর বই আকারে ভ্রমণযজ্ঞ; প্রথম ভ্রমণবই আমিরাতে তেরোরাত। তারপর আর থামেননি। প্রায় বছরই তাঁর এক বা একাধিক বই প্রকাশিত হতে থাকে। ২০০৯ সালে এক বইমেলাতেই ৪টা ভ্রমণবই লিখে চমকিত করে দিয়েছিলেন পাঠক এবং বোদ্ধামহলকে। ২০১১ পর্যন্ত তাঁর ভ্রমণবইয়ের সংখ্যা দাঁড়ালো ৮-এ। ৮টি বই নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ভ্রমণসমগ্র অষ্টভ্রমণ। অবশ্য এ বইগুলোর মধ্যে মালয় থেকে সিংহপুরী নামক বইটি আগে প্রকাশিত হয়নি, সরাসরি সমগ্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অবশেষে দ্বীপের দেশে নামে এ বই ২০১০-এ প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিলো পার্ল পাবলিকেশন্স থেকে কিন্তু প্রকাশকের নানা জটিলতায় তা আর হয়নি। সমগ্রে স্থান পাওয়া বইগুলো যথাক্রমে আমিরাতে তেরোরাত (২০০৪), আমেরিকা : কাছের মানুষ দূরের মানুষ (২০০৮) কালাপানি (২০০৯), সক্রেটিসের বাড়ি (২০০৯), হো চি মিনের দেশে (২০০৯), পাবলো নেরুদার দেশে (২০০৯), নদীর নাম টে (২০১০) ও সরাসরি সমগ্রে প্রকাশিত মালয় থেকে সিংহপুরী। বইগুলোর প্রকাশক উৎস প্রকাশন, অন্যপ্রকাশ, অবসর। অষ্টভ্রমণ-এর পৃষ্ঠাবিন্যাস করা হয়েছে শেষ থেকে শুরু হিসেবে। প্রকাশনার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ প্রকাশিত বই পর্যায়ক্রমে আগে বিন্যস্ত হয়েছে।
অষ্টভ্রমণ-এ দীর্ঘ ৭ পৃষ্ঠার একটা ভূমিকা লিখেছেন প্রফেসর ড. সফিউদ্দিন আহমদ। আলোচনায় প্রবেশ করার শুরুতে জেনে নিই এ মনীষী কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন লেখককেÑ
শাকুর মজিদ যথার্থই নন্দিত ও নান্দনিক শিল্পী। তার হাতে কখনো কখনো ক্যামেরা আবার শিল্পীর তুলি হয়ে অফুরন্ত নান্দনিক বিভায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কেউ হয়তো অনুসন্ধিৎসু হয়ে জানতে চাইবেন চিত্রনির্মাতা আর ক্যামেরায় চোখ রাখা শাকুর কলানৈপুণ্য দক্ষ না সাহিত্যিক শাকুর দক্ষ। তবে প্রথমেই আমাদের একটা অভিধায় অভিযোজিত হতে হবে যে, ক্যামেরা ও চিত্রনির্মাতা শাকুর এবং সাহিত্যিক শাকুর কখনো চোখ দিয়ে দেখেন না এবং কান দিয়ে শোনেন না। তার দেখা ও শোনা হৃদয় দিয়ে।

সক্রেটিসের জেলখানার স্মাওনে শাকুর মজিদ ও পঞ্চপর্যটক, ২০০৩ সালে

খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ এবং প্রাজ্ঞ লেখকের মূল্যায়ন যথার্থ। অন্য অনেকের দেখা এবং শোনার সাথে শাকুর মজিদের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্যটুকুর জন্য অন্য অনেকের মাঝ থেকে তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। তাঁর ভ্রমণ-নিবেদন দ্বিমুখী। বই বা পত্রিকার পাতা এবং টেলিভিশন পর্দা। দুটি মাধ্যমেই সমান সফল তিনি। তবে আমরা বইয়ের আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবো।
মালয় থেকে সিংহপুরী সপরিবারে বেড়ানোর গল্প। পারিবারিক এ ভ্রমণযাত্রায় লেখকের সঙ্গী স্ত্রী ও দুই পুত্র। ভ্রমণের মধ্যেই চলে আসে ঈদ। মালয়েশিয়ার একটা হোটেলে অবস্থানকারী এ পরিবারকে ঈদে পরিজনদের সাথে কাটাতে না পারার দুঃখ ততটা কাতর করে না, যতটা করে আমেরিকার মহাপ্রতাপশালী শাসক কর্তৃক এই ঈদের দিনেই ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দেয়ার দৃশ্যে। টেলিভিশনে লাইভ দেখানো হচ্ছে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসির দৃশ্য। ঈদুল আযহায় সংঘটিত এ ঘটনাকে ‘নির্মম’ভাবে বাক্যবন্দি করেছেন লেখক-
সকালবেলা টেলিভিশন অন করে মন খারাপ হয়ে যায়। একী দেখছি! সাদ্দাম হোসেনকে কোরবানি দিয়েছে আমেরিকান ইরাকি সরকার? সিএনএনে রিপোর্ট দেখাচ্ছে। যেখানে ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো সেখানে উপস্থিত থাকা এক লোক তার মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ফাঁসি কার্যকর করার বীভৎস দৃশ্যগুলোর ছবি ধারণ করে সিএনএনে দিয়েছেন। …পৃথিবীর সবচে সভ্য মানুষের দাবিদার অসভ্য মানুষগুলোর বর্বরতার চূড়ান্ত রূপ প্রত্যক্ষ করে মর্মাহত হয়ে পড়লাম।
এভাবেই একজন যথার্থ লেখক নিজের বেদনা সঞ্চারিত করে দেন পাঠকের মাঝে। কোরবানি ঈদের দিনের দিনের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে ‘কোরবানি’ শব্দের ভিন্ন ব্যবহারও হৃদয়ে দাগ কাটে, মোচড় খায়। ২ সপ্তাহের এ ভ্রমণে লেখক দেখিয়েছেন রূপকথার গল্পের মতো মালয়েশিয়ার সমৃদ্ধির সাফল্যগাথা। সে দেশের অনুপম পর্যটন স্থান এবং নান্দনিক স্থাপনাগুলোর মনোগ্রাহী বর্ণনা তো ছিলোই। মালয়েশিয়ার ঐতিহ্য, সংস্কৃতির নিপাট চিত্র ধরা পড়ে কলমে। অবশ্য শুধু মালয়েশিয়া নয়, এটা আসলে ‘যৌথ’ ভ্রমণ। যা বইটির নাম থেকে অনুমেয়। প্রথমে মালয়েশিয়া, তারপর সিঙ্গাপুরে পা রাখেন তারা। সিঙ্গাপুরের আদ্যোপান্তও মূর্ত হয়ে ওঠে কুশলী বর্ণনাচ্ছটায়।
স্কটল্যান্ড ভ্রমণে গল্প বিধৃত হয়েছে নদীর নাম টে-তে। স্কটল্যান্ডের ছোট্ট শহর ডান্ডি। পৃথিবীজোড়া ডান্ডির খ্যাতি তিন ঔ-র জন্য। এই তিন ঔ হচ্ছে ঔঁঃব, ঔড়ঁৎহধষরংস, ঔধস। ডান্ডিকে ঘিরে রয়েছে যে নদী, তার নাম টে। বিশ্বায়নের থাবায় একে একে বন্ধ হয়ে গেছে টে নদীপারে গড়ে ওঠা পাটকলগুলো। যেভাবে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশের পাটকলগুলো। বাংলাদেশের পাটকলগুলোর জন্য শোকগাথা বা কোনো কিছু না হলেও টে নদীপারে গড়ে উঠেছে জাদুঘর। এখানটায় একসময় রপ্তানি হতো সোনালি আঁশ খ্যাত বাংলাদেশের পাট। রপ্তানির স্বর্ণসময়ে নারায়ণগঞ্জকে প্রাচ্যের ডান্ডি হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। ডান্ডি নিয়ে স্মৃতিকাতরতার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর সেন্ট এ্যান্ড্রুজ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রভৃতিকে ঘিরে প্রাঞ্জল বর্ণনায় নিবিষ্ট না হয়ে পারা যায় না।
ধারণা করা হয়, যত লোক রাষ্ট্র হিসেবে চিলিকে চেনে তার চেয়ে আরো অনেক বেশি জানে পাবলো নেরুদার নাম। দক্ষিণ আমেরিকার শেষ মাথার দেশ চিলি। এই চিলি মূর্ত হয়ে উঠেছে পাবলো নেরুদার দেশে ভ্রমণকাহিনীতে। পাবলো নেরুদা বিশ্বখ্যাত কবি। তবে অনেকেরই অজানা তিনি একজন সফল বিপ্লবী, রাষ্ট্রনায়কও। চিলির স্বাধীনতা সংগ্রাম, ইতিহাস-ঐতিহ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি। প্রেম ও বিপ্লবের কবি নেরুদার দেশকে শাকুর মজিদ পরিচিত করান তাঁর সহজাত সরস বর্ণনায়। তিনি বলেন-
এখানে এসে ক্যামেরা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে যাই। ছবি তোলা যাবে এই স্যুভেনির শপের আর বাইরের বাগানের। ঘরের ভেতর ছবি তুলতে হলে আলাদা পারমিশন লাগবে। আলাদা পারমিশনের জন্য যখন কাউন্টারে গেলাম। তখন চক্ষু চড়কগাছ। (চড়কগাছ কী আমি জানি না, কোনো কোনো লেখক এই গাছের নাম ব্যবহার করেছেন বিস্ময় প্রকাশের জন্য, তাই আমিও করলাম)।
লেখকের রসবোধ যে প্রখর আর পরিমিত তার আরেকটা প্রমাণ দেখানো যাক-

২০০৭ সালে হো চি মিন সিটিতে

এনায়েত ভাই গান ধরেন- ‘আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি প্রাণ কোকিলারে’- আর তার সাথে কোরাস ধরি আমরা সবাই। …এর মধ্যে আমাদের অপর দুই চিলিয়ান সহযাত্রী, নৌকার মাঝি আর গাইড এঞ্জেলিকা নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে যেন কথা বলে। এঞ্জেলিকা বলে- নৌকার মাঝি জানতে চেয়েছেÑএই গানের মানে কী?
এঞ্জেলিকাকে বোঝানো হয় এর ইংরেজি অর্থ। কিন্তু সে কোনোভাবেই বুঝতে পারে না- রাতের বেলা কোকিলের ডাক শুনে মেয়েটি কেনই বা এতো উতলা হবে।
এভাবেই শাকুর মজিদ সূক্ষ্ম রম্যরস ছিটিয়ে যান পাতায় পাতায়। রঙ্গরসের ভেতর দিয়েই যেন দুই দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন চিলির এক চিত্রশিল্পী টেগোরের ‘জিতানজলি’ নামক বইটি পড়েছেন; শাকুর মজিদও সাবলীলভাবে ‘জিতানজলি’ পাঠকের সাথে আলাপচারিতা চালিয়ে যান। লেখক খোলা চোখে যা দেখে যান- বলে যান; নিজের অজান্তেই পাঠক লেখকের পিছ ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
ভিয়েতনামের প্রতিশব্দই যেন হো চি মিন। কেননা হো চি মিন মানেই তো ভিয়েতনাম। দীর্ঘদিন আমেরিকান ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের সাথে যুদ্ধ করে ভিয়েতনামের অবিসংবাদিত নেতা ছিনিয়ে এনেছের সে দেশের বিজয়, স্বাধীনতা। নিজেকে নিয়ে গেছেন এমন উচ্চতায়, যা এখনো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে দূর বিশ্বের মানুষও। মহাপরাক্রমশালী আমেরিকাকেও টেক্কা দেয়া সহজ কথা নয় মোটেও- কী পরিমাণ প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং সমরনায়কোচিত সিদ্ধান্ত নিতে পারলে একজন মানুষ সহজেই হয়ে উঠতে পারেন ‘হো চি মিন’। যুদ্ধজয়ের বীরত্বগাথাই শুধু নয়, নয় কোনো এক সমরনায়কের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হো চি মিনের দেশে বইটির প্রতিটি পাতা স্মরণ করিয়ে দেয় অবিস্মরণীয় ইতিহাসের গৌরবময়তাকে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রাম এবং তৎপরবর্তী স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার লড়াইকে। ফরাসি ও মার্কিনিদের সাথে দগদগে যুদ্ধস্মৃতি, তাদের নাম ঘৃণাভরে স্মরণ করলেও বর্তমানে পাল্টে যেতে শুরু করেছে ভিয়েতনাম। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে আমেরিকার নাম বাদ দেয়াতে সেটাই প্রমাণিত হয়। শুরুতে এ জাদুঘরের নামে আমেরিকা ও যুদ্ধাপরাধ শব্দ দুটি থাকলেও বর্তমান নামকরণ একেবারেই ‘নির্বিষ’।
জার্মানে শুধু সক্রেটিসের বাড়িই নয়, সমরকুশলী হিসেবে ইতিহাসে ধিকৃত এডলফ হিটলারেরও বাড়ি। তবু লেখক পজিটিভভাবে দেখেছেন জার্মানকে। তাই তো এ বইয়ের নাম হয়েছে সক্রেটিসের বাড়ি। মহান দার্শনিক সক্রেটিসের বাড়ি যে মাটিতে সে দেশের নামকরণ সক্রেটিসের বাড়ি হতেই পারে। এ মাটির আরেকজন কৃতীসন্তানের নাম নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। নেপোলিয়ন শুধু সমরকুশলী মহানায়ক হিসেবেই নয়, খ্যাত দার্শনিক হিসেবেও। তাঁর অনেক উদ্ধৃতি এখনো মানুষের মুখস্থ। এমন একটি উদ্ধৃতি হচ্ছে- ‘তোমার শেষ ভালো কাজটি তোমার অতীতের খারাপ কাজকে ভুলিয়ে দিতে পারে।’ তাঁর অসংখ্য দর্শনঋদ্ধ উদ্ধৃতির মধ্যে মহিলাদের নিয়ে দেয়া উদ্ধৃতিগুলোও এখনো স্মরণীয়। বিশেষ করে জ্যোতিষী যখন নেপোলিয়নের হাতে আঁতিপাঁতি করেও কোনো ভাগ্যরেখা খুঁজে পাননি তখন তিনি তলোয়ার দিয়ে নিজের হাতে রক্তরেখা অঙ্কন করে বলেছিলেন, বিধাতা আমার হাতে ভাগ্যরেখা দেননি, আমিই আমার হাতে উন্নতির রেখা দিয়ে দিলাম। এই যে মানসিক শক্তি, আত্মবিশ্বাস এখনো মানুষকে উজ্জীবিত করে, সাহস দেয়। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সোনালি আকর হিসেবে খ্যাত ল্যুভ’র মিউজিয়াম, আইফেল টাওয়ার, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা বিতর্ক, সক্রেটিসের হেমলক পান, সনাতন ধর্মের নতুন তত্ত্ব ইত্যাদি অনুপুঙ্খভাবে বর্ণিত হয়েছে। বর্ণনাগুণে যেন বার্লিন, এথেন্স, প্যারিসের রাস্তা চোখের সামনে চলে আসে।
কালাপানি পা-ুলিপিতে পাওয়া যায় ইংরেজ শাসনের বিশেষ একটি দিক। ইংরেজদের দণ্ডক দ্বীপ কালাপানি। পাহাড় এবং সাগরবেষ্টিত এ জায়গা রয়েছে ৫২৭টি দ্বীপ, অবস্থান ভারত মহাসাগরের পূর্বদিকে। ১৯৭৪ সালে প্যারিস অব ফার ইস্ট নামে প্রসিদ্ধ আন্দামানকে ভেঙে ফেলা হয়। নিকোবর নামে গঠন করা হয় আলাদা জেলা। আন্দামানের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত এ স্থানে নির্বাসন দেয়া হতো। ভয়ঙ্কর অপরাধীদের ফাঁসি বা অন্য কোনো সাজা না দিয়ে সরাসরি পাঠিয়ে দেয়া হতো এখানটায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার সাক্ষীও এই কালাপানি। কালাপানির গুরুত্বপূর্ণ দিক ছাড়াও এ বইয়ে আরো আলোচিত হয়েছে রস আইল্যান্ড, আন্দামানের বিধ্বংসী সুনামির কথা প্রভৃতি।
আমেরিকা ভ্রমণের অনুপম বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে আমেরিকা : কাছের মানুষ দূরের মানুষ-এ। সারাবিশ্বের অনেকেরই স্বপ্নের নাম আমেরিকা। বিশেষ করে বাংলাদেশিদের আমেরিকা প্রীতি এবং ভীতি নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছেÑআমরা আমেরিকাকে ঘৃণা করি আবার সবাই আমেরিকা যেতে চাই! এ উক্তি নির্মম সত্য। জ্ঞান-গৌরবে অনেক অগ্রসর, সভ্য মানুষের দেশ হিসেবে পরিগণিত হলেও আমেরিকার অকারণ মোড়লিপনা, সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা এবং ছোট-দুর্বল রাষ্ট্রের প্রতি অযাচিত খবরদারি, নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে গ্যাঞ্জাম জিইয়ে রাখাসহ আরো কত কাজ-অকাজ যে আমেরিকা করে তার ইয়ত্তা নেই। সব বাস্তবতার পরও আমেরিকা বিশ্বের কোটি তরুণের আরাধ্যÑস্বপ্নময় ভূমি। কী আছে আমেরিকায়, কেন সে এতো টানে? আমেরিকার জীবন রূঢ় আবার এই আমেরিকাতেই আছে নিশ্চিত জীবনের হাতছানি! আমেরিকাই হচ্ছে পৃথিবীর সেই দেশ যেখানে খুব সহজেই স্বর্গ বা নরকের স্বাদ পাওয়া যায়। ডলারের গুণে হাতের কাছে ধরা দেয় অনেককিছু, আবার ডলার উপার্জনের জন্যই ঘণ্টার হিসাবে মানুষ রাতদিন প্রাণপাত পরিশ্রম করে চলে। মোদ্দাকথা, এ ‘স্বপ্নের দেশ’কে নির্দিষ্ট কোনো ফ্রেমে বাঁধা একটু কঠিনই! আমেরিকায় আছে আর্থিক, সামাজিক আর স্বচ্ছল জীবনযাপনের মোহ। যা সুখান্বেষী মানুষকে খুব সহজেই টানে। এই আমেরিকাতেই মানবেতর জীবনযাপন করে এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। ভিক্ষুকও আছে এই দেশে! তবু সব বুঝে-শুনেই মানুষের এই দেশই আরাধ্য। এহেন আমেরিকার ভালো দিক খুঁজলে যেমন বিস্তর পাওয়া যাবে তেমনি বাজে দিকের ইতিহাসও ছোট নয়। আমেরিকা এখনো বর্ণবাদ প্রথা টিকিয়ে রেখেছে। কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ বৈষম্য, বাজে প্রথা ভীষণ নগ্নভাবেই পরিস্ফুটিত হয়। আমেরিকা চরম সভ্য এটা যেমন সত্য, আবার চরম অসভ্য এটাও সত্য। অনেক বাংলাদেশিই দেশের ‘ভালো’ চাকরি ছেড়ে আরো ভালো জীবনযাপনের মোহে পাড়ি জমায় আমেরিকায়। দেশে যারা খ্যাতিমান, আমেরিকায় সেই খ্যাতিমানদেরই কেউ ‘পুছে’ না। এ ধারার একজন মানুষ মিনার মাহমুদ। অবশ্য তাঁর কাহিনী অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। স্বৈরশাসক এরশাদের রোষানলে পড়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়। তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিন্তায় প্রকাশিত বিভিন্ন রাজনৈতিক লেখা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিলো এ সামরিক রাষ্ট্রপতির। আমেরিকায় পৌঁছে মিনার মাহমুদ বেছে নেন কষ্টকর জীবন। ট্যাক্সিক্যাব ড্রাইভার হিসেবে শুরু হয় নতুন পথচলা। এক রাতে তাঁর ট্যাক্সিক্যাবে চড়েছেন জনৈক ফরাসি। মিনার মাহমুদের বাড়ি বাংলাদেশে শুনে তিনি প্রশ্ন করলেন, তসলিমা নাসরিনকে চেনেন কিনা।
তসলিমা নাসরিন তখন ‘জ্বালাময়ী’ কলাম লিখে চারপাশ আলোড়িত করে ফেলেছেন। বিশেষ করে মৌলবাদীদের রোষানলে পড়ে খুব সহজেই তিনি প্রচুর আলোচিত-সমালোচিত। সে সমালোচনার জের ছড়িয়ে পড়েছে দেশ ছাড়িয়ে বাইরেও। তো মিনার মাহমুদ ফরাসি ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘ও আমার বউ ছিলো। আমি ওর স্বামী।’ ভদ্রলোক তাঁকে পাগল ঠাউরে সাথে সাথেই ভাড়া মিটিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে যান। এ ঘটনাই আমেরিকার নির্মম জীবন বোঝার জন্য যথেষ্ট। আমেরিকায় বাংলাদেশিদের জীবনযাপন লেখক খুব নিবিড়ভাবে অবলোকন করেছেন। আরো অবলোকন করেছেন গোটা আমেরিকার সমাজব্যবস্থা। স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, বাণিজ্য ও বাণিজ্যিকতার নগরী আমেরিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে লেখকের কলম হয়ে ওঠে কাব্যগন্ধী, চমৎকৃত করে ভাষার কারুকাজÑ
শুয়ে পড়ার আগে রাতের লাসভেগাসকে আরেকবার দেখার জন্য ২৩ তলার ওপর থেকে পর্দা ফাঁক করি।

“না, ঠিক রাত নয়। এটাকে ভোর বলে।
ঘণ্টা খানেক আগে যেখানে কালো পটভূমিতে ঝিকিমিকি আলোর নাচন দেখা গিয়েছিলো, এখন তা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে লাল আলোর দিগন্তরেখা। তার ওপর দিয়ে উঁচু-নিচু ভবনের অবয়ব। ওটিও কি আরেকটি পেইন্টিং? রাতের সব শো শেষ হয়ে যাবার পর এখন যে প্রদর্শনীর আয়োজন হচ্ছে পুবের আকাশে, তার কাছে এই পাপের নগরীর সব আয়োজন বড়ো তুচ্ছ।
কলম্বাসের পর বাংলাদেশিদের আমেরিকা-আবিষ্কারই শুধু নয়, সেখানকার বাঙালি সমাজের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-বৈশিষ্ট্য নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। আমেরিকা জীবনসংগ্রামী মানুষের কতটুকু কাছের হতে পারে দূরেরই বা কতটুকু অনেকটাই বোঝা হয়ে যায়। “

২০০১ সালে লেখক যখন আমেরিকায়

আগেই বলা হয়েছে আমিরাতে তেরোরাত বইটি দিয়ে শাকুর মজিদের ভ্রমণসাহিত্য পরিক্রমার সূত্রপাত। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। প্রকাশক ছিলো উৎস প্রকাশন। আমিরাত ভ্রমণের এ গল্পেও উঠে এসেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কষ্টগাথা। সব পরবাসেরই প্রায় অভিন্ন চরিত্র- লাঞ্ছনা-বঞ্চনা-অপ্রাপ্তি-বৈষম্য আর দুঃসহ অভিজ্ঞতা। তেমনি আমিরাতে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও ব্যতিক্রম নয়। শত কষ্টেও তারা পরগাছার মতোই পড়ে থাকে বিদেশে। কেন? উত্তর জানা-ই, তবু লেখকের বর্ণনা থেকে আরেকবার জানা যাক-
ছানু বলে, জানো শাকুরÑএই তেল আর সোনার খনির দেশে বিদেশিদের তারা মানুষ মনে করে না- কিন্তু তারপরও কেউ সহজে এদেশ ছাড়তে চায় না। তার প্রধান কারণ, এখানে তোমার নিরাপত্তা আছে। তুমি সারারাত দরোজা খুলে ঘুমাতে চাও ঘুমাও, কেউ তোমার ক্ষতি করবে না। লাখ টাকার বা-িল হাতে নিয়ে মাঝরাতে বাজার থেকে আসো, কেউ তোমার দিকে তাকাবেও না।
সব বাস্তবতার সাথেই আপস করেই বাংলাদেশিরা পড়ে আছে নিষ্ঠুর পরবাসে। শুধু বাংলাদেশিদেরই নয়, সারা বিশ্ব থেকে জীবিকার সন্ধানে আসা মানুষের আখ্যানও বিধৃত হয়েছে এ গ্রন্থে। প্রবাসের আইনশৃঙ্খলা, শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনের সাথে দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে খুব সহজেই হতাশ হয় বাংলাদেশের মানুষ। দেশের প্রতি একই সাথে হৃদয়ে জাগরুক থাকে অতুল ভালোবাসা এবং উগরাতে না পারা বিবমিষা।
শাকুর মজিদের ভ্রমণ মানে যেন শুধু ভ্রমণ নয়- ভ্রমণের মহাকাব্যিক আখ্যান এক। পরিব্রজনের নতুন এবং অনালোকিত অধ্যায়। আপাতদৃষ্টিতে অনুল্লেখ্য স্থান থেকেও বের করে আনতে পারেন ভিন্নামাত্রিক রূপ-রং-রস। তাঁর হাতে খেলা করে একই সাথে অনেককিছু। যখন যে দেশে যান, সে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সমস্যা-সম্ভাবনা-পর্যটন মুখস্থ করে ফেলেন যেন। তাঁর লেখার অনিবার্য উপাদানÑইতিহাস। ইতিহাসের কাছে বিশ্বস্ত থেকে, সত্যের অপলাপ না ঘটিয়ে শাকুর উল্টে যান খেরোখাতা। এতে চকিতে দৃষ্টিগোচর হয় অনেককিছু। লেখায় তথ্য পাওয়া যায় প্রচুর কিন্তু কখনোই তথ্য ভারাক্রান্ত নয়; ইতিহাসকেও ‘সুগার কোটেড’ করে পরিবেশন করার অনায়াস দক্ষতা রয়েছে বিরলপ্রজ এ লেখকের। নিজে স্থপতি হওয়ায় সারাবিশ্বের নামকরা স্থাপনা, স্থাপত্যশৈলীর প্রতি মনোযোগ দৃষ্টি কাড়ে। এসবও বিশ্লেষণ করেন। যেমন আইফেল টাওয়ার তাঁর কাছে ‘ইস্পাতের সাদামাটা খাম্বার সমাহার’ মাত্র। ‘হুড়মুড় করে এসে এটা দেখার কী আছে?’ এমন প্রশ্নও ছুড়ে দেন দর্শনার্থীদের প্রতি। শাকুর মজিদের সাথে ভ্রমণ মানে শুধু আনন্দযাত্রাই নয়, ইতিহাসযাত্রাও। ভ্রমণ বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর লেখা এবং রেখায়। সাদামাটা রেখাচিত্রেও যিনি ফুটিয়ে তুলতে পারেন বিশাল ক্যানভাস, তিনিই তো যথার্থ শিল্পজন। বইটি ৮টি দেশ নিয়ে লেখা হলেও প্রসঙ্গক্রমে দেশ এসেছে ২০টির বেশি। লেখক শব্দ নিয়ে ততটা খেলা করেন না, যতটা খেলা করেন আবেগ নিয়ে। আবেগ স্ফুরণের ধারা বইয়ে দিতেও তাঁর জুড়ি নেই। বইটির সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্য, প্রচুর প্রাসঙ্গিক ছবি স্থান দেয়া। ছবিগুলোয় ক্যাপশনের সাহায্যে একজন পাঠক খুব সহজেই কাহিনীর গভীরে ঢুকে যেতে পারেন। কিছু ছবি নয়নাভিরাম আবার কিছু কিছু ছবি নৃশংসতার সাক্ষী, যাতে অজান্তেই মুচড়ে ওঠে পাঠকের বুক। বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্য অনেকদূর এগিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, শাকুর মজিদের মতো লেখকদের কলম সচল থাকলে এ যাত্রা একদিন ইতিহাস ছোঁবে- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা অমূলক হবে না। চমৎকার গেটআপ মেকআপ, প্রায় নির্ভুল অক্ষরবিন্যাস, ঝকঝকে ছাপার এ বই উপহার দেয়ার জন্য উৎস প্রকাশন ও লেখককে ধন্যবাদ।

অষ্টভ্রমণ
শাকুর মজিদ
প্রকাশক : উৎস প্রকাশন
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি, ২০১১
প্রচ্ছদ : মাসুম রহমান
দাম ৯০০ টাকা
পৃষ্ঠা ৬০০

৭/৭/২০১২

মন্তব্য
Loading...