আরবীতে বলা হয় ‘আউল’, যার অর্থ যারা ঈশ্বরের একান্ত সেবক। এ্্ঁদের মধ্যে বৈষ্ণব সহজিয়া আছেন, আছেন মুসলিম সুফী-সাধক-ফকিররা। নিজের ধর্মের চেয়ে মানব ধর্মই এঁদের কাছে বড়। এজন্যে মুসলিম সুফী-সাধকরা ইসলামে বেশরা-পন্থী হিসেবে পরিচিত। বাউল শাহ আব্দুল করিমও এরকমই একজন যাকে ‘গাঁও গেরামের লোকে কয় এতো দেখি বেশরা’।
বাউল শাহ আব্দুল করিমের সারা জীবনের সাধনাই ছিল নিজেকে জানা এবং সৃষ্টিকর্তাকে চেনা। গানে গানে তিনি তার নিজেকে জানার চেষ্টা করেছেন। নিজের মধ্যে স্রষ্টাকে খুঁেজছেন। শাকুর মজিদ রচিত মঞ্চ নাটক ‘মহাজনের নাও’ এ যেনো তারই প্রতিফলন ঘটেছে। পয়ার ছন্দে লেখা এই নাটকের সংলাপ এবং মাঝে মাঝে করিমের গান প্রথম থেকে শেষ পর্যন্তই নয়, শেষ হওয়ার পরও সুর-মূর্ছনায় আমাদের চেতনায় অনুরনণ বাজাতে থাকে, দোলায়িত করতে থাকে। নাটকটি সম্পর্কে নাট্যকারের ভাষ্য Ñ
যেহেতু শাহ আবদুল করিম সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের মানুষ ছিলেন, তাঁর গানে তিনি নৌকাকে বেশি ব্যবহার করেছেন নিজের দেহের রূপক হিসেবে। তিনি নিজেকে ভেবেছিলেন কোনো এক মহাজনের কাছ থেকে ধার পাওয়া এক নৌকা। যে নৌকার মালিক তিনি নন, শুধু সঠিকভাবে চালিয়ে কোন এক ‘সোনার গাঁও’এ পৌঁছানোর গুরুদায়িত্ব তাঁর।
জীবনের সায়াহ্নে এসে তাঁর নাও কোন্ গাঁওয়ে ভিড়েছে সে শুধু তাঁর মহাজন জানেন। মূলত শাহ আবদুল করিমের জীবনের জটিলতা, সংকট এবং তা থেকে উত্তরণের বিষয়গুলো এনাটকে প্রকাশ পেয়েছে। সেই সাথে উঠে এসেছে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর বোধ ও দর্শন।” [মহাজনের নাও, সার সংক্ষেপ, উৎস প্রকাশন, ঢাকা,২০১১,পৃ-১১]
নাট্যকারের বক্তব্যেই স্পষ্ট, কেন তিনি নাটকের নাম দিয়েছে ‘মহাজনের নাও’। নাটকের প্রধান চরিত্র বাউল শাহ আবদুল করিমের জন্ম, শৈশব জীবন থেকে শুরু করে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, প্রেম-বিরহ, ঘাত-প্রতিঘাত এবং এরই মধ্যে স্রষ্টার সন্ধান ও শেষ পর্যন্ত করিমের মৃত্যু, ইত্যাদি ওঠে এসেছে নাটকে।
আট বছর বয়স থেকেই করিমের জীবনযুদ্ধ শুরু। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাবার চাচা ফকির নসিব উলাহর কাছে এসে করিম বাউল ধর্মের দীক্ষা নেন। কালে কালে নিজেই হয়ে ওঠেন একজন পরিপূর্ণ বাউল। গ্রামের মানুষ তাঁকে গানের জন্যে গ্রাম ছাড়া করে কিন্তু করিম গান ছাড়েন না। গান বাঁধেন, গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান আর সৃষ্টাকে খুঁজেন। কিন্তু বিশ্বজগতে মানবের মাঝে কেবল স্রষ্টাকে খুঁজবেন, তা কি করে সম্ভব? মানুষের অন্যায়-অপরাধ, অনিয়ম-অবিচারও তাকে ব্যথিত করে। তিনি তখন গানে গানে সেই অবিচারের প্রতিবাদ জানান। অশিক্ষিত, দরিদ্র, গ্রাম্যÑ যিনি রাজনীতি কী বুঝেন না কিন্তু সাধারণ মানুষের পাওয়া- না-পাওয়া, ভোটের সময় তাদের নানা ধরনের প্রতিশ্র“তি দেওয়া, প্রলোভন দেখানো এবং পরে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা, প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো করিম বঝতেন এবং তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করতেন
আমার ভাষায় বলি, ব্যর্থ সে সরকার
মেটাতে পারে না যে ভাতের অধিকার।
বৃটিশ গেলো, পাক গেলো, স্বাধীন বাংলাদেশ
তবে কেনো শোষণ আজও হয় নাতো শেষ ? [ পূর্বোক্ত,পৃ.৩৪]
করিম যে বাউল হয়ে গানে গানে কেবল স্রষ্টাকেই খুঁজেননি, সাধারণ দরিদ্র মানুষের কথাও ভেবেছেনÑ তাঁর গানে তারও প্রতিফলন ঘটেছে। যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচনে, ১৯৫৭ সালে সোহ্রাওয়ার্দির সভায়, মৌলানা ভাসানীর কাগমারী সম্মেলনে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে জনগণের ন্যায্য অধিকারর প্রতিষ্ঠার কথা গানে গানে জানিয়েছেন। তার জনপ্রিয়তা শুধু দেশেই নয় বিদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। ১৯৬৪ ও ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বিলেতে গিয়েছেন গান গাইতে।
প্রথম জীবনে আফতাবুন নেছা নামে এক নারীর সঙ্গে দুই মাস সংসার করেন । করিম চলে যান স্রষ্টাকে খুঁজতে আর অভাব-অনটনের সংসার ছেড়ে আফতাবুন নেছা চলে যান বাপের বাড়ি। সংসার ভেঙে যায়। তারপর প্রায় দেড় যুগের ব্যবধানে করিম বৈশাখী নামের এক মহিলাকে বিয়ে করেন। ভালোবেসে নাম রাখেন সরলা। তার মাঝেই খুঁজেন প্রথম জীবনের আফতাবুন নেছাকে, আবার কখনো খুঁজেন স্রষ্টাকে।
বাস্তব জগতের রক্ত-মাংসের মানুষের সঙ্গে বসবাস করে গানে গানে তাদের প্রেম-ভালোবাসা, সুখ- দুঃখ,পাওয়া-না-পাওয়ার কথা বলছেন আবার একই সঙ্গে গানে গানে স্রষ্টাকেও খুঁজছেন। বাস্তবে বিচরণ করতে করতেই চলে যাচ্ছেন অবাস্তব জগতে স্রষ্টাকে খুঁজতে। কাল থেকে মহাকালে, সীমা থেকে অসীমে। কখনো বাস্তবের মানবীর (সরলার) মাঝেই বিশ্ববিধাতাকে খুঁজেন। এই যে জীবন-চেতনায় থেকে আধ্যাতিœক-চেতনায় বিচরণ করাÑ করিমের জীবন-দর্শনের এদিকটি ‘মহাজনের নাও’এ প্রতিফলিত হয়েছে কাব্যিক ব্যঞ্জনায়।
সুবচনের প্রযোজনায় ‘মহাজনের নাও’ নাটকটি অনন্য হয়ে ওঠেছে সুদীপ চক্রবর্তীর সুনির্দেশনার কারণে। রূপসাগরে ডুব দিয়ে অরূপের সন্ধান, মানবের অন্দরে বিশ্ববিধাতার সন্ধানÑ প্রতীকী ব্যঞ্জনার এনাটক দর্শকদের কাছে সহজ করে তুলেছেন নির্দেশক। তাছাড়া দেহকে নাও এবং সেই নাও বেয়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে ‘বৈঠা’কে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে নাটকে ভিন্নতর মাত্রা যোগ করেছেন। এরিনা থিয়েটারের আদলে মঞ্চ সজ্জায় বেশ ক’টি বৈঠা-প্রতীক, কোরাস দলও কখনও কখনও বৈঠার প্রতীকী ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে তাদের অভিনয়ে মাধ্যমে। এই বৈঠা ‘মহাজনের নাও’ নাটকের মূল ভাবের স¤প্ররারণ হিসেবে বিবেচ্য। এই বৈঠা বেয়েই সৃষ্টার প্রতীকী মহাজন কর্তৃক প্রদত্ত ‘দেহের প্রতীকী নৌকাকে জন্মের পর থেকে বেয়ে বেয়ে আবার স্রষ্টার কাছে বা মহাজনের কাছেই পৌঁছাতে হবে। যিনি সঠিক পথে সেই ‘নাও’কে নিয়ে যেতে পারবেন তিনিই পাবেন মহাজনের সন্ধান। করিম একসময় তাঁর মহাজনের সন্ধান পেয়ে যান। সবাইকে কাছে ডেকে তাই বলেন
কান খাঁড়া করে দেখ ঐ দূর গায়
শুনতে পেয়েছো কেউ, ডাকে কে আমায়
আমি তো শুনেছি ডাক মৌলা আমার
নৌকা পাঠিয়ে দিছেন মাঝি মালার । [ পূর্বোক্ত,পৃ.৪৩]
কেউ শুনতে পায় না। কিন্তু করিম শুনতে পান তাঁর মৌওলার ডাক। আর সেই আহবানে করিম এক সময় এই ইহজগৎ ছেড়ে চলে যান অসীমের জগতে। করিম চলে যান কিন্তু রেখে যান তার মাটির শরীর। সবাইকে বলেন
তারপর আছে, আরো কথা আছে
মাটির শরীর রবে তোমাদের কাছে
সেখানে সরলা শুয়ে , সরলার ঘর
ও ঘরের পাশে দিও আমার কবর। [পূর্বোক্ত,পৃ.৪৩]
এ সংলাপে এক গভীর প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। তা হলো Ñ মানুষের মৃত্যুতেও তার জীবনের অবসান হয় না। মানুষের মৃত্যু হলেও মানব থেকে যায়। যেমন আছে তাঁর মাটির দেহ, যেমন আছে তাঁর জীবন দর্শন। এমনি প্রতীকী ব্যঞ্জনার সুন্দর প্রকাশ লক্ষ করা যায় এ নাটকের সমাপ্তিতে। করিম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সষ্ট্রার সন্ধান পান, স্রষ্টার কাছে যান।
করিমের চরিত্রে যে ক’জন অভিনয় করেছেন, মোটামুটি কৃতিত্বের ছাপ বা দর্শক-হৃদয় জয় করতে পেয়েছেন। রক্ত-মাংসের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে মানুষের অভিনয়ের পাশাপাশি কখনো মাঠের একদল গরু, ময়ূর কখনো নৌকা ইত্যাদি অভিনয় করানোতে নির্দেশকের দক্ষতা যেমন প্রশংসনীয় তেমনি অভিনেতা- অভিনেত্রীরাও একই সঙ্গে মানুষ, জীবজন্তুু, নৌকা ইত্যাদির অভিনয় দক্ষতার সঙ্গে করে নাটকে প্রাণোচ্ছলতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সঙ্গীতের মাধ্যমে সূচনা, এরপর একের পর এক সঙ্গীত, পয়ার ছন্দের সংলাপ, গাজীর গান, দুর্গোৎসবের দৃশ্য, শব্দ-নিঃশব্দের মুহূর্তগুলো, আলো-আঁধারির খেলা, সর্বোপরি কোরিওগ্রাফি সব মিলিয়ে সুবচন এর মহাজনের নাও একটি চমকপ্রদ প্রযোজনা স্বীকার করতেই হবে।। করিমের ২১ টি গানের অংশ-বিশেষ প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীকেই গাইতে হয়েছে। পাশাপাশি পয়ার ছন্দে রচিত আধ্যাতিœক ও জীবন-বাস্তবতার মিশেল সংলাপে নাটকটি মঞ্চে রূপায়িত করে তোলা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। কিন্তু এমন একটি দুরূহ কাজ সুবচন মঞ্চে সহজ-সরল করে উপস্থাপন করেছে। প্রায় সকল অভিনেতা-অভিনেত্রীই গান গাইতে পারে- এমন নাট্যদল বোধকরি কমই আছে। সুবচনের বুদ্ধিপ্রভ প্রযোজনা এবং বিদগ্ধ নির্দেশকের সুনির্দেশনায় ও সুবচনের হৃদয়-মন উজাড় করা কঠোর পরিশ্রমী শিল্পীদের অভিনয়ে মহাজনের নাও দেখে দর্শকরা যে মুগ্ধ,আনন্দিত হবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।
১৫/১০/২০১০