ভাটির পুরুষকথা-সুমনকুমার দাশ

‘ভাটির পুরুষ’-আখ্যান

শাকুর মজিদের গদ্যের বুনন-দক্ষতা চমৎকার। যেটি বলতে চান সেটি ভালোভাবেই উপস্থাপন করতে পারেন। ভ্রমণ-কাহিনি রচনায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার! ভাটির পুরুষ-কথা যেন তেমনি এক ভ্রমণ-কাহিনি। তবে এ ভ্রমণ একটু ভিন্ন ধাচের। ভ্রমণ-কাহিনিগুলো সচরাচর দেশ-বিদেশের নৈসর্গিক দৃশ্য কিংবা সেখানকার জনমানুষের বর্ণনা দিয়ে লিখিত হয়। কিন্তু শাকুর মজিদ আলোচ্য বইটিতে সেসবের ধার ধারেননি। নিশ্চয় পাঠকদের কাছে খটকা লাগছেÑতবে কেনইবা এটিকে ভ্রমণ-কাহিনি বলছি!
পাঠকদের দ্বিধাদ্ব›েদ্ব না-ফেলে এবার তাহলে একটু খোলসা করেই বলা দরকার। আসলে শাকুর মজিদ ভাটির পুরুষ-কথায় হাওরাঞ্চলে বেড়ে ওঠা অক্ষরজ্ঞানহীন এক সাধারণ ব্যক্তির ক্রমশ অনন্য-সাধারণ হয়ে ওঠার বয়ান শুনিয়েছেন। পাঠকদের সেই বয়ান শোনাতে গিয়ে শাকুর জল-মাটিসংলগ্ন হাওরের জনমানুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির আদ্যোপান্ত চষে বেড়িয়েছেন। হাওর-অধ্যুষিত ভাটি অঞ্চলের রং-রূপ-রস সবকিছুই তিনি সুস্বাদু বর্ণনায় পাঠকের কাছে হাজির করেছেন। এসব কারণেই বইটি পড়তে গিয়ে বারবার এটিকে ভ্রমণ-কাহিনিই মনে হচ্ছিল। যদিও আক্ষরিকভাবে বইটিকে ভ্রমণ-কাহিনি বলার কোনো সুযোগই নেই।
বইটি মূলত প্রয়াত বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে লেখা। যেহেতু করিম ভাটির মানুষ তাই স্বাভাবিকভাবে ভাটি অঞ্চলের পরিবেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি এ গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনাহারে-অর্ধাহারে এক রাখালবালক কীভাবে পরবর্তী জীবনে বাউলগানের কিংবদন্তি হয়ে উঠলেনÑসে কাহিনিই বইয়ের পরতে-পরতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কাহিনির সাবলীলতা ও বলার ধরনে শাকুর যথার্থভাবেই করিম-মানস অঙ্কিত করতে পেরেছেন বলে বইটির পাঠক হিসেবে আমার নিজস্ব অভিমত।
শাকুর মজিদ যখন শাহ আবদুল করিম-অনুসরণে বাউলের বসতস্থান সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে যান, তখন ছিল ২০০৩ সাল। এরপর টানা ছয় বছর অন্তত ১০ বার করিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন প্রামাণ্যচিত্র ‘ভাটির পুরুষ’। সেই প্রমাণ্যচিত্র নির্মাণের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গল্পগুলো নিয়েই শাকুর রচনা করেছেন ভাটির পুরুষ-কথা। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণকালে শাকুর মজিদ যেসব বাউল-শিষ্য, শিল্পী, লেখক ও গবেষকের সঙ্গে কথা বলে তথ্যাদি সংগ্রহ করেছিলেন তাঁদের সঙ্গে করিম-প্রসঙ্গে আলোচনার প্রায় সবকিছুই ঠাঁই পেয়েছে বইটিতে। এ থেকে পাঠকেরা শাকুর ছাড়াও আরো কিছু বিশিষ্টজনের করিম-ভাবনা বইটি থেকে জেনে নিতে পারবেন। সর্বমোট ২১টি অধ্যায়ে বিধৃত করিমের জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটা দালিলিক উপখ্যানও বলা যেতে পারে বইটিকে।
১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বালক বয়সে শাকুর মজিদ একটি টেপরেকর্ডারে করিমের ‘রাখো কিবা মারো এই দয়া করো’ গানটি শুনেছিলেন। সেই থেকেই করিমের গানের প্রেমে পড়েছিলেন। পরবর্তীতে বড় হয়ে নাগরিক সভ্যতার গ্যাঁড়াকলে পড়ে ভুলে গিয়েছিলেন বাউল করিমের সেই গানের কথা। ২০০৩ সালে নতুন করে সেই গান আর বাউলের প্রতি আগ্রহ জেগে ওঠে শাকুরের মনে। ওই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সে টানেই হাজির হয়েছিলেন শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে। এরপর একাধিকবার সেখানে যাওয়া-আসা করেছেন। এই যাওয়া-আসায় ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন আবদুল করিমের স্বকণ্ঠে গাওয়া গান ও কথা।
শাহ আবদুল করিম ছাড়াও শাকুর মজিদ করিমের গান প্রসঙ্গে বাউলেরই শিষ্য রোহী ঠাকুর, আবদুর রহমান, রণেশ ঠাকুর প্রমুখের সঙ্গে আলাপ করেছেন। ঢাকায় প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, ঢকাস্থ সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীসহ একাধিক শিল্পী-গবেষকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপকালে উঠে এসেছিল করিমের জীবন ও দর্শন। শাকুর মজিদ তাঁর বইয়ে এসব গল্পই বুনেছেন। শাকুর ২০০৩ সালে করিম-সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন আর সেটার সমাপ্তি ঘটে ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাউলের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। ওই ছয় বছরের দেখা করিমকে নিয়েই শাকুর মজিদ তাঁর ভাটির পুরুষ-কথা বইয়ে স্মৃতিতর্পণ করেছেন। বইটি পঠন-পাঠনের মাধ্যমে ইচ্ছে করলে পাঠকও এর রস কিছুটা আস্বাদন করে নিতে পারেন।

[ভাটির পুরুষ-কথা, শাকুর মজিদ \ প্রচ্ছদ : শিবু কুমার শীল \ প্রকাশক : বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড \ প্রকাশকাল : ফেব্র“য়ারি ২০১৪ \ ১৬৮ পৃষ্ঠা \ দাম : ২৭৫ টাকা ]

মন্তব্য
Loading...