‘ওমন স্থির হয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকা এই পর্বতটি বিগত ৬ কোটি বছর ধরে কত শত সভ্যতার আবির্ভাব, বিকাশ আর ধ্বংস দেখেছে। মানুষের ছাপ সে তা মাথায় নিয়েছে মাত্র ৭০ বছর আগে। সেদিন কি হিমালয়ের দর্পচূর্ণ হয়েছিল?’
হিমালয় পর্বত এবং মাউন্ট এভারেস্ট সম্পর্কে এভাবেই মন্তব্য করেছেন শাকুর মজিদ তাঁর ‘অন্নপূর্ণায়’ ভ্রমণকাহিনীতে। যখন নাগরকোটের রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোরবেলায় লেখক পূর্ব দিকে তাকিয়ে প্রত্যক্ষ করেন হিমালয়ের সৌন্দর্য।
এটা হচ্ছে শাকুর মজিদের নেপাল ভ্রমণের গল্প। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের একদল স্থপতির সঙ্গে প্রায় বাধ্য হয়ে লেখক ৮ দিনের সফরে নেপাল গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা ঘুরেছেন পোখরা, নাগরকোট আর কাঠমান্ডু অঞ্চল। যে স্থাপত্য সম্মেলনের নামে তাঁদের নেপাল যাত্রা, তাতে রেজিস্ট্রেশন ছিল না শাকুর মজিদের, তাই দিনব্যাপী বক্তৃতা শোনার সময়টা তিনি কাটিয়েছেন তাঁর ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে ঘুরে। দেখেছেন নেপালের প্রকৃতি, সংস্কৃতি, স্থাপত্য ও মানুষ। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই লেখা তাঁর আলোচ্য ভ্রমণকাহিনী ‘অন্নপূর্ণায়’।
নেপালে শাকুর মজিদদেও ভ্রমণ শুরু হয় পোখরা থেকে। পোখরা নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর পরেই এ শহরের অবস্থান। মূলত পর্যটনকে কেন্দ্র করেই বেড়ে উঠেছে শহরটি। আর এ শহরের পর্যটনের প্রধান আকর্ষণ এর পাহাড়গুলো।

পোখরা পৌঁছানোর পরদিন ভোরে লেখকেরা সদলবলে সারাংকোট পাহাড়ের চূড়া থেকে উপভোগ করেন অন্নপূর্ণা পর্বতের সৌন্দর্য এবং অন্নপূর্ণায় সূর্যোদয়। পোখরায় লেখকরা অবস্থান করেন মোট তিনদিন। এর মধ্যে তারা ঘুরে দেখেন ফেওয়া হ্রদ, ডেভিস ফল, বাদুড়গুহা, শ্বেতী নদী ইত্যাদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গাগুলো। পোখরা থেকে কাঠমান্ডু যাওয়ার পথে তাঁরা যাত্রাবিরতি করে ভিজিট করেন নেপালের বিখ্যাত মন্দির মনোকামনা মন্দিরটি। পোখরা থেকে কাঠমান্ডু ফিরলো স্থপতিদের দল।
পরের দিন কাঠমান্ডুর হোটেল সোয়ালটিতে বসবে এশীয় স্থপতিদের সম্মেলন। শাকুর মজিদের জন্য রুম বরাদ্দ করা ছিলো তার পাশের গ্রান্ড হোটেলে। কিন্তু লেখকের ভাষায়, ‘আমার মন পড়ে আছে নাগরকোট।’ তাই লেখক কাঠমান্ডু ছেড়ে নাগরকোট পাড়ি জমালেন। নাগরকোট নেপালের ভক্তপুর জেলার একটা পাহাড়ি গ্রাম। এটি মূলত একটি গ্রাম উন্নয়ন কমিটির অধীনে শাসিত অঞ্চল। ভক্তপুর জেলার বাগমতি অঞ্চলে এর অবস্থান। নাগরকোট দুটি কারণে বিখ্যাত। প্রথম কারণটি হচ্ছে, প্রায় সাত হাজার ফুট উপরের অনেক পাহাড় চূড়ার উপর থেকে অনায়াসে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। আর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, আকাশ পরিষ্কার থাকলে ওখান থেকে খুব সহজে হিমালয় পর্বতমালার মাউন্ট এভারেস্টসহ আরো পর্বতশৃঙ্গ একটু করে হলেও দেখা যায়। নাগরকোটে এর আগে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে একবার এসেছিলেন লেখক। প্রায় ১৫ বছর পর আবার এখানে এলেন। এই নাগরকোটেই রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোরবেলা হিমালয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করলেন লেকক, প্রত্যক্ষ করলেন প্রায় ৯০ মালি দূরের মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া।
আরেকটা মজার অভিজ্ঞতা লাভ করেন শাকুর মজিদ নাগরকোটে। রিসোর্ট কক্ষের বারান্দায় একরাশ মেঘ এসে ছুঁয়ে যায় লেখককে। সেই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার কথা লেখক নিপুণ ভাষায় বর্ণনা করেছেন এ গ্রন্থে।
নাগরকোট থেকে শাকুর মজিদ আবার ফিরে এলেন কাঠমান্ডুতে। সবাই যখন স্থপতি সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত তখন তিনি ঘুওে দেখলেন পুরো কাঠমান্ডু।
কাঠমান্ডু নেপালের রাজধানী। এই শহরের চারপাশে চারটি পাহাড় শিভাপুরি, ফুলচুকি, নাগার্জুন এবং চান্দগিরি। এই চারটি পাহাড়ের মাঝখানের উপত্যকাটিই কাঠমান্ডু শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় আট হাজার ফুট। এই কাঠমান্ডু ভ্যালিতেই নেপালের তিনটি আদি রাজধানী কাঠমান্ডু, পাতান এবং ভক্তপুরের অবস্থান। এই তিনটি আদি রাজধানী এখন আলাদা আলাদা জেলাও। খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকা এ তিনটি জেলাতেই নেপালের সবচেয়ে ঘন বসতি। প্রাচীনকাল থেকেই এ তিনটি লোকালয়কে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো নেপালের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কাঠামো। এখন কাঠমান্ডুই থেকে গেছে নেপালের রাজধানী হিসেবে। বাকি দুটো কেবলই ইতিহাসের অংশ।
কাঠমান্ডুর আগে শাকুর মজিদ ভ্রমণ করে পাতাল জেলা। কাঠমান্ডু থেকে মাত্র ৫ কিলোকিটার দূরে পাতানের অবস্থান। লেখক পাতানে ঘুরে দেখেন পাতান দরকার স্কয়ার, পাতানের সোনার বন্দও, কৃষ্ণ মন্দির, চক পাতান, হরিশংকর মন্দির, পাতান রাজপ্রাসাদ ইত্যাদি। এরপর কাঠমান্ডুতে লেখক ভ্রমণ করেন কাঠমান্ডু দরবার, হনুমান ঠোকা, কুমারী বাহাল ভবন, ত্রিলোক মোহন নারায়ণ মন্দির, কাষ্ঠমণ্ডপ, মাজু দেভাল নারায়ণ মন্দির, শিব-পার্বতীর মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, কালা ভৈরব, কাকেশ্বর মন্দির, তালেজু মন্দির ইত্যাদি স্থাপনা। কাঠমান্ডু দেখা শেষ হলে শাকুর মজিদ অবশেষে ভ্রমণ করেন কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত নেপালের আরেক পর্যটনপ্রিয় শহর ভক্তপুর। ভক্তপুরে তাঁর ভ্রমণস্থল ভক্তপুর দরবার চত্বর, ভাতগাঁও, সিদ্ধি লক্ষ্মী মন্দির, থমোদি চত্বর, ৫৫ খিড়কি প্রাসাদ প্রভৃতি।
এই পার্কে নেপালের লুম্বিনী বা চিতত্তান ভ্রমণ করা হয়নি শাকুর মজিদের। ও দুটো না দেখা হলে নেপাল নিয়ে লেখা বই সম্পূর্ণ হয় নাই। তাই লেখক কথা দিয়েছেন কখনো ঐ দুটো জায়গা ভ্রমণ করা হলে পরে এই গ্রন্থের সাথে সংযুক্ত করে দেবেন।
শাকুর মজিদ তাঁর এই ‘অন্নপূর্ণায়’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন স্থপতি কাজী নুরুল করিম দিলুকে। কেননা তাঁর আগ্রহের তাগিদেই শাকুর মজিদের এই নেপাল ভ্রমণ।
গ্রন্থের শুরুতে উইকিপিডিয়ার সূত্রে নেপাল প্রসঙ্গে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজন করেছেন শাকুর মজিদ। এই তথ্যগুলো যে কোনো ভ্রমণপিপাসু বা তথ্যসন্ধিৎসু ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে নেপাল সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা লাভ করতে।
অন্নপূর্ণায়
শাকুর মজিদ
প্রকাশক : উৎস প্রকাশন
প্রকাশকাল : অক্টোবর ২০১৪
প্রচ্ছদেও আলোকচিত্র ও ডিজাইন : শাকুর মজিদ
প্রচ্ছদেও নামলিপি : আবিদ এ আজাদ
দাম : ২৬০ টাকা