১০ সদর স্ট্রিট : রবীন্দ্রনাথের কলকাতা-রেজা ঘটক

১০ সদর স্ট্রিট : রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় !

১৬৯০ সালে কলকাতা নগরীর গোড়াপত্তন হয়েছিল। ইংল্যান্ড থেকে আসা বণিকেরা তখন কলকাতায় বাণিজ্য শুরু করেছিল। কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশের যশোর থেকে এক কুশারী ব্রাহ্মণ পরিবার ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। যশোরের চেঙিগুটিয়ার জমিদার দক্ষিণানাথ রায় চৌধুরীর উত্তরসুরীদের একটি অংশ হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার। যে কারণে কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ঠাকুর পরিবার অনেকটা সমান্তরালভাবেই বেড়ে ওঠে। ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। একসময়ে কলকাতাকে ‘সিটি অব প‌্যালেস’, ‘সিটি অব বুকস’, ‘সিটি অব জয়’ নানা নামে ডাকা হতো। এরপর একসময় কলকাতা যেমন রাজধানীর মর্যাদা হারায়, তেমনি ১৯০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করে ইংরেজরাও ভারত ভাগ করে বিদায় নেয়। কাকতলীয়ভাবে ঠাকুর পরিবারের জমিদারিরও তখন অবসান ঘটে। কলকাতা পত্তনের সোয়া তিনশো বছর পর নগরটি তাহলে এখন কী নিয়ে আছে? এই প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে গিয়ে কলকাতার নানা ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরিবেশ, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র, পুস্তক, খাবারদাবার, অনুষ্ঠান ও ঘটনায় লেখক, নির্মাতা ও স্থপতি শাকুর মজিদ খুঁজে পেয়েছেন এক রবীন্দ্রনাথকে। শাকুর মজিদের কলকাতা ভ্রমণে তাই উঠে এসেছে কলকাতায় রবীন্দ্রভ্রমণ নিয়ে এক নাতিদীর্ঘ বিশদ গবেষণা ও অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ। ‘১০ সদর স্ট্রিট: রবীন্দ্রনাথের কলকাতা’ বইটির আঙ্গিক, বর্ণনা, কাঠামো, বিষয়াদি, পাত্রপাত্রী ও ঘটনাবলী তাই শাকুর মজিদের অন্যান্য ভ্রমণ কাহিনীগুলো থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে শাকুর মজিদ ২৫ বার কলকাতা ভ্রমণ করে কীভাবে সেই কলকাতার রবীন্দ্রনাথকে আবিস্কার ও অনুধাবন করেছেন, তারই এক মনোজ্ঞ তথ্যবহুল ও সচিত্র বর্ণনা পাওয়া যায় আলোচ্য বইটিতে। যে কারণে ‘১০ সদর স্ট্রিট’ কেবল ভ্রমণ কাহিনী নয়, এটি ইতিহাসকে নতুন করে দেখা ও বর্তমানের সঙ্গে তার তুলনামূলক চিত্রের এক যুগলবন্দি মহাসন্নিবেশ, যেখানে কেন্দ্রে অবস্থান করেন ঠাকুর পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান পৃথিবী জয় করা কবি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

শাকুর মজিদ ২৫ বার কলকাতা ভ্রমণের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে পাঠককেও কলকাতার ইতিহাসের নানান খুটিনাটি বিষয়ের সঙ্গে অত্যন্ত দক্ষতায় বিচরণ করান। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ ও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি চিন্থিত যত জায়গা রয়েছে, সেখানকার সকল ধরনের স্থাপনা ও সেসব জায়গা দর্শনের বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে শাকুর মজিদ পাঠককে ইতিহাসের নানান স্মৃতিচারণ করেন। পাশাপাশি কলকাতা নগরির অন্য সকল ঐতিহাসিক স্থান, স্থাপনা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, খাবারদাবার ও পরিবেশের বর্ণনায়ও ইতিহাস একটি বিশেষ জায়গা দখল করেছে বইটি। তবে শাকুর মজিদ ইতিহাসের সঙ্গে যতোটা সম্ভব রবীন্দ্রনাথের কলকাতাকেই প্রাধান্য দিয়ে নানান ঘটনায় নানান আঙ্গিকে বিচিত্র অনুসঙ্গতায় নানাভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। বইটির ভূমিকায় লেখক অনেকটা এভাবেই তা স্বীকার করেছেন- ‘কলকাতাকে বহুবার বহু নামে ডাকা হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যেই আমি খুঁজে পাই, এটা আসলে সিটি অব প্যালেস বা সিটি অব জয় আর নেই, কলকাতা আসলে এখন “সিটি অব টেগোর”। আর এই ঠাকুর পরিবার বেড়ে উঠেছে কলকাতার বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। একসময় আমি এও আবিষ্কার করি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর সৃজনশীল মনের ভ্রূণ সঞ্চারে ও তার বিকাশে আছে প্রিয় সদর স্ট্রিটের ১০ নম্বর বাড়ি। এখান থেকেই ১৭ বছরের এক কিশোরের “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” হয়েছিল আর সেই থেকেই গড়ে ওঠা শুরু হয় এই কলকাতার, যা এখন রবীন্দ্রনাথের নগর।’

‘১০ সদর স্ট্রিট : রবীন্দ্রনাথের কলকাতা’ বইটিতে ১৩টি অধ্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন নামকরণে এবং উপ-শিরোনামে এক অনুপুঙ্খ কলকাতা মহানগরীর ছবিকে নানান দৃষ্টিকোন থেকে তুলে এনেছেন। প্রথম অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন ‘ঠাকুরদের গ্রাম’। এই অধ্যায়ে তুলে ধরেছেন জোড়াসাঁকো গ্রামে কীভাবে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের আগমন ঘটেছিল, সেই জোড়াসাঁকো বাড়িটির একটি অংশ কীভাবে রবীন্দ্রভারতী জাদুঘরে পরিণত হয়েছে, জোড়াসাঁকোর চিত্রশালার ছবির নিখুত বিবরণ, রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কথা, পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা, ঠাকুরবাড়ির আঁতুরঘরের বিশদ বর্ণনা, সেখানে কার কার জন্ম হয়েছিল সেসব ইতিহাস, ঠাকুরবাড়ির উত্তরাধিকারগণদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, ঠাকুরবাড়ির বহির্মহলের বিচিত্রা ভবনে রক্ষিত রবীন্দ্র স্মৃতিচিন্থের বিবরণ, ঠাকুরবাড়ির বহির্মহলে অবস্থিত রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্ট, ভিজ্যুয়াল আর্ট ও ফ্যাকাল্টি অব আর্টের বিবরণ, গঙ্গাতীরে ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ যে বাড়িতে ছিলেন এবং ঠাকুরবাড়ির বউয়েরা গঙ্গাতীরে যেখানে পালকিতে চড়ে স্নান করতে যেতেন, সেই গঙ্গাতীরের বর্ণনার সঙ্গে রয়েছে লেখকের গঙ্গাতীরের ইংরেজ আমলে বানানো প্রিন্সেপ ঘাট দেখার বিশদ বিবরণ। লেখক শুধু ভ্রমণই করেননি পাশাপাশি ওইসব স্থান, স্থাপনা, স্থাপত্যের ছবিও তুলেছেন। আর বইটিতে লেখকের তোলা সেসব ছবিও স্থান পেয়েছে।

শাকুর মজিদ বইটিতে দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন ‘বাবুদের দরদালান’। লর্ড ক্লাইভের করুণা, স্নেহ ও প্রশ্রয়ে কলকাতার আরেক বাঙালি জমিদার নবকৃষ্ণ দেব ১৭৬৬ সালে ‘মহারাজা বাহাদুর’ উপাধি অর্জন করেন। এই অধ্যায়ে শোভাবাজারে নবকৃষ্ণ দেবের রাজমহলের বর্ণনার পাশাপাশি লেখক লর্ড ক্লাইভের সংক্ষিপ্ত জীবনীও তুলে ধরেছেন। ‘পলাশীর যুদ্ধের ১০ বছর পর ১৭৬৭ সালে ইংল্যান্ড ফিরে যান লর্ড ক্লাইভ। কিন্তু ভারতে রেখে যান ঘুষ, দুর্নীতি, সম্পদ আত্মসাৎ, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, দুর্বৃত্তায়ন আর অপরাজনীতির এক জঘন্য ইতিহাস। তাঁর দুর্নীতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে ১৭৭২ সালে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট তাঁর দুর্নীতির তদন্ত শুরু করতে বাধ্য হয়। একে একে তাঁর দুর্নীতি সম্পর্কিত তথ্য বের হতে থাকে। আত্মসম্মানের কথা বিবেচনা করে তিনি সব সম্পদের বিনিময়ে তদন্ত বন্ধ করা তথা তাঁর সম্মান রক্ষার ব্যাপারে করুণ আবেদন জানান। তবু চলতে থাকে তদন্ত। ফলে অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর ইতিহাসের আজন্ম এই খলনায়ক গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন’ (পৃষ্ঠা ৪৪)।

যশোর থেকে যাওয়া পঞ্চানন কুশারীর (ঠাকুর) বংশধরেরা জোড়াসাঁকো ও পাথুরিয়াঘাটায় বিভক্ত হয়ে যান। জয়রাম কুশারীর দুই পুত্র নীলমণি ঠাকুর আর দর্পনারায়ণ ঠাকুর ব্রিটিশদের সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। নীলমণি ঠাকুর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে খাজনা আদায়ের চাকরি নিয়ে সুদের ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি মেছুয়া বাজারে জমি কিনে বসবাস শুরু করেন। ধীরে ধীরে ওই মেছুয়া বাজারই হয়ে গেল জোড়াসাঁকো গ্রাম। অন্যদিকে অপর ভাই দর্পনারায়ণ ঠাকুর পাথুরিয়াঘাটায় জমি কিনে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। দর্পনারায়ণের পুত্র গোপীমোহন ঠাকুর অনেক সম্পদশালী ছিলেন। কালীঘাট মন্দিরে তিনি সবচেয়ে বড় স্বর্ণনির্মিত উপহার প্রদান করেন। বাঙালিদের শিক্ষার উন্নয়নে তিনি অনেক কাজ করেন। তিনি হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নিজেও ইংরেজি, ফরাসি, পর্তুগিজ, সংস্কৃত, ফারসি ও উর্দু জানতেন। তাঁর ছেলে প্রসন্নকুমার ঠাকুর ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমসাময়িক। প্রসন্নকুমার ঠাকুর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। নাটকপাগল এই মানুষটি কলকাতায় প্রথম হিন্দু থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর এই নাটকপ্রীতির প্রবণতাটি পেয়েছিলেন ভাইপো জ্যোতিন্দ্রমোহন ঠাকুর। তাঁর ভাই হরকুমার ঠাকুরও ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি অনেকগুলো ভাষা জানতেন, গানের সুর করতেন, বই লিখতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটকের ইতিহাসের সঙ্গে তাই এই জ্যোতিন্দ্রমোহন ঠাকুরের নামটি জড়িত। পাথুরিয়াঘাটের প্রশান্তকুমার ঠাকুর স্ট্রিটে ‘ঠাকুর ক্যাসেল’ নামে যে প্রাসাদোপম বাড়িটি আছে, তার প্রথম দালানটি তাঁর বানানো। কিন্তু এই ঠাকুর ক্যাসেল দর্শন করে লেখক কিছুটা হতাশ হন। ‘হায় টেগোর ক্যাসেল’, ‘জোড়াসাঁকোর রাজবাড়ি: রাজা নেই, ফকির আছে’, ‘সিংহ বাবুর প্রাসাদ এখন মাতৃসেবা সদন’ এবং ‘মর্মর প্রাসাদের নির্মম রূপ’ ইত্যাদি উপ-শিরোনামে লেখক এসব ঐতিহাসিক ভবনকে বর্তমান জীর্ণ-শীর্ণ ঘিঞ্চি বস্তির উঁচু দালান বলে আখ্যা দেন।

লেখক তৃতীয় অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন ‘সাহেবের প্রাসাদনগর’। এই অধ্যায়ে লেখক বর্ণনা করেন ১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট জোব চার্নক নামের এক বণিক ৩৭ জন ইংরেজসহ তাঁর বাণিজ্যতরি নিয়ে ভাগীরথী নদীর তীরে সুতানুটি নামক গ্রামে প্রথম নোঙর ফেলেন। এরপর কীভাবে ইংরেজরা কলকাতায় ধীরে ধীরে তাদের বাণিজ্য প্রসার করেছিলেন, পলাশীর যুদ্ধে বাঙলার নবাব সিরাজদৌল্লাহকে পরাজিত করে কলকাতায় স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপনসহ নগর কলকাতার পত্তন করেছিলেন, তার বিশদ বিবরণ রয়েছে এই অধ্যায়ে। ‘কেরানিপাড়া থেকে বিবাদীগণ’, ‘রাজভবন: প্রাসাদনগরীর প্রথম তিলক’, ‘জোব চার্নকের সমাধিসৌধ’, ‘গ্রেনভিলির তিন প্রাসাদ’, ‘অন্তিম প্রাসাদ: ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধ’ ইত্যাদি উপ-শিরোনামে সেই সকল ইতিহাসের বর্ণনার পাশাপাশি লেখক ওই সকল প্রাসাদ ও স্মৃতি সৌধের স্থাপত্য নকশার তুলনামূলক আলোচনাও করেছেন এখানে। লেখক নিজেও একজন পেশাদার স্থপতি। তাই প্রাসাদ ও স্থাপনার ইতিহাসের সঙ্গে স্থাপনার নকশা, কৌশল, স্থাপত্যরীতি ও কোন প্রাসাদ কোন শহরের কোন প্রাসাদের অনুকরণে নির্মিত, সেই সকল বিষয়ের সংক্ষিপ্ত ধারণা তুলে ধরেন পাঠকদের কাছে। যা ভ্রমণ কাহিনীর পাঠকের কাছে এক পরম পাওয়া হিসাবে উঠে এসেছে।

চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ফুর্তির শহর’। এই অধ্যায়ে ‘বাবুদের বিলাস’, ‘সিটি অব জয়’, ‘কলকাতার বাইজি’ ও ‘সন্ধ্যা নামে পার্ক স্ট্রিটে’ নামে কয়েকটি উপ-শিরোনামে লেখক অষ্টাদশ শতকের শেষ চতুর্থাংশে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে ইংরেজদের বাবুগিরি ফলানোর নানান দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। ওই সময় ইংরেজদের সেবা করার ব্যাপারে চালবাজ ও চালাক চতুর বাঙালিদের মধ্যে স্বেচ্ছায় কাজ করার নানান অনুসঙ্গ ছিল। যদিও জাতিতে সবাই ছিলেন ব্রাহ্মণ, কিন্তু সারাদিন ইংরেজদের নানান কিসিমের সেবা প্রদানের পর বাড়ি ফিরে তারা স্বদেশিদের মধ্যে ব্রাহ্মণের গৌরব ও আধিপত্য রক্ষার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করতেন। ওই সময় শনিবারের কলকাতা ছিল শহরজুড়ে সারা রাত মদ, গাঁজা আর মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করার দিন। বিশেষ করে রামবাগান, সোনাগাছি, মেছোবাজার, সিদ্ধেশ্বরীতলা, হাড়কাটা, চাঁপাতলা, ইমামবক্স, চিৎপুর এলাকায় তখন মদের গন্ধে ম-ম করত। পার্ক স্ট্রিটের পূর্ব নাম ছিল কবরস্থান সড়ক (বেরি গ্রাউন্ড রোড)। এলিজা ইম্পে এসে ডিয়ার পার্ক বানালে তার নাম হয় পার্ক স্ট্রিট। ইংরেজদের জৌলুসকে তুলে ধরতে এখানে তখন এশিয়াটিক সোসাইটি ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজসহ অসংখ্য প্রাসাদ গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে এটি মাদার তেরেসা সরণি নামে পরিচিত। পার্ক স্ট্রিটে এখনও ২৫ ডিসেম্বরের বড়দিন আর থার্টি ফার্স্ট নাইটে ইংরেজ স্টাইলে রমরমা উৎসব হয়, সেসব ঘটনার প্রত্যক্ষ বিবরণ তুলে ধরেন লেখক নিজের উপস্থিতিসহ।

পঞ্চম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ঠাকুরের নগর’। এই অধ্যায়ে ‘কলকাতা মহানগর’, ‘কলকাতার তিন অঞ্চল’, ‘লবণ হ্রদ: বিধান ডাক্তারের নগর’, ‘রাজার হাটে জ্যোতিবাবু’, ‘ইএম বাইপাস: কলকাতার নতুন সরণি’, ‘রবীন্দ্রসরোবর: দক্ষিণ কলকাতার ফুসফুস’, ‘কলকাতার ক্লাব’ ও ‘ঠাকুরের বাজার’, উপ-শিরোনামে লেখক আধুনিক ও বর্তমান কলকাতার সচিত্র ও বিশদ বর্ণনা দেন। কলকাতা নামের উৎপত্তি থেকে কীভাবে আজকের কসমোপলিটন সিটি কলকাতা তার রূপ, সৌন্দর্য, বিস্তৃতি ও ক্রমবর্ধমান নগরায়ন নিয়ে বড় হলো তার এক সংক্ষিপ্ত অথচ পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিসংখ্যান তুলে ধরে লেখক এখানে একজন সত্যিকারের নগর বিশারদের ভূমিকায় নিজেকে উত্তীর্ণ করেছেন। পাশাপাশি আধুনিক কলকাতার বিভিন্ন স্থাপনা, স্মৃতিসৌধ, ভবন, লেক ও স্থাপত্যের ছবিসহ নিখুত বর্ণনায় বইটি একটি নতুন উচ্চতা পেয়েছে। যে কারণে ‘১০ সদর স্ট্রিট’ বইটিকে কেবল ভ্রমণ কাহিনী না বলে এটাকে নগর, স্থাপত্য ও ইতিহাসের একটি অনন্য দলিলের সংশ্রব বলা যায়। বইটি ভ্রমণ কাহিনী পাঠকদের পিপাসা মিটানোর পাশাপাশি বরং নগর ও স্থাপত্য নিয়ে যারা পড়াশোনা করেন, তাদের জন্য একটি মূল্যবান আকরগ্রন্থ হিসাবে বিবেচনা পাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা নগর ও স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন তাদের জন্য বইটি একটি মূল্যবান রেফারেন্স বই হিসাবে এক বাক্যে স্থান পাবার যোগ্য।

ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘কলকাতার ঠাকুর’। এই অধ্যায়ে ‘নেতাজির কলকাতা’, ‘নীল-সাদার কলকাতা’, ‘কলকাতার ঝড়ের পাখি’, ‘বিদ্যাসাগরের কলকাতা’, ‘রাসমণি : কলকাতার রানী’, ‘রামকৃষ্ণ’, ‘স্বামী বিবেকানন্দ’, ‘কলকাতার ভগিনী’, ‘কলকাতায় ক্ষুদিরাম’, ‘মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে’ ও ‘ অক্টারলোনি এখন শহীদ মিনার’ নামে কয়েকটি উপ-শিরোনামে কলকাতার কীর্তিমানদের কথা স্মরণ করেছেন লেখক। ইতিহাসের নানান প্রসঙ্গ তুলে ধরে লেখক এখানে কলকাতার সেই সকল কীর্তিমানদের বিভিন্ন অবদানের কথার পাশাপাশি তাঁদের নামে কলকাতার কোথায় কখন সড়ক, স্থাপনা, স্মৃতিসৌধ, পার্ক বা মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে, তার একটি সুশৃঙ্খল বর্ণনা দিয়েছেন। লেখক সেই সকল ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ব্যক্তির স্মৃতিস্তম্ভ বা ছবিও তুলেছেন, যা বইয়ের পাতায় পাতায় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

সপ্তম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ঠাকুরের গ্রন্থনগরী’। এই অধ্যায়ে ‘আনন্দবাজারে ৪৫ মিনিট’, ‘বইপাড়া কলেজ স্ট্রিট’, ‘কলকাতা যখন গ্রন্থনগরী’, ‘কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস’, ‘কলেজ স্ট্রিট যখন বঙ্কিমের’, ‘রবীন্দ্রনাথের শরৎবাবু’, ‘কলকাতায় নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘মরিবার হলো তাঁর সাধ’, ‘ঢাকায় সুনীল’, ‘কলকাতায় সমরেশ’ ও ‘কলকাতার বইমেলা’ উপ-শিরোনামে লেখকের বিভিন্ন সময়ের স্মৃতিচারণ ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ সদৃশ্য উপস্থাপিত হয়েছে। আমরা যে বাংলায় এখন লিখি বা পড়ি, তার সূচনা হয়েছিল ঊনিশ শতকে এই কলকাতায়। কলকাতায় গেলে লেখক কী কী বিষয়ে অস্থির থাকেন আর নিজের পিপাসা কোথায় কীভাবে মেটান, তার একটি মনোজ্ঞ বিবরণও রয়েছে এখানে।

অষ্টম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘নাটকপাড়ায় ঠাকুর’। এই অধ্যায়ে ‘থেটারের স্বাদ’, ‘কলকাতায় নাটকের সূচনা’, ‘বাবুদের নাটকপ্রীতি’, ‘ঠাকুরবাড়ির নাট্যশালা’, ‘কুনাট্য রঙ্গ থেকে মুক্তি’, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন মূলধারার বাইরে’, ‘একাডেমিতে ‘মহাজনের নাও”, ‘হায় বিনোদিনী’, ”সহজ পরবে’ বিভাস চক্রবর্তী’ ও ‘নাটকপাড়ায় এক বেলা’ উপ-শিরোনামে লেখক নিজের লেখা নাটক ‘মহাজনের নাও’ নিয়ে কলকাতা ভ্রমণের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি কলকাতার নাটকপাড়ার আদি থেকে বর্তমান সময়ের নানান অনুসঙ্গ ইতিহাস ও পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। বাংলা অঞ্চলে নাটকের বয়স পাঁচশো বছরের বেশি। ১৫০৯ সালে শ্রী চৈতন্যদেব প্রথম নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেন। বৈষ্ণবধর্মীয় সেই যে নাটকের মঞ্চায়ন শুরু হলো তার আধুনিকতা পেয়েছিল অষ্টাদশ শতকে ইংরেজদের হাতে এই কলকাতায়। নাটকের শহর কলকাতার সেই সব নাতিদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরার পাশাপাশি লেখকের নিজের অভিজ্ঞতাও ফুটে উঠেছে এই অধ্যায়ে।

নবম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘গঙ্গাপারের খাবার’। এই অধ্যায়ে ‘বাঙালির খাবার’, ‘বিলেতে কলকাতার খাবার’, ‘রবীন্দ্রনাথের খাবার’, ‘কলকাতার স্ট্রিট ফুড’, ‘নেতাজির পেঁয়াজি’, ‘কলকাতার খাবার’ ও ‘কলকাতার মিষ্টি’ উপ-শিরোনামে লেখক কলকাতার আদি ও বর্তমান সময়ের বিভিন্ন ধরনের খাবারের একটি মনোজ্ঞ বর্ণনা দেন। কলকাতার স্ট্রিট ফুডের বর্ণনা থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ বা নেতাজির পছন্দের খাবারের পাশাপাশি লেখক নিজের পছন্দের খাবারের তালিকাও পাঠকদের শোনান। কলকাতার কেসি দাসের রসগোল্লার মত পাঠকেরও তখন জিভে লালা আসার উপক্রম হতে পারে বলে আমার ধারণা। অন্তত যারা প্রথমবার কলকাতা ভ্রমণ করবেন, তাদের জন্য খাবারের এই অধ্যায়টি খুবই তথ্যভিত্তিক।

দশম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘কলকাতার সিনেমা’। এই অধ্যায়ে ‘রবীন্দ্রনাথের সত্যজিৎ’, ‘চলচ্চিত্রের রবীন্দ্রনাথ’, ‘সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ’, ‘নটীর পূজা’র নিউ এম্পায়ার’, ‘সত্যজিতের নন্দন’, ‘কলকাতার গৌতম ঘোষ’ ও ‘মাড়োয়ারিদের টালিউড’ উপ-শিরোনামে কলকাতার সিনেমা জগত ও সেখানে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি বা রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তৈরি সিনেমার একটি বিশদ বর্ণনার পাশাপাশি কলকাতার সিনেমার একটি পরিচয় ফুটে উঠেছে। তবে কলকাতার বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ রবীন্দ্রনাথের উপর ‘জীবন স্মৃতি’ নামে নির্মাণ করেছিলেন একটি ডকুমেন্টারি। যেটি ঋতুপর্ণের শেষ ছবি। এটির কথা আসেনি। এমন কি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছেলেমেয়েরা একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছেন, সেটির কথাও আসেনি। তাই নতুন সংস্করণে এই অধ্যায়ে লেখকের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে অন্তত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কলকাতায় যত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, সেগুলো যাতে তিনি ভবিষ্যতে অন্তর্ভুক্ত করেন। শাকুর মজিদ নিজেও একজন নির্মাতা। তাই চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখকের এই বইয়ে কিছুটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা হয়তো নতুন পাঠকের পিপাসা মেটালেও পুরানো পাঠকদের জন্য কিছুটা তৃষ্ণা রয়ে যাবে বটে।

একাদশ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ঠাকুরবাড়ির গান’। এই অধ্যায়ে ‘নিধুবাবুর টপ্পা’, ‘গানের ঠাকুরবাড়ি’, ‘রবীন্দ্র-উত্তর রবীন্দ্রসংগীত’, ‘রবীন্দ্রসদনের মোহর’, ‘অবাঞ্জিত দেবব্রত’, ‘বাংলা সিনেমায় ঠাকুরের গান’ ও  ‘দোহারের রবীন্দ্র-লালন সংযোগ’ উপ-শিরোনামে লেখক কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের গানের একটি বিশদ বর্ণনা দেন। রবীন্দ্রনাথের গান গ্রামীণফোন রেকর্ড আমল থেকে সিনেমা বা বর্তমান সময়ে ইউটিউবে কিভাবে শ্রোতাদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে, তারচেয়েও রবীন্দ্রনাথের গান কলকাতায় কীভাবে কতোটা মর্যাদা নিয়ে টিকে আছে, তার একটি মনোজ্ঞ বর্ণনা রয়েছে এই অধ্যায়ে। এই অধ্যায়েও লেখক অনেক পুরানো পাঠকের মনভরাতে পারবে কীনা আমার সন্দেহ রয়েছে। আশা করি লেখক রবীন্দ্রনাথের গানের অধ্যায়টিকে আরো তথ্যবহুল ও বিভিন্ন ঘটনার অনুসঙ্গ টেনে ভবিষ্যতে বড় করার উদ্যোগ নেবেন। এই অধ্যায়টিতে আমার অন্তত মন ভরেনি।

দ্বাদশ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘কলকাতা-দর্শন’। এই অধ্যায়ে ‘পিতামহের খিদিরপুরে’, ‘কলকাতা-সিলেট সংযোগ’, ‘কলকাতার টানা রিকশা’, ‘কলকাতার ট্রাম’ ‘ কলকাতার পাতালরেল’, ‘বিড়লার তারকামণ্ডল’, ‘কলকাতার ভিক্টোরিয়া মহল’, ‘ভারতীয় জাদুঘরে’, ‘মার সঙ্গে কলকাতা দর্শন’, ‘গড়ের মাঠ’, ‘ঘোড়ার মাঠ’, ‘হাওড়া ব্রিজ অথবা রবীন্দ্র সেতু’, ‘ হাওড়ার পার’ ও ‘খিদিরপুরের ডকে’ উপ-শিরোনামে লেখক কলকাতার বিভিন্ন স্থানের ভ্রমণের নানান অভিজ্ঞতা ও দর্শনীয় বিভিন্ন জায়গার ইতিহাস ও বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের কথা সচিত্র তুলে ধরেন। এই অধ্যায়টি হয়তো লেখকের পুনঃপুন কলকাতা ভ্রমণে ভবিষ্যতে আরো সমৃদ্ধ হবে। বিশেষ করে লেখকের পিতামহের খিদিরপুরে একসময়ের বসবাসের স্থানটি লেখক যেভাবে আবিস্কার করার নেশায় ছুটেছেন, সেটি পাঠকদের এক নস্টালজিয়ায় নিয়ে যায়। পূর্ব-পুরুষদের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে আমাদের সবারই এমন নস্টালজিক হবার কথা। কিন্তু আশ্চার্য হলেও সত্যি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আটবার বিলেত ভ্রমণ করলেও লন্ডনের কেনসাই গ্রিন সিমেট্রিতে নিজের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমাধি সৌধে একবারের জন্যও যাননি। যেটি আজও আমার মনে এক বড় বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। তাহলে কী রবীন্দ্রনাথ প্রিন্স দ্বারকানাথকে অপছন্দ করতেন? সেই অপছন্দ করার রহস্য তাহলে কী!

ত্রয়োদশ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘১০ সদর স্ট্রিট : চারুলতার নষ্টনীড়’। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছাড়াও কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবাহী অনেকগুলো বাড়ি আছে। পার্ক স্ট্রিটে তিনটি বাড়ি ছিল ৪৯, ৫০ ও ৫২/২ পার্ক স্ট্রিটে। ”উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকো গ্রামে তখন মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথের জমিদারি দেখাশোনা করেন বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মেজো ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের প্রথম বাঙালি সিএসপি হিসাবে বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন আহমেদাবাদে। কলকাতায় এলে থাকেন পার্ক স্ট্রিটের একটা ভাড়া বাড়িতে। জোড়াসাঁকোর বাড়িটি নেহাত গ্রামাঞ্চল বলেই হয়তো তখন নতুন জেগে ওঠা অভিজাত আবাসিক এলাকায় বসবাস শুরু হয় ঠাকুরবাড়ির লোকজনের” (পৃষ্ঠা ২৬০)।  কাদম্বরী দেবীর বয়স তখন ২০ আর রবীন্দ্রনাথের ১৮। এরকম সময়ে মেজো বউঠান জ্ঞানদানন্দিনীর তোপের মুখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্ত্রী কাদম্বরীকে নিয়ে ১০ সদর স্ট্রিটের বাড়িতে ওঠেন। তখন রবীন্দ্রনাথও এই বাড়িতে কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে সময় কাটাতেন। সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে ‘চারুলতা’ ছবিটি নির্মাণের সময়ে ১৯০১ সালের কলকাতাকে অবজ্ঞা করে ১৮৭৯ সালের কলকাতাকে চিত্রিত করেছিলেন। হয়তো নষ্টনীড়ের হোতা যে বাড়িটি, সেই বাড়িটির সময়কে মেলানোর জন্য সত্যজিৎ এটা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৩ সালে বিয়ে করার মাত্র চার মাস পর তাঁর প্রিয় খেলার সাথি এবং প্রেম-স্নেহ ও ভালোবাসার পাত্রী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন!

শাকুর মজিদও সত্যজিতের মত কলকাতার রবীন্দ্রনাথকে আবিস্কারের নেশায় সেই ১০ সদর স্ট্রিটকে কেন্দ্রবিন্দু করেছেন। যা বইটির নামকরণ, ইতিহাস ও ঘটনা পরম্পরার সঙ্গে পাঠককে নতুন করে রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী যুগলের সেই স্মৃতিময় ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’কে স্মরণ করিয়ে দেবে। হয়তো মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে পুত্রবধূ কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট নষ্ট না করা হলে পাঠকের সেই তৃষ্ণা মেটানোর একটা উপায় ছিল।  শাকুর মজিদ তাই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ১০ সদর স্ট্রিটে এসে রবীন্দ্রনাথকে পুনরায় আবিস্কার করার চেষ্টা করেন। হয়তো কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেই অসমাপ্ত কাহিনীকে ১৯০১ সালে নষ্টনীড় গল্পেই রবীন্দ্রনাথ বলার চেষ্টা করেছিলেন। নতুবা তারপর রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘজীবন শান্তিনিকেতন কাটালেও তাঁর প্রধান আশ্রয় ছিল ১০ সদর স্ট্রিটের সেই স্মৃতিময় বাড়ি বা নষ্টনীড়খানি। ‘১০ সদর স্ট্রিট : রবীন্দ্রনাথের কলকাতা’ বইটি শাকুর মজিদের অন্য ভ্রমণ কাহিনীগুলো থেকে নিঃসন্দেহে পাঠকের কাছে ইতিহাস, ঘটনা, পরিবেশ, স্থান, স্থাপত্য, নকশা, চলচ্চিত্র, সংগীত ও রবীন্দ্রনাথকে আবিস্কারের জন্য আলাদা গ্রহনযোগ্যতা দেবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল।

শাকুর মজিদের ‘১০ সদর স্ট্রিট : রবীন্দ্রনাথের কলকাতা’ বইটির প্রচ্ছদ করেছেন লেখকের আলোকচিত্র অবলম্বনে শিল্পী অশোক কর্মকার। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। অফসেট প্রিন্ট ও বোর্ড বাঁধাই বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৭২। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৪৫০ টাকা। কিন্তু বিদেশে বইটি কত ডলারে বিক্রি হয়, সেই তথ্যটি বইটিতে অনুপস্থিত।

৮/৫/২০১৬

কালি ও কলম-এ প্রকাশিত

মন্তব্য
Loading...