১০ সদর স্ট্রিট ঃ রবীন্দ্রনাথের কলকাতা – মঞ্জুশ্রী রায়

ওপার বাংলার চোখে আমার শহর কলকাতা

আমার শহর কলকাতা। আমার বেড়ে ওঠা, শিক্ষা-দীক্ষা এ শহরকে ঘিরেই। আমার বোধ, রাজৗনতিক চেতনা আবর্তিত হয়েছে এই শহরেই। এই শহরের মানুষ বলে প্রচ্ছন্ন এটা অহংকার সবসময় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আমার গর্ব শুধু এই শহরে জম্মেছি বলেই নয় এই শঞরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমন একজন মানুষের নাম যিনি  সবসময় আমাকে আর হয়ত আমার মতন অনেককে প্রতিনিয়ত প্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ। আমার বিনিদ্র রাত কাটে কখনও রবীন্দনাথের গল্পে-গানে। কখনও কখনও কণ্ঠে তুলে নিই সেই গান। গানের তরি ভাসিয়ে পেরিয়ে যাই সুখ-দুুঃখের হাজারও সোপান।

আমাকে পথ দেখায় রবীন্দ্রনাথ। এই শহরের চিরকালীন গর্বের ধন আমার রবীন্দ্রনাথ। এই শহরের অলি-গলি দিয়ে যখন হাঁটি তখনও রবীন্দ্রনাথ এভাবে জড়িয়ে আছে আগে বুঝিনি। বরং বলা ভাল আমার চোখ খুলে দিলেন শাকুর মজিদ। শাকুর মজিদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় নাটকের মাধ্যমে। সম্ভবত অনীকের গঙ্গা যমুনা নাট্যোৎসবে বাংলাদেশের ‘সুবচন’ নাট্য সংস্থার ‘মহাজনের নাও’ নাটকের মধ্য দিয়ে। বলতে দ্বিধা নেই এমন নাটক দেখার জন্য আমরা চাতক পাখির মতন অপেক্ষায় থাকি। নাটকের বিষয় আমাকে টেনে নিয়ে যায় ওপার বাংলায় আমার পিতৃভ‚মিতে। দেশভাগের যন্ত্রনা বুকে নিয়ে এপার বাংলায় পিতৃপুরুষরা চলে না এলে শোষণ যন্ত্রনা মহাজনি ফাঁসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংগ্রামরত আমার ভাইবোনেদের পাশে হয়ত আমিও একজন হতে পারতাম। সে প্রসঙ্গ ভিন্নতর। শাকুর মজিদের নাটক আমাকে ভাবিয়েছিল। যেমন এখন ভাবাচ্ছে শাকুরের ‘১০নং সদর স্ট্রিট: রবীন্দ্রনাথে কলতকাতা’ গ্রন্থটি।

সদর স্ট্রিট দিয়ে এজীবনে বহুবার গিয়েছি। দেখেছি রবীন্দনাথের আবক্ষ মূর্তি। অনুমান করেছি মূর্তিসংলগ্ন পাশের বাড়িটিতে রবীন্দ্রনাথ একসময় বসবাস করতেন। লিখেছেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাসহ অসংখ্য সৃষ্টির সঙ্গে এই বাড়ির ইতিহাস জড়িয়ে আছে। আমাদের ভাবনায় যে কতটা গলদ আছে শাকুর মজিদ ধরিয়ে দেন। ঊনিশশো নব্বই সালে প্রথম এই শহরে আগমন, তারপর বিগত হয়েছে ছাব্বিশ বসন্ত। লেখকের সঙ্গে এই শহরের একটা সখ্যতা গলে উঠেছে। সেই সখ্যতা রূপ পেয়েছে নিবির পাঠ ও অনুশীলনে। এই শহরের পরতে পরতে মিশে আছে আমাদের রবীন্দ্রনাথ। শুধু আমাদেরই বা বলি কেন দুই বাংলার রবীন্দ্রনাথ। সেই রবীন্দ্রনাথকে তিনি পড়েছেন এই শহরের ইট -চুন-সুরকির ইমারতে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পাশাপাশি স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব আবিস্কার করেছেন লেখক। মাত্র পঁচিশবার এই দেশ তথা এই শহর কলকাতা পরিভ্রমণে।

সোয়া তিনশো বছর আগে ইংল্যান্ড থেকে আসা বেনিয়ারা কলকাতায় বাণিজ্য শরু করেছিল। সৌজন্যে জব চার্নক। সুতানুটি থেকে কলকাতা। সে এক দীর্ঘ ইতহাস। যদিও পাশাপাশি সময়ে অধুনা বাংলাদেশের যশোর থেকে এক কুশারী ব্রাহ্মণ পরিবার ভাগ্যান্বেষণের জন্য কলকাতায় চলে আসে। এই পরিবারের সদস্য দ্বারকানাথ ঠাকুর একদা এখানকার মানুষের কাছে ইংরেজ রাজপুত্রের মতন সমাদর পেতে শুরু করেন। বৃটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতাকে ‘সিটি অব জয়’ নানা নামে অভিহিত করা হতে থাকে। একসময় রাজধানী কলকাতা থেকে স্থানান্তর হয়, ইংরেজরাও দেশ ছাড়ে কিন্তু রয়ে যায় পরাধীন ও স্বাধীন ভারতে রবীন্দ্রনাথের নানান স্মৃতি। সে ছবি মনের গোপন মণিকোঠা থেকে উজান বেয়ে সামনে চলে আছে এক কাÐারি, তিনি রবীন্দ্রনাথ। শাকুর মজিদ সেই রবীন্দ্রনাথকে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন একেবারে ছবির মতন। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সে আঁকা ছবির মতনই।

লেখক পরিব্রাজক শাকুর মজিদ তেরোটি অধ্যায়ে সাজিয়েছেন দশ নং সদর স্ট্রিটের শরীর। ঠাকুরের গ্রাম, বাবুদের দরদালান, সাহেবের প্রাসাদনগর, ফুর্তির শহর, ঠাকুরের নগর, ঠাকুরের গ্রন্থনগরী, নাকটপাড়ায় ঠাকুর, গঙ্গাপাড়ের খাবার, ঠাকুরের সিনেমা, ঠাকুরবাড়ির গান, কলকাতা-দর্শন ও ১০নং সদর স্ট্রিট : চারুলতার নষ্টনীড় নামক এই তেরোটি অধ্যায়ই সুচিন্তিত এবং পাঠে লেখকের একটি গবেষণাধর্মী মননের পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও ব্যাক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে অন্যান্য অধ্যায়ের তুলনায় নাকটপাড়ার ঠাকুর পাঠে কোনও নতুন তথ্য বা অনুসন্ধিষ্ণু মননের সন্ধান পাওয়া যায় না। আশার কথা হলো বইটি যেকোন জায়গা থেকেই পাঠ করা যায় এবং পাঠকের হৃদয়ের কোন না কোনভাবে জায়গা করে নেয়। এমন একটি মূল্যবান গ্রন্থ দুই বাংলার পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে বাংলাদেশের প্রথমা প্রকাশন। কিন্তু এই মুহূর্তে এপার বাংলার পাঠক দশ নং সদর স্ট্রিট কিভাবে পেতে পারেন বইটিতে কোনও হদিশ নেই।

দৈনিক গণশক্তি , মার্চ ২০১৭

মন্তব্য
Loading...