গতকাল ২০ এপ্রিল শুক্রবার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি’র জাতীয় নাট্যশালায় রেকর্ডসংখ্যক হাউজফুল দর্শকের উপস্থিতিতে উদ্ধোধনী মঞ্চায়ন হলো নাট্যদল প্রাঙ্গণেমোর-এর ১৩তম প্রযোজনা ‘হাছনজানের রাজা’। আজ ২১ এপ্রিল শিল্পকলার এক্সপারিমেন্টাল হলে অনুষ্ঠিত হবে নাটকটির দ্বিতীয় মঞ্চায়ন।

‘হাছনজানের রাজা’ নাটকটির রচয়িতা নাট্যকার শাকুর মজিদ ও নির্দেশক অনন্ত হিরা। মরমী গীতিকবি, মিস্টিক দার্শনিক ও জমিদার দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী’র বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় জীবনকে ঘিরেই এই নাটকের কাহিনী। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রামপাশা, লক্ষন শ্রী ও সিলেটের একাংশ নিয়ে একসময় দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী’র ছিল পাঁচ লাখ বিঘা সমান এক বিশাল জমিদারি।
জমিদার হাছন রাজা একদিকে যেমন ছিলেন প্রচলিত শাসকদের মতো অত্যাচারী, নারীভোগী, মদ্যপ, বাইজী সংস্কৃতিতে আসক্তি, সুদক্ষ কুড়া শিকারী, স্বেচ্ছাচারী, বেখেয়ালী ও ঘোড়ার খায়েশওয়ালা। তেমনি অন্যদিকে তিনি ছিলেন ভীষণ সংগীতপ্রিয়, সুতীব্র মাতৃভক্তি, জনহিতৈষী মানবদরদী, বিশাল জমিদারী জনগণের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে জনকল্যাণ কাজে নিজেকে উৎসর্গ করায় মতো একজন ত্যাগী শাসক।
যিনি ভাওয়ালী নৌকায় বাউলা সেজে ঘুরে বেড়ানো এক রহস্যময় সাধক। উদাস পিয়াসীর সন্ধানে যিনি হাওরে-বাওরে ঘুরে বেড়ান। আর নিজের মধ্যে সেই পরম সৃষ্টিকর্তাকে নিরন্তর খুঁজতে থাকা এক মরমী কবি ও মিস্টিক ফিলোসফার।
‘হাছনজানের রাজা’ নাটকে মূলত হাছন রাজা’র এই বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় জীবনের একপর্যায়ে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর, জীবন সম্পর্কে তাঁর আত্ম-উপলব্ধি ও মরমি সাধক হয়ে ওঠার গল্পকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেখানে তাঁর জগত সম্পর্কে এমন এক উলদ্ধি হয় যে, এ জগত সংসারের সব অত্যাচার-অনাচারের শিকড়ে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত ধন-সম্পদ। অথচ মহাকালের হিসাবে মাত্র অল্প কিছু দিনের জন্য এই পৃথিবীতে অতিথি হয়ে আসা মানুষেরা আসলে মহাজগতের সেই পরম মহাশক্তির কাছে একেবারেই নশ্বর।
সেই বোধের পর তিনি তাঁর সমস্ত ধন-সম্পদ জন কল্যাণের জন্য উইল করে দেন। তারপর নিজের কয়েকজন সঙ্গিনীকে নিয়ে হাওরে হাওরে ভাওয়ালী নৌকায় ভাসতে থাকেন। আর সাধন করতে থাকেন সেই পরমেশ্বরের। পরম সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজতে খুঁজতে এক সময় এই মরমী সাধক আবিস্কার করেন, তাঁর নিজের মধ্যেই সেই পরমেশ্বরের বসবাস। তাঁর যে পিয়ারীকে সবাই ‘হাছনজান’ বলে জানে-চেনে, সেই আসলে হাছন রাজা। অথচ জগতের মানুষের কাছে যিনি রাজা হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন, হাছন রাজা’র কাছে সে কেউ নয়, বরং পিয়ারী হাছনজানের ভেতরেই বিরাজমান এক প্রকৃত হাছন রাজা।
কাব্যধর্মী এই নাটকে হাছন রাজা’র জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কেই অত্যন্ত সুকৌশলে, শক্তিশালী মেটাফোরের ভঙ্গিতে, হাওরের রহস্যময় ভরা পূর্ণিমার জোছনায়, এক জাদুময় কায়দায় তুলে ধরেন লেখক শাকুর মজিদ। পয়ার আর অক্ষরবৃত্ত ছন্দের এক জটিল জাদুবাস্তবতায় শাকুর মজিদ যে নাটকটি রচনা করেছেন, যা লেখক শাকুর মজিদকে নতুন করে আবিস্কার করার এক প্রয়াসকে বরং উসকে দেয়। তাই আমরা বলতে পারি শাকুর মজিত মূলত একজন নগর বাউল ও কবি। কিন্তু চর্চা করেন গদ্য আর সন্ধান করেন শেকড়ের ভেতরের শেকড়।
এর আগে আমরা শাকুর মজিদকে সুনামগঞ্জের আরেক বাউল শাহ আবদুল করিমের জীবনী নিয়ে নাটক লিখতে দেখেছি। শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘মহাজনের নাও’ নাটকে আমরা নাট্যকার শাকুর মজিদকে প্রথম আবিস্কার করি। শাহ আবদুল করিম ও হাছন রাজা এই দু’জনের সাধনার লক্ষ্য যদিও এক এবং অভিন্ন। কিন্তু এই দুই মরমী সাধকের জীবনযাপনে অনেক তফাৎ ছিল। উভয়ের বেড়ে ওঠা এবং বোধোদয়ের প্রেক্ষাপটও ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।
বাউল শাহ আবদুল করিম ও হাছন রাজা যদিও একই ঘরানার গীতিকবি, কিন্তু তাঁদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ছিল একদম ভিন্ন। করিম যেখানে অনেকটা বাউল ঘরানার মানুষ ছিলেন, সেখানে হাছন মোটেও বাউল ছিলেন না, বরং নিজেকে তিনি বাউলা বলতেন। তাছাড়া করিম ছোটবেলা থেকেই একই রকমের চিন্তা নিয়ে বড় হয়েছিলেন। অন্যদিকে হাছনের জীবনের পরিবর্তন আসে মধ্যবয়সে, তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর। হাছনের চরিত্র তাই করিমের চেয়ে বর্ণিলতায়, বৈচিত্র্যময়তায় ও দ্বান্দিকতায় ভরপুর। যেখানে দিনের হাছন আর রাতের হাছন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ ছিলেন। ভূমির হাছন আর হাওরের হাছন ছিলেন আলাদা মানুষ।
এর আগে শাকুর মজিদকে আমরা চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে চিনি। চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন মেটাফোর ও মনতাজকে তিনি মঞ্চ নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করেছেন। যে কারণে শাকুর মজিদের হাতের সোনার কলমটি থেকে ঝড়ঝড়ে এক পয়ার ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মিশেলে পরপর রচিত হলো ‘মহাজনের নাও’ ও ‘হাছনজানের রাজা’র মতো দুটি জাদুবাস্তব নাটক। দুটি নাটকই কাব্যধর্মী ও গীতিময়। সুরের ঝর্ণায় দুটি নাটকই যেন ভরা পূর্ণিমায় দর্শকের চোখে জাদু আর রহস্য ছড়িয়ে যায়। যে রহস্যের কোনো শেষ নেই!
নাট্যকার শাকুর মজিদ ও নির্দেশক অনন্ত হিরা জুটি ‘হাছনজানের রাজা’ নাটকে মূলত সমসাময়িক কালের মানস সরোবরের ভাবনায়, কল্পনায়, মোহে ও প্রেরণায় একশো বছর আগের হাছন রাজাকে দেখাতে চেয়েছেন। ফলে পুরো নাটকটি এগিয়ে যায় গানে আর সংলাপে জোটবদ্ধ হয়ে। দর্শক দেখতে পায় যৌবনে জমিদার দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী’র বেপরোয়া জীবন এবং মায়ের মৃত্যুর পর জীবন সম্পর্কে তাঁর পরম উপলব্ধি ও মরমী সাধক হয়ে ওঠার গল্প। একালেও অনেকের ভেতরে হয়তো এমন একজন ত্যাগী ও ভোগী, সংগীতপ্রিয় ও মাতৃভক্ত, আত্মানুসন্ধানী ও উদাসী বাউলা হাছন রাজা দুর্দান্ত প্রতাপ নিয়ে বসত করে।
যেখানে জীবন সম্পর্কে একজন ভোগবাদী সামন্তপ্রভুর ধারণা পাল্টানোর সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধান করতে হাছন রাজাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে দেখা যায়। সেখানে গতানুগতিক ধারায় হাছন রাজা’র জীবনী তুলে না ধরে বরং এই মানিকজোড় হাছন রাজাকে উপস্থাপন করেন এই প্রজন্মের তারুণ্যের চলমান আড্ডায়, মস্করায়, ঠাট্টায় ও সমকালীন ফেসিনেশান ফেসবুকে। যেখানে সেই তরুণেরা এক রহস্যময় ভরা পূর্ণিমা রাতে নৌকা ভ্রমণে বের হয়। একসময় তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় এই বাউলা হাছন রাজার।
এ যুগের তরুণদের সেই নৌকার আড্ডায় হাছন রাজা তাঁর সঙ্গিনীদের নিয়ে একসময় সুর-রিয়ালিস্ট ধারার মতো মিশে যান। এ যুগের তরুণেরা কখনো তাঁর সঙ্গে সেলফি তোলে, কখনো তাঁকে নিয়ে ফেসবুকে মজার মজার স্টাটাস দেয়। আবার কখনো বাস্তবে বা কখনো কল্পনায় তারা এই হাছন রাজাকে তাদের সঙ্গী হিসাবে পায়। এ এক নতুন ধারার সুর, এ যেন এক নতুন মাত্রার ঢঙ। এ যেন এক নতুন যুগের মিশ্রণ। এ যেন একশো বছর আগের সেই হাছন রাজাকে সমকালীন তরুণদের সাথে টুইস্ট করার এক নয়া কৌশল।
‘হাছনজানের রাজা’ নাটকটি প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলের ১৩তম প্রযোজনা। নাটকটির মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন ফয়েজ জহির, সঙ্গীত পরামর্শক ছিলেন সেলিম চৌধুরী ও সূর্যলাল দাস। সঙ্গীত পরিকল্পনা করেন রামিজ রাজু, আলোক পরামর্শক ঠান্ডু রায়হান, আলোক পরিকল্পনা তৌফিক আজীম রবিন এবং পোশাক পরিকল্পনা করেছেন নূনা আফরোজ।
‘হাজনজানের রাজা’ নাটকটিতে ‘হাছন রাজা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন রামিজ রাজু। নাটকে রামিজ রাজু একাই এই নাটকের কেন্দ্র থেকে পরিধি, পরিধি থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তার ঘটান। চমৎকার অভিনয়, সুরেলা কণ্ঠ ও সুনিপুন স্টেপ ও বিচরণে রামিজ রাজু ছিলেন সত্যি সত্যিই ভারী চৌকশ। এর বাইরে নৌকার মাঝি চরিত্রটিকে আমরা উজ্জ্বলভাবে আবিস্কার করতে পারি। সে তুলনায় বরং অন্যান্য চরিত্রগুলো’র অভিনয়ে কিছুটা দুর্বলতা ছিল। বিশেষ করে সংলাপ প্রক্ষেপণে সুস্পষ্টতার অভাব এবং পদক্ষেপের ধরনে বৈচিত্রের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
‘হাজনজানের রাজা’ নাটকটিতে অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাইনুল তাওহীদ, সাগর রায়, শুভেচ্ছা রহমান, প্রকৃতি শিকদার, সবুক্তগীন শুভ, জুয়েল রানা, সানজিদা সরকার আশা, সুজয় দাশগুপ্ত, নিরঞ্জন নিরু, মনোয়ার মান্নান প্রীতি, সুমন মল্লিক, বাঁধন সরকার ও রুমা আক্তার।
নাটকে ঠান্ডু রায়হানের লাইট ছিল দুর্দান্ত। বিশেষ করে হাছন রাজার মায়ের মৃত্যু’র দৃশ্যটির লাইট ছিল সত্যি সত্যিই ভারী নস্টালজিক। ফয়েজ জহিরের সেট সেই তুলনায় সাদামাটা হলেও নাটকের সাথে বেমানান মনে হয়নি। বরং নূনা আফরোজ কস্টিউম ডিজাইনে আরো কিছুটা নতুন ভাবনার মিশেল ঘটলে নাটকটি আরো হৃদয় হন্তারক হতে পারতো। বরং নাটকটি রামিজ রাজু’র একক সুরেলা কণ্ঠের উপর ভর করে এসব ছোটখাটো টেকনিক্যাল বিষয়কে উত্তীর্ণ করতে বেশি সহায়ক ছিল।
এর আগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে ১৬ এপ্রিল ‘হাজনজানের রাজা’ নাটকটির একটি কারিগরি মঞ্চায়ন হয় এবং ১৯ এপ্রিল দ্বিতীয় আরেকটি কারিগরি মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়। আজ ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপারিমেন্টাল হলে নাটকটির দ্বিতীয় মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হবে।

নাট্যদল প্রাঙ্গণেমোর-এর ১৩তম প্রযোজনা ‘হাছনজানের রাজা’ উপহার দেওয়ার জন্য নাট্যকার শাকুর মজিদ ও নির্দেশক অনন্ত হিরাকে এবং প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলের সবাইকে আমার অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। জয়তু প্রাঙ্গণেমোর। জয়তু ‘হাছনজানের রাজা’।
মঞ্চায়ন শেষে দর্শক প্রতিক্রিয়া
[media_video id=”7857f26aaa79c2d77bd37f784c8c065f” url=”https://www.youtube.com/watch?v‹´›zjVY6P2zopY” width=”1400″ height=”1000″ hide_on_desktop=”false” hide_on_mobile=”false” animation_on_scroll=”{‹²›animation_enable‹²›:‹²›no‹²›,‹²›yes‹²›:{‹²›animation_type‹²›:‹²›fadeIn‹²›,‹²›animation_delay‹²›:‹²›0‹²›}}” _array_keys=”{‹²›animation_on_scroll‹²›:‹²›animation_on_scroll‹²›}” _fw_coder=”aggressive” __fw_editor_shortcodes_id=”f50c097043c8497edcf3baba704e3fbd”][/media_video]
——————————
২১ এপ্রিল ২০১৮
উদ্বোধনী শো দেখার পর প্রতিক্রিয়া