হুমায়ূন আহমেদ- বললেই চোখে ভেসে ওঠে এক শব্দ-জাদুকরের ছবি। তার ভক্ত গুনে শেষ করার নয়। মৃত্যুর পরও হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশে অচিন্তনীয় জনপ্রিয় এক নাম।
তাকে যারা পছন্দ করেন তাদের “হুমায়ূন আহমেদ: যে ছিল এক মুগ্ধকর” বইটি অবশ্যই ভাল লাগবে। আবার যারা অপছন্দ করেন তারাও এই বই থেকে তাকে নতুন করে জানার সুযোগ পাবেন। বইটির লেখক Shakoor Majid এখানে চমৎকার সব তথ্য দিয়ে পাঠককে হুমায়ূনের চারপাশে আটকে রেখেছেন।
শাকুর মজিদ এর কোন লেখা আমি আগে পড়িনি; তার লেখা লন্ডনী কইন্যার নাম যশ শুনেছি। বই পড়ে বুঝলাম তার লেখার হাত বেশ। হুমায়ূন আহমেদ এর মতো একজন আলোচিত, সমালোচিত এবং জনপ্রিয় লেখকের ব্যক্তিত্বকে আঘাত না করে তার দোষগুণকে সমান্তরালে রেখে যে কোন কিছুই লেখা এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মতো। শাকুর মজিদ সেই চ্যালেঞ্জ দক্ষ হাতেই সামলেছেন- সন্দেহ নেই। নানা তথ্য দেয়ার পাশাপাশি লেখক এই বইতে নিজের চোখ দিয়েও হুমায়ূনকে মাপার চেষ্টা করে গেছেন; পড়ে মুগ্ধ হয়েছি।
যা হোক, প্রথমা প্রকাশনীর এই বই থেকে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কিত কিছু তথ্য পাঠককে দেয়া যাক-
হুমায়ূন আহমেদ সবাইকে কথা বলে মুগ্ধ করে ফেলতেন। অনেকই তার চরম ভক্ত বনে যেতো। যেমন, অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ এর আসল নাম মাহফুজ রহমান। হুমায়ূন আহমেদ এর ভক্ত হিসেবে তিনি নিজের নাম বদলে আহমেদ রাখেন।
হুমায়ূন আহমেদ কড়কড়ে নোট পছন্দ করতেন, চেক গ্রহণে মজা পেতেন না। ১৯৯৮ সালে অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম Moinul Ahsan Saber এর মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের কাছে একটি উপন্যাস চান। হুমায়ূন ১০ লক্ষ টাকা দাবী করেন। মঈনুল আহসান সাবেরকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশক ১০ লাখ টাকার বস্তা নিয়ে তার বাসায় উপস্থিত হন।
পূত্র সন্তানের আশায় হুমায়ূন আহমেদ স্ত্রীকে নিয়ে শাহজালাল (র.)-এর মাজার পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
বাকের ভাই চরিত্রে প্রযোজকের পছন্দ ছিল তারিক আনাম। হুমায়ূন চেয়েছিলেন আসাদুজ্জামান নুরকে। পরবর্তীতে ঘেটুপূত্র কমলার আগ পর্যন্ত আর তারিক আনাম হুমায়ূনের সাথে কাজ করেননি।
যদি মন কাঁদে,
তুমি চলে এসো এক বরষায়
যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী
কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি
https://www.youtube.com/watch?v=fv3V9BFfcE8
“আমার আছে জল” ছবির এই গানটি লেখার ইতিহাস হলো, হুমায়ূন আহমেদের বয়ানে- “নুহাশপল্লীতে আমি একা পড়ে আছি। বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ শাওন নেই। এটা আমি সহ্য করতে পারছি না। এদিকে শাওনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা একান-ওকান হয়ে তার বাবা-মার কাছে চলে গেছে। শাওনকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। কোন অবস্থাতেই তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হবে না।
এসময় মুক্তিযোদ্ধার সাহস নিয়ে আমি একটা চিঠি লিখলাম শাওনের মার কাছে। চিঠিসহ ড্রাইভার চলে গেল তাদের বাসায়। বিকেলে দেখি শাওন এসে হাজির।” চিঠির ভেতরেই তিনি এই গানের কথাগুলো লিখেছিলেন।
শাকুর মজিদ হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানাতে চেয়েছিলেন। কথাটা তাকে বলার পর তিনি কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই শাওন বলে ওঠে, “হবে না, ওকে নিয়ে আমি ডুকমেন্টারি বানাবো।” ডকুমেন্টারিটা আর বানানো হয়নি।
হুমায়ূন আজাদকে নিয়ে তিনি একটা গল্প বলতেন। হুমায়ুন আজাদ প্রায়ই হুমায়ূন আহমেদকে বলতেন, তোমার লেখা ভালো, কিন্তু গভীরতা নেই। একবার গভীরতা আনার জন্য তিনি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একটা গল্প নিজ হাতে কপি করে নিয়ে যান। শুধু চরিত্রের নামগুলোকে মুসলমান করা হলো, পরিবর্তন এটুকুই। হুমায়ুন আজাদ নাকি এই গল্প পড়ে বললেন, হুম সবই ঠিক আছে, গভীরতা একটু কম।
গৌতম ঘোষের বহুল আলোচিত মনের মানুষ ছবিটি হুমায়ূন আহমেদ অর্ধেক দেখেই হল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দুই বাংলার সেরা লেখক বলায় তিনি শাকুর মজিদের ওপর বেশ চটেছিলেন।

২০১০ এর কোন একদিন। হুমায়ূন শাকুর মজিদকে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, “জানো শাকুর, আমার সবচেয়ে ছোট যে মেয়ে, বিপাশা, আমার সবচেয়ে আদরের মেয়ে ছিল। ওর গায়ের গন্ধ না শুঁকলে আমার ঘুম আসত না। সে যখন একটু বড় হয়ে গেল, আমার বিছানা ছেড়ে দিল। একদিন ছোট্ট একটা শিশি দিয়ে বলে, বাবা, এই শিশির মধ্যে আমার গা ধোয়া পানি আছে। শুঁকে দেখো, আমার শরীরের গন্ধ পাবে।………….জানো আজ তার গায়ে হলুদ হচ্ছে ও বাড়িতে। কাল তার বিয়ে হচ্ছে। আজ বিকেলে নুহাশ এসেছিল একটা কার্ড নিয়ে। কার্ডটি হাতে নিয়ে বললাম, বাবা, তোমাদের কার্ডে একটা মারাত্মক প্রিন্টিং মিসটেক আছে, এটা সংশোধন করতে পারবে?
নুহাশ ড্যাব ড্যাব করে তাকায়।
তাকে বললাম, এখানে তোমাদের লেখা উচিত ছিলা- পিতা মৃত ড. হুমায়ূন আহমেদ। মৃত কথাটি থাকলেই বরং তোমাদের জন্য অনেক সুবিধা হতো। বিপাশার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা “বাবা কোথায়” টাইপের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পেত না।”
(ফেইসবুক থেকে)