যা পড়েছি
যা জেনেছি
গ্রন্থ: পাবলো নেরুদার দেশে
লেখক: শাকুর মজিদ ( #Shakoor_Majid )
প্রচ্ছদ: শাকুর মজিদ ও প্রতীক ডট ডিজাইন
প্রকাশক: অবসর প্রকাশনা সংস্থা
৪৬/১ হেমেন্দ্র দাস রোড, সূত্রাপুর; ঢাকা-১১০০।
মূল্য: ১০০ টাকা।
লেখক শাকুর মজিদ-এর ‘কালাপানি’ গ্রন্থের ন্যায় এটিও একটি ভ্রমণ কাহিনী। ভ্রমণপিয়াসী পঞ্চ পর্যটক এবার এশিয়া-ইউরোপ ছেড়ে ভৌগলিক অবস্থানের আমাদের একদম বিপরীতে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে ছুটে যান।
লেখক শাকুর মজিদের ‘কালাপানি’ বই পড়ে পঞ্চ পর্যটক বা পিপি-এর নামসমূহ জানার আগ্রহ ছিল। অবশেষে পঞ্চ পর্যটক বা পিপি বা পঞ্চ স্থপতির নাম জানা গেলো। স্থপতি কাজী মোহাম্মদ আরিফ, স্থপতি তরিকুল ইসলাম লাভলু, স্থপতি রেজাউল করিম, স্থপতি এনায়েত কবীর এবং লেখক ও স্থপতি শাকুর মজিদ। লেখক এই বইটি তাঁর অপর চার সুপ্রিয় সফরসঙ্গীর নামে উৎসর্গ করেছেন।
এই বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপে লেখক শাকুর মজিদ সম্পর্কে অপর শ্রদ্ধেয় স্থপতি ও পঞ্চ পর্যটক-এর একজন তরিকুল ইসলাম লাভলু লিখেছেন, শাকুরকে দিয়ে কিছু একটা শুরু করানো কঠিন। অথচ একবার শুরু করাতে পারলে সেই কাজের পরিসর সে আদিগন্ত প্রসারিত করে তার ভেতর ওড়াতে থাকে হাজার ফানুস। চরিত্রের এই দিকটি জানি বলেই আমাদের পিপি (পঞ্চ পর্যটক) ট্যুরে শাকুর মজিদ হয়ে যায় অনিবার্য।
লেখক শাকুর মজিদ সম্পর্কে পঞ্চ পর্যটক-এর সদস্য স্থপতি তরিকুল ইসলাম লাভলু-এর এই কথার সঙ্গে আমিও শতভাগ একমত। তিনি শুধু পরিব্রাজক নন। তিনি তাঁর চোখের দেখা কানের শোনা বিষয়গুলো চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতোই অত্যন্ত সহজবোধ্য ও হৃদয়গ্রাহী করে পাঠকের কাছে তুলে ধরেন। এ এক অসাধারণ গুণ।
লেখক ও স্থপতি শাকুর মজিদ অন্যান্য স্থপতিগণের সঙ্গে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে ‘পন্তিফিশিয়া ক্যাথলিকাত ইউনিভার্সিদাদ দ্য চিলি’-তে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক স্থাপত্য সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। তাঁদের মতো পৃথিবীর প্রায় আরও ১০০ দেশের স্থপতিগণ এই Power and Low Energy Architecture (PLEA) সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলি। স্বৈরশাসক পিনোচেট এবং নোবেলজয়ী প্রেমিক ও বিপ্লবী কবি পাবলো নেরুদার চিলি সাধারণ মানুষ কমই জানে। ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এই দেশটি বেশ পরিচিত। ভিদাল, সানচেজ, বার্গাস প্রমুখ ফুটবল খেলুড়েদের খেলা আমিও কম-বেশি দেখি। ওদের নিয়ে আলোচনা করি। পিনোচেট ও পাবলো নেরুদা আমাদের আলোচনায় ঠাঁই পায় না।
ব্রাজিলের রাজধানী সাওপাওলো বিমান বন্দরে পঞ্চ পর্যটক-এর ভোগান্তি দিয়ে এই ভ্রমণ কাহিনী শুরু হয়েছে। যাত্রার শিডিউলের বাইরে ব্রাজিলের রাজধানীতে পাঁচ তারকা হোটেল থাকার সুযোগ পেয়ে তাঁদের মনের ‘ফুর্তি’ বেড়ে গেলেও পরে ট্রানজিট না পেয়ে বিমান বন্দরে কারাবন্দির ন্যায় রাত্রিযাপনের রসাত্মক বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক একজন প্রাক্তন ক্যাডেট হিসেবে ক্যাডেট কলেজের উপমা দিতে বেমালুম ভুলে গেছেন। তবে ফাইভ স্টার হোটেলের পরিবর্তে ফ্লোর স্টার-এর (বেরসিক পাঠক ভুলে ফোর স্টার পড়বেন না যেন) উল্লেখ সেই ভুলে যাওয়ার মাশুল হিসেবে উশুল হয়ে গেছে।
সান্তিয়াগোর পথে আধবুড়ি (লেখকের ভাষায়) বিমানবালাদের বাদামি চামড়ার আরোহীদের প্রতি আচরণ, পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতমালা আন্দিজ, স্প্যানিশ নাবিকদের যা বিজয় ও আবিষ্কার তা চিলির আদিবাসীদের কাছে পরাজয় ও দস্যুপনা, পর্তুগিজ নাবিক কলম্বাসের অভিযানের মাধ্যমে ইউরোপীয় লুটেরা বণিকদের উত্তর আমেরিকা দখল, প্লাজা দ্য আরমাস, সান্তিয়াগোর স্থাপত্য ইত্যাদির ঐতিহাসিক ও সুবিন্যস্ত বর্ণনা খুব ভালো লেগেছে।
তবে লেখক সেদেশের একজন পটুয়ার কাছে নিজকে ‘বাংলাদেশী’ পরিচয় দেওয়ায় সে চিনতে পারেনি। কিন্তু ভারতীয় বলায় সে চিনতে পারে। বিদেশ বিভূঁইয়ে এই বিড়ম্বনার কথা আগেও শুনেছি। কিন্তু নিজকে আমি কোনভাবেই ভারতীয় ভাবতে নারাজ। এই বিষয়টি আমার জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর ও কষ্টকর মনে হয়।
এখন ফুর্তিবাজ চিলিদের বিভিন্ন দিকও আলোচিত হয়েছে। চিলির বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- সংসদ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর সঙ্গে লেখকের কথোপকথন সারাবিশ্বের সকল ছাত্রের জন্য প্রযোজ্য। ছাত্ররা শুধু তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরা ও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তবে কেউ হেরে গেলে কারচুপির অভিযোগ না তুলে তার চেয়ে যোগ্যতর কেউ নির্বাচিত হয়েছে মেনে নিয়ে তাকে অভিনন্দন জানানোর মানসিকতা থাকতেই হবে।
বিদেশে ভিন্ন ভাষা জ্ঞান না থাকায় হাস্যকর অনেক ঘটনা শুনেছি। লেখক হোটেলে গিয়ে পরোটা খাওয়ার জন্য ডিম ভাজি খেতে চেয়ে ওয়েটারকে ছবি এঁকে বোঝানো এবং ডিমের পরিবর্তে আলু সেদ্ধ ও মাংসের তৈরি পিণ্ড নিয়ে হাসাহাসি করা, পরিশেষে মুরগির নীচে ডিম এঁকে সমাধান পাওয়ার বিষয়টি অভিনব মনে হয়েছে।
যাকে ভিত্তি করে এই বইটি রচিত হয়েছে তার বিস্তারিত ও বিশদ বিবরণ ‘নেরুদা’ অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে তার জন্ম, বেড়ে উঠা, কবিত্বের বিভিন্ন বিষয়, তার প্রেম, বহুবিবাহ, ভোগবাদি জীবন, তার মৃত্যু, তার বাসস্থান নির্মাণ, সেসব সংরক্ষণের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও পর্যটকদের আকর্ষণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে।
পঞ্চ পর্যটক সান্তিয়াগোর বাইরে বেড়ানোর সুযোগ পান। তাদের গাইড এঞ্জেলিকা নাম্নী একজন তরুণী। মজার ব্যাপার হলো সে তার অসুস্থ বোনের চাকুরি বাঁচাতে ট্যুরিস্ট গাইডের দায়িত্ব পালন করতে এলেও এ ব্যাপারে তার ন্যূনতম ধারণা নেই। পঞ্চ পর্যটক ওর প্রতি মনঃক্ষুণ্ণ হলেও তা প্রকাশ করতে পারেন না। বরঞ্চ তার সিঙ্গেল মাদার হওয়ার বিষয়টি জেনে তারা সহানুভূতিশীল হোন।
চিলির আঙ্গুর চাষ ও বিখ্যাত লাল পানীয় তৈরি সম্পর্কে কিছু ধারণা ছিল। কিন্তু আঙ্গুর বাগানে পৃথক পৃথক গাছে পানি দেওয়ার বিষয়টি আমার অজানা ছিল। পর্যটক কেন্দ্রের নাচ ও গান সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। কিন্তু স্থপতি এনায়েত ভাইয়ের গাওয়া ‘আমায় এতো রাতে কেন ডাক দিলি…’ গান নিয়ে হাস্যরস সত্যই উপভোগ্য।
ভিনা-দেল-মারে Val Parasio বা ভ্যালি অব প্যারাডাইস বা স্বর্গের উপত্যকা নাম ও ওর বিবরণ আমাকে মোহিত করেছে। দূরে নীল সমুদ্র, পেছনে আন্দিজের বেড়া আর তার মাঝে ভিনা-দেল-মার। এসব বর্ণনা শুনে সেই প্রকৃতির মাঝে আমার মন ছুটে যায়। যে প্রকৃতির মাঝেই নেরুদার কবি প্রতিভা বিকশিত হয়েছে। অতুলনীয় বর্ণনায় বইটির সমাপ্তি হয়েছে।
বই পড়া শেষ হলেও এর রেশ আমার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। আমার মনে ‘প্রত্যাশা’ ও ‘আক্ষেপ’ জ্ঞাপক অনেক ‘যদি’র উদয় হয়।
#প্রত্যাশার_যদি: যদি ছবিগুলো রঙিন হতো! যদি বইটির পরিসর আরও বর্ধিত হতো! যদি বানান নিয়ে কথা বলার সুযোগ না হতো! যদি এই লেখকের অন্যান্য ভ্রমণ কাহিনীগুলো পড়ার সুযোগ হতো!
#আক্ষেপের_যদি: যদি আমার অনেক টাকা থাকতো! যদি আমার এমন ভ্রমণের অবাধ সুযোগ থাকতো! যদি আমার এমন লেখার যোগ্যতা থাকতো!
ধন্যবাদ সবাইকে।
দর্পণে দর্শন ফেইসবুক পেইজে প্রকাশ, ২১ ডিসেম্বর ২০২১
– মোঃ কামরুজ্জামান, সহযোগী অধ্যাপক- গণিত বিভাগ ও হাউস মাস্টার গোমতী হাউস, কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ।