গ্রন্থ: কালাপানি- মোঃ কামরুজ্জামান

যা পড়েছি
যা জেনেছি
গ্রন্থ: কালাপানি
লেখক: শাকুর মজিদ
প্রচ্ছদ: মাসুম রহমান
প্রকাশক: মাজহারুল ইসলাম
অন্য প্রকাশ, ৩৮/২-ক বাংলা বাজার; ঢাকা।
মূল্য: ১২০ টাকা।
#ভূমিকা: ‘কালাপানি’ ঐতিহাসিক বিবরণ, ছবি ও তথ্য সমৃদ্ধ একটি ভ্রমণ কাহিনী। কালাপানি শব্দটি আমি আগে বহুবার শুনেছি। এর সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা ছিল। এই বইটি পড়ার সুযোগ পেয়ে আমার অস্পষ্ট ধারণাগুলো সুস্পষ্ট হয়েছে।
ভ্রমণপিপাসু লেখক ও তাঁর অপর চার বন্ধু, মোট পাঁচজনের দলকে লেখক ‘পঞ্চ পর্যটক’ সংক্ষেপে ‘পিপি’ নামকরণ করেছেন। তাঁরা পাঁচজন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ঘুরেছেন, ছবি তুলেছেন, ভিডিও করেছেন ও উপভোগ করেছেন। ভ্রমণ শেষে ফিরে এসে লেখক তাঁর চোখের দেখা ও কানের শোনার বিষয়গুলো ও উপলব্ধি সম্পর্কে সুন্দর বর্ণনা করেছেন।
৮০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে ‘ল্যান্ডিং ইন আন্দামান’, ‘এক্সপ্লোরিং আন্দামান’, ‘আদিবাসীর খোঁজে’, ‘সুনামি, হায় সুনামি’, :কালাপানি: সেলুলার জেল’, ‘রস আইল্যান্ড’, ‘ভাইপার আইল্যান্ড’ ও ‘কোরাল দ্বীপে’ নামক আটটি অধ্যায় রয়েছে। প্রতিটি অধ্যায়ে ছবি, ঐতিহাসিক সত্য ও বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
#ল্যান্ডিং_ইন_আন্দামান: এই অধ্যায়ে লেখক সেখানে ভ্রমণ, অবস্থান, থাকা-খাওয়া ও আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন। এখানে বিভিন্ন আইল্যান্ড-এর নাম নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ না থাকলেও ‘ইন্টারভিউ আইল্যান্ড’ নামকরণ সম্পর্কে আমার কৌতূহল নিবৃত হয়নি।
#এক্সপ্লোরিং_আন্দামান: ‘প্যারিস অফ দি ফার ইস্ট’ খ্যাত আন্দামানে ভারতীয় স্থপতি চার্লস কোরিয়া’র নকশায় নির্মিত বে-আইল্যান্ড রিসোর্টটি
পঞ্চ পর্যটকের প্রিয়। এর পাহাড়ের ঢালুতে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা থাকলেও লেখক ছবি তুলতে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যান। যার যা নেশা। এক্সপ্লোরিং আন্দামান অধ্যায়ে এই বর্ণনা আমাকে ক্ষণিকের জন্য বিচলিত করে। দুটো মালয় শব্দ ‘হন্দুমান’ থেকে ‘আন্দামান’ এবং ‘নাকাভারাম’ থেকে ‘নিকোবর’-এর উৎপত্তি। মালয় এই শব্দদ্বয়ের অর্থ যথাক্রমে ‘হনুমান’ ও ‘নগ্নদের ভূমি’। এসব এই বই পাঠে জেনেছি।
#আদিবাসীর_খোঁজে: আদিবাসীর খোঁজে অধ্যায়ে লেখক বিভিন্ন দুস্প্রাপ্য ছবির পাশাপাশি এনথ্রোপলজি পাস তাদের টুরিস্ট গাইড হাসিনা প্রদত্ত বিশদ বিবরণ তুলে ধরেছেন। এই অধ্যায়ে আদিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কয়েকটি দিকও বর্ণিত হয়েছে।
#সুনামি_হায়_সুনামি: এই অধ্যায়ে ২০০৪ সনে ২৬ ডিসেম্বর সারা বিশ্বের ন্যায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জেও সুনামি যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সেই নিদর্শনের ছবি সংযোজন এবং পরবর্তীতে কিছু সংস্কারের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সুনামির এই দিনটি আমিও ভুলিনে। কারণ সেদিন আমি এমজিসিসিতে ডিউটি মাস্টার ছিলাম এবং সদাচর হাউসে বসে ভূমিকম্পন অনুভব ও পরবর্তী ধ্বংসলীলার কথা জেনে হতবিহবল হয়েছিলাম।
#কালাপানি_সেলুলার_জেল: উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি এবং বিশ্বাস করি তা হলো তাদের যে কোন শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধবাদীকে দেশদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং ভয়ংকর ও অমানবিক শাস্তি প্রদান করা বড় কর্তব্য মনে করতো। এজন্য তারা শুধু দেশে বন্দীশালা নির্মাণ করেই নিবৃত হয়নি, নিজের নিরাপত্তা ও শাসনের নামে শোষণ ও নির্যাতন বাধাহীন করার জন্য দূর নির্জন দ্বীপে পাঠিয়ে দিতো।
সভ্য যুগে নির্মম নির্যাতনের কেন্দ্র গোয়ান্তামো বে-এর ন্যায় কালাপানি বা আন্দামানেও তদ্রুপ প্রাচীন এক কারাগার সেলুলার জেল। এখানে প্রীতিলতা, বিনায়ক দামোদার প্রমুখ মুক্তিকামী ব্যক্তিগণ রাষ্ট্রদ্রোহীর অপবাদ নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরেছেন। সেলুলার জেল, বিভিন্নজনের ভাস্কর্য ও ছবি সমৃদ্ধ বিবরণ কালাপানি: সেলুলার জেল-এ তুলে ধরা হয়েছে।
#রস_আইল্যান্ড: ব্রিটিশ সার্ভেয়ার স্যার ড্যানিয়েল রস-এর নামে এই দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। রস আইল্যান্ডে ব্রিটিশ দুঃশাসনের (লেখকের ভাষায় শাসন) স্থাপনাসমূহের নিদর্শন রয়েছে। এখানে পঞ্চ পর্যটক নতুন একজন টুরিস্ট গাইড প্রদীপ-এর নেতৃত্বে ঘুরে ফিরে দেখেন, তথ্য সংগ্রহ করেন ও ছবি তুলেন। এই দ্বীপে কালের সাক্ষী হয়ে তিন শ’ বছরের পুরাতন একটি বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে।
#ভাইপার_আইল্যান্ড: টুরিস্ট গাইড প্রদীপের মতে এই আইল্যান্ডের নামকরণের পিছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। এই দ্বীপে ‘টি এস এস ভাইপার’ নামে একটি জাহাজ প্রথম নোঙ্গর করেছিল। সে অনুযায়ী এর নাম ভাইপার আইল্যান্ড করা হয়েছে। অথবা এই দ্বীপে মারাত্মক বিষাক্ত রাসেল ভাইপার সাপের দেখা পাওয়া যেতো। সেজন্য এর নাম ভাইপার আইল্যান্ড হয়েছে।
আন্দামানে সেলুলার জেল তৈরির আগে ব্রিটিশদের মতে চিহ্নিত ভয়ঙ্কর আসামিদের এই দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হতো। এখানে পাকিস্তানের পেশোয়ারের আফগান কয়েদি শের আলী কর্তৃক লর্ড মায়োকে হত্যা এবং পরবর্তীতে শের আলীর ফাঁসির ঘটনাটির বিবরণ যে কাউকে আবেগাপ্লুত করবে। আমি হিন্দি বুঝি না। এখানে ভারতীয় পর্যটকদের উদ্দেশ্যে প্রদীপের বক্তৃতা হিন্দি ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। যা শুনে হিন্দিভাষীরা আবেগাপ্লুত হয়েছিল।
#কোরাল_দ্বীপে: লেখক কোরাল দ্বীপে সামুদ্রিক প্রবাল দেখার সুযোগ পান। এখানে একটি মুক্তা তৈরির কারখানাও আছে। এই দ্বীপে যে লাইট হাউস আছে তার ছবি ভারতীয় মুদ্রায় ছাপা হয়েছে। এই দ্বীপে ঘোরাফেরা শেষে পঞ্চ পর্যটক-এর আন্দামান ও নিকোবর আইল্যান্ড পরিভ্রমণ শেষ হয়।
#শেষ_কথা: বইটির প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপের ও ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহের সাদা-কালো ছবি সংযোজিত হয়েছে। অমূল্য ছবিগুলোর অস্পষ্টতা বইটির সৌন্দর্য ম্লান করে দিয়েছে। রঙিন ছবি ছাপালে বইয়ের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি হয়তো প্রকাশক বিবেচনা করেছেন। আমার বিবেচনায় বইয়ের শেষ ফর্মাটি শুধু রঙিন ছবিগুলো সংযুক্ত করলে এর মান আরও সমৃদ্ধ হতো।
বইটিতে বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ (যেমন কনোটেশন, ডিনোটেশন, ফাম্বলিং ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয়েছে। এসব শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করলে আমার মতো সাধারণ পাঠকের জন্য সহজবোধ্য হতো। তাছাড়া হয়তো লেখকের অন্যমনঃস্কতায় (সেচ্ছায় হতে পারে) একই বর্ণনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ছোট্ট দু-চারটি বানান বিভ্রাটও দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
লেখক শাকুর মজিদ-এর দ্বিতীয় বই পড়া হলো। তাঁর লেখা আমার পঠিত প্রথম বই ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’। সেই বইয়ে লেখকের রসবোধ যেমন প্রশংসনীয়, এই বইটির মূল উপজীব্য বিবেচনায় লেখকের প্রকাশ ভঙ্গির ভাবগাম্ভীর্যতাও লক্ষণীয়।
আমার মতো নগণ্য পাঠক, যাদের সাধ আছে সাধ্য নেই; যাদের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সামর্থ্য নেই- তাদের জন্য এই বইটি নিঃসন্দেহে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো অনেক বড় সহায়ক হবে। বইটির ঘরে ঘরে পাঠকের হাতে পৌঁছুবে- এই প্রত্যাশা করছি।
ধন্যবাদ সবাইকে।
– মোঃ কামরুজ্জামান-  সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ ও হাউস মাস্টার, গোমতী হাউস, কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ।

লেখকের ফেইসবুক পেইজ ‘দর্পণে দর্শণ’ – প্রকাশ, ১৯ ডিসেম্বর ২০২১

মন্তব্য
Loading...