পাঠকের ভাবানায় “ছাত্রকাল ট্রিলজি”- রাজিব হুদা

“ছাত্রকাল ট্রিলজি” মুলত একটি সংকলন গ্রন্থ । এখানে ক্লাস সেভেন১৯৭৮, ক্যাডেটের ডায়েরি এবং বুয়েটকাল নামে তিনটি স্মৃতিচারণমূলক আত্মজীবনী বইয়ের সংকলন করা হয়েছে। পাঠক চাইলে বইগুলো আলাদা আলাদা ভাবে পড়তে পারেন আবার চাইলে এই ট্রিলজিতে একসাথেও পড়তে পারেন। এই বইতে একজন গ্রাম্য কিশোর কিভাবে শহুরে নাগরিক হয়ে উঠলেন বা পরিণত ব্যক্তিতে পরিপূর্ণ হলেন সেই বর্ণনা এসেছে খুব হৃদয়গ্রাহী ভাষায়।
শাকুর মজিদ তাঁর লেখনী শৈলী দিয়ে ইতোমধ্যে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। বিশেষ করে তাঁর ভ্রমন কাহিনীর জন্য তিনি বেশি পরিচিত হয়েছেন। তবে “ছাত্রকাল ট্রিলজি”তে লেখকের ব্যক্তিগত বিষয়াবলী উঠে আসলেও এর আবেদন অনন্য। “ক্লাস সেভেন১৯৭৮” পর্বে উঠে এসেছে একজন সদ্য কিশোরের কথা। যার জীবনের চৌহদ্দী তখনো নিভৃত গ্রামের মায়ময় প্রকৃতি। বর্ষার দিনগুলো যে নিজে নৌকা চালিয়ে স্কুলে যায়। বাবার কড়া নির্দেশনা উপেক্ষা করার সাহস যার হয় নাই। বন্ধুদের নানা বাউন্ডুলেপনা দেখে যার ভেতরে কিছুটা আক্ষেপ কাজ করে। জেলা সদরে যেতে পারা তখনো যার জন্য রোমাঞ্চকর ব্যাপার অথবা জেলা সদরে যেতে হবে শুনে আগের রাতে যার ঘুম হতো না। সেই ছেলেটাকে একদিন চলে যেতে হয় ক্যাডেট কলেজের কঠিন নিয়মানুবর্তি জীবনে। এই যে তাঁর ঝরঝরে বর্ণনায় শৈশবের গল্প বলা, সেই গল্প পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে এ যেন আমারই শৈশব। লেখকের গ্রাম মাথিউরা যেন চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানেই লেখক হিসেবে শাকুর মজিদের স্বকীয়ধারার পরিচয় পাওয়া যায়।
ছাত্রকাল ট্রিলজি বইতে শাকুর মজিদ যা লিখেছেন তা লেখকের ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলে হয়তো দূরে সরিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু শাকুর মজিদ যে ভঙ্গিমায় ঘটনাগুলো উপস্থাপন করেছেন তা ঠেলে সরিয়ে দেবার উপায় নেই। “ছাত্রকাল ট্রিলজি” কেবল একটি স্মৃতিকথার সম্ভার নয়। এই বইকে একটি জার্নি বলা যেতে পারে। যে জার্নিটা শুরু হয় বিয়ানীবাজারের প্রত্যন্ত এক গ্রাম মাথিউরা থেকে। আর জার্নিটা শেষ হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাকে লেখা একটা চিঠির মধ্যে দিয়ে। এই জার্নিটা যার সাথে শুরু হয় তিনি একজন সদ্য কিশোর। আর জার্নির শেষ স্টেশনে এসে দেখা যায় তিনি একজন পরিপূর্ণ যুবক। বইটির শেষ পর্যায়ে এসে মনে হয় নিজেই যেন টাইম মেশিনে চড়ে দীর্ঘ একটি সময় পরিক্রমন করে আসলাম। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার যেন সিলেট চট্টগ্রাম ভ্রমন হয়ে যায় লেখকের সাথে। এক বর্ষার বিকেলে লেখক ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। নতুন পরিবেশে সব কিছু নতুন, মা-বাবা, ভাই বোন পরিবারের চেনা জানা কেউ নেই। লেখকের মন খারাপ হয়, লেখকের সেই মন খারাপ পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে। তিন খন্ড বইয়ের প্রথম খন্ড “ক্লাস সেভেন ১৯৭৮” নামে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির প্রথম বছর ক্লাসে সেভেনের ঘটনার মধ্য দিয় শেষ হয়।
ছাত্রকাল ট্রিলজি বইয়ের অন্যতম অংশ বা খন্ড “ক্যাডেটের ডায়েরি”। এই পর্বে লেখক অষ্টম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ক্যাডেট জীবনের নানা ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ক্যাডেট কলেজ আমাদের কাছে পরিচিত এর সুশৃংখল ব্যবস্থাপনার জন্য। এর বাইরে এর শিক্ষা ব্যবস্থা, নিয়মানুর্তিতা এবং নানাবিধ আচার আচরণ সম্পর্কে খুবই কমই জানা যায়। লেখক শাকুর মজিদ “ক্যাডেটের ডায়রি” পর্বে সেই সমস্ত ঘটনাগুলোকেই সন্নিবেশিত করেছেন। ক্যাডেট কলেজে ছাত্রদের ডায়রি লেখার একটা প্রচলন আছে। এই পর্বে লেখক তাঁর ছাত্রজীবনের সেই ডায়েরি তুলে ধরেছেন। যা পাঠকের মনে একই সাথে আনন্দ বেদনার সঞ্চার করে থাকবে, একই সাথে পাঠকের জিজ্ঞাসু মনের অনেক উত্তর যোগাবে।
ছাত্রকাল ট্রিলজি” শেষ পর্ব রচিত হয়েছে “বুয়েটকাল” নিয়ে। লেখক শাকুর মজিদ শিক্ষা জীবনে বুয়েটের স্থাপত্য কলায় ছাত্র ছিলেন। এই অংশে লিখেছেন বুয়েটের ক্যাম্পাস জীবনের কথা। লেখকের বাবা চাইতেন তার ছেলে ডাক্তার হোক। কিন্তু লেখকের মনে সুপ্ত বাসনা ছিল নাবিক হবার। যাঁর বাবা, দাদা, নানা নাবিক ছিলেন তাঁর মন তো বিশ্ব পরিভ্রমনের জন্য ব্যাকুল হবারই কথা। কিন্তু বাবার কড়া নির্দেশ নাবিক হওয়া চলবে না, তোমাকে ডাক্তার হতে হবে। অগত্যা মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বসে আছেন। এমন সময় ঢাকা থেকে বন্ধুর চিঠি এলো- বুয়েটে স্থাপত্য কলায় তাঁর সাথে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে এতে করে বন্ধুর সুবিধা হয়। ব্যস ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন স্থাপত্য কলায়। তাঁর এই ভর্তি হবার ব্যাপারটাকে বলা যায়- তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। বুয়েটকাল-এর লেখা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে শাকুর মজিদ সৌভাগ্যবানদের মধ্যে সৌভাগ্যবান। তিনি যখন যেখানে হাত দিয়েছেন তখন সেখানেই সোনা ফলেছে। বুয়েটে শিক্ষা জীবনে তিনি একজন পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন। এখানেই ফটোগ্রাফিতে তাঁর হাতেখড়ি। একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে তিনি জড়িত হন এই সময়ে। বুয়েটকাল পর্বে লেখক তাঁর লাল রঙা বাইসাইকেলের কথা বলেছেন। এই সাইকেলের বর্ণনা আমার ভেতরে খুব আগ্রহ তৈরি করে এবং সাইকেলটার বিদায় পর্ব আমাকে বেশ বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। পরিশেষে মা’কে লেখা একটা চিঠির মধ্যে বুয়েটকাল তথা ছাত্রকাল ট্রিলজি শেষ হয়।
আগেই বলেছি “ছাত্রকাল ট্রিলজি”কে একটা জার্নি বলা যেতে পারে। যে জার্নির শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে আর শেষ হলো ১৯৯৩সালে। লেখকের জীবনের বা ছাত্রজীবনের দীর্ঘ যোল বছরের বর্ণনা এই ছাত্রকাল ট্রিলজি। বইটা শেষ করার পরে মনে হলো চোখের নিমেষে এই দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেল। আর ঘটনার শুরুর প্রায় চল্লিশ বছর পরে যখন এই বই হাতে নিয়েছি তখন তা আমার পাঠক মনে এক নস্টালজিয়া তৈরি করেছে। এই চল্লিশ বছরে কত সহজে আমাদের জীবনযাত্রা, অভ্যাস, যোগাযোগ সংস্কৃতি আর এই শহরের অবকাঠামো কতখানি পরিবর্তন হয়েছে তা পাঠকের চোখে ধরা পড়ে। পরিবর্তনের এই ঝরাপাতা আর নব পল্লবের মেলবন্ধন “ছাত্রকাল ট্রিলজি” পাঠকের হৃদয়কে শিহরিত না করে পারে না। “ছাত্রকাল ট্রিলজি” পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করুন- আমি সেই

শুভ কামনা করছি।
২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ফেইসবুকে প্রকাশিত
মন্তব্য
Loading...