১৯৮৬ সালের ঘটনা । তখনো আমার অটোফোকাস ক্যামেরাই ভরসা। ছবি খুব একটা খারাপ আসেনা। দিনের বেলা রোদের আলো থাকলেই হয়। শুধু খুব কাছে গিয়ে কারো মুখের ছবি তোলা যায়না। ফ্লাসের আলোয় ৬-৭ পর্যন্ত কাভার করে । এ জন্য আমি বেছে বেছে সময়ের ছবি তুলি। আমার ছবি তোলার বিষয় পত্রিকা জন্য লেখা ফিচারে যা দরকার, শুধু সেটুকুই।

ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা নিয়ে একটা ফিচার হবে, প্রচ্ছদ কাহিনী। সুতরাং, আমি বিকেল হলেই বইমেলায় চলে যাই। বড়ো বড়ো লেখকদের দেখি । শামসুর রাহমান আর সইয়েদ শামসুল হক বসে বসে গল্প করছেন, এম আর আখতার মুকুল তাঁর ‘আমি বিজয় দেখেছি’ বই নিয়ে নিজের স্টলে বসেছেন, মুহম্মদ রফিক একটা টেবিলের উপর নিজের বই নিয়ে আছেন পুকুর পাড়ে। কোথাও বসে আছেন রফিক আজাদ, কিংবা ‘এখানে নির্মলেন্দু গুণকে পাওয়া যায়’ শিরোনামের স্টল, এসব। এসময় হুমায়ুন আহমেদেরও কদর শুরু হয়। তাঁর ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটি উপন্যাস হয়ে এসেছে, তাঁকে ঘিরে প্রকাশকদের স্টলে ভিড়। তিনি ভাগ করে করে বিভিন্ন স্টলে গিয়ে বসছেন । তরুণ-তরুনীদের ভিড় তাঁকে নিয়েই দেখি বেশী।
একসময় দেখি এ ভিড়ে এক পরিচিত মহিলা কবিও। তাঁকে আমি তখন চিনি, তিনি তসলিমা নাসরিন। ‘নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’ নামে তাঁরও একটা কবিতার বই বেরিয়েছে। জাতীয় কবিতা পরিষদের আসরে তিনি কবিতা পড়ছেন। কিন্তু তিনিও যে হুমায়ূন আহমেদের এত ভক্ত, জানা ছিলো না। ১৯৮৬ সালের বইমেলায় তাঁকে দেখেছি এপ্রোন পরা আরো কয়েক তরুনীর সঙ্গে স্টলের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে থাকা হুমায়ুন আহমেদের অটোগ্রাফের জন্য হাত বাড়াতে, সে ছবিও তুলেছিলাম। আবার ১৯৮৭ সালেও যখন হুমায়ুন আহমেদকে ঘিরে থাকা তরুনীদের ছবি তুলতে আমার অটোফোকাস তাক করি, সেখানেও কাকতালীয় ভাবে তাঁকেই পেয়ে যাই।

এ ঘটনার বছর পাঁচেকের মাথায় তসলিমা নাসরিনের বিরাট পরিবর্তন হয়। দুজন ডাক সাইটে সম্পাদকের সাথে তাঁর প্রণয় ও পরবর্তিতে বিবাহের ফলে সেসময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাগজসমূহে তাঁর কলাম ছাপা হতে থাকে। প্রেমের কবিতা দিয়ে শুরু করলেও তিনি নারীবাদি কলাম লেখিকা হিসেবে নাম করেন। কলামের পাশাপাশি পুরুষ ও ধর্ম বিদ্বেষী কিছু লেখার কারনে তিনি বিতর্কিতা হয়ে পড়েন। ১৯৯২ সালে শহীদুল হক খান ‘নাট্যসভা পুরস্কার’ দেবেন ৭ গুনীকে। আমন্ত্রন পত্র আসে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার অফিসে। আমাকে পাঠানো হয় এসাইনমেন্ট কাভার করার জন্য। রিপোর্ট লেখা, ছবি তোলা- দুটোই আমার কাজ। আমার তখন নিজের এস এল আর হয়েছে, মিনোল্টা এফএক্স-৩০০। আমি যথা সময়ে জাতীয় যাদুঘর-এর ছোট্ট হল (সুফিয়া কামাল মিলনায়তন)-এ গিয়ে দেখি কাজী আনোয়ার হোসেন, কবি শামসুর রাহমান প্রমুখ পুরস্কারপ্রাপ্তদের সঙ্গে চমৎকার একটা শাড়ি পড়ে সামনের সারিতে বসে আছেন তসলিমা নাসরিনও। এর আগে তসলিমা নাসরিন কোনো বড়ো পুরস্কার পেয়েছেন বলে শুনিনি। তবে সে বছরই তিনি কলকাতার ‘আনন্দ পুরস্কার’ও পান। এ নিয়ে বাংলা একাডেমিতে অনেক কথাও বক্তৃতায় বলা হয়েছিলো, সবই পুরস্কারের বিরুদ্ধে।
কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখি, বেশ কিছু গুণমুগ্ধ পাঠক কিছুক্ষণ পরপর তসলিমার কাছে এসে বই খুলে অটোগ্রাফ নিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। তাঁর পাশে কবি শামসুর রাহমান। তিনি চুপচাপ বসে আছেন।
মাত্র ৫ বছরের ব্যাবধানে অটোগ্রাফ দেয়া নেয়া নিয়ে একই মানুষের এমন পরিবর্তন আমাকে চমকিত করে।
