আশ্রয়, ১৯৮৯

১৯৮৯ সাল। রুমমেটের ক্যামেরা আমি হেফাজতে রাখি আর খালি সাব্জেক্ট খুজি। আমার সাইকেল আছে একটা। বুয়েটের বাইরে কিছু পত্রিকার অফিসে ছুটোছুটি আর নীলক্ষেত-নিউমার্কেট পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি, এই আমার কাজ।
আমার কালো রঙের একটা ব্যাগ থাকে সবসময়। আর্কিটেকচারের সব ছাত্রকেই এরকম একটা ব্যাগ সঙ্গে রাখতে হয়। এর মধ্যে থাকে কাগজ কাটাকাটির জিনিসপত্র। আমার ব্যাগে বাড়তি থাকে একটা ক্যামেরা। আমি কাজ না থাকলেও বস্তির পাশ দিয়া সাইকেলে মেরে যাই। বস্তিতে সাবজেক্টের অভাব নাই। আর গরিব মানুষের ছবি তোলা বেশী সহজ। কারন তাঁদের প্রাইভেসি নিয়ে তারা চিন্তিত নয়।
বস্তির পাশ দিয়ে গেলে বিকেল বেলা তাঁদের সুখী জীবনের চিত্র পাওয়া যেতো। দুপুরের আহার সেরে তারা আড্ডায় বসতো। এদের বেশীরভাগের পুরুষ সদস্য সস্তা শ্রমের কাজে বাইরে, বস্তিগুলো নারী ও শিশুময়। লাইন ধরে বসে একজন আরেক জনের মাথার উকুন বেছে দিচ্ছি, তলা নিয়ে হয়তো কোনো শিশু মায়ের দুধ খাওয়ার পায়তারা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের এস এম হলের সামনের রাস্তার উপর মায়ের সাথে শিশুর ঘুম, ১৯৮৯

করছে, মা ও ব্যাবস্থা করে দিচ্ছে, সমস্যা নাই।
আমার চেনা জানা পরিসরের বাইরে মা আর সন্তানের আন্তরিক ঘনিষ্ঠতার ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে বেশ কিছু বস্তিতে । ছবি তোলার সময় তারা নিষেধ করা দূরের থাক, কেউ কেউ পাত্তাই দিতো না। কেউ শুধু অনুরোধ করতো ছবিটা পাওয়ার। পরেরবার ছবি নিয়ে গেলে, ঘরের পান-সুপারী খাইয়ে দিতো কেউ কেউ।

একবার পলাশীর বস্তি (পলাশী নীলক্ষেত)র ছবি তুলে ডিপার্টমেন্টে ফিরছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের এস এম হলের সামনের রাস্তা দিয়ে। সেখানেই একটা গেট ছিলো তখন। গেটের পাশে একটা বড়ো গাছ ছিল। গাছটি আছে, গেটটি নেই। সেই গেটের কাছে ফুটপাথের অপর দেখি শুয়ে আছেন এক মহিলা, তাঁর পাশে এক শিশু। তাঁদের পাশে কিছু খাবারের প্যাকেট। বিকেল বেলা রাস্তা দিয়ে গাড়ি যায়, রিকশা যায়,হর্ণ বাজে, কিন্তু তাতেও দিবানিদ্রার কোনো ব্যাঘাত ঘটছেনা মা এবং শিশুটির। তারা যেহেতু ঘুমিয়েই ছিলো, তাই টের পায়নি বলে আস্তে করে টিপ দিয়ে ছবিটা তুলে চলে এলাম। কী পরিমান নির্ভরতা থাকলে ছোট্ট শিশুটি মার পাশে এমন অরক্ষিত পরিবেশে ঘুমাতে পারে, আমাকে তখন সে কথাই ভাবাচ্ছিলো।

এর পরের বছর জাতীয় সংসদ ভবনের চত্বরে দেখি এক বাবার পাশেও কী আরামে শুয়ে ঘুমাচ্ছে আরেক শিশু।

 

মন্তব্য
Loading...