হে বন্ধু, বিদায়, ১৯৯১

ভোরের সুর্য অঠার আগে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত কেমন লাগে, এমনটি দেখার জন্য রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই আমরা বেরিয়ে পড়ি মোটেল থেকে। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন তাজু ভাই। ভালো নাম খন্দকার তাজ উদ্দিন, তিনি ২ বছর গ্যাপ দিয়ে এবার ঠিক করেছেন থিসিস জমা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাবেন। ডিজাইন প্রজেক্টের সাইট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বেতবুনিয়ার একটা পাহাড়ি অঞ্চল, যেখানে পুলিশের ট্রেনিং সেন্টার হবে। আমি তার সঙ্গী হয়েছি দুইটা কারনে। দ্বিতীয় কারন, তার সাইটের ছবি তুলে দেয়া। আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায় বিকেল বেলা। আমরা চাইলে ঢাকা ফিরতে পারি, অথবা রাতে থেকে পরদিন। রাতে যদি থাকতেই হয়, তবে বেতবুনিয়া কেনো? অল্প দূরে কক্সবাজার আছে, ওখানেই নাহয় রাত কাটিয়ে সকালের বাসে ঢাকা ফেরা যায়।

কক্সবাজারে আমরা রাত ১০টা নাগাদ পৌঁছই। তখন অন্ধকারে একবার হেঁটে আসি ভেজা উপকূল এবং ভোরের আলোর জন্য প্রতীক্ষা করি। সকাল বেলার প্রথম আলো্য আমরা সমুদ্র তীর দেখবো বলে শেষ রাতে ঘুম থেকে ওঠে তৈরি হয়ে যাই।

১৯৯১ সালের অক্টোবর মাস। একটু শীত পড়েছে । মোটেল থেকে খালি পায়ে বেরোতে বেশ ঠান্ডাই লাগলো। তাজু ভাইর আদেশ- খালি পায়েই যেতে হবে। পায়ের তালুতে ভেজা বালুর ছোঁয়া না লাগলে নাকি কক্সবাজারের সী বিচ কে ফীল করা যাবে না।

তখন আমার দুটো ক্যামেরা। একটায় সাদা কালো ফিল্ম, অপরটিতে রঙ্গিন। আমি সাদা কালো ফিল্মের ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এবং টের পাই, ভোরের সৈকতে একটা মিষ্টি হাওয়া বইছে। এই শীতেও শীত শীত মনে হচ্ছে না। খানিক পরে একটু আলো ফুটলে দেখি- সমুদ্র সৈকতটি যথেষ্ট নির্জন। কিছু জেলে ছাড়া আর কোনো জনমানব নাই। আমি এদিক ওদিক যা-ই দেখি ছবি তুলতে থাকি।

প্রকৃতির কাছে মানবেরা কতো ক্ষুদ্র এই শিশুই যেনো তাঁর সাক্ষী

তখন কলাতলীর দিকে সাধারণত টুরিস্টরা খুব একটা যেতো না। পাড়েই কিছু জেলেদের বাশ-বেতের ঘর।সমুদের পাড় অনেকটা পাড় ভাঙ্গা নদীর মতো। একটা পাড়ে দেখি একটা শিশু দাঁড়িয়ে আছে, একা।

পাশে নতুন গজিয়ে ওঠা কিছু তৃণ। ছেলেটির গায়ে কোনো জামাকাপড় নাই। আমি থেমে যাই। এবং যথেষ্ট নীচু হয়ে একটা লো এঙ্গেল শট নেই শিশুটির। আমার কাছে এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এ বিশ্ব সংসারের তাবত মানুবকূলের প্রতিনিধিত্বকারী হলো এই শিশুটি। তার সামনে বিশাল আকাশ আর সমুদ্র। এদের কাছে মানবকূলতো শিশুই।

এ ছবিটা তোলা শেষ করে দেখি তাজু ভাই আমার কাছে নাই। তিনি অনেক দূর চলে গেছেন। তিনি যেখানে গেছেন, তার আশে পাশেও আর কেউ নাই। মনে হলো আর কিছুদূর গেলেই তিনি আমার লেন্সের সীমানা থেকে হারিয়ে যাবেন। মানুষের চলে যাওয়াটা এ-রকমি হয়। আস্তে আস্তে মানুষের দৃষ্টির আড়াল হতে হতে একসময় একেবারি হারিয়ে যায়।

তাজু ভাইর এ ছবিটা তোলার ২৪ বছর পর, দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১৫ সালের ৩ মার্চ তিনি মারা যান। আমি তার এ ছবিটা দিয়ে আমার ফেসবুকের কাভার পিকচার বানিয়ে আমার শোকগাঁথা লিখি । ৫ মার্চ ছিলো তার স্মরণসভা। সেখানে তার বন্ধুরা এ ছবিটা দিয়ে ব্যানার করেছিলো। নীচে লেখা- হে বন্ধু, বিদায়।

 

মন্তব্য
Loading...