কাওরান বাজার টেক , ১৯৯১

১৯৯১ সালে আমি বুয়েটের ফোর্থ ইয়ারে পড়ি। ‘সেমিনার’ বিষয়ক একটা সেশনাল কোর্স আছে আমাদের। ২০ মিনিট সময়ে শিল্পের যেকোনো বিষয় নিয়ে সচিত্র বক্তব্য পেশ করতে হবে, যেমন করে কোনো সেমিনারে করা হয়। ক্লাসে সবাই ব্যাস্ত হয়ে বিশয় খুঁজে, রাতের পর রাত জেগে প্রেজেন্টেশন তৈরি করে। তার কিছু ফোটোগ্রাফও থাকে, বাকি সব টেকনিক্যাল ড্রয়িং। আমি ঠিক করলাম একটি বস্তির মানুষের ঘরসজ্জা এবং ঘরের সামনের জায়গাটুকু তাঁরা কখন কিভাবে ব্যাবহার করে তা নিয়ে একটি উপস্থাপনা তৈরি করবো। জায়গা হিসেবে বেছে নিলাম- কাওরান বাজার টেক।

কাওরান বাজার টেক ছিলো সোনারগাঁ হোটেলের এক প্রতিবেশী দ্বীপ। একটা ঝিলের মাঝখানে একটা উঁচু জায়গা, সেখানে বাশ-বেত দিয়ে কিছু তাঁবু বানিয়ে কয়েকটি পরিবার থাকে। যাতায়াতের জন্য তাঁরা ব্যাবহার করে কচুরিপানার ভেলা। একসাথে কয়েকজন উঠে, কেউ একজন লগি দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়া যায় তাঁদের একান্ত সেই দ্বীপে।

কাওরান বাজার বস্তি, যেখা্নে এখন বিজিএমইএ ভবন

এ দ্বীপটা তাঁদের একান্ত নিজস্ব এক রাজ্য। কয়েকগজ দূরের পাঁচ তারকা হোটেলটিকে অবলিলায় টিটকারি দিয়ে তাঁরা নিজের মতো বিকেল বেলা হাওয়া খেতে খেতে আড্ডায় বসে যান। কয়েকগজ দূরের রাজধানীর নাগরিক জীবনের কিছুই তাঁদের নাই। না বিদ্যুৎ, না জল বা পয় নিষ্কাশনের কিছু। ঘরের মধ্যে না আছে দরোজা, না কোন জানালা। গরম লাগলে খোলা আকাশের তলায় গায়ে বাতস মেখে আরাম করে ঘুমায় তাঁরা।

আমি ছবি তুলি স্লাইড করার জন্য ট্রান্সপারেন্ট পজিটিভ ফিল্মে। সঙ্গে আমার তখন দ্বিতীয় ক্যামেরা, সেখানে সাদা কালো ফিল্ম ভরা আছে। এই বস্তিতে হঠাত এক নব্বই উর্ধ্ব বয়েসের একজনকে পেয়ে যাই।এ বয়সে তিনি কখনই কোনো চিকিৎসা নেননি, কোনো অসুখ বিসুখ তেমন হয়না, সামান্য কিছু হলে নিজের মতো ঘাষ-লতা-পাতার রস খেয়ে তিনি সুস্থ হয়ে যান।

কাওরান বাজারের মাছের বাজারের উলটা দিকের রাস্তা দিয়ে যেতে এখনো আমার মনে পড়ে সেই দ্বীপবাসিকে আর মনে পড়ে নাম না জানা সেই বৃদ্ধকে, যার ছবি পরবর্তিতে আমার ‘বাংলার মুখ’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও একই নামে আমার একটা আলোকচিত্র এলবামে প্রকাশ করি।

মন্তব্য
Loading...