হারিয়ে যাবার আগে

আমার জীবনে তোলা সবচে বিস্ময়কর ছবি

আমার তোলা ছবি নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলে আমি বলি, আমার জীবনে তোলা সবচে বিস্ময়কর ছবি হচ্ছে এটি। এর নাম দিয়েছি, হারিয়ে যাবার আগে Before it disappears .

মজার ব্যাপার হলো – আমি হাজার বার চেষ্টা করলেও এমন আরেকটা ছবি আর তুলতে পারবো না। কোন দুইটো মুহূর্তই এক হয় না, কোন দুটো ফ্রেম এক হয় না। তবুও ফিল্মে রি-টেক নেয়া হয়, বারবার একই ছবি তোলার জন্য, কিন্তু আসলে সবগুলোই আলাদা আলাদা ছবি হয়।

কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। এমন ছবি কী আসলে আমি তুলেছি ? নাকি কোন যাদুর হাত আমাকে দিয়ে তুলিয়েছিল ?

প্রথমে ঘটনাটা বলি।

ঘটনা ২০০৯ সালের ১২ জানুয়ারি। সদরঘাট থেকে ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজের ভাড়া করা তেতলা জাহাজটির একটা ছাদ আমরা দখল করে আছি। আমাদের সাথে হুমায়ূন আহমেদও।

পুরো ঘটনাটা বইতে যেভাবে লেখা ছিলো, তা হলো – “দুপুরের ভাত খাওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদ খানিক ঘুমান। এটা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। জাহাজেও তার ব্যতিক্রম হলো না। বিকেলের দিকে রোদের তেজ কমে এলে সবাই ছাদের ওপর উঠে আসেন। ছাদে বড় মাদুর বিছানো হয়েছে। দূরে এক পাশে বাংলাদেশের শেষ সীমানার জনপদের সামান্য চিহ্ন, অন্য পাশে শুধুই সমুদ্র। জাহাজের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কতগুলো গাঙচিল উড়ে উড়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নাইকন এন-নাইনটি ক্যামেরাটা নিয়ে পাখিগুলোর ছবি তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ছবি তোলাতে তেমন দক্ষতা নেই তাঁর। একবার ইচ্ছা হলো বলি, ‘স্যার, ক্যামেরা ধরার একটা কৌশল আছে।’

ছাদের ওপর গোটা তিরিশেক যাত্রী। আবালবৃদ্ধবনিতা। এদের অর্ধেকের বেশিই ক্যামেরাম্যান। সবার হাতেই ক্যামেরা, যার ক্যামেরা নেই, তার জন্য মোবাইল ফোন তো আছে!

শুরু হলো নানা রকম ফটো সেশন। বিদায়ী সূর্যটা এমন সহজভাবে এসে ধরা দেয় না। গাঁও-গেরামে গেলে বিস্তীর্ণ হাওরপাড়ে হয়তো খানিকটা পাওয়া যায়; বাংলাদেশের সমুদ্রতীরে পাওয়া যায় না। এখানে সমুদ্রের বুকে সূর্য ডোবে। আজ ডুবছে সমুদ্রের বিপরীত দিকে, গাছগাছালির আড়ালে। কিছুক্ষণের মধ্যে ছাদের ওপর ঘুড়ি ওড়ানোর আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

এত প্রাণোচ্ছল ক্যামেরাম্যানদের দেখে হুমায়ূন আহমেদ এক ফটো প্রতিযোগিতার ঘোষণা দিয়ে বসেন। প্রতিযোগিতা সবার জন্য উন্মুক্ত। তিনি নিজেও থাকবেন একজন প্রতিযোগী হিসেবে। সুন্দরবন ট্যুরে তোলা প্রত্যেকের হাজার হাজার ছবি থেকে বাছাই করে সর্বোচ্চ ১০টি করে ছবি জমা নেওয়া হবে। যে কটা ছবি জমা পড়বে, তার মধ্য থেকে ১০টি ছবিকে পুরস্কৃত করা হবে। এ ছবিগুলো বাঁধাই করে রাখা হবে নুহাশ পল্লীর হলঘরে।

ঘোষণা শোনার কিছুক্ষণ পর একটা ঘুড়ি পানিতে পড়ে আধডোবা হয়ে যাওয়ার সময় আমি একটি ছবি তুলি। ক্যামেরার এলসিডি স্ক্রিনে ছবিটা তাঁকে দেখাই। তিনি একবার আমার দিকে তাকান, একবার ছবির দিকে। আর কারও কোনো ছবি না দেখেই ডিক্লেয়ার করে দেন, এটাই ফার্স্ট।

এ ফলাফল মানতে চাইল না দুজন বড় প্রতিযোগী- মাজহার ও মাসুদ আকন্দ। তাদের দাবি, ঢাকা না ফেরা পর্যন্ত প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা যাবে না। কোমরে গামছা বেঁধে ছবি তুলতে শুরু করল তারা। (যে ছিলো এক মুগ্ধকর- বই থেকে টুকা)”

তো এই ছিলো ঘটনা ।

সুন্দরবন থেকে ফিরে ঢাকা এসে কম্পিউটারের পর্দায় এ ছবি দেখে আমি থ। এটা কী করে সম্ভব ?

কারন ছবি যখন তুলি আমি ঘুড়িটাকে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে দেখি। আমার খেয়াল ছিলোনা যে , যেখানে আমি বসে আছি তার পাশে জাহাজের ছাদের রেলিং। এ রেলিং-কে আড়াল করেছে আরো অতিরিক্ত বাঁশের বেড়া, এই বেড়া সাদা ও লাল রঙএর কাপড় দিয়ে প্যাচানো। যে মুহূর্তে আমি একটা আহত ঘুড়ি দেখেছি যে সে মাঠা ঘুরিয়ে পড়েই যাবে আমি ভিউ ফাইন্ডারের ভেতর দিয়ে শুধু তাকেই দেখেছি। দেখতে দেখতে শাটার টিপতে টিপতে আমি ক্যামেরার ল্যান্সের জুম চার্য করেছি। জুম চার্জ করার কারনে লাল কাপড়ে প্যাঁচানো পাইপটি ওয়াইডে থাকা অবস্থায় ফ্রাকশন অব এ সেকেন্ড এক্সপোজড হয়, তার দাগ রয়ে যায়। আবার জুম ফুল চার্য হবার পরও মাতাল  ঘুড়িটা জলের কাছে সমর্পিত হয়ে যখন স্থির হয় তখনো সে ফ্রেমে দৃশ্যমান। সে কারনে ফটোশফিক – অপাসিটি, লেয়ার, এসবের কোন কিছু না করেই একটি বস্তুর আড়ালে থাকা অপর বস্তুও ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায়।

আমি এখানে পরপর তিনবার শাটার টিপি। তিনটা তিন রকমের। তিনটা সাটার আমি আসলে তিনবারে না, একবারেই টিপি। ছররা বন্দুক দিয়ে যেমন করে গুলি করে, অনেকটা এরকম।

আমি যখনই এই ছবিগুলো দেখি, বিস্মিত হই। এ ছবিটার বর্ণনা পড়ে আমার অরক্তিও ছোটভাই রুমেল খুব আহ্লাদ করে দেখতে চাইলো।

তাকে দেখানোর পর সে আরো মুগ্ধ। আমার কাছে অনুমতি চায়, ছবিটা বাধাই করে রাখার।

আমি অনুমতির সাথে এই ছবিটার সত্ত্বও রুমেলকে দিয়ে দিয়েছি। এখন থেকে কেউ এই ছবি ব্যবহার করতে চাইলে রুমেলের অনুমতি নিতে হবে।

 

 

মন্তব্য
Loading...