আনিস স্যারের সাথে যেদিন আমার প্রথম খুব কাছাকাছি যায়গা থেকে দেখা সেদিনও তাঁর সাথে আমার দুইবার হ্যান্ডশেক করা ছাড়া কথা হয় নি। কথা বলার সাহসও ছিলো না, সুযোগও না। যদিও যে অনুষ্ঠানটি ছিলো আমারই এবং আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের।
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের প্রথম বছরের কাহিনী লিখেছি- ক্লাস সেভেন ১৯৭৮। আমার প্রথম আত্মজৈবনিক বই। বইটি ছাপার আগে কয়েকজনকে পিডিএফ পাঠিয়েছিলাম। তখন থেকেই হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। ছাপার খবর পেয়ে এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের সংগঠন ওফা ঠিক করলো শেরাটন হোটেলে এর একটা প্রকাশনা অনুষ্ঠান করবে। তারিখ ঠিক হয়ে গেল, ২০০৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। অনুষ্ঠানে আমাদের কলেজের প্রাক্তন শিক্ষকেরা থাকবেন। লেখকদের মধ্যে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, ইমদাদুল হক মিলন থাকবেন আর প্রধান অতিথি এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
আমি বাকি লেখকদের চিনি, আনতেও পারবো, কিন্তু আনিসুজ্জামান স্যারের সাথে আমার কোন পরিচয় নাই। উনি কি আসবেন ?
ওফা ঢাকা চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার ভাই। তিনি বললেন- স্যারের সাথে আমার কথা হয়েছে। তুমি কার্ডে নাম দিয়ে দাও, আর এক কপি বই আমার কাছে দিয়ে দাও, আমি উনার বাসায় পৌছাই দিব।
যথারীতি আগের রাতে তাঁর বাসায় বই পৌছানো হলো এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি ঠিক সময় মতোই এসেও গেলেন।
এই প্রথম এতো কাছ থেকে তাঁকে দেখা এবং বক্তৃতা শোনা।
আমি যে বিষয়টা লক্ষ করলাম, তা ছিলো তাঁর কথা বলার পরিমিতি । তিনি যে আমার বইটি সম্পূর্ণ পড়ে এসেছেন তা নিশ্চিত হলাম এটুকু শুনে – যে কথাগুলো বলার জন্য ১২০ পাতার ক্লাস সেভেন ১৯৭৮ বইটি লিখেছিলাম ঠিক সেই সেই কথাগুলোই তিনি উদৃত করছেন। যে বন্ধুটাকে নিয়ে রসিকতা করেছিলাম, ঠিক তাঁর কথাটাই তিনি বলছেন, যে কারনে বইটা ছাপাতে চেয়েছিলাম, দেখি ঠিক সেই কারনটাই তিনি বলছেন। আমার সাথে তো তাঁর কোন কথা হয়নি, দেখাও হয়বি, আলাপও নাই। অথচ এক রাতের মধ্যে বইটির আদ্যোপান্ত পড়ে নির্যাসটুকু বলে দিচ্ছেন মাত্র ৫ মিনিটের বক্তৃতায়।
এই ভিডিও ক্লিপটি ছোট করতে গিয়ে দেখি ফেলে দেয়ার মতো একটা বাক্যও নাই আবার মনের মনে এই আফসোসটাও নাই যে স্যার আমার বইএর এ কথাগুলো বললেন না। তখনই বুঝেছিলাম, তিনি এমনি এমনি আনিসুজ্জামান হননি।
২০০৮ সালের পর আস্তে আস্তে তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
আনিসুজ্জামান স্যারের প্রথম ছবি তুলি আমি ২০১০ সালের বইমেলায়, তাঁর অজান্তেই।
কিন্তু আমার আর্কাইভ বলছে, ৩০ বছর আগেই তাঁর ছবি আমি তুলে ফেলেছি। ঘটনাটা ১৯৯০ সালে। ক্লাস প্রজেক্ট ছিলো বাংলা একাডেমি । সার্ভের জন্য ছবি তুলেতে গিয়েছি, তুলেছিও অনেক। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে দুজন প্রৌঢ় হেঁটে আসছেন । কেউ কেউ বলছেন তাঁর একজন আনিস স্যার। এটা ঠিক হলে এটা আমার ক্যামেরায় তোলা তাঁর প্রথম ছবি। আর ঠিক না হলে- ধরে নেব ১৯৯০ সালে উনি অনেকটা এ রকমই ছিলেন। আর বাংলা একাডেমি আর আনিসুজ্জামান নামটা তো একে অপরের সাথে খুব ভালো ভাবে জড়িত। দীর্ঘদিন তিনি এর সভাপরি ছিলেন।
তাঁর সাথে প্রথম আলাপের বছর চারেকের মাথায় তাঁর সঙ্গে আড্ডা দেয়ার ও আহার-বিহার করার আমণত্রণ পেয়ে যাই এবং নান রসিকতা ও ঢং তামাশা করার উপলক্ষও পাই।
একবার আমি বলেছিলাম, স্যার ৫ বছর আগে আপনি আমার একটা বইয়ের মোড়ক খুলেছিলেন, আপনার কি মনে আছে?
তিনি বইয়ের নামটাও বলে দেন।
২০১২ সালে একবার বড় বাঁচা থেকে বাঁচিয়ে দেন তিনি আমাকে। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বই লিখেছি। বইয়ের নাম ” যে ছিল এক মুগ্ধকর” । এখন ব্যক্তির নামের সাথে ‘মুগ্ধকর’ শব্দটি যাবে কী যাবে না, এ নিয়ে চিন্তায় আছেন প্রথমা’র সম্পাদনা বিভাগ। এর মধ্যে আম্র সাথে দেখা, প্রথম আলোর অফিসেই আনিস স্যারের সাথে । তিনি তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কাল নিরিবদি’র দুটো কপি নিয়ে এসেছেন । কথা বলছেন সম্পাদক মতিউর রহমানের ঘরে। আছেন সাজ্জাদ শরিফও সেখানে। আমি এই প্রসঙ্গটা তুললাম। তিনি খালিক চিন্তা করে বললেন- যদিও তেমন ব্যবহার হয় নি, তবে হলেও ভুল হবে না।
ব্যাস, আর পায় কে ! এই নাম বইয়ের জন্য টিকে যায়।
আরেকবারের ঘটনা।
হাছন রাজার নাম প্রথম আলো লিখে – ‘হাসন’। দিয়ে । আমি বিগড়ে যাই। যুক্তি দেখাই। ‘হাসন’ যে ভুল, তাঁর দলিল হাজির করি। ক্যাচাল করি ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের সাথে। তিনি নরম গলায় বলেন- বাংলা একাডেমিতো এই নাম দিয়েছে, আগে তারা সংশোধন ক্রুক।
আমি বাংলা একাডেমি বরাবর চিঠি লিখি নতুন মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজীর কাছে। সাথে সকল দলিলাদি।
একদিন মহাপরিচালক মহোদয় আমাকে ফোন করে বসেন। বলেন- একটা মিটিং-এ এ প্রসঙ্গ তুলেছি। আনিস স্যার আপনার ডকুমেন্ট দেখে সাথে সাথে বলেছেন – ‘হাসন’ সংশোধন করে ‘হাছন’ করা হোক । এ ব্যাপারে আমরা খুব শিগগিরির একটা সার্কুলার দিব।
যদিও এখনো কোন সার্কুলার আসে নাই, তবে এখানেও যে আমার মতে তাঁর সায় ছিলো, এতেই আমি আপ্লুত।
আমার ছবির আর্কাইভ খুঁজে দেখি তাঁর সাথে আমার দহরম-মহরমের ছবি তোলা শুরু হয় ২০১৪ সালের পর থেকে । প্রথম দিকে অন্যপ্রকাশের মাজহারের বাসা কিংবা দাওয়াতে কোন রেস্টুরেন্টে অথবা কোন বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। এমনি তিনি খুবই হ্যাঁবোধক মানুষ ছিলেন। কাউকেই – না বলতে পারতেন না বলে, কারো দাওয়াতই তিনি উপেক্ষা করতেন না।
২০১৫ সালে অন্যপ্রকাশ থেকে তাঁর আত্মজৈবনিক বইটি প্রকাশের উপলক্ষে একটা ছোট্ট খানাদানার আয়োজন করে মাজহার। সেখানে আমাকে তিনি তাঁর একটি বইও উপহার দেন। আড্ডায় আমরা প্রাণ খুলে অনেক কথাই বলি।
রাতের দাওয়াতে যেখানে স্যারেরও আসার কথা তিনি এসে পৌছাতেন সবার শেষে। আমরা হয়তো জানতে চাইতাম, এটা ৪ নং না ৫ নং অনুস্টান করে এলেন ?
বলতেন, না আজ কম ছিলো, তিনটা। কমিয়ে দিচ্ছি। আর পারবো না।
বলতাম, স্যার, আপনার পরে তো আর লোক নাই। আমরা কারে নিয়া অনুষ্ঠান করবো ?
হাসতেন।
বলতেন- কারো জন্যে কিছু থেমে থাকে না। ঠিকই সব কিছু চলবে।
আমাদের দলের কেউই তাঁর ছাত্র নই, কিন্তু আমরা সবায় তাঁকে স্যার বলে ডাকতাম।
২০১৬-১৭ সালের দিকে স্যারের সাথে বেশি দেখা হয় ঢাকা ক্লাবের নানা দাওয়াতে। এ দাওয়াতগুলোর আয়োজক ছিলেন কবি মারুফুল ইসলাম। মারুফ ভাইকে আনিস স্যার খুব পছন্দই করতেন, মারুফ ভাইও আপ্যায়ন করা পছন্দ করতেন । মারুফ ভাই তাঁর নিজের ছাড়া স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এমনকি বন্ধুবান্ধবদের জন্মদিনও পালনের আয়োজন করতেন। জোর করে বিশেষ শিডিউল নিয়ে রাখতেন আনিস স্যার বা মঞ্জুর স্যারের জন্য। এই সব আয়োজনে দেরি করে হলেও আনিস স্যার এসে হাজির হতেন। কখনো একা, কখনো আগেই এসে যেতেন তাঁর স্ত্রী, পুত্ররা। তবে আয়োজনের সময় আডদায় মশগুল থাকতেন। রমনীকূলের কাছে তিনি বিশেষ প্রিয়ভাজনও ছিলেন।
আনিসুজ্জামান স্যারের সাথে আমাদের সম্পর্ক খুব মিশ্র। আমরা সিগারেট খাওয়ার জন্য তাঁর সামনে থেকে চলে যেতে চাইলে বসিয়ে দিতেন। বলতেন- এখানে বসে খাও। তাঁর সাথে আলাপ করা যেতো জগতের যে কোন বিষয় নিয়ে। কথা বলতেন কম, শুনতেন বেশি।
আনিস স্যারের অনেক গুণ। তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। আমাদের মাননীয় প্রধান মন্ত্রীও তাঁকে শিক্ষকের মতো মর্যাদা দিতেন। তাঁর জন্য পেতে রাখা গালিচা তিনি ছেড়ে দিতেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের জন্য। আমাকে যেসময় বাগ্লা একেডেমি পুরস্কার দেয়া হয়, তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশেই ছিলেন দিত্নি।
আজকে স্যারের মৃত্যু সংবাদের সময় তাঁর জন্মসালের হিসাব পেলাম। দেখি আমার বাবা আর তাঁর জন্ম একই বছরে ছিলো। ৪৮ বছর বয়সে আমার বাবা মারা না গেলে হয়তো এখন দেখতে আনিস স্যারের মতো হতেন।
বাবা মারা যাবার পর মনে হয়েছিলো বড় ছাতাটা মাথার উপর আর নাই।
আনিসস্যারের মৃত্যু সংবাদ শুনেও মনে হলো, আমাদের মাথার উপর থেকে বড় ছাতাটা সরে গেলো।
(ফেইসবুকে প্রকাশিত স্ট্যাটাস থেকে )