সাইকেলের ছায়া , ১৯৯২

১৯৯২ সালের কথা।
একদিন দুপুরের পরপরই আমাদের এডিপিএস এর এক অতি উৎসাহী সদস্য, আমার প্রাক্তন ক্লাসমেট (সে তখন পঞ্চম বর্ষে, আমি চতুর্থ) আমিনুল টিটো আমার তিতুমীর হলের চার তলার রুমে আসে। আমাকে শুয়ে থাকতে দেখে বলে, কী ব্যাপার, তুই ছবি জমা দিবি না ?
আমি মাথা নাড়ি। বলি, না।
কেন ?
কথা বলি না।
টিটো আবার বলে, এখনো পুরা এক দিন বাকী আছে, কাল সন্ধ্যা ৭ টায় আলিয়াস ফ্রাসেস-এ জমা নেবে। পুরা এক দিনের চেয়ে বেশি সময় আছে। চল, দুজন মিলে বেরিয়ে পড়ি বিকালে। সাব্জেক্ট- ট্রান্সপোর্টেশন। আমার মাথায় বিরাট এক আইডিয়া আছে। আমারটা কাল সকালে তুলবো।
কী আইডিয়া ?
আমার ছবির ক্যাপশন হবে- দ্যা লাস্ট জার্নি। যদিও সবাই নানা রকমের গাড়ি, রিকশা, এসবের ছবি দিবে- আমি দিবো একটা শবযাত্রার ছবি। তোদের এই বারান্দা থেকে কাল ভোরে ছবি তুলবো। আমি তো প্রতিদিনই দেখি, এদিক দিয়ে লাশ নিয়ে আজিমপুর গোরস’ানের দিকে বেশ কয়েকটা লাশ যায়। কালও নিশ্চয়ই যাবে।
তুই দে। আমি দিচ্ছি না। অসুবিধা আছে।
আরে কিসের অসুবিধা ? প্রাইজমানি দেখসোস ? ফার্স্ট প্রাইজ গোল্ড মেডেল, সেকেন্ড প্রাইজ এসএলআর ক্যামেরা। ফ্রেঞ্চ এম্ব্যাসি সপন্সর। লেটস ট্রাই।
আমি কথা বলি না।
টিটো রুম থেকে বেরিয়ে যায়, যাবার আগে বলে, আমি যাচ্ছি নিউ মার্কেট। ফিল্ম কিনে আনছি। তোর সাইকেলের চাবি দে।
আমার সাইকেল গার্ড রুমের ভেতর। তালা মারি না এখন। তুই নিয়ে যা।
আধাঘন্টার মধ্যে টিটো ফেরত আসে আমার রুমে। বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে একটা কোডাক ফিল্মের বাক্সো। আমার ক্যামেরার ব্যাগ আমার হাতে ধরিয়ে বলে, যা ছবি তুলে নিয়ে আয়। আমার জন্য শেষের দিকে ৬-৭টা এক্সপোজার খালি রাখিস। কাল সকালে ফজরের আজানের পরই আমি বেরুব ছবি তুলতে – দি লাস্ট জার্নি।
আমি সত্যি সত্যি আমার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাই। নানা করসতের কিছু ছবি তুলি। সবই স্লো সাটারসিপডের ছবি। সাইকেল টু রিকশা বা ভ্যান । সাইকেল চালিয়ে একেবারে ফার্মগেট অভারব্রিজে যাই। নীচে সাইকেল তালা দিয়ে উপরে উঠে পজিশন নেই। সন্ধায় পর কাওরান বাজারের রাস’া দিয়ে বাস, কার চলে, বাতি জ্বালিয়ে। অভার ব্রিজের রেলিং এ ক্যামেরা বসিয়ে ২০-৩০ সেকেন্ডের টাইম এক্সপোজারে কয়েকটা ছবি তুলে হলে ফেরত আসি।
রাতে খেয়ে দেয়ে টিটোকে খুঁজি। হলে তার কোন সীট নাই, বাসা গুলশানে। কিন’ আমাদের রুম তার একটা অস’ায়ী ঠিকানা। আমার টেবিলের উপর তার টুথব্রাশ টুথপেস্ট থাকে। সে মাঝে মাঝে এখানেই ঘুমায়। আজ সে রুমে নাই। শুনলাম সে ডিপার্টমেন্টে, ডিজাইন করছে। কাল তাদের প্রিলী। আজ রাতে ক্লাসেই ঘুমাবে।
আমি ক্যামেরা নিয়ে সাইকেল করে আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট চলে যাই। নীচ থেকে ডাক দেই টিটোকে। তাদের ক্লাসরুম দোতালায়। টিটো আমার ডাক শুনে বেরিয়ে আসে। আমি নীচ তলার এক পিলারের গায়ে সাইকেলটা ঠেস দিয়ে টিটোর আগমনের প্রতীক্ষা করি। এবং এ সময় লক্ষ করি, উপর থেকে একটা টাংস্টেন বাল্বের আলো আমার সাইকেলের চাকার এক পাশে পড়ে ফ্লোরের উপর চমৎকার ছায়াময় একটা প্যাটার্ন তৈরি করে ফেলেছে। আমার কাঁধে ব্যাগ, ব্যাগে ক্যামেরা। ক্যামেরার ভেতর ৮ টি মাত্র খালি এক্সপোজার আছে। আমার এখন ছবি তুলতে ইচ্ছা হচ্ছে আমার সাইকেল চাকার ছায়ার, এবং এই ছবিটাই আমি জমা দিতে চাই।
টিটো নীচে নেমে এসেছে। সে ক্যামেরা নেবে। দেখে আমি সাইকেলের চাকার ছবি তুলি। আমাকে বলে-এটা কী তুলিস?
আমি বলি- কিছু না। তুই এবার এই সাইকেলের উপর ওঠ। সাইকেল চালা। আমি তোর এমন ছবি তুলবো, দেখবি, তুই ভুত হয়ে সাইকেল চালাচ্ছিস।
টীটো যখন আমার সাইকেলের উপর

আমি ক্যামেরাটা একটা কিছুর উপর রেখে তাঁর দুইটা ছবি তুলি। একটা ৫ সেকেন্ড এক্সপোজারে, আরেকটা ১০ সেকেন্ড। কোনটা যে টিকবে বলতে পারছি না। কিন’ একটা টিকবেই। কোনটা যে টিকবে- কাল ডেভেলাপ করার আগে বোঝা যাবে না।
ছবি তোলা শেষ করে টিটোকে ক্যামেরা বুঝিয়ে দিয়ে আমি আবার ফেরত এসে ঘুমাই রুমে।
সকাল বেলা হল ক্যান্টিনে আছি, নাস-া খাবো। টিটো এসে ঢুকে। সারা রাত জেগে ডিজাইন করেছে, ভোর বেলা আমাদের বারান্দায় না এসে চলে গেসে আজিমপুর গোরস-ানে, দি লাস্ট জার্নির ছবি তুলতে। খুব ফুর্তিতে সে নাই। আজ সেরকম লাশের বহরের ছবি সে পায় নি। তা ও তুলেছে।
আজ দেড়টায় থিওরি ক্লাস শেষ করে, লাঞ্চ করে আমি চলে যাব এলিফ্যান্ট রোড। মাস্টার কালার থেকে ফিল্ম ডেভেলাপ করে প্রিন্ট করে সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যে আলিয়াস ফ্রাসেসে ছবি জমা দেব। একজন সর্বোচ্চ ৪ টা জমা দিতে পারে। টিটো বলল, আমি দেব ২ টা, তুইতো ৪ টা দিবি। ৬ টার খরচ ৪৮০ টাকা, ২০টাকা ডেভেলাভ চার্জ। এই নে -এটা তোর জন্য আমার গিফট।
এই বলে মানিব্যাগ থেকে একটা ৫ শ টাকার নোট আমার হাতে দিয়ে নাস-ার অর্ডার দিল। আমরা নাস-া খেয়ে যে যার ক্লাসে চলে গেলাম।
মাস্টার কালার ল্যাবে ছবি প্রিন্ট করতে এসে বিপাকে পড়ে যাই। টিটোর ছবিগুলোতে ফোকাসে সমস্যা। আন্ডার এক্সপোজড। ছবি তুলেছে সে ৬ টা। এখান থেকে একটা দেয়া যায়। আরেকটা কোথা থেকে দেই ?
আমার ছবিগুলো আমার কাছে ভালোই লাগলো। একটা আছে একটা গাড়ির কাঁচে এক রিকশার প্রতিচ্ছবি, আরেকটা এক রিকশাওয়ালাকে প্যান করে স্লো সপীডে তোলা, কাওরান বাজারের গাড়ির লাইনও খারাপ আসে নাই। টিটো সাইকেল চালাতে চালাতে ভেনিশ হয়ে গেসে, এমন ছবিটাও ভালো। আমার ৪ টা হয়ে যায়। টিটো টাকা দিয়েছে আমার ছবি প্রিন্টের, অথচ তার ২ টা ছবি হছে না। ৬ টায় জায়গায় ৫ টা প্রিন্ট করেছি। আমি সাইকেলের চাকার ছায়া ফেলা ছবিটা প্রিন্ট করতে দিলাম।
প্রিন্ট হাতে পেয়ে মনে হলো, এ ছবিটা দারুন এসেছে। লেগে যেতে পারে। সাইকেলের অন্য ছবিটা টিটোর নামে জমা দিয়ে এটা নিজের নামে দেই।
কিন’ পরক্ষণেই মনে হলো, ফটোগ্রাফার নিজেই বা সাব্জেক্ট কী করে হয়?
বাদ এসব। ঐ ছবিটা টিটোর নামে জমা দিয়ে রিসিট নিয়ে এলাম হলে।
থ্রি-আর সাইজের সবগুলো ছবির প্রিন্ট দেখিয়ে টিটোকে বললাম, আমার এই ছবিটা কিন’ তোর নামে দিয়ে দিয়েছি। প্রাইজ পেলে ফিফটি ফিফটি, ওকে ?
টিটো হাসে। অবজ্ঞার হাসি। সে আবার প্রাইজ পাবে ? কিন ‘হাসতে হাসতে বলে, আচ্ছা, ফার্স্ট প্রাইজ তো গোল্ড মেডেল। এটা পেলেই আমরা পরদিন বায়তুল মোকাররমে গিয়ে বিক্রি করে ফিফটি ফিফটি নিয়ে নেব। আর সেকেন্ড প্রাইজ যদি হয়, এটা আমার একার । কারন তোর ক্যামেরা আছে, আমার নাই। এটা হবে আমার জীবনের প্রথম ক্যামেরা, এক বারেই এসএলআর।
আমি বলি- ঠিক আছে, ডান।
সপ্তাহ দুয়েক পর এক লোক একটা খাম নিয়ে আমার রুমে আসে। বেশ বড় খাম। খামের উপর আলিয়াস ফ্রাসেসের লগো দেখে আমার কলিজাটা ছ্যাত করে উঠে। লোকটা ৪০৪ নম্বর উত্তর রুমটি নিশ্চিত হতে চায় । আমি নিশ্চিত করতেই সে বলে- এসএএম আমিনুল হক কে ?
আমি চুপসে গিয়েও বলি, ও এই রুমেরই। আপনি চিঠিটা রেখে যান। আমি দিয়ে দিবো।
আমি সই করে চিঠি রাখি।
আমি জিজ্ঞেস করি- আর কোন নামের কারো চিঠি আছে ?
না।
লোকটি চলে যাওয়ার পর পরই খাম ছিড়ে চিঠিটি আমি পড়ি। ইংরেজিতে লেখা অভিনন্দন বার্তা। ট্রান্সপোর্টেশন শীর্ষক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় তাঁর তোলা দি শ্যাডো অফ বাইসাইকেল ছবিটা রৌপ্য পদক পেয়েছে। এটা দ্বিতীয় পুরস্কার। পুরস্কার হিসাবে পাবে একটা রূপার মেডেল, একটা এসএলআর ক্যামেরা, সার্টিফিকেট। পুরস্কার দেয়া হবে অমুক তারিখে আলিয়াস ফ্রাসিসে।
সঙ্গে আরেকটা ছোট খাম। সেই খামের ভেতর এক পাতার একটা কার্ড। পরের দিন ফরাসী রাস্ট্রদূতের বাসায় পুরস্কার প্রাপ্তদের সৌজন্যে ককটেল পার্টির দাওয়াত।
আমি টিটোকে ফোন করতে নীচে নামি। হলের কয়েন বক্স নষ্ট। কাজ করে না। ডিপার্টমেন্টে যাই। ফোন করি টিটোকে তার বাসায়। সে বিশ্বাস করে না। বলে- বুঝছি, তুই পাইসস, কংগ্রেচুলেশন্স।
আমি বলি এসে চিঠি নিয়ে যা।
সন্ধ্যায় এসে টিটো চিঠি দেখে আতকে ওঠে।
দুই দিন পর অনুষ্ঠান। আমরা সবাই টিটোর পুরস্কার আনতে যাই। কাঁপতে কাঁপতে টিটো পুরস্কার নিয়ে এসে নামে।
রাতে রুমে আসে টিটো। তাঁর হাতে ক্যামেরার ব্যাগ আর একটা কার্ড । বলে, কাল ফ্রেঞ্চ হাই কমিশনারের বাসায় তোকেও যেতে হবে। আমি বলেছি আমার ফ্রেন্ড কে নিয়ে যাব। এই দেখ, কার্ড দিয়েছে আরেকটা।
আমি বলি, না রে, আমার টিউশনী আছে, আমি যাব না। তুই যা।
টিটো ক্যামেরার ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। বলে, এই নে। এটা তোর। আমি মাঝে মাঝে তুলবো, আমাকে শিখাই দিস।
আমি ব্যাগটা তাঁর হাতে তুলে দেই। বলি- এটা তোর ভাগ্যে এসেছে।
এরপর আর কোন আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় ছবি দেই না।
– বিস্তারির আছে –বুয়েটকাল-এ
মন্তব্য
Loading...