ইয়েস, হাম ভি কাঁঠাল খায়া

তখন মধ্য-সত্তর, তখন আমি দশ-এগারো।

আমাদের গ্রামের বাড়ি ভাটা ভাগে। ভাটা ভাগে পানি আর পানি। মাছের আরাম আমাদের। উজানীরা বলে – ব্যাঙোর মুতে বারিষা হয় আমাদের আর তখন জাল নিয়া খেউ মারলেই খলুর ভরে মাছ নিয়া আসা যায়। কিন্তু ফল ফলাদির চাষ কম, এই চাষ উজানে হয় বেশি।

বিয়ানী বাজারের দুই ভাগ, উজান আর ভাটা ভাগ।  আমাদের আত্মীয় স্বজন ভাটাভাগে বেশি, উজানী কম । এইজন্য কম যাওয়া হয়। কিন্তু  এইসব উজানী কুটুম বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার দুই মজা। এক- ভাটা ভাগের মতো প্যাক নাই রাস্তাঘাটে, ছড়ার উপর চিরচিরাইয়া পানি যায়, জসিম উদ্দিনের গ্রামের মতো- ‘কাকের চক্ষুর নিয়া’ স্বচ্ছ সেই পানি । এই শীতল পানির ভেতর পা ভিজিয়ে ভিজিয়ে আর পায়ের পাতার আগা দিয়া পানি ছিটিয়ে ছিটিয়ে আমি ফুফুর বাড়ি যেতাম, বাউর বাগ। ফুফুর বাড়ি ফলের আড়ত। লুক্লুকি আর বুবি পেড়ে খাওয়ার আনন্দ ছিলো আলাদা। কাঁঠালও ছিলো, কিন্তু সে গল্প মইর বাড়ির। সেটা বলি।

১৯৭৬ সালে আমার তিন নম্বর মই (খালা)র বিয়ে হয়ে গেলো চন্দগ্রামে। সে আমলে বিবাহের সময় কনের সাথে তাঁর নিকটাত্মীয় শিশুশ্রেণীর কাউকে সাথে দেয়া হতো, যাতে কইন্যা বাপের বাড়ির জন্য খুব মন খারাপ না করে। সুতরাং এই কোটায় আমি স্থান পেলাম। আমার সাথে আমার চেয়ে দুই বছরের বড় আমার আরেক খালা, কুসুম। আমরা বরযাত্রীদের সাথে কন্যা নিয়া চলে গেলাম নতুন কুটুম বাড়ি।

এ ধরনের কুটুমেরা যে অনেক রাজকপালী হয় জানতাম না। অনেক খাতির যত্ন করা, উপহার দেয়া, নানা বাড়িতে দাওয়াতের উপর থাকা আর সারা দিন শুধু খাওয়া আর খাওয়া।

তৃতীয় দিন সকাল বেলা আমার খালুর ছোট ভাই, জালাল মামা আমাকে ডাকেন- ভাইগনা বেটা, আইও কিত্তা দেখাই তুমারে ।

-কিত্তা কিতা মামা?

-আমরার খেত অয় যেখানো।

– না মামা। আফনে যাইন।

জালাল মামার মন খারাপ। তিনি তাঁর গরুর পাল নিয়া চলে গেলেন।

এই জালাল মামার মতো গ্রু প্রেমিক মানুষ আমি জীবনে দেখি নি। ঝড়ের রাতে প্রবল কাল বৈশাখির সময় নিজের ঘর ছেড়ে চলে যেতেন গরুর ঘরে, চাল ভেঙ্গে গরুর উপর পড়ে গেলো কী না সেটা দেখতে। আরেকবার শুনি, বিশাল একটা মশারি কিনেছেন তিনি। এই মশারি দিয়ে পুরা গরুর ঘর তিনি ঢেকে রাখেন। আর অবসর সময়ে গরুর ঘরে চলে যান, তাদের সাথে গল্প করেন। তিনি নাকি গরুর কথা বুঝেন। গরুর সাথে কথা  বললে  তারা লেজ নাড়ায়, হাম্বা হাম্বা করে, এর কোনটার কী মানে তিনি নাকি জানেন। এসব গল্প শুনি জালাল মামার

তৃতীয় দিন জালাল মামা আমাকে একটা লোভনীয় প্রস্তাব দেন।

-ভাইগনা, আমরার আনারস টিল্লা দেখসো নি ?

-না।

আইও, তুমারে দেখাই।

-চলেন।

এবার মামার সাথে চলে যাই। বাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর সমতল। এতা পার হয়ে অনেকটুকে হেঁটে একটা জঙ্গলের কাছে গিয়ে মামা দাঁড়ান। আমাকে বলেন- সাবদানে আইওবা, জুক-ফুক আছে।

বুঝে গেলাম- এখানে হবে না। জোঁক আছে এই টিলায়।

আমি নীচে বসে থাকি। তিনি আমাকে দেখান আনারসের এই টিলার কোথায় কত আনারস আছে। কোনটার কী নাম। কোন সময় কোনটা খেতে হয়। আনারসের গায়ের রঙ সবুজ থেকে হলদে হয় কখন। কোনটা এখনো তিতা , কোনটা মিস্টি – এসব।

আমাকে এইসব জ্ঞান দিয়ে তিনি চলে যান ভেতরে। ফেরত আসেন দুইটা ছোট ছোট  আনারস নিয়ে।

মামার লুঙ্গির সাথে কাচি লাগালো ছিলো। সেটা দিয়েই কচ কচ করে কেটে ফেলেন আনারস। এবার চার পিস করে আমার হাতে দিয়ে বলেন, ভাইগনা রাখো তুমার আতো, এখন খাইও না, উবাও।

আমি দুই হাতে চার পিস আনারস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তিনি লুঙ্গির গিটের পাশ থেকে একটা কাগজের পুটলি বের করেন । বলেন- ভাইগনা, আবো সিজন আইসে না , বিত্তুং একটু টেংসি করবো বা, তুমা লাগি নুন লইয়া আইসি, নুন মাখাই খাও। বও অনো।

আমাকে টিলার তলায় একটা গাছের নীচে বসিয়ে জালাল মামা পুরা দুইটা আনারস খাওয়াইয়া ছাড়েন।

এরপর তাঁর সাথে কিত্তা দেখতে যাই। সেখানে তিনি তাঁর গরুগুলোকে স্পেশাল কেয়ারে পানি খাওয়ান। তাদের গায় হাত বুলান। আদর করেন। আমাকে ডাকেন, বলেন- ভাইগনা, তুমি তো ছাত্র ভালা, আমার গরুটারে আতাই দাও।

আমিও হাত বুলাই।

ফিরে আসি বাড়ি। কিন্তু মামু আমার লগ ছাড়েন না, বলেন,- আও ভাইগনা, খাটল খাই।

আমি বলি- মামা, সকালেই তো ঘরে খেলাম নাস্তার সময় খই আর কাঁঠাল। এখন বাদ দেই, ঘরো তো আছেই, লাগলে খাবো ।

কিন্তু মামু আমার নাছোড়বান্দা।

বলেন- আয় বেটা। ই জাত কাটল খাইওসত না কুনো দিন। ভাটাবাগি বেটাইন তুমরা কাটল খাওয়া চিনো না।

-আই মামা।

এবার মামুর সাথে রোয়ানা দিয়ে দিলাম। বাড়ির পেছন দিকেই ঘরের পেছনে অনেকগুলো কাটাল গাছ। সব গাছে কাঁঠাল ধরা। তিনি উচ্চতায় খাটো এমন একটা কাঁঠাল গাছের তলায় গিয়ে আমাকে ডাকেন।

আমি কাছে যেতেই বলেন- ভাইগনা, ঊঠো বা।

-মানে?

-গাছো উঠো।

আমি গাছ বাইতাম ফারি না মামু। কুনদিন উটসি না।

হাসেন জালাল মামা। আস্তে আস্তে বলেন- ভাটাভাগি বেটাইন তুমরা, কুন্তা জানো না, খালি জাল বাওয়া জানো। আয় বেটা, আমার কান্দো উঠ।

অতোপর সত্যি সত্যি আমাকে তাঁর কাধে উঠিয়ে একটা গাছের ডাল ধরিয়ে বলেন এই ডাল টান দিয়ে ধরে তাঁর উপর উঠে বসে পরতে এবং জীবনের প্রথম ও শেষবারের মতো আমি সত্যি সত্যি সেই গাছের  ডালের উপর বসে যেতে পারি।

আমাকে বসানো নিশ্চিত করে তিনি বাদরের মতো কয় লাফ দিয়েই আমার থেকে খানিক উচুতে আরেকটা ডালের উপর বসে পড়লেন।

এখন আমরা মামু ভাইগনা দুইজন দুই ডালে বসে আছি । আমি যে গাছের ডালে উঠে বসতে পারি এমন গৌরবোজ্জ্বল দৃশ্য কাকে যে দেখাবো লোক খুজে পাই না। আমি এদিক ওদিক তাকাই। আমার সাথে মাথিউরা থেকে আসা আমার কুসুম খালা (৪৪ বছর ধরে বিলেত প্রবাসী)কেও দেখছি না, আর যার বিয়ে হয়েছে তিনি অতি অন্দরমহলী, তাঁকেও দেখাবার সুযোগ নাই।

এই যখন ভাবছি  তখন জাম্বুরা সাইজের একটা কাঁঠাল দুই হাতে মোচড় দিয়ে দুই ভাগ করে এক ভাগ আমার হাতে দিতে দিতে জালাল মামু বলেন- নে বেটা , অনো বইয়া বইয়া শেষ কর ।

আমি এক হাতে এক গাছের ডাল ধরে আছি, হেলান দিয়েছি আরেক ডালে, এক হাত খালি আছে। যে হাত দিয়ে ডাল পেচিয়েছি সেই হাত দিয়ে কাঁঠালাংশ ধরে আরেক হাত দিয়ে এক কোয়া কাঁঠাল বের করে মুখে দিতে দিতে লক্ষ্য করি, গাছের ডালে বসে বসে কাঁঠাল খেতে পারার মতো বাহদুরি আমি দেখাতে পারছি  না কাউকে।

আচ্ছা, তখন যদি ফেইসবুক থাকতো আমি নিশ্চয় গাছের ডালে বসে চন্দগ্রামের কাঁঠাল বাগানে চেক ইন দিয়ে এই কাঁঠাল খাওয়াটাকে লাইভ করতাম আর এই এই লাইভের শিরোনাম দিতাম – হ্যা, হাম ভি কাঁঠাল খায়া।

মন্তব্য
Loading...