নীল স্যুটকেস

আত্মজৈবনিক উপাখ্যান (অসমাপ্ত) 

সেই স্যুটকেস

মিশিগানের স্টার্লিং হাইটস শহরের কিলবোর্ন ড্রাইভ লোকালয়ের বাড়িতে বসে আছি। আমি বেশ ক্লান্ত। সারাদিন ধরে অনেক হাটাহাটি হয়েছে ওয়ালমার্ট আর ‘বেষ্ট-বাই’তে। কাল সকালে আমরা দেশে উঁড়ে যাবো। ২০ দিনের আমেরিকা সফর আমাদের প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অবসাদ এসে গেছে শরীরে। কিন্তু বড় কাজটা বাকি এখন। ব্যাগ গোছাতে হবে।

ব্যাগ গোছানোর কাজে সিদ্ধহস্ত আমার স্ত্রী। তিনি যে কোনো পরিমানের জিনিসপত্র যে কোনো আকারের ব্যাগের মধ্যে ভরে ফেলতে পারেন বলে আমার ধারনা। এই ধারনা কিছুক্ষনের মধ্যে তিনি মিথ্যা প্রমাণ করে দিলেন। মুখে রক্তবর্ণ এনে আমাকে যা যা বললেন তার সারাংশ এমন যে আমার কোনো কমনসেন্স নেই। কী পরিমান জিনিস কোন ব্যাগে আটে এটা নিয়ে আমার ধারনা নাই।

আমি বলি – দুটো মাত্র জ্যাকেট কিনেছি আমার দুই বন্ধুর জন্য। দেশে মাঝে মাঝে শীত পড়ে। শীত পড়লে এই পশমের জ্যাকেট গুলো তারা আরাম করে পড়বে।

স্ত্রী বলেন – এই দুই জ্যাকেটের জায়গা আমার নাই। নতুন স্যুটকেস কিনে আনো।

কী বিপদরে ভাই! পঞ্চাশ ডলার দামে যে দুই জ্যাকেট কিনলাম তার জন্য কি আরো পঞ্চাশ ডলারের স্যুটকেস কিনতে হবে?

কিনো । না হলে ফেলে যাও। এসব জ্যাকেট বঙ্গবাজারে অনেক সস্তায় কিনতে পাওয়া যায়। ঠিক এই জ্যাকেটই আমি কিনে দিতে পারবো ওখান থেকে হাফ প্রাইসে। এগুলো ওদেরকে দিয়ে যাও। ওয়ালমার্ট-এ ফেরত দিলে ওরা ডলার দিয়ে দেবে।

বক্তৃতা শেষ। আমি চুপ করে বসে আছি। আমরা ৩জন যাত্রী। আমাদের ৬টা লাগেজ নেবার সুযোগ আছে। আমাদের স্যুটকেস হয়েছে ৫টা। সুতরাং আরেকটা আমরা নিতেই পারি। কিন্তু এর জন্য কি কিনে আনতে হবে?

বৌ বলে, সন্ধ্যায় গিয়ে নিয়ে আসো। ৩০-৩৫ ডলারেও পাওয়া যায়, আমি দেখেছি। নিয়ে এলে আমার আরো কিছু জিনিষ আছে ভরে দেবো।

আমি নুরুর দিকে তাকাই। দেখি, সে কিছুই বলেনা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জামাই বৌর ঝগড়া দেখে। এখন আবার দোকানে যাওয়া মানে অনেক যন্ত্রনা। এটা তো ইস্কাটন থেকে আজিজ মার্কেটে যাওয়া নয়। ইস্কাটন থেকে উত্তরা যাওয়া। গাড়ি লাগবে, চালক লাগবে। সময় হাতে মাত্র তিন ঘন্টা। যা করার খুব দ্রুত করতে হবে।

আমি আস্তে করে নুরুকে বলি- তোর বাসায় ভাঙ্গাচোরা কোন পুরোনো স্যুটকেস আছে?

– আছে একটা, তুমি নিবা?

নতুন না পুরান?

নতু্নও আছে পুরানও আছে।

আমি বলি, যা পুরান একটা নিয়ে আয়।

নুরু নীচে চলে গেলো।

বেজমেন্টে তাদের আরো একটা বাসা। দুইটা কামরা আছে, একটা বড়ো ঘর, সেখানে দুই সেট সোফা বিছানো । কিন্তু কেউ ওখানে খুব একটা বসে না, শোয়ও না। রান্না হয় মাত্র। মাঝে মাঝে খাওয়াও। সেই ঘরের এক পাশে একটা গোডাউন টাইপের জায়গা আছে। সে ঘরের ভেতর নানা রকম মালামাল রাখা। খানিক পরে হেলতে হেলতে একটা নীল রং এর স্যুটকেস নিয়ে এলো আমার কাছে।

আমি বলি, এটাই কি পুরনো? এটাতো নতুনের মতো দেখি।

নুরু বলে, আমি একটা কাপড় দিয়ে এটা ঢেকে রেখেছিলাম। ধুলো লাগেনি এজন্য নতুন মনে হচ্ছে।

আমি তাকাই স্যুটকেসটির দিকে।

নুরু বলে – চিনতে পারছো এই স্যুটকেস?

আমি তাকিয়ে থাকি। একবার মনে হলো স্যুটকেসটা আমি চিনি আবার মনে হলো- চিনি না।

নুরু বলে চিনেছো?

আমি বলি-হ্যা।

জুন, ১৯৮৪

চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে সিলেটের বিয়ানীবাজারে আমাদের মাথিউরা গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি মাত্র এক সপ্তাহ আগে। বাড়ি আসার আগে শখ করে ঢাকা  দেখতে চাইলাম। আগে কোনো দিন ঢাকা যাওয়া হয়নি। শহর বলতে চিনি সিলেটের সুরমা গাঙ্গের এইপার, যেদিকে রেল স্টেশন আর চট্টগ্রাম। ঢাকা রাজধানী শহর। না জানি কতো কিছু আছে সেখানে। দেশে থেকে বাদ বাকি পড়াশোনা করলে তো ঢাকাতেই করতে হবে! সুতরাং শহরটা চেনা দরকার।

ক্যাডেট কলেজ থেকে বেরোলাম মে মাসে। জুন মাসের মাঝামাঝি পযর্ন্ত ঢাকায় থাকলাম রায়হানের বাসায়। ঢাকা দেখলাম, আইএসএসবি পরীক্ষা দিলাম। মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম আবার ঢাকায় আসতে হবে। বুয়েটে বা মেডিক্যালে পড়তে হলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে এখানে।

ঢাকায় আমার দুই আত্মীয় আছেন। একজন নানা, তিনি মায়ের চাচা, থাকেন মীরপুরে। আমি তাঁর ঠিকানা জানিনা। আরেকজন দাদা, তিনি বাবার চাচা, থাকেন মহাখালী। ঠিকানা জানিনা। সুতরাং কারো সঙ্গেই আমার কোন যোগাযোগ থাকেনা। আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই, সিনেমা দেখি আর বুয়েট-মেডিক্যালে ভর্তির খোঁজ খবর নেই। দিন পনেরো থাকার পর আমি বাড়ি চলে যাই।

এক বিকেলে আমার বড় চাচা আমাকে ডাকেন। দেখি পুকুর পাড়ে তিনি দাঁড়িয়ে, হাতে একটা চিঠি। আমাকে দেখে বলেন, ঢাকা থেকে একটা চিঠি এসেছে। চিঠি লিখেছেন মতছিন (ভালো নাম- হাজী মুতাছীম আলী) দাদা।

বড় চাচার চোখে কিছু সমস্যা। ভাল করে লেখা পড়তে পারেন না। তার চোখে চশমাও নেই। তিনি লেখাটির মর্মার্থ খুব ভালো বুঝতে পারছেন না। খামের ভেতর থেকে চিঠির কাগজ বের করে চিঠি পড়তে পড়তে আমাকে বলেন, তোর বাফ এখন ঢাকাত। মতছিনচা’য় লেখছইন।

বলেন কি ! আমি অবাক।

মাসখানেক আগেই আম্মার কাছে চিঠি এসেছে। লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনী থেকে। জাহাজ যাবে মাল্টায়। কিন্তু এখন ঢাকায় কেন?

আমি হাত থেকে চিঠি নেই। মতছিন দাদা খুব ছোট ছোট হাতে লিখেন। তার হাতের লেখা ভালো করে পড়া যায়না। চিঠি লিখেছেন আং হেকিমকে উদ্দেশ্য করে, যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে- আং মজিদ একটু অসুস্থ। জাহাজ থেকে ডাক্তার সঙ্গে করে তাকে ঢাকায় এনেছে। এখন তাঁর বাসায় আছেন। আমাকে যেন পাঠানো হয়। সঙ্গে তাঁর বাসার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার।

আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে ফোন নাম্বার টুকে নিলাম। এলাম ঘরে, ঠিক করলাম এখনি বিয়ানী বাজার গিয়ে ফোন করতে হবে বাবাকে। কিন্তু কী কারণে বিয়ানী বাজার যাবো এটা ঘরের কাউকে জানানো যাবেনা।

মা যদি জিজ্ঞেস করেন? মাকে সে সুযোগ দেওয়া যাবেনা। আমার কাছে ৫শত টাকা আছে। সুতরাং টাকার সমস্যা নাই। আমি পলিথিনের ব্যাগের মধ্যে একটা জিন্সের প্যান্ট ভরে লুঙ্গি পরে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম।

হেটে হেটে ৩ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যা সাতটার দিকে পৌঁছালাম নিউমার্কেটের টিএন্ডটি অফিসে। এর আগে এখান থেকে লন্ডনে ফোন করেছি আমি। ঢাকায়ও করেছি। কিন্তু সময় লাগে অনেক। অপারেটরকে নাম্বার দিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। একসময় হ্যালো আলফা-বিটা-চার্লি-ডেলটা…টাইপের নানা কথা বলার পর লাইন পায়। এই লাইনের সংযোগ দেয়া হয় অন্য টেলিফোনে। সেখান থেকে কথা।

কিন্তু আজ আমার কপাল খারাপ। বৃষ্টির কারনে লাইন যাচ্ছেনা। চারখাই পযর্ন্ত সংযোগ আছে। তারপর নেই। অনেক কষ্টে ভৈরব পর্যন্ত লাইন পেলো কিন্তু ঢাকা পাওয়া গেলোনা। আমি বৃষ্টির মধ্যে কাদামাখা পথ পেরিয়ে ছাতা মাথায় নিয়ে রাত দশটায় বাড়ি ফেরত এলাম। বাড়ির কেউ কিছু জানেনা। পরদিন ফোন করার জন্য যেতে হবে সিলেট। আমার পকেটে সেই পাচশ’ টাকার নোট।

১৯৮৪, মাথিউরা

তখন বর্ষা কাল। গয়না নৌকা দিয়ে ঢাকাদক্ষিন বাজার পযর্ন্ত গিয়ে বেবিট্যাক্সিতে গোলাপগঞ্জ। সেখান থেকে সিলেটের বাস পাওয়া গেলো। ভোর সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম, সিলেট পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা প্রায় একটা। ফোন করার জন্য গেলাম টেলিফোন অফিস। সেখানে লম্বা সিরিয়াল, অনেক সময় লাগবে। টিএন্ডটি থেকে ফোন করতে পারলে খরচ কম। ঢাকায় ট্রাংক কল করা যায়, বারো টাকা মিনিট। একজন পরামর্শ দিলো পাশে গুলশান হোটেল আছে। তাদের ফোন থেকে ডাইরেক্ট কথা বলা যায়। সময় কম লাগে। কিন্তু রেট একটু বেশি। বিশ টাকা মিনিট। আমি হেঁটে হেঁটে গুলশান হোটেলের কাউন্টারে যাই। রিসিপশনে তালা দেয়া ফোন নিয়ে বসে আছেন ম্যানেজার। আমি তাকে ফোন নাম্বার দেই। তিনি ফোনের তালা খুলে ডায়াল করেন এবং এক ডায়ালেই আমি পেয়ে যাই মতছিন দাদাকে। তিনি ডেকে আনেন বাবাকে। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলি।

বাবার স্বরটা আমার কাছে একটু অন্যরকম লাগে। কথার মাঝখানেও শুনি তিনি কাশছেন, গলার আওয়াজ ভাঙ্গা। আমি জিজ্ঞেস করি – কিতা অইছে আফনার?

বাবা ধীরে ধীরে বলেন- বুকে সামান্য একটা টিউমার হয়েছে তাঁর , সেঁক দিলে কমে যাবে। এ জন্য কয়দিন থাকতে হবে ঢাকায়। জানতে চান, আমি কি ঢাকায় আসতে পারবো ?

আমি বলি যে- আমি আজ আসবো ঢাকায়। রাতের বাসে।

বাবা জিজ্ঞেস করেন, আমার কাছে টাকা আছে কিনা।

আমি বলি, আছে পাঁচশ টাকা।

বাবা বলেন, সাড়ে চারটায় একটা ফ্লাইট আছে সিলেট থেকে। দেখো টিকেট পাও কিনা। পেলে প্লেনে চলে আসো।

আমি এর আগে কখনো প্লেনে চড়িনি। ট্রেন আমার প্রধান বাহন। চট্টগ্রাম যাই সেকেন্ড ক্লাসে, ভাড়া ১৩ টাকা। ঢাকার ভাড়া কত হবে জানিনা। ঢাকা কখনো ট্রেনে যাইনি। শুনেছি নতুন একটা বাস এসেছে সিলেটে, নাম- মিতালী পরিবহন। খুব আধুনিক। রাস্তায় লোক ওঠায় না। যদিও ৫টা ফেরি পার হতে হয় ঢাকা যাওয়ার জন্য কিন্তু আরাম অনেক। ট্রেনের চেয়ে ভাড়া বেশী, ৬০ টাকা ভাড়া। কিন্তু এখন এটাতেই সবাই যায়। আমি ভেবেছিলাম রাত ৯টায় মিতালী পরিবহনের যে বাস ছাড়বে কদমতলী থেকে সেই বাসে করে চলে যাবো ঢাকা। কিন্তু হলোনা। কিন্তু প্লেনেট টিকিট কাটতে হয় কোন কাউন্টার থেকে আমি তো জানি না ।

আমাকে সাহায্য করেন হোটেলের ম্যানেজার। বলেন, বিমানের টিকেট কাটতে হয় বিমান অফিস থেকে। কিন্তু এখন বিমান অফিসে টিকেট বিক্রি করবে না। আমি যদি সরাসরি এয়ারপোর্ট চলে যাই, এবং ‘চান্স’ এ যদি টিকেট পেয়ে যাই, তবে দুইশ’ পঁচিশ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে চলে যেতে পারবো। ৩৫ মিনিটে ঢাকা। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, রিস্ক নেব। আবার ২০ টাকা খরচ করে আরো এক মিনিট কথা বলি ঢাকায়। জানাই, আমি এয়ারপোর্ট যাচ্ছি, প্লেনে টিকিট পেলে সাড়ে ৪ টার ফ্লাইটে আসবো, না পেলে রাতে।

বিমান অফিসে আমি প্লেনের টিকেট পেয়ে যাই আর দুরুদুরু বুকে প্লেনের ভেতর প্রবেশ করি।

বাবাকে নিয়ে একদিকে এক অজানা আশংকা, অন্যদিকে আকাশের উপর পাখির বুকের ভেতর লুকিয়ে ওড়ার মত রোমাঞ্চ -আমাকে বিহ্বল করে ফেলে। এই আমার প্রথম বিমান চড়া। এই আমার আকাশ পথে ওড়াওড়ির সূচনা।

প্লেন নামলে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই দেখি মতছিন দাদা দাড়িয়ে। আমাকে বলেন – তোর ব্যাগ কোথায়?

আমি বলি যে ব্যাগ নিয়ে আসিনি। আমি সিলেট আসার জন্য বাড়ি থেকে এসেছিলাম। ফোনে কথা বলে ঢাকা এলাম।

মহাখালী ১৯৮৪

মহাখালী কাঁচাবাজারের সাথে লাগোয় একটা গলি। এক পাশে বেশ বড় একটা প্লট। প্লটের একদিকে ইংরেজী ‘এল’ হরফের আকৃতির টিনের ঘর। বাকি জায়গাতে কতগুলো গাছ। বাড়ির ভেতর ঢুকে যাবার পর ঠিক মনে হয় না ঢাকায় এসেছি। টানা লম্বা বারান্দা। বারান্দায় জাল দিয়ে গ্রিল দেয়া। বেশ বড় বারান্দা। এই বারান্দায় অনায়াসে কয়েকজন মিলে বসে বসে গল্প করা যায়্।

আমার থাকার জায়গা হয়েছে এ বাড়ির ড্রয়িং রুমে। এমনিতে ড্রয়িং রুমটা বেশ বড়। আছে দুইটা খাট। চারটা সোফা, আলনা। যে খাটটি বড় তার পাশে একটা ছোট টেবিল। টেবিলের উপর বাবার চশমা রাখা। তার পাশে বাবার ব্রিফকেস। ব্রিফকেসের পাশে নীল রং এর একটা বড় স্যুটকেস। তার উপর সাদা রং এর একটা শার্ট রাখা। এটা বাবার শার্ট। বাবার শার্টে একটা গন্ধ আছে। আমি টের পাই। ঐ বিছানাটা নিশ্চয়ই বাবার।

আমি সোফায় বসে থাকি। মতছিন দাদা আমার বিছানা দেখিয়ে দেন। আলমারী থেকে তার নিজের একটা লুঙ্গি দেন আমাকে কাপড় বদলাবার জন্য। আমি লুঙ্গি পরে বসে থাকি। বুঝতে পারি পাশের বিছানাটায় আমার থাকার বন্দোবস্থ হতে পারে। কিন্তু সেই বিছানাটা তার বড় ছেলে শাহজাদার।

শাহজাদা চাচার সঙ্গে আমার খুব পরিচয় নাই। আমি বাবাকে খোঁজার জন্য ভেতেরর ঘরে যাই। দেখি রান্নাঘরের পাশের খাবার টেবিলে বাবা বসে আছেন। বাটি থেকে জলজ কিছু খাবার তিনি মুখে তুলছেন। নিশ্চয়ই এটা স্যুপ।

বাবা চিন্তিত হয়ে পড়লেন আমাকে নিয়ে। বাড়িতে কী করে খবর দেয়া যায় যে আমি ঢাকা এসেছি? মতছিন দাদা বলেন, তিনি বিয়ানী বাজারে রড সিমেন্টের এক পরিচিত দোকানদারকে ফোন করে বলে দেবেন। সেই লোক তার কোনো কর্মচারীকে বাড়ি পাঠিয়ে জানাবে।

নুরু, লতিফ, শবনম, রাসেল, ১৯৮৪

আমরা নানা বিষয়ে কথা বলি। বাড়ির গল্প বলি। নুরু, লতিফ, সবু, রাসেল তারা কে কোন ক্লাসে পড়ছে, কে কি করছে, কার রেজাল্ট কেমন – এসবই আলোচনার বিষয়। আমাকেও নানা রকম ইন্টারোগেশন করা হয়। রেজাল্ট কী হবে- মেট্রিকের মতো ইন্টারমিডিয়েটেও স্ট্যান্ড করতে পারবো কীনা, এসব প্রশ্নের ভালো জবাব দিতে পারিনা।

দাদি বলেন- কি পড়বা?

আমি কী জবাব দিব বুঝতে পারি না। বাবার মুখ থেকে জাহাজে জাহাজে নিখরচায় সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ানর গল্প শুনে শুনে ঠিক করে ফেলেছি মেরিনার হব। এ নিয়ে অনেক স্টাডিও আমার। পরীক্ষার খাতায় একবার জীবনের লক্ষ্য লিখতে গিয়েও লিখেছি- আমি নাবিক হতে চাই, দুনিয়া দেখতে চাই। এর মধ্যে মেরিন একাডেমির ফর্ম আনাতেও দিয়েছি। দাদিকে বলি – মেরিনে যাবো।

না, না – ধমক দেন বাবা। বলেন, মেরিন না, অন্য যা ইচ্ছা।

আমি মিন মিন করে বলি, আম্মায় কইন মেডিক্যাল ফড়তে।

বাবা বলেন যে তাঁর কোন আপত্তি নাই। শুধু সেই বিষয় পড়তে হবে যেটা পড়লে আমি সবচেয়ে ভালো করবো মনে করি।

আমাদের প্রথম রাতের আড্ডা শেষ হয়ে যায় দ্রুত । রাতে খেয়েদেয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি শাহজাদা চাচার সঙ্গে তারই বিছানায়।

ঘুমাতে যাবার আগে এবং ঘুম থেকে ওঠার পরেও মাঝে মাঝে শুনি বাবা কাশছেন। সন্ধ্যায় একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কাশির অষুধ কী খাচ্ছেন। বাবা স্পষ্ট করে কিছু বলেন না। বলেন- আছে, সব আছে।

পরদিন সকাল বেলা খুব ভোরে দেখি বাবা বিছানায় নাই। তিনি বাইরের বারান্দায় বসে আছেন। আমি ঘুম থেকে উঠে গিয়ে ওখানে কি বসবো?

আমার সাহস হয়না । আমি বিছানার এপাশ ওপাশ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙলো বেলা দশটায়। দেখি বাবা নাই। ঘরে দাদাও নাই। দাদা গেছেন তার দোকানে। দাদিকে জিজ্ঞেস করতে বলেন বাবা রাশমনো হাসপাতালে গেছেন। বুকে সেক দিতে হয়। নয়টায় ডাক্তারের এপোয়েন্টমেন্ট ছিলো।

আমি নাস্তা খাই। হাটাহাটি করি। দাদার ফোন থেকে আমার দু’একজন বন্ধুকে ফোন করি। আমার ঢাকা আগমনের খবর শুনে তারা কিঞ্চিত অবাক হয়। তাদেরকে খুব গুছিয়ে বলতে পারিনা।

একবার বাবার বিছানার কাছে এসে দেখি তার বালিশের তলায় কিছু কাগজপত্র। আমি পুরো বালিশ উল্টে দেখি রীতিমত ফাইল।

মাল্টার এক হাসপাতালের নাম লেখা। রোগীকে তারা প্রথম কি কি লক্ষণের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল তার বর্ননা। শরীরের মাপ, ওজন, বয়স, এসবের পাশাপাশি চামড়ায় কোথায় কোথায় দাগ এবং গোটা টাইপের কিছু জিনিস দেখা গেছে তার বিবরণ এক কাগজে। কি কি টেস্ট করাতে হবে তার একটা ফর্দ আছে।

আরেকটা বড় প্যাকেটের ভেতর দেখি কতগুলো এক্সরে, তার রিপোর্ট। দেখি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের রেডিওলজি বিভাগের এক অধ্যাপকের আরেকটা ফর্দ। সেখানে রোগের নামের জায়গায় ইংরেজীতে ‘সিএ’ লিখে লেখা হয়েছে – লাংগস। আরেকটা প্রেসক্রিপশন – ঢাকা মেডিক্যালের ক্যানসার বিভাগের প্রধান। ড. আব্দুল হাই এর নাম লেখা সেখানে। ডাক্তারী সাংকেতিক ভাষায় অনেক কিছু লেখা। কিছু ঔষুধের নামও।

আমি কাগজগুলো যত্ন করে সেখানে রেখে দেই। কেউ জানেনা যে আমি এসব দেখে ফেলেছি। বাবার সাথে আমার গল্প হয়। বিষয় একটাই- কী বিষয় নিয়ে পড়তে চাই এখন। আর তেমন কিছু না। তৃতীয় দিন বাবা বলেন – কাল সকালে ১০ টার ফ্লাইটে তোমার জন্য টিকেট কেটে এসেছি। বাড়ি চলে যাও, ওরা হয়তো চিন্তা করছে। বলো কিছুদিন পরই আমি আসছি। এবার থাকবো বেশ কিছুদিন।

আমি নীল রং এর স্যুটকেসটা নিয়ে পরদিন বিমানে করে সিলেট নামি।

আমার সাথে সেই নীল স্যুটকেস আর একটা ন্যাশানাল প্যানাসনিক টু-ইন –ওয়ান। আমার চোখ পড়ে আছে এটাতে। এর আগে আমাদের রেডিও ছিলো কিন্তু ক্যাসেট প্লেয়ার ছিলো না । এবার আমি নিজের পছন্দের গান শুনতে পারব এই আমার আনন্দ। কিন্তু আমার কাছে তো ক্যাসেট নাই। ক্যাসেট ছাড়া প্লেয়ার নিয়ে লাভ কী ?

আমি যে বেবিট্যাক্সি রিজার্ভ করেছি তাকে নিয়ে  ঢুকে পড়ি লন্ডন ম্যানসন, দোতালায়। সেখানে পাওয়া যায় কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তির ক্যাসেট । কিন্তু বিক্রি হবে না। টাকা দিলে কপি করে দিবে, সময় লাগবে এক ঘন্টা। আমি বেবি ট্যাক্সিকে দেড় ঘন্টা বসিয়ে রেখে ক্যাসেট কপি করাই। আরেকটা সাগর সেনের রবীন্দ্রসংগিতের ক্যাসেটও কিনি। এই দুইটাই আমার জীবনের প্রথম কেনা ক্যাসেট। এই প্লেয়ার চলবে ব্যাটারি দিয়ে।  চারটা নতুন ব্যাটারিও কিনে ফেলি। বাবা আমাকে টাকা দিয়েছেন। আমার পকেট গরম । মনে ফূর্তি। আমি এগুলো নিয়ে সোজা চলে আসি গাছতলা ।

গোলাপগঞ্জ আর চারখাইর মাঝামাঝি জায়গায় হাওড়ের পাশে কতগুলো গাছের তলায় এখানে কিছু গয়না নৌকা বাধা থাকে। বাবা বলে দিয়েছেন, নৌকা রিজার্ভ করে নিয়ে যেতে। এই নৌকায় একা কেবল আমি থাকবো, আর কেউ না। অন্য গয়না নৌকাগুলো লোকজন ভরলে রওয়ানা দেবে, আর নামিয়া দেবে ঈদ্গাহ বাজারে। জন প্রতি ৩ টাকা ভাড়া। আর ২০ টাকা দিলে একা নৌকা নিয়ে বাড়ি যাওয়া যাবে। আমি একটা নৌকা রিজার্ভ করে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেই। আমার সঙ্গে সেই নীল স্যুটকেস।

নুরুর কথা

তুমি কিছু না বলে সিলেট গেলা, তাই না ভাইয়া? আমরা সারাদিন তোমার কোন খবর পাইনা। একবার ভাবলাম তুমি সম্ভবত তুহিন ভাইয়ের বাসায় থেকে গেছো। বিকালে নৌকা বাইচ, সন্ধ্যায় সিনেমা দেখে রাতে ওবাসায় থেকে গেছো। নিশ্চয়ই পরদিন আসবে। আমি আম্মাকে বার বার বলেছি- ভাইয়া নিশ্চয়ই তুহিন ভাইয়ার বাসায় আছে, কাল চলে আসবে।

কিন্তু তুমি পরদিন বাড়ি আসোনা। আম্মা মহা চিন্তায় পড়ে যান। আমিও। কিন্তু আম্মাকে আমি বুঝতে দেইনা যে আমিও চিন্তায় আছি।

পরদিন রাতের বেলা হঠাৎ হারিকেন জ্বালিয়ে আলিম ভাই আসেন আমাদের ঘরে। বলেন বিয়ানীবাজারে একজন খবর দিয়েছে, মতছিন দাদা জানিয়েছেন, তুমি ঢাকা আছো।

আমরা যাই বড় চাচার ঘরে। বড় চাচা বলেন, গত পরশুদিন মতছিন দাদার কাছ থেকে চিঠি এসেছে। সেই চিঠিতে লেখা ছিল তোমাকে যেনো ঢাকা পাঠানো হয়। কিন্তু তুমি যে ঢাকা যাবে এমন কথা আমাদের কাউকে তুমি বলে যাওনি।

কেন বলোনি? আমরা মন খারাপ করবো এ জন্য ? আমি কিন্তু জেনে নিয়েছি বড় চাচার কাছ থেকে যে বাবা অসুস্থ। তাকে জাহাজ থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে দেশে। তিনি ঢাকা আছেন। তুমি গিয়ে কিছুই জানালে না। বাবার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে দাদা চলে গেলেন মসজিদে। মিয়াসাবের পকেটে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দোয়া পড়ালেন এশার নামাজ শেষে।

পরদিন খতমের আয়োজন হলো বাড়িতে। জোহর নামাজের পর তিনজন মোল্লা এলেন বাড়িতে। দাদার নেতৃত্বে মিয়া সাহেবেরা প্রথমে ওয়াজ করলেন কিছুক্ষণ। বললেন, মৃত্যু ছাড়া সব অসুখের শিফা আল্লাহ রাব্বুলের কাছে আছে। আল্লাহ্ চাইলে সব করতে পারেন। একজন রোগীকে সুস্থ করে তোলা আল্লাহ সুবহানাতা’লার কাছে কোনো বিষয়ই না।

এর পর শুরু হলো ইউনুস নবীর কাহিনী। কিভাবে তিনি মাছের পেটে ছিলেন এবং এই দোয়াটি মাছের পেটে থাকা অবস্থায় তিনি পাঠ করার কারনে আল্লাহ তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনেন। সুতরাং এটাও কোন বিষয় না। শুরু হলো দোয়া ইউনুস এর সূচনা পর্ব। এক লাখ চব্বিশ হাজার বার পড়তে হয় – লা-ইলাহা ইল্লা আনতা, সুব্হানাকা ইন্নি কুন্তু মিনায যালিমীন। মিয়াসাহেবেরা বললেন, কয়েকজন মিলেও এটা পড়া যায়। আম্মা শুরু করে দেন। আমিও করি। আমি খাতায় লিখে রাখি হিসাব। দুই দিনে ১২ হাজার বার পড়া যখন শেষ করেছেন তখন এক বিকেলে আমাদের বাড়ির পশ্চিম পাড়ের পুকুর পাড় দিয়ে একটা গয়না নৌকা এসে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে।

তখন আমাদের বর্ষা কাল। আর বর্ষা মানেতো থৈ থৈ পানি।  আমাদের বাড়িটা একেবারেই একটা টুকের উপরে। ছোটবেলায় বর্ষাকালে এটা একেবারে  দ্বীপ হয়ে যেতো চারদিকে পানি থাকতো। তুমি যে বছর ক্যাডেট কলেজে গেলে সেই ১৯৭৮ এ বাড়ির পূব পাশে একটা পুকুর করা হলো। পুকুর কাটালেন বাবা। পূবের বাড়ির লোকেরাও পশ্চিম পার্শ্বে আরেকটা পুকুর কাটালো। সেই দুইটা পুকুর কাটার পর আমাদের বাড়ি আর দ্বীপ থাকলো না। গ্রামের মুল সড়কের সাথে তার একটা সংযোগ হয়ে গেলো। এখন দুইশো সত্তুর ডিগ্রি কোণে আমাদের পানি থাকে। আগে ছিল তিনশো ষাট ডিগ্রী কোণের। আগে পানি যেমন থৈ থৈ করতো এখনো করে। কিন্তু ঠিক টের পাইনা। তারপরও আফাই করলে পূবের রাস্থা মরে যায়, নৌকা ছাড়া বাড়িতে আসা যায় না। এটা জেনেই হয়তো তুমি রিজার্ভ গয়না নিয়ে বাড়ির একেবারে ঘরের কাছে এসে পৌঁছালো আমি আর দৌঁড়ে যেতে পারিনা।

আমার মনে পড়ে তুমি যখন ক্যাডেট কলেজ থেকে ছুটিতে বাড়ি আসতে তখন আমরা সবাই এক সাথে দৌঁড়ে বাড়ির কাছে মাঠে চলে যেতাম। যে তোমাকে আগে দেখতো সে-ই চিৎকার করে উঠতো। তার চিৎকার শুনে সবার সব কাজ ফেলে আমরা দৌঁড়াতাম তোমাকে নিয়ে আসতে। আমরা কেউ তোমার ব্যাগ নিতাম । ছোট ব্যাগ, তাও অনেক ভারি। তখন আমি অনেক বড়, নাইনে পড়ি, কিন্তু এবারের তোমার ব্যাগে হাত দিতে পারিনা। এবার তুমি দেখি আমাদের জন্য একটা স্যুটকেস নিয়ে এসেছো। নীল রং এর স্যুটকেস। কী সুন্দর! চারদিকে চিকচিক করছে নিকেলের একটা ব্যান্ড। এটাতে তালা মারা নাই। তুমি কতগুলো নম্বর ঘুরিয়ে ঠাস করে আমাদের সামনে খুলে ফেললে। আমরা সবাই ভেতরে কি কি আছে তা দেখার জন্য ব্যস্ত। আম্মাকে দেখিনা। আম্মা কোরআন খতম নিয়ে বসেছেন। বারবার বলছেন তোর বাপের খুব কঠিন অসুখ হয়েছে।

আমি আম্মাকে বলি, তুমি কেমনে জান?

আম্মা একটা চিঠি নিয়ে এসেছেন। বাবার চিঠি, লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বন্দর থেকে। এ রকম চিঠি আমাদের বাড়িতে কিছুদিন পর পর আসতো। একটা চিঠি আমরা সবাই বার বার পড়তাম। মার নামে আসা চিঠি দাদা খুলতেন না, কিন্তু মন খারাপ করতেন। কখনো কখনো এয়ার লেটারে চিঠি না এসে এনভেলপের মধ্যে চিঠি থাকতো। এনভেলপের ভেতর ২/৩টা কাগজ। প্রত্যেকের নামে আলাদা আলাদা চিঠি। কিন্তু এবার এসেছে এয়ার লেটারে। চিঠি আম্মার নামে। আমি খুলে দেখি, উপরে লেখা, ‘এলাহী ভরসা’। বাবা চিঠি শুরু করতেন ‘প্রিয়তমা ফরিদা’ এটা লিখে। আম্মা যখন আমাদের চিঠি পড়ে শোনাতেন, তখন এই শব্দ দু’টি বলতেন না। এখনো বলছেন না। তিনি চিঠি পড়া শুরু করেন। বলেন, এই দেখ – তোর বাবা যখন চিঠি লিখেন সব সময় লিখতেন “আশা করি তোমরা ভালো আছো । আমিও ভালো আছি।” কিন্তু এই চিঠিতে “ আমিও ভালো আছি” এই কথা লেখা ছিলোনা। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল কিন্তু কিছু বলিনি।

আম্মা কিন্তু বাবার সব চিঠি তাক তাক করে রেখে দিতেন টেবিলের ড্রয়ারে। মাঝে মাঝে দেখতাম আম্মা শুয়ে শুয়ে বাবার পুরোনো চিঠি পড়তেন। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আসা চিঠি। নানা রকমের খাম নানা রকমের স্ট্যাম্প। তুমি একবার বলেছিলে স্ট্যাম্পগুলো তোমার জন্য রেখে দিতে। আমি ইনভেলাপের উপর পানি ভিজিয়ে কিছুক্ষন পর টান দিয়ে খুলে ফেলতাম। তারপর ভাতের মাড় দিয়ে আঠা লাগিয়ে খাতার ভেতর রেখে দিতাম তোমার জন্য। তুমি ক্যাডেট কলেজ থেকে এসে এগুলো দেখে খুব মজা পেতে। আমাকে অবাক করার জন্য তুমি কতগুলো পোষ্টকার্ড দেখাতে আমাকে। ভিউকার্ড। বাবা অনেক জায়গা থেকে দু লাইন লিখে তোমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতেন। কোনটাতে দেখতাম ক্যাঙ্গারুর ছবি কোনটায় লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ বা সিডনীর অপেরা হাউজ। তুমি আমাদের বলতে ইন্টার মিডিয়েট শেষ করে মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হবে। বিনা পয়সায় দেশ দেখার সখ ছিল তোমার। এখন আল্লাহ তোমার সব সখ মিটিয়েছে।

রাতের বেলা আমি হারিকেনটা উঁচু করে ধরলাম, তুমি এই স্যুটকেসটা খুললে।  এই প্রথমবারের মতো তোমাকে দেখে বাবা বাবা মনে হয়েছিল। আগে বাবা যখন স্যুটকেস খুলতেন তুমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে, বাবার সামনে আসার সাহস ছিলো না তোমার। আমি বাবার কোলে বসে পড়তাম, হাত দিয়ে নিজে বের করে আনতাম সব কাপড়। বাবা যার নাম বলতেন, দৌড়ে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে দিয়ে আসতাম। আজ মনে হলো এই ঘরের কর্তা আসলে তুমি এবং এই স্যুটকেসটাও তোমার। বাক্স খুলা হলে দেখি নানা রকমের কাপড়চোপড়। জিনিসপত্র দেখেই বুঝতে পারি কার জন্য কোনটা আনা হয়েছে। এডিডাস কোম্পানীর জুতা মানে তোমার জুতা। তুমি রাতের বেলা লুঙ্গির সাথে এডিডাস এর কেডস পরে হাটাহাটি করলে। দুটো স্কাট মেক্সি আছে। একটা ছোট একটা বড়। বুঝতে পারি একটা শবনমের জন্য, আরেকটি আমার। এক বাক্স কলম আছে। নানা রং এর কলম। আছে চকলেট, নানা রকমের মশলা, সাবান, শ্যাম্পু, লোশন। আমি মশলা আর সাবান নিয়ে আম্মার কাছে যাই। আম্মা অন্ধকারের মধ্যে নামাজ পড়ছেন। তিনি মোনাজাতে। মোনাজাতের মধ্যে কান্নাকাটি করছেন। আমি সাবান আর মশলার প্যাকেট তার চৌকির পাশে রেখে আসি।

নামাজ শেষ করে আম্মাকে বলি- তোমার জিনিস গুলো বুঝে রাখো। আম্মা কোন কথা বলেন না। এখানে কী কী জিনিস নিয়ে আসা হয়েছে এই নিয়ে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। মনে হলো নীল স্যুটকেসের জিনিস তার কাছে অর্থহীন।

রাতে খেতে বসে আম্মা তোমাকে নানা রকমের প্রশ্ন করেন।এসব প্রশ্ন হচ্ছে তোর বাবা কি হাটতে পারছে? না শুয়ে? কথা বলতে পারবে?

তুমি মহা বিরক্ত। তাঁকে যতই বোঝাতে চাও যে বাবার বুকে সামান্য টিউমার হয়েছে মাত্র সপ্তাহ খানেক পর তিনি বাড়ি আসবেন, আম্মা বোঝেন না। বলেন- কাল তাঁকে নিয়ে বিয়ানীবাজার যেতে। তিনি ফোনে বাবার সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু এই বর্ষায় মা কে নিয়ে বিয়ানীবাজার যাবে কে ?

আমাদের আগের দিনের বর্ষাকালটা তোমার মনে আছে ভাইয়া? বিকেল বেলা সাদা পানিতে থৈথৈ করতো। আচ্ছা, বর্ষার বর্ণনায় যে থৈ থৈ বলে এটা নিশ্চয়ই আমাদের বেজ গ্রামের মেয়েগুলোর কাছ থেকে। তাই না? হাসছো কেন ?

আমাদের বাড়ি থেকে মাইল দু্ই দূরের গ্রাম বেজগ্রাম। আমাদের বাড়ি গ্রামের একপাশের শেষ মাথায়। এই বাড়ি থেকে ঐ গ্রামের মাঝখানে আর কিছু নাই। বর্ষাকালে খালি পানি আর পানি। বেজগ্রামের লোকেরা আমাদের বাড়ির ঘাটে নাও বেঁধে চলে যেতো বাজারে। বাজার শেষে আবার আমাদের পুকুর পাড় থেকে নাও এর গলুইয়ের সাথে বাঁধা দড়ি খুলে দিয়ে নিয়ে যেতো। তুমি প্রায়ই তাদের নৌকা নিয়ে হাওরে চলে যেতে। আমাদের বাড়িতে যদিও তখন ঘরে ঘরে একটা করে নাও ছিলো, কিন্তু জনে জনেতো আর নাও নাই। তুমি বেজগ্রামের লোকদের নৌকা নিয়ে হাওরে চলে যেতে। মাঝে মাঝে আমাকেও নিতে। আমরা শুনতাম তৈ তৈ তৈ তৈ বলে বেজগ্রামের মেয়েরা তাদের হাঁসগুলাকে ডাকতো। শত শত নাকি হাজার হাজার হাসের পাল। কোনোটা খয়েরি কোনোটা সাদা। ওরা যখন দল বেঁধে ভেসে যেত মনে হতো যেন একটা খয়েরী রঙের দ্বীপ ভেসে ভেসে যাচ্ছে। হাঁস গুলো আবার প্রত্যেকে নিজনিজ মালিকের বাড়ি চেনে । ভোর বেলা তারা গ্রামের নানা রকম বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক সঙ্গে সারাদিন হাওরে ভাসতে ভাসতে আবার যার যার খোয়াড়ে গিয়ে হাজির হয়ে যেতো।

নৌকার মধ্যে তোমাকে দেখতাম কথা কম বলতে। তুমি আমাকে বলতে ঐ দেখ আকাশে কত দ্রুত রং বদলায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে তুমি আমাকে বাঘ দেখাতে, ভল্লুক দেখাতে, হাতি দেখাতে। আমি আকাশে মেঘের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতাম। বলতাম- কই আমিতো কিছু দেখিনা। তুমি আমাকে বলতে – গাধা। আরো বলতে- আমার মাথায় কিছু নাই। মনে আছে?

ঢাকা থেকে বাবার নীল স্যুটকেসটা নিয়ে আসার পর দেখি তুমি আর আমাকে নিয়ে যাওনা। তুমি নতুন নতুন ব্যাটারি কেনো। বাবার আনা লাল রং এর টুইনওয়ান নিয়ে তুমি একা চলে যেতে নৌকা নিয়ে। নৌকার মাঝখানে বাঁশের খাটিয়া বিছানো। সেখানে টুইন ওয়ানটা রেখে তুমি গলুই এর উপর চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে। তোমার কাছে দুইটা মাত্র ক্যাসেট। একটাকে কয়েকটা কবিতা আবৃত্তি করা আরেকটা রবীন্দ্র সঙ্গীত। মাঝে মাঝে জোরে হাওয়া এলে আমি ভয় পেয়ে যেতাম। দেখতাম তোমার নৌকাটা দুলছে। আমাদের বন্দে আগে তো আফাই হতো। আফাইয়ের সময় বড় বড় ঢেউ এসে লাগতো আমাদের একদম ঘরের বারান্দায়। গভীর রাতে মাঝে মাঝে তুফান আসতো। এ সময় আমার ভয় খুব বেশি লাগতো। একবার মনে হতো এই তুফানে বোধ হয় আমাদের ঘর পড়ে যাবে। আমাদের ঘরের উপরের দুই নারকেল গাছ ছিল। তুফানের তোড়ে নারকেলের ডালগুলো আমাদের টিনের চালের উপর আছাড়ি বিছাড়ি খেতো। আমি ভয় পেতাম। এই সময় আমাদের দাদা জোরে জোরে আজান দিতেন। নামাজ ছাড়াও যে আজান হতে পারে আমি আর কখনো কোথাও দেখিনি। ঝড়ের রাতে আমরা সবাই দাদার ঘরে চলে আসতাম। দাদা বলতেন বেশী বিপদের ইশারা পেলে আজান দিতে হয়। আজান দিলে বিপদ কেটে যায়। আমি দেখতাম আজানের কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যি তুফান থেমে যেতো।

দাদার কথা তোমার মনে আছে ভাইয়া? নিশ্চই আছে। আমি আম্মার কাছেও শুনেছি তোমার আর দাদার কত গল্প। আমাদের বাবা জাহাজে। আমাকে আর তোমাকে নিয়ে আম্মা ঘুমাতেন। ঘুম থেকে উঠেই তুমি চলে আসতে দাদার কাছে। দাদা ফজরের নামাজ পড়েই এসে বসতেন তেলাওয়াতে। আম্মা দাদার জন্য চা আর তোমার জন্য দুধ নিয়ে আসতেন। কাপের ভেতর কুকিস বিস্কুট পুরোটা ফেলে চামচ দিয়ে তুলে তুলে খেতে। দাদা মাঝে মাঝে সকাল বেলা ঈদগা বাজারে যেতেন চা খেতে। আমাদের বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে ঈদগা বাজার। দাদা হাটছেন আর তুমি দাদার ঘাড়ে। তোমার মুখে যখন বুলি ফোটা শুরু হয় দাদা তোমাকে ইংরেজী বর্ণমালা মুখস্থ করান। এবিসিডি নাকি ছিলো তোমার প্রথম শেখা বুলি। তোমার এক দেড় বছর বয়সে গ্রামের বাজারে লোকজন জড়ো হয়ে তোমার কথা শুনতো। তুমি এ থেকে জেড পযর্ন্ত তাদের শোনাতে। দাদার সব বন্ধুরা তোমাকে খুব আদর করতো, চকলেট কিনে দিতো। একটা বর্ন শেখার জন্য নাকি তুমি একটা খাতা নষ্ট করতে। আমাদের স্বরবর্ণে একটা বর্ন ছিল হ্রস্বলী। এটা তুমি নাকি লিখতেই পারতে না। যেদিন প্রথম এটা লিখতে পারলে দাদা মসজিদে তুশা সিন্নি খাওয়ালেন। দাদার কাছ থেকে তোমার ইংলিশ শেখা। গ্রামের লোক যখন তোমার নাম জিজ্ঞেস করতো সিলেটী ভাষায় তুমি ইংরেজীতে জবাব দিতে। তাকে পাল্টা প্রশ্ন করতে বলতে- হোয়াট ইজ ইয়োর নেম? এটা নিয়ে কত হাসাহাসি। তোমার সব গল্প আমার আম্মার কাছ থেকে শোনা। তুমি খুব চালাক ছিলে ছোট বেলায়। দাদার সঙ্গে ভাত খেতে বসতে। খাবার শেষে থাকতো ভাত দিয়ে দুধ আর কলা খাওয়া। আম্মা দাদার জন্য বড় কলা দিতেন আর তোমার জন্য ছোট কলা। তুমি নাকি একদিন দাদাকে প্রশ্ন করলে আচ্ছা দাদা তুমি বড় হয়ে গেছো আর আমি বড় হবো। এখন তুমি বলো, বড় কলাটা তোমার খাওয়া দরকার না আমার? তোমার এই প্রশ্ন শুনে দাদা তোমাকে বড় কলা দেবার আগে আম্মাকে ডেকে আনেন। তাকে বলে্‌ন, দেখো তোমার তিতলা পুয়া কিতা জিগাইলো। ইগু বড় অইয়া কুন্তা অইবো।

বাবার অসুখের কথা শোনার পর দাদাকে দেখতাম খুব অস্থিরতা দেখাতে। তিনি জিগির করতেন জোরে জোরে আর সেজদায় অনেকক্ষণ উপুড় হয়ে থাকতেন। তার বন্ধুত্ব ছিলো গ্রামের সকল মৌলভীদের সঙ্গে। তিনি তাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। মসজিদে জুমার নামাজের পর মিয়া সাহেবকে টাকা দিতেন। টাকা পেয়ে মিয়া সাহেবেরা লম্বা লম্বা দোয়া পড়তো। বাড়িতে এসে বলতেন – আব্দুল মজিদের বেমার বালা অইজিবো।

দাদার গল্প

দাদার কথা আমারও খুব মনে পড়ে, নুরু।

ছোটবেলা দাদার কাছেই বড় হয়েছি। বাবা জাহাজে জাহাজে থাকেন। বছর দুই বছর পর একবার আসেন। দুই চাইর মাস থেকে আবার তাকে জাহাজে চলে যেতে হয়।

জাহাজে দাদার চাকরি ছিলো আগে। বৃটিশের জাহাজ। দাদা রিটায়ার করার সময় বাবাকে ঢুকিয়ে দেন চাকরিতে । বাবা মেট্রিক পাশ করে জাহাজে চাকুরী নেন। প্রথমে বাটলার। এখন চীফ স্টুয়ার্ড। আমাদের দাদার প্রায় সারাটা জীবন কেটেছিল কলকাতায়। বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলোনা। ১৯ বছর বয়সে তিনি কলকাতা চলে যান। সেখান থেকে জাহাজে করে সারা দুনিয়া দেখা। এসব জাহাজ বেশি যেতো লন্ডনে। অনেক লোক জাহাজ থেকে লন্ডন নেমে গিয়ে আর ফেরত আসতো না। তারা পরবর্তিতে বিলাতে রেস্টুরেন্ট ব্যাবসা করে বড়লোক হয়ে যায়। দাদা লন্ডনে না নেমে কলকাতায় ফেরত আসতেন। কলকাতার খিদিরপুরে তাঁদের বাড়ি ছিল। দেশ ভাগের সময় মুসলমানরা অনেকে সবকিছু বিক্রি করে চলে আসে নিজের দেশে পুর্ব পাকিস্তানে। দাদাও আসেন।

কী কী নিয়ে এসেছিলেন জানিনা। তবে বহু পুরোনো একটা টিনের স্যুটকেস আছে দাদার এখানেই তার সকল সম্পত্তি। আমাদের দাদার স্যুটকেস আসলে স্যুট রাখার কেস ছিলোনা। ওটা টিনের তৈরি একটা বাক্স। এখানে কড়া আছে। কড়ার সাথে তালা লাগানো। দাদার এই বাক্সে থাকতো তার সমুহ সম্পদ। নগদ টাকা, জমির দলি্‌ কিছু কাগজ-কলম, তাবিজ লেখার সরঞ্জাম।

কলকাতায় তিনি নাকি কোনো এক পীরের মুরিদ ছিলেন। এই পীর তাকে শিখিয়েছেন কিছু দোয়া ও তাবিজ। দিস্তা কাগজ ভাজের পর ভাজ করে কতগুলো ছোট ছোট টুকরায় ভাগ করতেন দাদা। তারপর তার কলম বের করতেন। কলম অনেক সময় আমি বানিয়ে দিতাম। বাশ গাছের শক্ত আটি খুব ভাল করে ছিলে আগাটা কলমের নিভের মতো বানাতাম। দাদা তার টিনের বাক্স থেকে কতগুলো পুড্ডি বের করতেন। এর ভেতরে নানা রং এর পাউডারের মতো জিনিস। আম্মাকে বলা হতো পানি গরম করে নিয়ে আসতে। একটা হাতল ভাঙ্গা চায়ের পেয়ালার মধ্যে গরম পানির ভেতর কাগজের পুটলির ভেতর থেকে কালো কালো গুড়া ফেলে কাঠি দিয়ে নাড়া হতো। দাদা বলতেন কালি এভাবে বানায়। তারপর ইনজেকশনের পর ডাক্তারের ফেলে দেয়া ছোট ছোট কৌটার ভেতর সেই কালি রাখা হতো তুলার ভেতর। আর বাশের কঞ্চি দিয়ে বানানো আমার কলম দিয়ে দাদা তাবিজ লিখতেন আমারই তৈরি করা কাগজের টুকরার উপর। আমি দাদার পাশে শুয়ে শুয়ে দেখতে দেখতে একবার মনে হলো- এসব তাবিজতো আমিও লিখতে পারি।

কতগুলো ছক একে আরবী কতগুলো সংখ্যা লিখতে হয়। আমি আরবী বর্নমালা লিখতে শিখে ফেলেছি। আমার জন্য অসুবিধা হয়না। আমি দাদার জন্য অনেকগুলো তাবিজ লিখে রাখি। দাদা কলকাতা থেকে নিয়ে আসা তাবিজের বই দেখে দেখে রোগের নাম লিখে রাখেন তাবিজের উপর।

আমাদের বাড়িতে অনেক দূর দূরান্ত থেকে মানুষজন আসতো। বেশিরভাগই মহিলা এবং তারা বয়স্ক মহিলা, কোন অল্প বয়েসী তরুন তাদের সাথে থাকতো। তারা প্রথমে এসে দাদির সঙ্গে কথা বলতো। দাদির কাছে তাদের রোগের বর্ননা দিত। কেউ আসতো নিজের জন্য, কেউ অন্যের অসুখের জন্য। দাদা সব শুনে তার টিনের বাক্সের ভেতর থেকে তাবিজ বের করে দিতেন।

যারা তাবিজ নিতে আসতো তারা কেউ খালি হাতে আসতোনা। বেশিরভাগের গাটে থাকতো সুপারী। কেউ ক্ষেতের কদু বা ঘরের মুরগীও নিয়ে আসতো। নগদ টাকা কাউকে দিতে দেখিনা। এর মধ্যে আমি এমনও দেখি যে, কারো বাড়িতে কোন বাচ্চা পেটের অসুখে মাটিতে লুটোপুটি খাওয়া অবস্থায় দাদাকে এসে নিয়ে যেতে। দাদা গিয়ে পানির মধ্যে লবন দিয়ে তার উপর বিড়বিড় করে কিছু পড়ে ফু দিয়ে দিচ্ছেন। এবং আমি অবাক হয়ে দেখতাম যে কিছুক্ষনের মধ্যে সেই বাচ্চাটির কান্নাও থেমে যেতো।

সেই দাদাকে আমি দেখি এখন অনেক চুপ চাপ। আমার যখন বয়স অনেক কম, স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর দাদা হজ্ব করে আসেন। সারা গ্রামের লোকেরা ‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার’ শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল করে দাদাকে নোউকায় উঠিয়ে দেয়। এর পর আমাদের আর কিছু মনে ছিলো না। যুদ্ধের বছর বাবাও দেশে ছিলেন না। তার যাহাজ সেবছর আমেরিকায়। বাড়িতে আমার মা আর দাদী। নুরুর তখন এক বছর বয়স। দেশ স্বাধীন হবার এক বছর পর বাবা দেশে এলেন। বাব যখন বাড়ি আসতেন তখন দুইজন একটা বাঁশের মাচায় করে দুই তিনটা স্যুটকেস নিয়ে আসতেন। কখনো কখনো লেপ-তোষক-জাজিমও আসতো। অনেকগুলূ ব্যাগ বোচকা। বাবা সব মালামাল দাদার ঘরে এনে রাখতেন। বাবা খয়েরী রঙ্গের প্যান্ট পড়তেন বেশি, সঙ্গে সাদা হাফ বা ফুল শার্ট। বাবার গায়ে মিষ্টি ঘামের গন্ধ ছিলো। বিদেশি সেন্ট মাখানো কাপড় থেকে বেরুতো সেই ঘ্রাণ। বাবা বাড়ি এলে প্রথমে নুরু তার কোলে উঠে পড়তো। নুরুকে কোল থেকে নামাতে নামাতে দেখতাম, আম্মা আসতেন শরবতের গ্লাস হাতে। টেবিলের পাশে গ্লাস রেখে তিনি বাবাকে সালাম করতেন পায়ে ধরে। সালাম করেই মা চলে যেতেন রান্না ঘরে। আমরা বাবার কাছে এসে দাড়াতাম, আমাদের চোখ থাকতো বাবার স্যুটকেসের দিকে। বাবা একে একে দুইটা স্যুটকেস নিয়ে দাদার ঘরে চলে যেতেন। একটা বড় পাটি বিছানো হতো দাদার ঘরে। দাদা বসতেন চেয়ারে, পাশে দাদি। বাবা এক এক করে দুইটা স্যুটকেস খুলতেন। একটা একটা করে জিনিস বেরোচ্ছে আর একজন একজন এর মালিকানা পাচ্ছে। যে যারটা পেলো তা নিয়ে প্রদর্শনীতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। দাদার ঘরে স্যুটকেস রেখে বাবা তার জিনিসপত্র নিয়ে চলে যেতেন।

এর কয়েক বছর পর, আমার বয়স যখন ১২-১৩র মতো, তখন দেখলাম, বাবার সাহস বেড়ে গেছে। তিনি স্যুটকেস নিয়ে আর দাদার ঘরে যান না। তার ঘরেই ঘুলেন আর দাদা-দাদীর জন্য আনা জিনিসপত্র, যেমন পিতলের নকশাদার চিলিমচি, পানদানি, নকশাদার হুকা, মখমলের টুপী বা মখমলের জায়নামাজ, এসব। টের পেলাম, বাবা যখন দাদার কাছে স্যুটকেস সারেন্ডার করতেন, তখনো তিনি পুরা বাবা হননি, ছেলে রয়ে গিয়েছিলেন। আমি কিশোর হওয়ার পর থেকে তিনি পুরাপুরি বাবা হতে শুরু করেন আর তার স্যুটকেসের দখলদারিত্ব তার বাবা থেকে তার বড় বাবার কাছে চলে যায়। স্যুটকেস খোলা হতে শুরু করে তার তত্ত্বাবধানে। তিনি খুলেন, আর আমরা ভাগ বাটোয়ারা করি।

চানতারা আধুলি

তোর জন্মের ঘটনা আমার মনে আছে। আমার তখন ৫/৬ বছর বয়স। শীতকাল ছিলো। যে রাতে তোর জন্ম, ভোর হতেই দাদি আমাকে পাঠালেন নানা বাড়ি। বলেন, তোর নানীরে খবর দে।

আমি এক দৌড়ে নানার বাড়ি পৌঁছে যাই। বাড়ি থেকে কোনোকোনি দৌঁড়ে গেলে ৪/৫ মিনিটের বেশি লাগে না। বর্ষায়ও এমন। শুধু বর্ষা শেষে যখন আউশ ধান বোনা থাকে, তখন আর যাওয়া যায় না। ঘুরে যেতে হয়। আমাদের দাদার বাড়ি আর নানার বাড়িত একই পাড়ায়। নানার বাড়ি পাড়ার প্রথম বাড়ি। আর দাদার বাড়ি পাড়ার মাঝখানের বাড়ি। এক সময় গ্রামের ঠিক মাঝখানেই ছিলো। কিন্তু দাদার বাবা গোফাটের সাথে লাগোয়া বাড়ি বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তখন অনেকটা হাওড়ের উপরে ছিলো বাড়ি। এখন নাই। তো সেই বাড়ি থেকে এক দৌড়ে কোনাকোনি নানার বাড়ি গিয়ে নানীকে ঘুম থেকে উঠাই। তখন হালকা ফর্সা হয়েছে। আজান পড়েছে একটু আগে।

নানীর একটা উঁচু পালংক ছিলো। প্রায় দোতলার মতো। আমি সিঁড়ি বেয়ে এই পালংকের উপর উঠতাম। এটা একটা খুবই ফাংশনাল খাট ছিলো। চমৎকার ডোকোরেশন করা চারদিক, সিথানেও কারুকাজ। কালো রং-এর  কাঠ দিয়ে বানানো। সেই পালংকের ভেতর নানীর সমূহ সম্পত্তি। সম্পত্তির মধ্যে ছিলো চিনামাটির   কারুকাজ করা  বাসনকোশন, কাচের গ্লাস। যেগুলো বিশিষ্ট মেহমান এলে বের করে দেয়া হতো। অন্য সময় সবাই ভাত খেতো টিনের প্লেটে। মেহমান এলে এই সিন্দুকের ভেতর থেকে বের করা হতো জাহাজী ক্রোকারিজ।

আমাদের নানা আর দাদা এক সময় জাহাজে চাকরী করতেন।  একই জাহাজে। কোলকাতা থেকে ছাড়তো জাহাজ। সেই জাহাজে চড়ে তারা এক সঙ্গে পৃথিবীর কতো দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। এবং এই দেশ দেখতে দেখতে এক সময় আমার নানার বড় মেয়ে চতুর্দশ বছরে পদার্পন করলে তাঁর ইচ্ছা হয়, তার বন্ধু পুত্রের সাথে বিয়ে দেবেন। আমাদের নানা এসব বিষয়ে খুব পাকা। কোলকাতায় বসে বসে তিনি নিজের কণ্যার বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করে ফেলে ছিলেন।

এখন আর তিনি জাহাজে চাকরী করেন না। তিনি থাকেন বিলেত। লন্ডনে স্থায়ী হয়েছেন। মাসে মাসে বাড়িতে ঢাকা আসে নানীর কাছে। নানী এই টাকা লুকিয়ে রাখেন এই সিন্দুকের ভেতর। সিন্দুক কাম পালংকের ব্যবহার খুব কঠিন। প্রথমে বিছানা তুলতে হবে। তারপর বিশেষ রকমের লম্বা চাবি দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তার ডালা খুলতে হবে, অনেকটা গাড়ির পেছনের বেয়নেট খোলার মতো। তারপরও শেষ নাই। তলায় আরো দুই তিন স্তর। এসব পালংক-কাম-সিন্দুক থেকে চোর তো দূরের কথা, খুব এক্সপার্ট ডাকাত ছাড়া কেউ মালামাল নিয়ে যেতে পারবে না। চোরের বাপের ক্ষমতা নাই এখান থেকে জিনিস চুরি করতে। তবে ডাকাতের খুব এক্সপার্ট না হলে তারাও ধারণা করতে পারবে না যে এই বিছানার তলায় এমন কিছু আছে। শুধু নানার বাড়ি না আমাদের দাদাকেও দেখেছি, ঘরের চৌকির তলায় গর্ত করে সেখানে একটা কাশার কলসি রাখা থাকতো। সেই কলসির ভেতর থাকতো দাদীর গলার হার। দাদার টাকা।

আমি নানীর ঘরে ঢুকতেই তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠেন। এবং পস্তানো শুরু করেন। কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। রাতে এসে গেছেন ঘুমানোর জন্য। দেখে এসেছেন, মেয়ের শরীর সব ভালো। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতেই যে মেয়ে তাঁর নাতনীর জন্মই দিয়ে দেবে, এটা ভাবেন নি। তিনি শরীরে কাপড় পেঁচিয়েই বেরিয়ে যান বটে, কিন্তু আবার আমাকে নিয়ে ঢুকে পড়েন তাঁর কামরায়। তাঁর বিছানার তোষক উঠিয়ে, তালা খুলে ডালা উঠান। এবং একটা কারুকাজ করা চিনামাটির তরকারির বাটির ভেতর রাখা সিকি থেকে জিন্নাহর ছবিওয়ালা একটা আধুলি আমার হাতে দেন। আমার মনে হয় এর আগে আমাকে কেউ কখনো কোন পয়সা দেয়নি। এই ছিলো আমার জীবনে পাওয়া প্রথম অর্থযোগ, টাকা পয়সা উপহার হিসাবে পাওয়া। এই আধুলি দিয়ে কী কী কিনতে পাওয়া যায়, আমি তখনো ভালো করে জানি না। শুধু জানি, এটা দোকানে দিলে লজেন্স চকলেট, এসব পাওয়া যাবে। মুদরিস দাদার দোকান আছে খালের পাড়। আমি হিসাব করে ফেলি, এটা নিয়ে দিয়ে দিব তাঁকে। দেখি কী কী পাই।

নানীকে নিয়ে আমি বাড়ি আসি। তখন ধানকাটা হয়ে গেছে ক্ষেতে। ধান কাটার পর শুকনো ধানের ডালাগুলো হেলিয়ে পড়েছে মাটির উপর। তার উপর পড়েছে শীতের শিশির। আমি আরেক দৌড়ে বাড়ির কাছে এসে দেখি, নানী এখনো মাঝপথ বরাবর। তিনিও দ্রুত হাঁটছেন, কিন্তু আমার সাথে  তাঁর গতি মিলছে না বলে আমার সাথে সাথেই তাঁকে পাওয়া গেলো না। বাড়ির কাছে, মুতরা বনের ধারে এসে আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। নানী এলে, তাঁকে নিয়ে তোর কাছে যাই।

আম্মা তখন রান্নাঘরে একটা চটের উপর বিছানা করে শুয়ে। পাশের চুলা থেকে কাঠ পুড়িয়ে পুড়িয়ে ঘর গরম করা হচ্ছে। ঘরের মধ্যে ধোঁয়ায় চোখ ভিজে যায়। একটা কাপড়ের পুটলি দিয়ে তোরে বেঁধে রাখা হয়েছে । চোখ বোঝা। লাল টকটকে গাল। চুলার আগুন থেকে যে তাপ বেরুচ্ছে, সেই তাপ এনে লাগানো হচ্ছে তোর কপালে, তোর গালে।

আমার তখন পুরোপুরি সকাল হবার প্রতীক্ষায়। মুদরিস দাদার দোকান কখন খুলবে লোকাজনকে জিজ্ঞেস করতে থাকি। আমার হাফপ্যান্টের পকেটে কায়দে আজমের ছবিওয়ালা চানতারা মার্কা একটা আধুলি। আমি বারবার হাত ঢুকিয়ে দেখে নেই, পকেটে আমার সেই আধুলিটা আছে তো!

তোমার তো কলকাতা দেখার খুব শখ ছিলো, আম্মা? ছিলো না!

হ্যাঁ ছিলো তো।
আমিতো জানি কেন?
২০০২ সালের ঘটনা। আমি তখন নতুন ভিডিও ক্যামেরা কিনেছি। এই ক্যামেরা নিয়ে লন্ডন যাবো কয়েকদিন পর। নবাব আলী নামে এক পুরনো লন্ডনী আছেন, এক্রোস দ্যা সেভেন সীস এন্ড থার্টিন রিভার্স বইতে যে কতগুলো পাইওনিয়ার সিলেটির লন্ডনে অভিবাসনের গল্প বলা আছে তার মধ্যে জীবিত এখনো তিনি। তার কাহিনীতে আছে, একসময় তিনি কলকাতায় ছিলেন। খিদিরপুরে।

এই খিদিরপুরে শুনেছি আমার দাদার বাবারও দোকান ছিলো। দাদাও খিদিরপুর থেখে উঠে যেতেন। আমি খিদিরপুর দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

দাদার কোলে বসে বসে সকাল বেলা চায়ের সাথে টোস্ট বিস্কুটপ গুলিয়ে খেতে খেতে কত গল্প শুনেছি কলকাতার। দাদা তখন শুধু কলকাতার গল্পই বলতেন। তার গল্প শোনার মানুষ নাই। আমরা যারা আছি, তারা গল্প অনেকবার শুনে শুনে ক্লান্ত। উনি গল্প শুরু করলেই মাঝখান থেকে তাঁর গল্পের বাকী অংশ বলে ফেলতে পারতাম। কলকতা, গঙ্গা নদী, জাহাজ ঘাট, মাড়োয়ারী, নদীর মাঝখানে মসজিদ, পীরের মোকাম, পীরের কাহিনী, ফকিরের গল্প, সাহেবের গল্প, ইংরেজ কাপ্তানের গল্প এসব নানা কাহিনী শুনতে শুনতে ক্লান্ত। কিন্তু এই কাহিনীর জায়গাগুলো যখন আবার নিজেই দেখতে আসবো, এটা ভাবিনি। যখন এলাম, তখন আমার হাতে ক্যানন মিনি ডিভি এক্সেল আরএস ক্যামেরা। আমি ট্রাইপয়েডে বসিয়ে পুরনো দালানগুলোর ছবি তুলি।

দাদা বলতেন, যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সে বাড়িটির মাঝখানে উঠান, চারপাশে ঘর। দালান ৪ / ৫ তলা বাড়ি। আমি একম মাঝখানে উঠানওয়ালা একটা বাড়ি পেয়ে তার ছবি তুলতে শুরু করি। ভয় পেয়ে যায় লোকজন। মনে করে মিউনিসিপলিটি থেকে এসেছি। এরা ভয়ে ভয়ে এসে আমাকে ছবি তোলার কারণ জিজ্ঞাসা করে। আমি আসল কারণের কথা বলার চেষ্টা করি না। বুঝাতে পারবো না। বলি, আমি স্থাপত্যের ছাত্র। সামনে কলোনিয়াল হাউজিং নিয়ে আমার একটা সেমিনার আছে। তার জন্য কতগুলো রেন্ডম স্যাম্পলিং করে বাড়ির ছবি তুলছি।

লোকেরা কী বুঝলো, কী না। তারা আমাকে আর খুব ঘাটালো না।

আমি নবাব আলীর কলকাতাবাসের ছবি ধারণ করি, আর আমার দাদার কথা মনে করি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আম্মাকে যখন কলকাতা দেখাতে নিয়ে আসি, বলি, আম্মা কী কী দেখতে চাও। মনে আছে, আম্মা?

আছে।

বলোতো কী বলেছিলে আমাকে প্রথম?

বলেছিলাম, কীবা মাছর কী বা টেফ, তাইন দিতা নি কইলকাত্যার খেফ

আগে মানুষজন কলকাতা নিয়ে এমন ভাবতো। কলকাতা আসা ওতো সহজ বিষয় ছিলো না। কিন্তু একমাত্র কলকাতাই ছিলো আমার বাপ দাদাদের বিদেশ। তোমাদের বাপদাদার আমল থেকে লন্ডন-আমেরিকা শুরু হয়েছে, আমরা বিদেশ বলতে তখন কলকাতাকেই বুঝতাম।

আম্মা বলেন, আগে মানুষজন কাউকে বড় কোন ধমক দেবার সময় বলতো, ‘থাবড়া মারি হাবড়ার ফুল দেখাই দিমু’।

ঊাহ! থাপ্পড় মেরে হাওড়া সেতু দেখাবে। থাপ্পড়ের সিলেটী প্রতিভাষা হাবড়া, এর সাথে ছন্দ মিলে হাবড়া, মানে হাওড়া ব্রিজ।

আমরা হওড়া ব্রিজ পার হতে হতে এসব কথা শুনি।

কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের বাড়ি দেখা হলো, কলকাতা যাদুঘরে মমি দেখানো হলো। আম্মাকে বলি, আর কী দেখবা আম্মা।

আম্মা বলেন, জাকারিয়া স্টিট আর নাখোদা মসজিদ।

আমি বলি, কেন? ওটা তো কলকাতায় মুসলিমদের এলাকা।

আম্মা বলেন, এখানে তোর নানা থাকতেন।

আমি আম্মাকে নিয়ে গাড়িতে বসেই নাখোদা মসজিদ দেখাই। আম্মা বলেন এই মসজিদে তোর নানা নামাজ পড়তেন।

আমি বলি- এই সড়কটিই জাকারিয়া স্ট্রিট।

আম্মা বলেন, তোর নানা এখানে থাকতেন।

আমি বলি, ঠিকানা জানলে বলো, সেই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাজির হয়ে যাবো।

আম্মা হাসেন। ৫০-৬০ বছর আগের কাহিনী। শুধু জায়গার নাম মনে আছে, আর কিছু না।

আমাদেরকে নিয়ে আমি কলকাতার ভিক্টোরিয়ার সামনে এসে দাঁড়াই। ছবি তুলি।

রাণী ভিক্টোরিয়ার গল্প আম্মা জানেন। তিনি তাঁর পিতা এবং শ্বশুড়ের কাছে শুনেছেন।

আমাকে বলেন, এখানে রেস খেলার জায়াগা কোথায়? তোর দাদা রেসের ঘোড়ার কাছে সব দিয়ে খালি হাতে দেশে ফেরত গিয়েছিলেন।

আমি দাদার কাছে রেসের ঘোড়ার অনেক মজার মজার গল্প শুনেছিলাম। একেকটা ঘোড়ার একেক নাম আছে। প্রত্যেকটা ঘোড়ার  স্ট্যাটিসটিক্স তার মুখস্ত ছিলো। কোন ঘোড়ার নানী কে, এটাও তিনি জানতেন। নানা রকমের হিসাব নিকাশ করে ঘোড়ার পেছনে বাজি ধরা হতো। কিন্তু ঘোড়ারাও নাকি জানতো যে, আজ সে জিতবে না হারবে। সেই হিসাবে বাজিগরদের পকেট ফুটা করা হতো। আমার দাদাও ফুটো হতে হতে সব বিক্রি করে খালি হাতে দেশে চলে যান, যাবার আগে বাবাকে তাঁর জাহাজের চাকরী দিয়ে যান। বৃটিশ মালবাহী জাহাজের খাদ্য বিভাগের কর্তা হিসাবে বাবার চাকরী হয়ে যায় আর তার পরের বছরই মার সাথে বাবার বিয়ে।

কলকাতার ময়দানে আম্মাকে নিয়ে ঘোড়ার আড়তে চলে যাই। আম্মা কী সুন্দর সুন্দর নাম বলেন- একেকটা ঘোড়ার।

আমি বলি, তুমি জানো কেমনে?

তোর দাদার কাছ থেকে এসবের গল্প শুনেছি। শুনতে শুনতে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে।

আমি আম্মাকে বেলপুরি খাওয়াই, মাসালা শরবত খাওয়াই। আম্মা বলেন, তোর সাথে ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো যেন আমার বাবার সাথে ঘুরছি। বাবাজানের সাথে যখন বাজারে যেতাম, যাওয়ার সময় পথে পথে থামিয়ে দোকান থেকে নানা জিনিস কিনে খাওয়াতেন। তুমি এখন আমার বাবা।

আমি বলি, কলকাতায় অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে। আর কী দেখতে চাও।

আম্মা বলেন, আমি একটু জাহাজ ঘাটটা দেখতে চাই। যেখান থেকে জাহাজ ছাড়ে।

ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাই গঙ্গার ওপারে। সেখানে একটা জায়গা থেকে খুব সুন্দর হুগলি বন্দর দেখা যায়। আরো মজার বিষয়, সেখানে এমন একটা লোহার ব্রিজ আছে, যা জাহাজ চলাচলের সময় খুলে যায়। আমাদের খুবই কপাল ভালো, কিছুক্ষণ আগেই একটা মালবাহী জাহাজ নোঙর খুলে  বেরিয়ে গেলো। তার জন্য খুলে দেয়া হলো ব্রিজের মাঝখানটি। সে চলে যাবার পর, আবার জোড়া লেগে গেলো।

এবার চালু হয়ে গেছে পথ। আমাদের ফেরার পালা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আম্মা গালে হাত দিয়ে বসে আছেন একটা বেঞ্চির উপর।

আমি বলি, কী আম্মা মন খারাপ কেন?

তিনি বলেন, না , কিছু হয় নাই।

বুঝলাম কিছু হয়েছে। এটা তিনি এখন বলবেন না, বলবেন খানিক পরে।

খুব একটা খানিকপর হয় নাই। আগেই বলে বসলেন- তোর বাবাও এরকম এই জায়গা থেকে জাহাজে করে চলে যেতেন। তিনি বলেছেন, এসম প্রচুর বন্ধুবান্ধব, স্বজনেরা বিদায় দিতে আসতো। দেখতে আসতো জাহাজ কিভাবে যাচ্ছে। যতক্ষণ জাহাজ দেখা যেতো, ততক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকতো লোকেরা। কারণ, এই জাহাজ ইন্ডিয়া পার হয়েই মহাসমুদ্রে গিয়ে পড়বে। কত জাহাজ নিখোঁজ হয়, কত জাহাজ ঝড়ের কবলে মারা যায়। আর মানুষজন যারা মারা যায় নানা অসুখ বিসুখে, তাদেরকে জাহাজের ডেকে জানাজা পড়িয়ে বস্তাবন্দি করে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়।

শবনমের মেয়ে নুসরাত ছিলো পাশে। সে বলে, নানু এই লাশগুলো কি হাঙ্গরের পেটে চলে যেতো!

নানু এসবের জবাব দেন না। তিনি চলে যাওয়া জাহাজটির দিকেই চেয়ে থাকেন।

জাহাজ

সমুদ্র দেখে বিহবল হয়েছিলেন আম্মা একবার। সেও এই ২০১৪ সালে, যখন ফৌজদাহাট ক্যাডেট কলেজে আমাকে একটা রিসেপশন দেয়া হয়েছিল। পরদিন আম্মাকে নিয়ে আসা হলো ক্যাডেট কলেজে। সাথে শবনমের পরিবার আর স্বপন।

কলেজ ঘুরে দেখা শেষ করে আমরা গেলাম পতেঙ্গার কাছে, সমুদ্র দেখতে। সেখানে একটা বিশেষ বীচে আমাদের সমুদ্র দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

এই প্রথম আম্মার সমুদ্র দেখা। দেখি, হা হয়ে তাকিয়ে আছেন দূরের একটা জাহাজের দিকে।

আমি বলি, কী দেখ আম্মা, সমুদ্র? ঢেউ? সানসেট?

আম্মা বলেন, ঐ দূরের কতগুলো জাহাজ দঁড়ানো আছে। তোর বাপ বলতেন, তাঁদের জাহাজগুলো সমুদ্রের অনেক গভীরে থাকতো। সেখান থেকে ছোট ছোট ইঞ্জিনবোট দিয়ে তাদের নিয়ে আসা হতো তীরে। দেখলাম, তোর বাপ যে জাহাজগুলোতে থাকতো, এইগুলাই সেই জাহাজ।

আর এই জাহাজ থেকে ফেরা সময়ই স্যুটকেস ভরে ভরে তোদের জন্য জিনিসপত্র নিয়ে আসতেন।

শবনম এসময় কাব্য করার চেষ্টা করে। বলে-ইশ, এখন যদি এরকম একটা জাহাজ থেকে নৌকা বেয়ে বাবা চলে আসতেন এখানে? আমি দেখতাম বাবা কেমন হয়! সবাই বলে- বাবা, বাবা, আমি তো জানি না, বাবা কেমন হয়!আমার তো বাবার কোন চেহারা মনে নাই।

আমরা আরো কিছুক্ষণ পতেঙ্গায় থাকি সূর্য ডুবে যাবার পরও কিছুক্ষণ আলো থাকে। সেই আলোয় জাহাজগুলো দেখা যায়। সেখান বাতি জ্বলে ওঠে, সেই বাতি ধীরে ধীরে নিকষ কালো আকাশের কিনারা বরাবর টিপটিপ করে জ্বলতে থাকে।

ক্যাডেট কলেজে বাবা

আচ্ছা, বাবা কিন্তু তোমাকে দেখতে তোমার ক্যাডেট কলেজে গিয়েছিলেন। তোমার সাথে দেখা হয় নি। মনে আছে?

আছে। প্রথমদিন বাবা আমাকে নিয়েই কলেজে গিয়েছিলেন, সেই ২৫ জুন ১৯৭৮। এরপর মাত্র দুই তিনবার বাবা গিয়েছিলেন প্যান্টেস ডে তে। প্রথমবার গিয়েছিলেন বড় মামাকে সাথে নিয়ে  ১৯৭৯ সালে। মামা তখন লন্ডন থেকে এসেছেন। তাঁর হাতে একটা ক্যামেরাও ছিলো। তিনি কয়েকটা ছবি তুলেছিলেন আমার। কিন্তু সেই ছবিগুলো কখনো পাইনি। পরে বড় মামাকে জিগ্যেস করেছিলাম- বহুবার। মামা বলেন, রিল জ্বলি গেছে।

ক্যামেরার ফিল্ম কী করে জ্বলে যায় আমি আজও বুঝতে পারি নাই। সেদিনের ছবি তোলা থাকলে এটা হতো আমার জীবনের প্রথম কোনো রঙিন ছবি। ছবি না পাওয়ার দু:খ থাকা বাবার মলিন মুখের কথা মনে পড়ে। বারবার বলেছিলেন- কেনো যে কিছু ফল-ফুরুট নিয়ে এলাম না কেন। বারবার ফলের দোকান খুঁজলেন।

আমাদের কলেজের প্যারেন্টস ডে তে সবাই খাবার নিয়ে আসতো। যাদের প্যারেন্টস আসতো না, তারা খাবার ভাগ দিতো। খাবার মানে কিছু ফল, কিছু পিঠা, সন্দেশ, এই আর কী। কেউ কেউ গাড়িতে বসে খেতো, কেউ কেউ বেঞ্চিতে বসে।

বাবা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন যে, ক্যাডেটরা বাবা-মা’র পাশে বসে খাচ্ছে। তিনি বলছেন- ইশ, তোর জন্য কিছু নিয়ে এলাম না।

আমি বলি, টাকা দিলে ক্যান্টিন থেকে কোক ফান্টা কিনতে পাওয়া যায়।

তিনি হাউজ মাস্টারকে খুঁজেন।

আমাদের হাউজ মাস্টা বাচ্চি খান। তিনি আমাকে একদিন বলেন, তোমার বাবা কিছু টাকা দিয়ে গেছেন আমার কাছে, তোমার বিশেষ কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে বলিও।

এই হাউজ মাস্টার এক বিচিত্র চরিত্রের মানুষ ছিলেন।

আরেকদিন আমাকে বলেন, তোমার আব্বু আমার কাছে ৩শ টাকা দিয়ে গেছেন। আমি সেখান থেকে ১শ টাকা খরচ করেছি আমার প্রয়োজনে। আমি পরে আবার ১শ টাকা দিয়ে দিব।

আমি বুঝি না। কাকে দিবেন? টাকা তো তাঁর কাছেই থাকবে।

তিনি খোলাশা করেন। তোমার বাবার রাখা টাকা আমার কাছে আমানত হিসাবে আছে। তাঁর মতামত ছাড়া আমি এখান থেকে টাকা সরাতে পারি না। তাঁকে যখন পাচ্ছি না তোমাকে শুধু জানিয়ে রাখলাম।

আমি চুপ করে থাকি।

বুঝলাম ৩শ টাকা হাউজ মাস্টারের কাছে আছে। আমাদের মাসের কুপন দেয়া হয় ২০ টাকা। ২০ টাকার কুপন নানা রঙের পাতার সমাহার। হলুদ, লাল, নীল, সাদা। কোনটি পঁচিশ পয়সা, কোনটি পঞ্চাশ পয়সা, কোনটি এক টাকা, কোনটি দুই টাকা- এরকম। আামি প্রথমে জ্যামিতি বক্স আর ওয়ারটার কালার বক্স কেনার টাকা চাই স্যারের কাছে। স্যার টাকা দেন না। বলেন, ক্যান্টিন থেকে জিনিস নিয়ে নিতে। তিনি ক্যান্টিনে বলে রাখবেন।

আমি জ্যামিতি বক্স কিনি না। ফান্টা, কোন আর রম্বস বিস্কুট কিনি। খেয়ে দেয়ে কুপন দেই না। বলি মিস্টার বাচ্চি খান স্যার….। ক্যান্টিনের ম্যানেজার খাতায় কী সব টুকে রাখেন। আমার দিন চলে যায়।

বাবা আরেকবার এসেছিলেন আমাদের কোন এক অনুষ্ঠানে। সেবার আমাদের প্যারেড ছিলো। এই প্রথম বাবা আমাকে দেখেন খাকী পোশাকে। এর আগে প্যারেন্টস ডে তে আমাদের পোশাক হতো- ইভিনিং ড্রেস। সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট, কালো জুতা মোজা আর কলেজ টাই।

আমাদের যখন কুইক মার্চ দিয়ে ডায়াসের বাইরে চলে আসি। আমি আড় চোখে দেখি বাবাকে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। সাথে কাশেম ভাই। কিন্তু বাবার চোখ আমার দিকে নয়। তিনি বারবার চোখ ঘুরাচ্ছেন। আসলে এই তিনশো ক্যাডেটের মধ্যে আমার অবস্থান কোন জায়গায়, কখন আমি প্যারেড করে তাঁর সামনে এসে পড়বো এটা তাঁর জানা নাই। সুতরাং তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হতে হয়েছে।

প্যারেড শেষে বাবা বলেছিলেন, আমাকে তিনি দেখেছেন। আমি জিগ্যেস করলাম- আমি কোন সারিতে ছিলাম?

বাবার উত্তর সঠিক ছিলো।

বাবা শেষবার কলেজে এসেছিলেন আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার কিছুদিন আগে। জাহাজে চলে যাবেন। তার চিঠি এসেছে।  দেখা করতে এলেন প্রিন্সিপালের কাছে। সেটা প্যারেন্টস ডে ছিলো না। প্যারেন্টস ডে ছাড়া ক্যাডেটদের দেখা করার নিয়ম নাই, কিন্তু বিশেষ কারণে বাবা মা দেখা করতে পারেন। ক্যাডেটদের ডেকে অফিস রুমে নেয়া হয়। সেখানে ওয়েটিং রুমে বসে বাবা মার সাথে কথা বলা যায়। অনেকটা জেলখানার মতো।

কিন্তু সেবার যে দেখা হয়নি, এটা আমি জেনেছিলাম আমার এক হাউজ টিউটর মিস্টার মান্নানের কাছ থেকে। বাবা যখন প্রিন্সিপালের রুমে, মিস্টার মান্নান এলেন আমাদের ক্লাস রুমে। তখন আফটার নুন প্রেপ চলছে।মিস্টার মান্নান আমার কাছে এস দাঁড়ালেন, কী কী সব যেন জিজ্ঞাসা করলেন। আমি সব কথার জবাব দিলাম। তারপর তিনি চলে গেলেন। বাবা পরে মাকে বলেছিলেন প্রিন্সিপাল বলেছেন – আপনার ছেলে ভালো আছে। সামনে তার এইচএসসি পরীক্ষা। আপনি বিদেশ চলে যাচ্ছেন এটা শুনলে তার মন খারাপ হবে। পড়ায় মন দিতে পারবে না। আপনার ছেলে খুব ভালো আছে, রেজাল্ট ভালো, স্পোর্টস-এ ভালো। আপনি বরং চলে যান।

বাবা চলে এসেছিলেন, আমার সাথে দেখা হয় নাই।

যখন দেখা হলো, তখন তিনি ঢাকায়। আমি ক্যাডেট কলেজ শেষ করে বেরিয়ে এসেছি। ঢাকায় ছিলাম। ঢাকা থেকে ফেরত গেলাম বাড়ি। আর সে সময় মতছিন দাদার লেখা চিঠি গেলো চাচার কাছে। আমি সেই চিঠি পকেটে নিয়ে চলে আসি ঢাকায়। বিমানে আসি। সে আমার প্রথম বিমান চড়া। কত আনন্দ, কত রোমাঞ্চ, কত চিন্তা!

বাবার রেডিও

আচ্ছ ভাইয়া, বাবা যেভাবে তোমার পড়ার খবর নিতেন, তুমি কি তোমার ছেলেদের সে রকম কর?

না।

আমি পারি না। আমাদের সময় বাবাকে আমরা খুব ভয় পেতাম। আমার ছেলেরা আমাকে ভয় পায় না। বাবার সাথে তর্ক করা দূরে থাক, বাবার কথার বিপরীতে কোন কাজ করবো, এমন সাহস ছিলো না।

আমার মনে আছে, আমি যে বছর ক্যাডেট কলেজে যাই, তার আগের বছর আমাদের বাড়িতে প্রথম রেডিও আসে। বাবাই নিয়ে এসেছিলেন। একটা চামড়ার জ্যাকেটের মধ্যে ভরা, ইটের আকারের একটা রেডিও। ন্যাশনাল প্যানাসনিক। এটা বাবার ঘরে থাকতো। ব্যাটারী দিয়ে চলতো। ব্যাটারী পুরনো হয়ে গেলে শব্দ কমে আসতো। আবার নতুন ব্যাটারী দিলে জোরে আওয়াজ হতো।

বাবা বাড়ির বাইরে গেলে এই রেডিও মাঝে মাঝে আমি আমার ঘরে নিয়ে আসতাম। কিন্তু বাবাকে দূর থেকে দেখা মাত্র আবার রেডিওটা বাবার ঘরের টেবিলের উপর রেখে আসতাম। আমি বেশি শুনতাম অনুরোধের আসর ‘চাওয়া পাওয়া’ আর সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান-‘দূর্বার’।  মাঝে মাঝে আমি রেডিওতে চিঠি লিখতাম অনুরোধ করে। এবং অপেক্ষা করতাম আমার অনুরোধের এই গানটি রেডিওতে বাজে কী-না তার জন্য। কখনো কখনো আমার নিজের কানে আমার নাম উচ্চারিত হতে শুনেছি। এই খবর আমার কাছে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে বাবার কাছে চলে যায়। বাবা আমাকে ডাকেন। আমিতো খুব ভয় পেয়ে যাই।

রেডিওতে চিঠি আমি নিজে লিখেছি কী-না এটা জানতে চান।

আমি সত্য কথা বলি।

এবার আমার সামনে খাতা-কলম দিয়ে বলেন, আব্দুল আলীমের গাওয়া ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি নাইওরী গাও তোল’ এই গানটার জন্য যেন আমি এখনই চিঠি লিখি।

আমি অল্প কয়েক লাইন লেখার পর বাবা আমার কাছ থেকে খাতা কেড়ে নেন।

বলেন, আগে উপরে লিখ  তারিখ। পরে লিখ অনুষ্ঠান প্রযোজক, অমুক অনুষ্ঠান। এরপর লিখ- বিষয় ‘পছন্দের গানের জন্য অনুরোধ’। তারপর আরো অনেক কিছু লিখার পর নিজের পুরো নাম ঠিকানা। মোটামুটি পত্র লিখনের পাঠ আমার হয়ে যায় এখান থেকে। অথচ এর আগে, তেমন কিছু না লিখে খামের মধ্যে গানের নাম আর নিজের নাম লিখে আমি যখন পাঠিয়েছিলাম আমার অনুরোধের গান প্রচারে কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যা বাবার কাছে।

বাবাকে চিঠি লিখে প্রথম ধরা খাই, আমি যখন ক্লাস ফাইভে। সে সময় দাদার কাছে বাবা চিঠি লিখতেন, আমি তখন ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করি। হাতের লেখার জন্য প্রশংসা পাই। দাদা চাইলেন, আমি যেন বাবার কাছে নিজ হাতে চিঠি লিখি। দাদা ডিকটেট করেন, আমি একের পর এক লিখে চিঠি লেখা শেষ করি। ইতি, আপনার স্নেহের পুত্র – হেলন।

দাদাকে চিঠি পড়ে শুনাই। দাদা খুব প্রশংসা করেন। আমি চিঠির শেষে একটু পন্ডিতি করি। পুত্র শব্দটা বদলাই । লিখি- ‘ইতি, আপনারই দৌহিত্র, হেলন।’

‘দৌহিত্র’ লেখার একটা কারণ আছে। সে সময় ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে আমার চাচাতো ভাইদের ব্যবসা দিয়ে বসেন বাবা, শ্রীমঙ্গলে। চাচাতো বড় ভাই কাশেম, তিনি প্রায়ই দাদার কাছে চিঠি লিখতেন। খুব সুন্দর ছিলো তাঁর চিঠির ভাষা। চিঠির শেষে লেখা থাকতো, ইতি আপনারই দৌহিত্র কাশেম। এই চিঠিও আমার পড়া হতো। আমি সেই চিঠি সামনে রেখে অনেক বানান সেটার মতো লিখেছি। ‘দৌহিত্র’ শব্দটার প্রতি আমার টান জমে যায়। আমিও বাবাকে লিখি, ইতি আপনার দৌহিত্র। বাবা দেশে ফেরত এলে সব চিঠিও নিয়ে আসতেন। একদিন মাকে দেখান এই চিঠি। দেখো- কী লিখেছে?

আমার মা আমাকে ডেকে বলেন দৌহিত্র মানে নাতি। যেমন, আমাদের নবী করীম (সা:) এর দৌহিত্র ছিলো হাসান আর হোসেন।

আমি শিখলাম।

তবে চিঠি লেখা নিয়ে আমার আরেক শিক্ষা কথা ভুলতে পারি না।

আমি তখন ক্যাডেট কলেজে। চিঠি লিখি আম্মাকে, দাদাকে। বাড়ি থেকে যাবার সময় আমাকে অনেকগুলো ডাক টিকেট লাগানো খাম দিয়ে দেয়া হতো। আমার কাছে নির্দেশ ছিলো যে সপ্তাহের প্রথম দিনি আমি যেন একট চিঠি লিখি। যে কোনো কিছু লিখে দিলেই হবে। সময় না পেলে, ‘আমি ভালো আছি’ শুধু এটুকু লিখে ডাক বাক্সে যেন ফেলি। আমি প্রতি সোমবার একটি করে চিঠি দেই আম্মার কাছে। আম্মার জবাবের জন্য আমার অপেক্ষা করতে হয় না। পরের সোমবার এলেই আমি আবার ডাক বাক্সে আমার খাম ছাড়ি। একবার দাদা লিখলেন, আমি যেন বাবার কাছে ইংরেজিতে চিঠি লিখি।

বিশাল কঠিন কাজ। ‘আপনি আমার সালাম নিবেন’ এর ইংরেজি কী লিখবো বুঝতে পারি না। আমি কী লিখেছিলাম মনে নাই। মাস খানেক পরে সেই চিঠি ফেরত এলো আমার কাছে। দেখে মনে হলো পরীক্ষার খাতার এক পাতা ফেরত এসেছে আমার কাছে। প্রায় প্রত্যেক লাইনে লাইনে অনেকগুলো লাল গোল্লা দেয়া। আমাকে বলা হলো-এগুলো সংশোধন করে যেন আবার এই চিঠি তাঁকে লিখে পাঠাই।

এরপর বাবাকে আর কখনো ইংরেজিতে চিঠি আমি লিখি নি।

রেডিওতে চিঠি লেখার ফলাফল ভালো। আমার জন্য রেডিও শোনার একটা বিশেষ সময় বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। তাহলো দুপুর দুইটা ও বিকাল ৫টার খবর এবং সংবাদ পার্যালোচনা। কারণ সামনে আমার ক্যাডেট কলেজের মৌখিক পরীক্ষা। সেখানে আমাকে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে হবে। আমি তো কারো কাছ থেকে শুদ্ধ বাংলায় কথা শুনিনি। স্কুলে আমাদের স্যাররাও শুদ্ধ বাংলা বলতে পারবে না। এমনকি যে শিক্ষক সিলেটের নন, নোয়াখালির, তিনিও বলতেন নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায়। প্রমিত বাংলার সাথে পরিচয় করানোর জন্য আমি রেডিও শুনা শুরু করি অফিসিয়ালি। আর সেটা ছিলো খবর। এতে ‘কারেন্ট এফেয়ার্স জানা হবে আর বাংলা ভাষা শেখা হবে।

বাবা জাহাজে চলে গেলে আমি প্রথম যে জিনিসটার একক মালিকানা নিয়ে আত্মতৃপ্তীতে ভুগতাম, তাহলো আমাদের সেই ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিও।

কিন্তু মেট্রিক পরীক্ষায় কয়েকমাস আগে বাবা বাড়ি এসে আমাকে অন্যরূপ দেখান। কলেজ থেকে বাড়ি এসেছি। ছুটিতে আছি । আরামে খাই দাই, ঘুরিয়া বেড়াই আর রেডিওর গান শুনি। একদিন তিনি আমাকে কাগজ কলম নিয়ে তার ঘরে যেতে বলেন।

আমি দাঁড়িয়ে থাকি। তিনি বলেন – লিখ।

বুঝলাম- ডিকটেশনের ক্লাস হবে এখন। তিনি যা যা বলবেন, আমি তা তা লিখবো।

লেখা শুরু হলো –

এক- ফজরের আজানের সাথে সাথে ঘুম হইতে উঠিব

– এক এক করে রাতে এশার নামাজ পড়ে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত সারা দিনের রুটিন আমাকে লিখতে হলো। এর মধ্যে কখন বাংলা, কখন অংক, কখন বিজ্ঞান, কখন ইসলাম শিক্ষা পড়তে হবে আর কোন সময় কোন সাবজেক্ট রিভাইজ দিতে হবে তার বর্ণনা আছে। আছে আছরের নামাজ থেকে মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত সময় ফুটবল খেলাও। সবকিছু লেখার পর বললেন- এবার লিখ- ‘রেডিও শুনিব না।’

তুমি কি রেডিও শুনতে তারপর?

বাবার সামনে না। বাড়িতে না থাকলে শুনতাম।

দাদির কাহিনী

আমি তখন অনেক বড়। হাই ইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। এই সময় একদিন শুনি আমাদের এই দাদী আসল দাদী না। তিনি হাতন দাদি।

আমাদের অরিজিনাল যে দাদি ছিলেন, আমার বাবার জন্মদাত্রী, তিনি মারা যাবার পর দাদা এই দাদীকে বিয়ে করেন। আমাদের বাড়ি থেকে সোজা পশ্চিম দিকে তাকালে হাওড় বাওড় বিল-ঝিল পার হয়ে আরেকটা গ্রাম দেখা যায়। কুশিয়ারা নদীর পাড় দিয়ে এই গামগুলো। এই গ্রামগুলোর আড়ালে সূর্য ডুবতো। আমি খুব ছোটবেলা মনে করতাম এই গ্রামের পেছনে দুনিয়ার আর কিছু নাই। এটা আমাদের থানায়ও পড়ে না। গোলাপগঞ্জের মধ্যে পড়েছে। এই গ্রামের অনেক লোক লন্ডনী। আমার দাদীর পরিবারেও অনেক লন্ডনী আছেন। এক সময় বৃটিশে জাহাজগুলো এই গ্রামের পাশ দিয়ে যেতো। অনেক লোক এইসব জাহাজে উঠে পড়তো। জাহাজ যেতো কলিকাত্তা। কলিকাত্তা থেকে লন্ডন। অনেকে জাহাজ থেকে লন্ডন চলে যায়। আমার এই দাদীর আগে যে বিয়ে হয়েছিলো তাঁর সেই স্বামীও লন্ডন চলে গেছে। কিভাবে গেলেন তা তাঁর মনে নাই।

নতুন বিয়ে হয়েছে, তাঁর যখনো স্ত্রীজ্ঞান হয় নাই। অর্থাৎ তিনি তখনো নাবালিকা। রাতে ঘুমান শ্বাশুড়ির সাথে। হয়তো বয়স তাঁর তখন নয়-দশ হবে এমন। বিয়ের পর দুই বৎসর হয়েছে, এমন এক দিন তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান এক কাপড়ে। হাতে একটা চটের ঝোলা। বাড়ির পাশে খেয়া পার হতে দেখেছে তাঁকে গ্রামের কেউ। কেউ জিজ্ঞাসা করেছিলো- ভাই, তুমি খই যাও।

তিনি জবাব দিয়েছিলেন, – আমার বউ লাগি শাড়ি কিনাত যাইয়ার বা ঢাকা দক্ষিন বাজারো।

এরপর আর তাঁর কোন দেখা নাই, খবর নাই।

অনুমান করি, এই ঘটনা যখন ঘটে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে। চল্লিশে দশকের মাঝামাঝি সময়। ইংল্যান্ডে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। ভারতীয় শ্রমিকেরা ইংরেজদের কাছে খুব প্রিয়। এঁরা দরিদ্র এবং প্রভুভক্ত। তাই এঁদের কদর বেশি। নদীর ঘাটে জাহাজ ভিড়লে কিশোর-তরুনদের তারা ডেকে জাহাজে নিয়ে নিতো। বয়-এর কাজ করানোর মতো ইংরেজ কিশোর তাঁদের কাছে নাই। তাই এই অঞ্চলের মানুষ তাঁদের পছন্দ।

দাদির কাছে তাঁর সেই স্বামীর অনেক গল শুনেছি। যতবার তিনি শুরু করতেন গল্প কখনো শেষ হতো না। এক গল্প করতে করতে আরেক গল্প শুরু হয়ে যেতো। একটানা ১৪ বছর তিনি অপেক্ষা করেছেন তাঁর স্বামীর জন্য। স্বামীর খোঁজ পাওয়া যায় নি।

বাড়ির ছাড়ার দুই বছর পরে তারা খবর পান যে তিনি বেঁচে আছেন এবং লন্ডনে আছেন।

লন্ডনের সাথে যোগাযোগের কোন বন্দোবস্ত নাই। কেউ কেউ লন্ডন থেকে চিঠি লিখে।  কিন্তু তাঁর বাড়িতে কোন চিঠি আসে না। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন লন্ডন গিয়েছেন তাঁদের গ্রামের। এঁদের কেউ হয়তো ৩/৪ বছর পর একবার বাড়ি আসেন, তাঁর কাছে খোঁজ নিতে যান । খোঁজ যেটা পাওয়া গেলো তা খুব সুখকর না। তিনি বাঙ্গালীদের সাথে খুব একটা মিশেন না। থাকেন লন্ডনের বাইরে লিভারপুলে। একজন জানিয়েছে, তাঁর মা কে দেখার জন্য তিনি আসবেন। বৌকেও লন্ডন নিয়ে যাবেন।

এই খবর পেয়ে দাদী অ তাঁর শ্বাশুড়ি প্রতিদিন অপেক্ষা করতে থাকেন। তাঁরা পীরের কাছে যান। পীরের কাছে যাবার সময় ঘরের মুরগি, কদু নিয়া যান। পীর সাহেব আসমানের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে একটা তারার দিকে আনগুল নির্দেশ করে বলেন, আইব, আইব

খুশিতে চন্মনে হয়ে যান তাঁরা। আসবেন তিনি ?

কনে পীর সাব।

আমাবইশ্যার রাইত।

এরপর থেকে তাঁদের প্রতীক্ষা থাকতো, কবে অমাবশ্যা আসবে। প্রথম অমাবশ্যার সন্ধ্যায় হাড়িতে অতিরিক্ত চাল দিতে বলেন শ্ব্বাশুড়ি। তিনি নিশ্চিত আজ আসবেন।

রাতে ভাত রান্না হলো, মুরগী জবাই হলো। ভোর রাত পর্যন্ত এই দুই নারী কুপি জ্বালিয়ে ঘরের মধ্যে থাকেন। গাছের নাড়াচাড়ায় বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে, এই মনে করে যে এখন বুঝি তাঁর স্বামী এলো।  তিনি এলেন না ।

পরদিন থেকে অপেক্ষা আর জোরদার হলো। দুইজন মিলে কতোগুলো চাল একটা ডালার উপর নিয়ে বাছতে শুরু করেন। একবার এক চাল শ্বাশুড়ি, আরেক চাল তিনি নিজে। এটা এক ধরনের গূনাগুনি খেলা। একটা একটা করে চাল বাছের পর যদি চালে ‘আগ দে’ মানে বিজোড় হয়, তখন ফলাফল হবে কাংখিত, মানে আসবে। আর শেষ চালটি যদি আগ না দেয়, দুই জনের সমান সমান হয়ে যায় তাঁর মানে, ফল ভালো না।

এই খেলা তাঁরা দিনের পর দিন খেলতে থাকেন। একবার আগ দে তো পরের বার দেয় না। এক সাথে সব বার আগ হয় না তাঁদের।

এ ভাবে ১৪ বছর কাটোলো দাদীর সধবার জীবন। এক সময় খবর পাওয়া গেলো তাঁর স্বামী এক বৃটিশ কালো মহিলাকে বিয়ে করে তাঁর সাথে সংসার করছে এবং তাঁদের একটা মেয়ে সন্তানও হয়েছে। এবং ঘরবাড়, দেশ নিয়ে তিনি কোন কথা বলতে চান না। তখন তাঁর শ্বাশুড়ি তাঁর জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করেন। বিয়ে হয় আমার দাদার সাথে।

আমাদের দাদা ছিলেন জাহাজী। কলকাতায় ছিলো দাদার আস্তানা। কিন্তু দেশভাগের সময় কলকাতার সবকিছু বিক্রি করে দেন। জাহাজে করে তিনি অনেক দেশে গিয়েছেন। লন্ডনেও বহুবার গিয়েছেন। তিনি পরহেজগার মানুষ। মাদ্রাসায় পড়েছেন। সারাক্ষণ আল্লাহ রাসুল করেন। নাসারার দেশ বলেন লন্ডনকে, তাই তিনি কখনো সেখানে থেকে যাবার চেষ্ঠা করেন নাই। কলাকাতার সাথে সম্পর্ক ছেদ হবার পরে চট্টগ্রামের সাথে সম্পর্ক হয়। আগে বাড়ি থেকে মাইল বিশেক দূরে শাহবাজপুরের লালু স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে ট্রেনে উঠতেন। বাড়ি থেকে যাবার সময় কলাপার ভেতর বিন্নি চালের ভাত আর মাছ ভাজা দিয়ে দেয়া হতো। এটা দুবার পর্যন্ত খাওয়া যায়। দুইবার খাবার পর লাতু স্টেশনে পৌছানো যেতো। সেখান থেকে রাতের ট্রেনে করে সোজা কলকাতা। এই ছিলো যাত্রা পথ। এই পথ এখন বদলে গেছে। তাঁরা এখন লাতু পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে রাতের মেইল ধরেন চট্টগ্রামের। এই ট্রেন পাহাড়তলী স্টেশনে পোউছালে সেখান থেকে নেমে গাট্টি বোচকা নিজে বয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতেন পতেঙ্গার সী-ম্যান্স হোস্টেলে। সেখানে অপেক্ষা করতেন নতুন জাহাজের। জাহাজ এলে

নানার কাহিনী

রানীর বাড়ি নানীর বাড়ি

শাপলার বিয়া

আমরা যখন ছবির মডেল

ছোটবেলার নানা গল্প

ছড়িয়ে যাওয়া পরিবারের কাহিনী

সেই স্যুটকেস

ভাইয়া, তুমি তো সব চেয়ে ভালো জানো, এর পর আর কী কী ঝড় গেলো আমাদের উপর দিয়ে। বাবা মারা গেলেন এক বছর পর। তুমি বুয়েটে ভর্তি হয়ে বাড়িতে বসে আছো। তোমার ক্লাস শুরু হবে দেড় বছর পর। তুমি এক সময় চলে গেলে ঢাকায়। টিউশনী করে টাকা কামতে শুরু করলে। আমাদের জন্য ব্যাগ ভর্তি করে করে তুমি ঈদের কাপড় নিয়ে আসতে। আমাদের কখনো বুঝতে দিতে না, যে আমাদের বাবা মারা গেছেন। এর মধ্যে আমি মেট্রিক পাশ করলাম। কলেজে ভর্তি হলাম। প্রথম যেদিন কলেজে গেলাম, ক্লাসের শেষে জুতা কেনার জন্য এক দোকানে গিয়েছিলাম। সেখানে এক লোক আমাকে দেখে। তারপর খোজ খবর নিয়ে বাড়িতে একটা প্রস্তাব আসে আমার বিয়ের। তুমি তখন বুয়েটে পড়। সেকেন্ড বা থার্ড ইয়ার হবে। আমার বিয়ের সমস্থ বাজার ঢাকা থেকে করে আনলে তুমি। বাড়ি থেকে টাকা নাও না, অথচ কোথায় তুমি টাকা পাও, সেটাও বলো না। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি, কখন তুমি বাড়ি আসবে। হঠাত দেখা যেতো তোমাকে, এক কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ছবি তুলতে তুলতে বাড়ির দিকে আসছো। আমরা দৌড়ে গিয়ে তোমার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বাড়ি যেতাম। এই ব্যাগে থাক্তো তোমার সম্পদ, যেমন এই স্যুটকেসে আমার।

আমার বিয়ের সময় কাপড় চোপড় ভরে নেয়ার জন্য দুইটা স্যুটকেস লাগে। একটা এসেছিল আমার জামাইর বাড়ি থেকে, আরেকটা আমাদের কেনার কথা। তুমি বিয়ানীবাজার গেলে স্যুটকেস কিনতে। বললে, যেটা পছন্দ হয়, সেটা অনেক দামের। কেনো নি। বললে, বাবার আনা পুরানো স্যুটকেস আছে একটা ঘরে, সেটা নিয়ে নিতে।

আমি দেখি, বাবারই পুরনো একটা লুঙ্গি দিয়ে স্যুটকেসটা প্যাচিয়ে রেখেছিলেন মা। বাবার মৃত্যুর ৫ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু স্যুটকেসটা কেমন যেন চকচক করছে। এটা নীল রঙ্গের এবোনাইট শিট দিয়ে সম্ভবত বানানো। চারপাশে দুই সারির নিকেলের বেল্ট, কেমন যেন চিকচিক করছে। পেছন দিকে মোটা কলমের কালি দিয়ে বাবার নাম লেখা। তোমরা সবাই মিলে আমার বাপের বাড়ি থেকে দেয়া কাপড় চোপড় এই বাক্সে ভরলে। আমার বিয়ে হলো, আমি এই বাক্স নিয়ে গেলাম শ্বশুড় বাড়ি, সেও আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে।

এই স্যুটকেস নিয়ে ভাইয়া আমার অনেক স্মৃতি, অনেক কথা, অনেক ইতিহাস। আঠারো বছর ধরে আমি আমেরিকায় আছি। আমার বিয়ের পর শুধু আমেরিকা আসার সময়ই এটা আরেকবার ব্যাবহার করেছিলাম। আর না। এর মধ্যে ৫/৬ বার আমি বাংলাদেশে গিয়েছি। কখনো এটা নেই না, যদি নষ্ঠ হয়ে যায়, এই ভয়ে। এখন তোমাদের সময় কম। তুমি এইটা নিয়ে যাও ভাইয়া, তোমার কাছেই এটা থাকুক।

শেষ প্রহর

আমি নুরুকে বলি, তোর মেয়েকে ডাক, আমি একটু ওয়াল মার্ট-এ যাব। আমাদের হাতে এখনো দুই ঘন্টা সময় আছে।

নুরুর চোখ ভিজে আসে। সে আমার কাছ থেকে ভেজা চোখ লুকানোর জন্য গাড়ির চাবি আনতে যায়।

মন্তব্য
Loading...