ইলিশের বৈশাখ, বৈশাখের ইলিশ

আমাদের ছোটবেলার সবচেয়ে অপছন্দের মাছ ছিলো ইলিশ। আমার দাদা সপ্তাহে দুইবার বাজারে যেতেন। সোম ও শুক্রবার। তাঁর বাজেট থাকতো বিশ টাকার মতো। ৭-৮ টাকায় কেবল ইলিশ মাছই পাওয়া যেতো। সে কারণে প্রতিদিনই শেষ আইটেম হিসেবে একটা সস্তার ইলিশ তিনি নিয়ে আসতেন। প্রায় ৫০ বছর আগের সব কিছু স্পষ্ট মনে নেই, যেটুকু আছে, তাতে মনে হয় এখনকার ৭-৮০০ গ্রামের একেকটা ইলিশ মিলতো ৭-৮ টাকায়। দাদা কাপড়ের ঝোলা ক্যারি করত- ওটা ভারি। ওর ভেতর আলু, মুকি, পান, তামাক, চিনি, চা-পাতা, বিস্কুট এসব। আমি আস্ত ইলিশটা বয়ে আনতাম। ইলিশের মুখের ভেতর বেত আটকানো। যেতে যেতে যে-সকল লোকের সঙ্গে দেখা হতো, তারা দাম জানতে চাইতো। সব সময় আমার দাম জানা থাকতো না। দাদার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে দাম জেনে বলতাম। এর উত্তরে সবাই বলতো, ইলিশোর দাম দেকি বাড়ি গেলো।
সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকা হতো কেবল বাজারের দিন। মাগরিবের নামাজ শেষ করে দাদা বাড়ি আসতেন। তারপর মাইল দুই পথ হেঁটে হেঁটে বাড়ির কাছে আসতেই ডানে বামে অনেক বাড়ির রান্না ঘরের পাশ দিয়ে যেতে হতো। সেখানেও প্রথমে শব্দ পেতাম, পরে গন্ধ। কার উনুনে কড়াইয়ের ওপর তেল ঢালা হয়েছে আর তার ওপর ইলিশ পড়ে ছ্যাত্‌ করে শব্দ করে উঠলো, শোনা যেতো। আর ঘরের উঠান মাড়িয়ে পাশের সরু রাস্তা বরাবর তার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তো টের পেতাম। বুঝতাম, ও বাড়ির কপালেও শুধুই ইলিশ।
আমাদের অঞ্চলে (সিলেটের বিয়ানী বাজার) সস্তায় ইলিশ পাওয়ার একটা কারণ ছিলো। ভারতের করিমগঞ্জের আর সুতারকান্দির বর্ডার আমাদের এলাকা সংলগ্ন। চাঁদপুর থেকে এই রুটে রাতের অন্ধকারে ইলিশ পাচার হতো ভারতে। বর্ডার ‘গরম’ থাকলে ‘বুঙ্গা’র এই মালগুলো বাজারে বিক্রি করে ফেলা ছাড়া উপায় ছিলো না। সে কারণে প্রায় প্রতি বাজারেই ইলিশের আমদানী ছিলো প্রচুর। আমরাও সপ্তাহে দুইটা করে ইলিশ খেতে খেতে ইলিশের প্রতি প্রায় বিতৃষ্ণা জন্মে যেতো। ইলিশ ছাড়া অন্য মাছ বেশী প্রিয় ছিলো। কিন্তু উপায় ছিলো না। সারা বছর ইলিশে নির্ভর ছিলাম, যেহেতু এর দাম কম। আর এক সময় টের পেলাম যে, এই একটি মাত্র মাছ নানা ভাবে, নানা রকমের তরকারি দিয়ে রান্না করা যায় এবং প্রতিটারই ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিলো মুকি দিয়ে ইলিশ। দুইটাই পিছলা পিছলা। আমার কাছে বড়োই সুস্বাদের। ইলিশের ডিম ভাজা, কিংবা আমের বোল দিয়ে পাতলা ঝোলের তরকারিও ছিলো প্রিয়। ভাজা ইলিশ ২-৩ টুকরা করা হতো বড়োদের জন্য, কদাচিত তার ভাগ আমরা পেতাম। ইলিশের মাথা দেয়া হতো বাবাকে। বাবা বছরের বেশীরভাগ সময় জাহাজে থাকতেন, তখন মাথা পেয়ে যেতাম আমি। এই ছিলো আমার শৈশবের ইলিশ বিলাসিতা।
ইলিশ যে এমন মহার্ঘ টের পেলাম তার একযুগ পর ঢাকা এসে। এখানে ইলিশের অনেক রেসিপির কথা শুনি। ইলিশ দোপেঁয়াজা, শর্ষে ইলিশ, আরো কতো কী! আরো শুনি, পশ্চিম বঙ্গের মানুষের কাছে নাকি এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত খাবার। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে নাকি প্লেনে করে ইলিশ পাঠাতেন সামরিক শাসক এরশাদ।
এই ইলিশ পহেলা বৈশাখের একটা আইটেম হয়ে দাঁড়ায় রমনার বটমূলে, এবং এটা আমি টের পাই এখানে আমার প্রথম উপস্থিতি, সেই ১৯৮৭ সালেই। খবর নিয়ে জানি যে ১৯৮৩ সালে কয়েকজন রমনার বটমূলে এক ডেকচিতে কিছু পান্তা ভাত আর কড়াইতে ইলিশ ভাজা নিয়ে বসেছিলেন। প্লেটে প্লেটে করে তারা বিক্রিও করেছিলেন। এই ঘটনার দাবীদার দুইজন। একজন দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ, অন্যজন সাংবাদিক শহিদুল হক খান। এদের সঙ্গে অবশ্য আরো কয়েকজন ছিলেন। নিতান্ত কৌতূহলী হয়েই তারা এটা প্রথম করেছিলেন। কিন্তু পরের বছর দেখা যায়, মুড়ি-মুড়কির সঙ্গে সকালের নাস্তা হিসাবে এটার বাজার ভালো যাচ্ছে। খুব ভোরে যারা রমনার বটমূলে গান শুনতে আসেন, তারা সকাল বেলা ক্ষুধার্থ হয়ে পড়লে এই আইটেমটা বাজার পেয়ে যায়। ১৯৯১ সালে, এরশাদের পতনের পরের বছর মহা জমজমাট বৈশাখী উৎসব হয় রমনায়। দেখি মাছের বাজারের মতো পান্তা-ইলিশের হাট বসেছে সেখানে। সৌখিন রাঁধুনীরা নিজেই দোকান দিয়ে বসেছেন। আমাদের হলের এক বড়োভাই আমাকে প্রায় জোর করে নিয়ে যান তার স্টলে। ভাবীর পান্তা ইলিশের দোকানে বসিয়ে আমাকে মাটির শানকির ওপর কিছু ভেজানো ভাত আর এক টুকরা ইলিশ, সঙ্গে পেঁয়াজ-কাচামরিচ দিয়ে সাজিয়ে দেন। আমি অনেক কষ্টে ২-৩ লোকমা খেলাম। পান্তা ভাত আমি কখনো খাইনি। আমার গলায় আটকে যায়। খাওয়া শেষ করে বিল দিতে চাই। দেখি দাম লেখা, ইলিশ প্রতি পিস ২৫ টাকা, পান্তা ৫ টাকা। আমি হলে ৬ টাকায় ফুলকোর্স ডিনার খাই। এখানে ৩০ টাকা দিতে হবে? তাও, বড়োভাই বলে কথা। বড়ো মুখ করে নিয়ে এসেছেন। আমি মানি ব্যাগে হাত দেই।
বড়োভাই, নিতান্ত ভদ্রতা করে বললেন, আরে না, না, লাগবে না।
আমি আবার হাত বের করে ফেলি। আমার ৩০ টাকা রক্ষা পেলো।
এসব কাহিনীর দুই দশক পর দেখি ইলিশ নিয়ে এলাহী কাণ্ড! বৈশাখের সঙ্গে ইলিশ এসে জড়িয়ে যায়। টেলিভিশনের রান্নার অনুষ্ঠান, দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাক্ষিকের রাঁধুনীর পাতা, সর্বত্র বৈশাখের খাবার হিসাবে আমাদের ‘এক্সপার্ট’ রন্ধনবিদেরা ইলিশ-পান্তাকে প্রায় জোর করে বৈশাখের খাবার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্ঠা করতে থাকেন এবং মিডিয়ার সৃষ্ঠ এই উপাচার আমাদের এক শ্রেণীর নাগরিকদের সংস্কৃতি হয়ে যায়। সঙ্কট দেখা দেয়, যখন এই কারণে ইলিশের চাহিদা বেড়ে যায় এবং তখন আগে থেকে স্টক করে রাখা বড়ো ইলিশ ১০ গুণ পর্যন্ত বেশী দামে এটা বিক্রির চেষ্টা করে। এবং তখনই আরেক শ্রেণীর নাগরিক এই ইলিশকে বর্জনের কথা বলে।
ইলিশ কি বৈশাখের খাবার?
আমার ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে। হিন্দু-মুসলমান মিলে আমাদের এলাকা। আমাদের সকল উৎসবই ছিলো ধর্মকে কেন্দ্র করে। আমারা, মুসলমানেরা ঈদ আর শবে বরাতে উৎসব করতাম। এর বাইরে বিয়ে-শাদী ছিলো। আর হিন্দুদের আয়োজনে উৎসব ছিলো সংক্রান্তি, বান্নি, রথ, এসব। কিন্তু সে সকল উৎসবে আমাদের যাওয়া ছিলো অবশ্যাম্ভাবী। কয়েক মাস আগে থেকে পয়সা জমাতাম বান্নি যাওয়ার জন্য। আমার একটা বাঁশের ব্যাংক ছিলো। এর মধ্যে ফুটো করে রাখতাম। দুই পয়সা, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, সিকি, আধুলী পেলেই এর ভেতর ঢুকিয়ে রাখতাম। বান্নির দিন সকাল বেলা ব্যাংক কাঁটা হতো। ৬-৭ টাকা পেয়ে যেতাম। তারপর ৩-৪ মাইল দূরের হিন্দু গ্রামের পাশে বসা বান্নি থেকে গুড্ডি, নাটাই, মোয়া, তিলুয়া, খই এসব কিনে আনতাম। অনেকগুলো ঘুড়ি কেনা হতো। সঙ্গে সুতো ও নাটাই। পুরা ৩-৪ মাইল মেঠো পথ ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে বাড়ি এসে পড়তাম। সবাইকে তিলুয়া, খই খাওয়াতাম। এসব নিয়ে মহা উৎসব বসতো বাড়ির উঠানে সন্ধ্যা বেলা।
বৈশাখে আমাদের কোনো আলাদা খাবার ছিলো না। আমার তিন পুরুষ আগে হয়তো সবাই চাষা ছিলেন, কিন্তু আমার দুই পুরুষ আগে থেকে সবাই চাকরিজীবী। বর্গাওয়ালারা ধান দিয়ে যেতো, সে কারণে গ্রামে থাকলেও চাষবাসের জীবন আমার দেখা হয়নি। কৃষকেরা আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যেতেন ফজরের সঙ্গে সঙ্গে। তাদের সঙ্গে লুঙ্গি দিয়ে প্যাঁচানো একটা থালা থাকতো, সঙ্গে পানির মগ। আমাদের অঞ্চলে পান্তা ভাতের খুব চল ছিলো না। ওখানে হয়তো অন্য কিছুও ছিলো। ‘বিরান ভাত’ এখন যেটাকে আমরা ‘ফ্রায়েড রাইস’ বলি- এরকমের খাবারের ব্যাবহার ছিলো বেশী।
পহেলা বৈশাখকে আমরা বলতাম ‘সন’। এই ‘সন’ খাওয়ার জন্য পহেলা বৈশাখে আমার দাদার সঙ্গে বেরোতাম, কারণ অন্তত দুইটা দোকানে রসগোল্লা খাওয়ানো হতো, যারা দাদার কাছে টাকা পেতো। আমাদের ঈদগাহ বাজারে দুটো দোকান থেকে সারা বছর বাকীতে ‘খরচ’ নেয়া হতো। বাবা বাড়ি এলে দোকানদার টাকা পেতো। আমার সুবিধা অনেক ছিলো, যেকোনো কিছু আমি দোকান থেকে নিয়ে নিতে পারতাম, আমাকে টাকা দিতে হতো না। সবুর চাচা খাতায় লিখতেন। সেই খাতা বছর বছর বদলাতো। লাল রঙের কাপড় দিয়ে বাধাই করা খাতা, প্রস্থে ৪-৫ ইঞ্চি, লম্বায় ১২ ইঞ্চির মতো। এটাকে বলা হতো ‘হাল খাতা’। এই খাতায় আগের বছরের হিসাব ক্লিয়ার করে দেয়ার কথা। কিন্তু আমাদের হিসাব পুরা ক্লিয়ার হতো না। দাদা কিছু দিতেন, বাকীটা ‘ইজা’ লিখে নতুন খাতায় সংখ্যা বসতো। আমার দাদা যখন এই লেনদেন নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তখন আমাকে বসিয়ে দেয়া হতো লাল পর্দা দিয়ে আলগা করে রাখা দোকানের আরেক পাশে, যেখানে একটা ছোট টেবিল আর কয়েকটা টুল রাখা। আমার বসার পর এক কর্মচারী আমার জন্য একটা ছোট প্লেটে জিলাপী, নিমকি, খাজা আর রসগোল্লা নিয়ে আসতো।
সবুর চাচাকে মাঝে মাঝে বলতে শুনতাম, ভাতিজারে আরোখটা রসগোল্লা দাও। কর্মচারী আমার জন্য আরেকটা রসগোল্লা নিয়ে আসতো। আর আমি প্রতি বছর সবুর চাচার ‘সন’ খাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকতাম।
আমার সেই ‘সন’ খাওয়া উৎসব এখন বৈশাখী উৎসব, বৈশাখী মেলা। আমরা এখন কতো কিছু করি!
কপাল আমাদের ৩৬৫ দিনের মধ্যে আমরা কমপক্ষে দুইবার ভাবি আর ভান করি যে, আগামী বছরটা যেনো ভালো যায়। যার কাছে বলি, তিনিও কি বিভ্রান্ত হন না আমার এই চাওয়া দেখে?
মন্তব্য
Loading...